মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১৬

প্যাঁচা

প্যাঁচা

অশোক দেব


এক.
ঘুম না এলে কার যেন কান্না শোনা যায়। কে যেন কাঁদে। আসলে রাত্রিই ফোঁপায় নির্ঘুম মানুষের কানের কাছে। ঘুম আসে না। অনেক আগে একদিন মানুষের ঘুম না আসা শুরু হয়।জীবনে কোনও এক প্রথম রাত্রি থাকে যেদিন মানুষের ঘুম আসে নাপিয়ালের শুরু হয়েছিল এক কোজাগরী রাতে। সে রাতে সবাই জাগে, কিন্তু তার জাগার অনুমতি ছিল না। বাড়িতে লক্ষ্মীপূজা বেশ ধুমধাম করে করা হয়। কত আগে থেকে শুরু হয়ে যায় চিঁড়ে কোটা। ঢেঁকিঘরে বিকেলের অবসরে, তালে তালে পা পড়ে। ভেজা ধান আবার মাটির কড়াইয়ে ভাজা হয়। সেই সোঁদা ধান ঢেঁকির মুষলের নীচে যায়। ঠাম্মা তালে তালে, ফাঁকে ফাঁকে নেড়ে দেন। ওদিকে অনুদিদি, অর্চনাদিদি, কখনো মা কিংবা কাকিমা পা দিয়ে ঢেঁকি চালান। ফড়ফড় করে মুড়িও ভাজা হয়। খই ভাজার দৃশ্য সবচেয়ে সুন্দর হয়। সাদা সাদা খই আগুনের উত্তেজনায় কড়াই থেকে লাফিয়ে পড়ে। যেন আগুন দিয়ে ফুল ফোটানো হচ্ছেএসব চলে। মোয়া হয়। নাড়ু হয়। ঘি তোলা হয়। ক্ষীর হয়। দুর্গাপূজা শেষ হতেই এইসবের গন্ধে ম-ম হয়ে থাকে বাড়ি। বাড়ির পাশেই আখের ক্ষেত। সেখানে এইসময় জোর বেড়া দেওয়া হয়। চুরি যেতে পারে। কচি পাঁঠাগুলোকে বেঁধে ফেলা হয়, চুরি যেতে পারে। হাঁসার পায়ে দড়ি দিয়ে ইঁদারার পাড়ে বেঁধে রাখা হয়। চুরি যেতে পারে। এমন এক লক্ষ্মীপূজার রাতে পিয়ালের প্রথম নিদ্রাচুরি হল।

সেবার সে বায়না করেছিল পূজাটা নারুকাকার বাড়িতে কাটাবে। নারুকাকা ওদের বাড়ির বছরমুনিষ। পিয়ালের স্বপ্নের পুরুষ। তরতর করে নারকেল গাছে উঠে যায়। বালতি পড়ে গেলে কেমন একটা আঁকশি দিয়ে জাদুমন্ত্রে তুলে আনে ইঁদারা থেকে। সরু একটা লিকলিকে বাঁশি বাজায়। গোরুগুলিকে বাধ্য করে রাখে। বিভিন্ন ধমক বিভিন্ন গোরুর জন্য। গলা পাল্টে ধমক দিলেন তো ধলীর কান খাড়া, আবার আরেক রকম ডাক দিলে সুড়সুড় করে চলে আসে বিশাল নন্দী। পিয়ালকে গামছা দিয়ে পিঠে বেঁধে টুক করে ছড়া পেরিয়ে যান এক ডুবে। হাঁশাপাঁশ শুরু হবার আগেই ওপাড়ে গিয়ে ভেসে ওঠেন। সেই নারুকাকা পূজার সময়ে নিজের বাড়ি চলে যান। সেই বিরহ কঠিন বড়। পিয়াল বায়না করেছিল, নারুকাকার সঙ্গে যাবে। গেল।

দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। সোনার ধান ফলে আছে। নুয়ে পড়ছে প্রতিটি গাছ। আকাশ নিকষ নীল।  একটা চাঁদ পূর্ণশশী হয়ে আছে। তার থেকে ধেয়ে পড়ছে জোছনা। একটা জলা-জলা জায়গা।জল যেন সোনা-গলানো। সেই জল থেকে হঠাৎ উঠে এসেছে বিশাল একটা পদ্ম। পদ্মাসন। তাতে বসে আছেন মা। মা লক্ষ্মী। এয়োতির জিনিসপত্র, কড়ি ছড়িয়ে আছে আরেকটা পদ্মপাতার ওপর। মায়ের কাঁখে স্বর্ণকলস। ক্যালেণ্ডার থেকে কেটে নেওয়া এই ছবিটকে বাঁধাই করা হয়েছে। তাতেই নিবেদিত হল সকল পূজা। মাটির মেঝে জুড়ে ধানের ছড়া আঁকা হয়েছে, আরও নানা আলপনা। এটাই নারুকাকাদের সবচেয়ে ভালো ঘর। তাতে একপাশে একটা বিছানায় শুতে দেওয়া হয়েছে পিয়ালকে। সারা ঘরে একটা গন্ধপূজা আর নানা ফলের গন্ধ মিশে গিয়ে সেটা তৈরি হয়েছে। পিয়ালের ঘুম আসে না। বিছানাটা যথাসাধ্য পরিপাটি করা হয়েছে, তবুও একটা পুরনো গন্ধ। একটা তেলের বাতি জ্বলছে সামনে। আর দেখা যাচ্ছে সেই প্যাঁচা। সেই প্যাঁচাটাই আসল। ঘুম আসে না। পিয়াল উঠে গিয়ে লক্ষ্মীপাঁচালিটা নেয়।

হেনকালে বীণাযন্ত্রে হরি গুণগান।
উপনীত হইলেন নারদ ধীমান।।
ধীরে ধীরে উভপদে করিয়া প্রণতি।
অতঃপর কহিলেন লক্ষ্মীদেবী প্রতি।।
শুন গো, মা নারায়ণি, চলো মর্ত্যপুরে।
তব আচরণে দুখ পাইনু অন্তরে।।
তব কৃপা বঞ্চিত হইয়া নরনারী।
ভুঞ্জিছে দুর্গতি কত বর্ণিবারে নারি।।
সতত কুকর্মে রত রহিয়া তাহারা।
দুর্ভিক্ষ অকালমৃত্যু রোগে শোকে সারা।।
অন্নাভাবে শীর্ণকায় রোগে মৃতপ্রায়।
আত্মহত্যা কেহ বা করিছে ঠেকে দায়।।

মানুষ আত্মহত্যা করে? কেন? বেড়ার ফাঁক দিয়ে কোজাগরী চাঁদের আলো চাপা উল্লাসের মত ঘরে চলে আসছে। আর কে যেন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। থেমে থেমে। পিয়াল ঘুমোতে পারে না। আসে না ঘুম। ওই পেঁচাটাই আসল। তার দিকেই চলে যাচ্ছে চোখ। এমন ধবল পেঁচা পৃথিবীতে আছে? নাকি সে হল মীনা? মীনা এসেছিল আজ, ব্রতকথা শুনতে। মীনা মাঝে মাঝে কয়েকবার চোখ বুজে বুজে বড় করে তাকায়। এটা তার মুদ্রাদোষ। এ না হলে ওকে যেন মানাতই না। এমন চোখ কেবল চেয়ে থাকার কাজ করবে? এই কথা এখন মনে হয় পিয়ালের।

ঘুম না এলে এইসব মনে আসে। কবে কবে আর ঘুম আসেনি তার? পরীক্ষার আগে রাত জাগতে হয়নি। কোনোদিন পড়া নিয়ে ভাবতে হয়নি। সারাদিন ওইটাই তো করতে ভালো লাগে পিয়ালের। গ্রামের বাড়ি সেই আশি সালে তছনছ হয়ে গিয়েছে। বাবা তাদের শহরের এই বাড়িতে এনে তোলেন। কিসের শহর? সে ছিল তখন একটা বড়সড় গ্রাম। কেবল বিজলি বাতিটা নতুন।

