অশোক দেব
সদাপুরাণ
দুই.
দুই.
মওত কা কূঁয়া-র
ছেলেটা বাঙালি এ কথা কে জানতো! তার মোটরবাইকটি পুরনো। সেটি নিয়ে সে কাঠের
কুয়োয় নেমে যায়। তার দেওয়াল ধরে
ছেলেটির তীব্র ভ্রুম-ভ্রুম। ঘোরে, ঘোরে। যেন সে জন্ম থেকেই একটা কূপের মধ্যে পুরনো একটা মোটর বাইক নিয়ে ঘুরে চলেছে। নীচে
চলে যাচ্ছে, ওপরে উঠে আসছে।জীবনের ঝুঁকি নেওয়াটাই তার ব্যবসা । ঝুঁকিটাই বিক্রি করে। হিন্দিতে কথা বলে, আসলে
বাঙালি।বিড়িতে পুরে গাঁজা খায়। কথায় কথায় ‘বেনচোদ’ বলে। সে যে বাঙালি সেটা জেনেছে মরু।
নগেন্দ্র সাহাকে বলে
নগুসা। নগেন্দ্র ‘নগু’ হয়েছে আর সাহা হয় ‘সা’। নগুসা বারকি বাঁধে।
কৃষকের থেকে ধান কিনে এনে সেদ্ধ করে, সেদ্ধ করা ধান
শুকিয়ে নেয়। পরে ভাঙিয়ে চাল করে। সে চাল বিক্রি করাই তার কারবার।এটাই বারকি
বাঁধা।নগুসা বারকি বান্ধে। কিন্তু
আর কিছু বাঁধতে পারেনি। ওর বউটা কথায় কথায় সোডা খায়। খাবার সোডা। পেটে যন্ত্রণা।একদিন
সে ফাঁসি দিয়েছিল যন্ত্রণায়। তখনও মরেনি। তার শাড়ির নীচে পা বেয়ে হলুদ প্রস্রাব
গড়িয়ে পড়ছিল।নগুসা হতভম্ভ হয়ে কেবল জয়রাম, জয়রাম করছে। উঠছে
বসছে। মরু অসম্ভব সেজেছিল সেদিন। তার আনন্দমেলা যাবার কথা। মওত কা কূঁয়া-র
ছেলেটা তো বাঙালি। আনন্দমেলায় সে বাইক নিয়ে কাঠের কূপে ঘোরে। সে খেলা শেষ হলে ‘চিত্রহারে’ মিঠুন
সেজে নাচে। মরুর মিঠুন পছন্দ। এমন সময়ে মা-কে সজনের গাছ হতে
ঝুলে ছটফট করতে দেখে কেমন একটা চিৎকার করল। শুনে মনে হল, সে আমাকে কু করেছে।মেয়ে
তো, মাত্র তার শক্ত স্তনে জমাট কুয়াশা ভাঙছিল। ভাবলাম কষে
একটা চড় দিয়ে আসি। ঢুকতেই দেখি ধান শুকানোর চকচকে শাদা উঠোনের পাশে একটা সজনে গাছ।
একটি মেয়েমানুষ গাছের ডাল হতে ঝুলছে। গলায় একটা নীল নাইলনের দড়ি। মাটি থেকে মাত্র
ফুট দুয়েক উচ্চতায় তার ফাটা ফাটা পাগুলি। যে মাটি ছেড়ে যাবে বলে সে ঝুলেছিল, সে
মাটির নাগাল পাবার জন্যই তার পা দুখানি নীচের দিকে হাতড়ে চলেছে। গাছের ডালটি তরুণ।
সে যেন ভেঙে পড়বে। কিন্তু কিছুতেই ভাঙছে না। দুলে দুলে মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করছে। জড়িয়ে
ধরি ঝুলতে থাকা দেহ। ঠেলে ওপরে ধরে রাখি। মরুর মা — ফাঁসিতে ঝুলে পড়া, সোডাখোর একটা নারী — আমাকে
তার সবটা ভার দিয়ে দিল। কিছুটা মৃত্যু মিশে থাকার কারণে, তার ওজন বেশ বেড়ে