ঘুম আসে না।  ওই সেদিনও ঘুম আসেনি, যেদিন রিনা কাকিমা সারা পুকুর দাপিয়ে সাঁতার কেটেছিলেন। নতুন বিয়ে হয়ে পাড়ায় একটা পরি চলে আসে। রিনাকাকিমা। হোসেন মিয়ার পুকুরে জল মায়ার মত ছড়িয়ে থাকেসে পুকুরে এক কোনে মেয়েদের স্নানের জন্য কায়দা করে আড়াল বানানো। মুসলমান নারীরা স্নান করে। দেখাদেখি সবাইই ওখানে চলে যায়। রিনা কাকিমা সেসব মানেন না। দেখি, আমারে কেডা ধরতে পারস? বলেই সারা পুকুরে তোলপাড়। পুকুরটাও হেসে খিলখিল। যেন একটা জলপরীকে হারিয়ে ফিরে পেয়েছে সে পুকুর। সেদিন রাতে ঘুম এলো না। সারারাত কে যেন কেঁদে গিয়েছে। ফুঁপিয়ে। পিয়াল ঘুমোতে পারেনি। ঘুম আসেনি।

দুই.

এইখানে জঙ্গল। রিজার্ভ ফরেস্ট। মাঝখানে এই অনেকটা জায়গা কোনও বড় গাছ নেই। লোকটা এইখানে একা, নিজে নিজে একটা কুটির বানিয়ে ফেলেছে। পিয়াল আসে। গার্ড, ফরেস্টার কাউকে পাত্তা দেয় না। পিয়াল এসেছে। এই যে এসেছে লোকটা ফিরেও তাকাচ্ছে না। দূরে নিচু জমিতে একটা টলটলে জলের ডোবা। ধীরে হেঁটে গিয়ে সোজা ডুবে গেল সেই সাধু। আর ওঠে না। ওঠেই না। এতক্ষণ? একসময় ভুস করে জেগে ওঠে। ভেজা কাপড়ে উঠে আসে, হাতে একটা কাঁসার কমণ্ডলু। সোজা কুটিরে ঢুকে গেল। পিয়াল পেছন পেছন চলে আসে। এটাই মন্দির। মাঝে একটা শিবলিঙ্গ। অদ্ভুত। সাদা, স্বচ্ছ। যেন ঠিকরে আলো বেরুচ্ছে। যোনিপীঠ নেই।মাটি দিয়ে খুব সুন্দর করে একটা ছোট চাতাল। তাতে সে শিবলিঙ্গ। লোকটা তখনও ভেজা কাপড়ে। শিবের মাথায় জল ঢাললেন কমণ্ডলু থেকে। তারপর সব পাল্টে গেল। শীর্ণ, রোগা, অতিশয় দুর্বলদর্শন সেই গৈরিকধারীর কী কণ্ঠধ্বনি! সারা বনভূমি যেন গমগম করে উঠল।

‘অসিতগিরিসমং স্যাৎ কজ্জলং সিন্ধুপাত্রং
সুর-তরুবর-শাখা লেখনী পত্রমুর্বী।
লিখতি যদি গৃহীত্বা সারদা সর্বকালং
তদপি তব গুণানামীশ পারং ন যাতি’

হুহু করে কাঁদছে লোকটা। হায়হায় করে উঠছে যেন এই বনভূমি। দূরে পিয়ালের গাড়ি। দুজন সহকারী। পেছনে পুলিশের গাড়ি। লোকটাকে আজ উৎখাত করতে হবে। এইখানে রিজার্ভ ফরেস্ট দখল করে আশ্রম বানাচ্ছে? ভেবেছিল লোকটা স্নানাদি সেরে এলে ঘরে বসে বুঝিয়ে বলা যাবে। এখন এই কান্না মেশানো স্তোত্র শুনে উলটে নিজে বিহ্বল হয়ে গেল। কী বলছে লোকটা— নীলপর্বত যদি কালি হয়, সমুদ্র যদি দোয়াত হয়, পারিজাত গাছের শাখা যদি কলম হয়, পুরো পৃথিবীটা যদি লেখার পাত্র হয় আর এইসব দিয়ে যদি স্বয়ং সরস্বতী চিরকাল ধরে তোমার মহিমার কথা লিখতে থাকেন, তথাপি হে মহাদেব, তোমার গুণাবলীর কথা লিখে শেষ করা যাবে না— কী বিশ্বাসে লোকটা এসব বলছে? কী তার উচ্চারণ, শুদ্ধ, স্পষ্ট আর গম্ভীর!পিয়াল বাইরে চলে আসে। সূর্য ঠিক মাথার ওপরে। শাল গাছের বনভূমির ফাঁক দিয়ে চিকচিকে রোদ আগুনের মত এসে পড়ছে। মাটিতে পড়ে শিশুর মত হামগুড়ি দিয়ে শেষে শীতল হয়ে যাচ্ছে।
– হোয়াটস ইয়োর প্রবলেম ব্রাদার?
ফিরে তাকিয়েই চোখে চোখ পড়ে যায়। এমন উজ্জ্বল প্রভাক্ষরা চোখ পিয়াল বহুদিন দেখেনি।
– ইটস আ রিজার্ভ ফরেস্ট এরিয়া, সে বলে
— তো?
— ইউ ক্যানট অকুপাই দ্যা প্লেস লাইক দিস
— দ্যান, হু ক্যান?
— না, মানে এটা বেআইনি
— হু মেকস ইয়োর ড্যাম আইন?
পিয়াল চুপ করে যায়। লোকটা ঘরে গিয়ে পাতায় করে একটু মিছরি, সাগুদানা, কিসমিস নিয়ে আসে। সবাইকে ডাকে।পিয়ালের সব লোকজন সুড়সুড় করে এগিয়ে আসে। হাত পেতে  প্রসাদ নেয়। কী করা যায়, ভাবতে পারছে না পিয়াল। বরং উপরে চিঠি লেখাই ভালো হবে ভেবে যাবার উদ্যোগ করে।
–  বেটা
পেছনে তাকায় পিয়াল। লোকটা এগিয়ে আসে। পায়ের দিকে তর্জনী দেখায়।
— ইঁহাসে শুরু করনা, ধীরে ধীরে উপর তক আ না।আপনে আপ কো জাননে কা, সমঝ নে কা কৌসিস কর না। নিন্দ আ যায়েগি।

পিয়াল প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। টলতে টলতে, আছুড়িপাছুড়ি করে গাড়িতে এসে বসে। চল চল।

সেই চলে আসার পর আর ওদিকে যায়নি। পরে সে মন্দির থেকে সেই অদ্ভুত লোকটাই উধাও হয়ে যায়। স্থানীয় লোকেরাই সেখানে এখন একটা পাকা মন্দির বানিয়ে, কমিটি টমিটি গড়ে নিয়েছে। কী মাসে যেন সাতদিন সাত রাত হরিনাম সংকীর্তন হয়।

এখন ঘুম আসছে না। পিয়াল নিজের পায়ের কাছে চলে আসে। ধীরে ধীরে একা হয়ে যায়। কে যেন কাঁদছে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। নিজের কাছে চলে আসতে গেলে কান্নাটা বাড়ে। তবু সে পায়ের কাছে চলে আসে। গোড়ালির একটু ওপরে সেই দাগটা আছে। দেরাদুনে ট্রেনিঙের সময় একটা নির্বিষ সাপ জাপটে ধরে কামড়ে রেখেছিল। কী তার শক্তি। হাবিব এসে সুইস নাইফ খুলে ফালা ফালা করে দিয়েছিল সাপটাকে। তারপর ইনফেকশন হয়ে গেল। ভালো হতে অনেকদিন সময় লেগেছিল। আরও ওপরে চলে আসে, হাঁটুর কাছে এলেই সমীরকে মনে পড়ে। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে খইয়ের নাড়ু বানানো হয়। সেসব একটা হাঁড়িতে করে উনানের ওপর শিঁকের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়। জামাই ষষ্ঠীর দিনে সেটা খোলা হবে। সমীর সেসব চুরি করে। নীচে পিয়াল, হাঁটুর ওপর ভর দেওয়া, তার পিঠে দাঁড়িয়ে সমীর নাড়ু চুরি করে। একটা কী যেন পড়ছে ডানদিকের হাঁটুর নীচে, ফেটে যাচ্ছে। শব্দ করা যাবে না। সমীর নেমে এলে দেখা গেল একটা কাচের টুকরো কোথা থেকে পড়ে ছিল। সেটা গেঁথে গিয়েছে। ঘরের পেছন থেকে দুরকি পাতা এনে ডলে দিয়েছে সমীর।