গিয়েছে। তার শরীরে কেমন একটা রোগের গন্ধ। সজু আর কাজু নগুসা-র দুই
ছেলে। সজল, কাজল। তার মধ্যে সজু তীর খেলার এজেন্ট। ডাইল খেয়ে বুঁদ
হয়ে থাকে। ডাইল মানে ফেন্সিডিল। সে এখন বাড়িতে নেই। কাজুটা ছোট। স্কুলে যায়।
সেটাকে ডাকি
— একটা কিছু দিয়া দড়িডা কাইট্যা দে।
— একটা কিছু দিয়া দড়িডা কাইট্যা দে।
সে ছুটে রান্না ঘরে
যায়। এর মধ্যে অনেক লোক জমে গিয়েছে। আত্মহত্যা আসলে একটা তামাশা। এটা দেখতে পাওয়া
যায় না।মরে যাওয়াটা দেখতে পাওয়া বিরল ঘটনা। মৃতকেই কেবল দেখি আমরা। তাই
আত্মহত্যাকালে জীবন্ত মানুষ দেখা আরও বড় তামাশা। সকলে এই কাণ্ডটি ঘটার সম্ভাব্য কারণ
নিয়ে, মুখে মুখে, চোখে চোখে এমনকি
নীরবতা দিয়ে নানা গল্প রচনা করছে। চারদিকে
এত গল্প জমে গেল যে, কখন কাজু বটনিদা দিয়ে দড়ি কেটে দিয়েছে, বুঝতে
পারিনি। কাজুর মা-র পুরো বডি আমার ওপরে আশ্রয় করল। আমি তাকে নিয়ে পড়ে
গেলাম মাটিতে। আমি নীচে, মরুর, সজু ও কাজুর মা এবং নগুসা-র বউ
আমার ওপরে। এই প্রথম আমি একটি নারী শরীরের স্পর্শ পেলাম। ফলত আমি বুঝতে পারলাম না, নারী
কি মৃত্যুর ভার নাকি নারীর ভারকে মৃত্যু বলে। আমি তাকে শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে চলে আসি।
ততক্ষণে কে একটা রিকশা ডেকে এনেছে।আমি চলে এলাম। রিকশাওয়ালাটা তো জানে না কী ঘটে
গেছে। আমি তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি, সে আমাকে কু করে
দিল। চুপ ছিলাম। আরও চুপ হয়ে গেলাম।
গার্লস স্কুলের
পেছনে আনন্দমেলা এসেছে। সেখানেই সেই মৃত্যুকূপ। সেখানে তাঁবুতে তাঁবুতে নানা
জিনিস। বয়ামে পোরা বিষধর সাপের দেহ।ফর্মালিনে চোবানো। একটা তাঁবুতে আছে নানারকমের
জাদু-দর্পণ। কনভেক্স, কনকেভ। সামনে
দাঁড়ালে নিজেকে মোটা, বেঁটে কিংবা ভাঙাচোরা দেখা যায়। আলাদা একটা তাঁবু আছে, সেখানে
সাপে-নেওলে ঝগড়া বাঁধানো হয়। সারাক্ষণ বলে, এই
লাগবে এই লাগবে, আসলে লাগে না। আমি কখনো সেই যুদ্ধ দেখিনি। একটা হাতি
আছে। সে একটা বলের ওপরে উঠে দাঁড়ায়। তার গায়ে ঘাপটি মেরে আছে বুনো মনখারাপ। ওদিকে একটা গগনচুম্বী টাওয়ার হয়েছে। সেটাতে একটা ছেলে
উঠে যায়। গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে নীচের ছোট পুকুরটাতে লাফিয়ে পড়ে। সে ধীরে ধীরে