সমীরটা কোথায় গেল? শেষ শুনেছিল কাঁঠালিয়াতে পোস্টিং। সেখানেই বাড়ি করেছে। জমিজমা করেছে অনেক। তাতে ধান চাষ ফেলে পুলিশের সঙ্গে রফা করে গাঁজার চাষ করত। অ্যারেস্ট হয়ে গিয়েছিল? আচ্ছা সমীরটা কোথায় এখন? ছটফট করে পিয়াল। সমীরের জন্য নিদারুণ কষ্ট হয়, কেন গেলি গাঁজার চাষ করতে? এখন কি জেলে? এখুনি কোনোভাবে জানা যেত যদি। শরীরের পথ ধরে নিজের কাছে তো আসতে পারছে না পিয়াল। কোনওমতেই পারে না। একদিনও পারেনি।  মোবাইল থেকে একটা বালিকার কণ্ঠ ভেসে আসে, এটা হৈমন্তী সেট করে দিয়েছে। সময় বলে দেয়, ‘এখন সময় রাত একটা বেজে চল্লিশ মিনিট’।

তিন.

বাইরে এসে চাঁদের দিকে তাকায়। আজকালের মধ্যেই পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। বাবা-মায়ের ঘরটাই এখন ঠাকুরঘর। ছোটোভাইয়ের বউটা কত যে ঠাকুর এনে প্রতিষ্ঠা করেছে!

— তুই একটা কিছু ফাইনালি ক
— কিতা কমু, ইডাই ফাইনাল
— সংসার করতি না?
— না
— তাইলে কী করবি?
— সংসারে সংসার করা ছাড়া আরও কাজ আছে। নাই?
— যা, যা আমার চোখের সামনে থিকা...
বাবার এই কথা শুনে ধীরে ধীরে উঠে চলে আসে পিয়াল।
— পিলু
— কও
— আমার কথাডাও রাখতি না?
— না, মা ক্ষমা কর...

কী হত সংসার করলে? পিয়াল আকাশের দিকে আর তাকাতে পারে না। বাবা-মায়ের ঘর থেকে একটা গন্ধ আসে। সবসময়ই একটা গন্ধ আসে ঘরটা থেকে। ওঘরে বাবা-মায়ের বিছানাটা পাতা আছে। তাতে মা-বাবার ছবি। তমালটা ঠান্ডা। ছোট ভাই। সবেতেই দাদা। তার বউটাও ওই একই। সারাদিন বিডিওগিরি করেও মেয়েটা কিছু ভোলে না। দাদার এটা দাদার সেটা। কবে নতুন গামছা আনতে হবে, বইমেলা থেকে গুচ্ছের বই কিনে এনে দিতে হবে। দাদার রাতে ঘুম কম হয়, তাই সকালে এদিকটাকে ব্যারিকেড করে দিতে হবে, যাতে কেউ না জ্বালায়। আসলে কেউই তো আসে না এদিকে। একটা মাত্র ভাইপো সে পুনেতে থাকে। কাজের মেয়েটাই যা জ্বালায়। চাকরি ছেড়ে দিয়ে যা টাকা এসেছে সব তমালের কাছে দিয়ে দিয়েছে পিয়াল। তমাল সেসব নিয়ে কী একটা স্কিমে রেখেছে মাসে মাসে টাকা আসে। আর পিয়ালকে বসে নানা হিসেব শুনতে হয়। শোনে। গা করে না। একটা ছেলে এসে প্রেসার মেপে যায়, ওষুধ দেয় খেতে। সপ্তা সপ্তা রক্ত নেয়, ওজন মাপে। ওকে এসব করে রিপোর্ট পেশ করতে হয় হৈমন্তীর কাছে। তমালের স্ত্রী। মা-ই যেন ফিরে এসেছে ওই মেয়েটির রূপে। পিয়াল ওদের দোতলার দিকে তাকায়। এদিক থেকে একটা শান্তির আগার বলে মনে হয়। এর চেয়ে আর কী চাই? কত বড় বাড়ি, প্রায় একটা ছোটখাটো তরুস্থলী। বাবার লাগানো একটা গাছও কাটা হয়নি। এদিকে পুরনো ঘরটা ছিল, অনেক পুরনো। সেটাকে ভেঙে শুধু এটা গড়ে দিয়েছে হৈমন্তী। একটা সর্বসুবিধাযুক্ত কুটির যেন। নিজের বারন্দায় বসে ঘরটির প্রতিও কী আদর জন্মালো। এত রাতে কী আর করা? গান শুনবে? আরেকটা ট্র্যাঙ্কুলাইজার খেয়ে নেবে নাকি? আরেকটু চেষ্টা করা যাক।

শুয়ে বুকের কাছে চলে আসে মনোযোগ। কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। কান্নাটা বেড়েছে। একটা দেওয়ালবাতি জ্বলছে। ক্ষীণ আলো। একটু ভারি ভারি লাগছে বুকটা। পিয়াল কী একটা শব্দে বুকের দিকে তাকায়। একটা প্যাঁচা। এত বড়? ধবল। বনবিদ্যা পড়ার সময় দেরাদুনে বন্য পশুপাখিদের নামধাম পড়েছিল। এটা টিওটো আলব্যা? বুকের ওপর এসে বসেছে। একটু একটু লাগছে নখরগুলি। পিয়াল নড়ে না। তাকিয়ে থাকে।

দেওয়াল সরে গেল। কেমন একটা জলমেশানো মাটির গন্ধ ভেসে আসছে। আকাশে নিকষ নীল ছড়িয়ে আছে। দিগন্ত পর্যন্ত ব্যাপে আছে সোনার ধান্যক্ষেত্র। জলের থেকে হঠাৎ একটা বিরাট পদ্ম উঠে এল। তাতে বসে আছে মীনা। গলায় মণিহার, কাঁখে স্বর্ণকলস। দুবার চোখ বুজে আবার খুলে তাকালো। তখন সে অবিকল রিনা কাকিমা। পিয়াল তাকিয়ে থাকে।

প্যাঁচাটা ধীরে তার শক্ত চঞ্চু ঢুকিয়ে দেয় পিয়ালের বুকে। বকবক করে বেরিয়ে আসে কান্না। জমা কান্নার একটা দারুণ গন্ধ। বাবা-মায়ের ঘরের থেকে যেমন আসে। আবার আবার। পাখিটা এবার পায়ের নখরও চালায়। আকাশ আরও নীল হয়ে যেতে থাকে আরও নিকষ। পেঁচাটা সবটা কান্না বের করে নিয়ে এলে পরে পিয়ালের ঘুম এল।

চার.

সকাল। একটু দেরি হয়ে গেল আজ। পিয়াল শুয়ে আছে। সুগত রায়চৌধুরি, ডাক্তার। এ কী করতে এসেছে। ওদিকে হৈমন্তী। ওমা, মেঝেতে কেন রে তুই? তমালটা কোথায়?
— ম্যাসিভ হয়েছে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক...
— অ্যাই ডাক্তার, কী বলছিস তুই? জোরে জোরে বলে পিয়াল... কেউ কি শুনছেই না?

সারা ঘরে দলা দলা কান্না পড়ে ছিল। পাখিটা কাল সারারাত এই করেছে। খুবলে খুবলে বের করে এনে সারা ঘর করেছে।  হৈমন্তীটা সেসব কুড়িয়ে নিয়ে তমালের হাতে দিচ্ছে।

(অন্যদেশ।। শারদীয় সংখ্যা।। ১৪২৩)
এরকম এক কলমের খুব শখ। যেন পূর্বজন্মে দেখেছি (অ্যামাজন এফিলিয়েটেড)

৭টি মন্তব্য:

  1. কী এক মায়া থাকে লেখায় তোমার৷ অদেখা লক্ষ্মীপ্যাঁচার রূপের মতন৷

    উত্তরমুছুন
  2. এক‌টি ছবি। কোলাজ। ঘাটভরা,
    গগনভরা, মানুষের আদলভরা ছবি, থৈ থৈ ..

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ পাঠের জন্য এবং এত সুন্দর মন্তব্যের জন্য।

      মুছুন
  3. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  4. প্যাঁচাটা আসতো যদি আমার ঘরে....... নিকষ নীল রাতের বুক জুড়ে অমন বসতো যদি....��

    উত্তরমুছুন