টাওয়ারে উঠে যাচ্ছে। গান হচ্ছে ‘ইয়ে দুনিয়া, ইয়ে মেহফিল, মেরে
কামকি নেহি’। যেন সে
মরে যাবে। আসলে মরবে না। জীবিত লোকেদের মৃত্যুর কথা বললে কেমন একটা আলো জ্বলে
বুকের মধ্যে। দুঃখের আলো। সেই আলোটাই এরা বিক্রি করে। আর এইদিকে সেই ঝলমলে তাঁবু।
সেটাতে আবার একটা মেহফিল। চিত্রহার। টিকিট
কেটে সার করে লোকে ঢুকছে। আমার দুয়েকজন আগেই দীনেশ স্যার। একটা মাংকি ক্যাপ পরে
আছেন। আসলে তত শীত নেই যতটা সঙ্কোচ। আমিও ভেতরে গেলাম। খড়ের ওপর বসে আছি। কালো
পর্দা খুলল। ‘আয়াম আ ডিস্কো ডান্সার’ হল। তারপরেই এল ‘হিম্মতওয়ালা’। ‘ও তাকি, ও তাকি, ও তাকি
তাকি তাকি রে...’ দেখলাম সে ছেলে আজ জিতেন্দ্র হয়েছে। আমাদের মরু শ্রীদেবী
হয়ে বেশ নাচল। তার স্তনযুগল হয়ে গেল মেয়েদের সাধারণ বুক।ফলে সে দুটো ভয়ঙ্কর নাচছিল। মরু আমাকে দেখেছে। কৃতজ্ঞতা
বশত সে আমার দিকে বুক নাচালো। তাল ছেড়ে দিয়ে দুবার বেশিই নাচালো। পরে চোখে চোখ
পড়তে মিষ্টি হেসে আবার নাচালো। আমি তাঁবুর বাইরে চলে আসি। এসেই তোমাকে মনে পড়ল।
স,
তোমাকে ভাবতে হলে
তামাশার তাঁবু পেরিয়ে আসতে হয়। এলাম। আমার গায়ে এখনো একটা
মিহি আত্মহত্যা লেগে আছে। কয়েকটা উচ্ছিষ্ট রকমের গান লেগে আছে। মেয়েদের বুকের নাচন
লেগে আছে। কী করি বল তো? স্নান করে নেব?
তোমার স্নানের কথা
ভাবি। জলের সঙ্গে গান মিশিয়ে তুমি স্নান কর। আমি তোমার গুনগুন শুনি। তোমাকে স্নান
করিয়ে দেওয়া জলের ঝমঝম শুনি... ধুর, আজ আর লিখতে ইচ্ছে
করছে না।
জানো, যখন
তাঁবু হতে বেরিয়ে এলাম, মরণী ছুটে এলো। সাথে সেই ছেলেটা। রোগা একটা দাগ-লাগা
ছেলে। তার গায়ে হাজার বছরের দারিদ্র্য লেগে আছে। গাঁজায় চোখ লাল। মরণী, মানে
মরু, এসে আমাকে ঠুক করে একটা প্রণাম করল। ছেলেটাকে দিয়েও
প্রণাম করালো।
—
আমরা আজগা মা-র বাড়িত বিয়া করলাম।
মরণী বলল।
—
আশিব্বাদ রাখবেন। বলেই ওদিকে চলে গেল মওত কা কূঁয়া।
আজ একটা স্বপ্ন দেখব
ঠিক করলাম, জানো? দেখব, একটা ওরকম কাঠের
কুয়োর মধ্যে দিশাহীন একটা মোটরবাইকে চোখ বেঁধে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে মরুকে। সে ঘুরছে।
আকাশের কোথা হতে ঝুলছে তার মায়ের দুটো ফাটা ফাটা পা। ইতি ২২
ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪
তোমার একান্ত
সদানন্দ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন