অশোক
দেব
সদাপুরাণ- তিন
সদাপুরাণ- তিন
হাসন মিয়াঁর বাপ রহিম মিয়াঁ। রহিম মিয়াঁ পুরুষ। প্রকৃত
পৌরুষ নিয়ে তাঁর ধারণা স্পষ্ট। মাটিতে পড়ে থাকা কলসির কানা পেচ্ছাপ করে ফাটাতে
পারে যে পুরুষ, সে পুরুষ। তিনি এ কাজ পারেন। তাঁর বয়স ষাটের বেশি। সুতরাং তিনি
একজন পুরুষ। এরকম নানা তত্ত্বের জনক রহিম মিয়াঁ আসলে গপিস্ট। যারা দরদর করে মিছে
কথা বলতে পারে,আমাদের ভাষায় তারা গপিস্ট। কিন্তু রহিম মিয়ার গপ নিছক
মিছেকথা নয়। তাঁর বলার ভঙ্গিটি ঔপন্যাসিকের।রহিম মিয়াঁ ফাজিল। উত্তরপ্রদেশের কোনও
এক মাদ্রাসা থেকে তিনি এই ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি ফাজিল পাশ। এটা প্রচারিত। তিনিই এর প্রচারক। নিজের
সাম্রাজ্য থেকে এক পা নড়েন না। বিশাল
বাড়ি। তিনটে পুকুর। গাছপালা, গোয়াল, বাড়ির পশ্চিমে নদী
পর্যন্ত সব জমি তাঁদের। রাজার লেঠেল ছিলেন এদের বাপ পিতামহ। গোমতী চর
বানিয়ে বানিয়ে চলে এল এই নতুন খাতে। তার আগে ছিল আরও পূবে। সেখানে
নদীর আদিরূপ
মরাগাঙ হয়ে শুয়ে আছে। এইসব চরার দখল নিয়েছিল এদের পূর্বপুরুষেরা। এই সত্যটুকু ছাড়া
রহিম মিয়ার সবকিছু মিথ্যা দিয়ে রচিত। যেমন তাঁর সোনার ফ্রেমের চশমা। সোনাটা সত্য।
চশমাটা মিথ্যা। কারণ, সেটিতে পাওয়ার নেই। তাঁর বাহারি হুঁকাটা সত্য, কিন্তু
ধূমপান মিছে। কারণ তিনি ধূমপান করেন না। গল্পের মাঝে মাঝে যেসকল শ্লোক রহিম মিয়াঁ
অনর্গল বলেন, সেগুলো আরবি। তাঁদের উচ্চারণটা সত্য কিন্তু ভাষাটি
মিছে। কারণ তিনি তালব্য, মূর্ধা, জিহ্বা ব্যবহার করে
যা বলেন, তার একটি শব্দও আরবি নয়। উচ্চারণরীতিটা এমন অভ্যাস
করেছেন, শুনলে তালেব তো তালেব, আলেমরাও ঘাবড়ে যায়
— জেডা আপনে ইডি করেন কিতা? কোরানের নামে বানাইয়া সুরা কন, হের উপরে কী ভাষা কন তার নাই ঠিক...
এইকথা বলেছিল করিমগঞ্জ থেকে আসা নতুন হুজুর। চারদিনে তার চাকরি নট
করে দিলেন রহিম মিয়াঁ। দায়ঃ সখিনার মাইয়ারে ফোসলানো।
যাবার আগে সেই তরুণ হুজুর বারবার জানতে চেয়েছিল, ‘জেডা সখিনাডা কেডা?’
— তোর মা, খবিশ। যা ট্যাকা লইয়া দূর হ।
মাদ্রাসা চলে রহিম মিয়ার টাকায়।
— জেডা আপনে ইডি করেন কিতা? কোরানের নামে বানাইয়া সুরা কন, হের উপরে কী ভাষা কন তার নাই ঠিক...
এইকথা বলেছিল করিমগঞ্জ থেকে আসা নতুন হুজুর। চারদিনে তার চাকরি নট
করে দিলেন রহিম মিয়াঁ। দায়ঃ সখিনার মাইয়ারে ফোসলানো।
যাবার আগে সেই তরুণ হুজুর বারবার জানতে চেয়েছিল, ‘জেডা সখিনাডা কেডা?’
— তোর মা, খবিশ। যা ট্যাকা লইয়া দূর হ।
মাদ্রাসা চলে রহিম মিয়ার টাকায়।
জেডা বলবেন। তোমার কাজ শুনে যাওয়া এবং বিশ্বাস করা। সেই
বিশ্বাস করবার ভঙ্গী যত বিশ্বাসযোগ্য হবে, তোমার ভাগ্য তত
খুলবে।খেতে পাবে নানা কিছু। কাঁচামিঠে আম থেকে শুরু করে কাবাব, যা
খেতে চাও পাবে। একটু আপত্তি করেছ, কিংবা
যুক্তি খুঁজলেই শুনতে হবে খিস্তি। সে খিস্তিতে মায়ের চরিত্রনাশ হয়ে যেতে পারে, বাপ চোরস্য
চোর হয়ে যেতে পারেন। সুতরাং সেদিকে না যাওয়া ভাল।
এই বিশাল সম্পত্তি রহিম মিয়াঁ কী করবেন? হাসন
আর মজিদ তাঁর দুই পুত্র। হাসন হল নিষ্কর্মা। মজিদ মারফতি। একজন বিয়ে করে আর তালাক
দেয়। আরেকজন বাঁশি বাজায় আর হায় হায় করে। রহিম মিয়াঁর স্ত্রী নেই। কাঁচামিঠে আমগাছ
আছে। তাঁর নীচে তিনি করাত কোম্পানির লুঙ্গি আর লখনৌ থেকে আনা পাঞ্জাবি পরে দারুণ
এক আরামকেদারায় বসেন। পাশে বাহারি স্টুলের ওপর সেই পেতলের হুঁকো। তার গোটানো
নল।আরেকটা স্টুলের ওপর নেয়ামুল কোরআন, পবিত্র আল কোরআন আর মকছেদুল
মোমিন ও ইংরেজি পত্রিকা। সেসব থাকে, পড়া হয় না। রহিম মিয়াঁ সারা দুনিয়াকে
অস্বীকার করেন। তাতেই তাঁর আনন্দ।মুখে সেই অস্বীকৃতি মেখে তিনি বসে থাকেন। তাঁর
পায়ের কাছে বসে লোকে কথা শোনে। ডম্বুরের বাঁধ তৈরির সময়ে এক মা হাতির মর্মন্তুদ
আত্মত্যাগের গল্প বলেন। গোমতীর ব্রিজ তৈরি করার সময় কেবল বানায় আর ভাঙে, বানায়
আর ভাঙে। দিনে যতটা বানানো হয় রাতে সেটা ভেসে যায়। ইঞ্জিনিয়ারের দল আসে যায়। কিছু
করতে পারে না। রহিম মিয়াঁ ছেলেধরা পাঠিয়ে দূর হবিগঞ্জ থেকে এক
বেশ্যাপুত্রকে আনালেন। তাকে বলি দেওয়া হয়েছিল নির্মীয়মাণ ব্রিজের
গোড়ায়।সেই রক্ত পান করে নদী
শান্ত হয়। এইসব বলেন রহিম মিয়াঁ।এসবের ভিত্তি তিনি। আবার আজকে বলা কাহিনী কালকে অন্যরূপ করে দেবার মালিকও
তিনি। তোমার কাজ বিশ্বাস করা।
আজ শুক্রবার। আজই আসল কেরামতি। রহিম
মিয়াঁর ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্টির নখ বড়। তাতে শর্ষের তেলে ভুসাকালি মেখে চকচকে
দর্পণ তৈরি করা হয়।জুমার নমাজ সেরে এসে মসজিদ হতে ফিরে একটা সময়ে রহিম মিয়াঁ চোখ
রাখেন নখদর্পণে। চশমা খোলা। পুতপুতে চোখ। মরুর বড় ভাই সজু। সে আর তার দলবল বসে
থাকে। রহিম মিয়াঁ হঠাৎ হঠাৎ একটা নম্বর বলেন। এরা টুকে নেয়।
পৃথিবীতে এক স্থান আছে। মেঘালয় রাজ্যের কোথাও দুই
পাহাড়ের মাঝখানে বিশাল এক মাঠ। সেখান কত
কত তীরন্দাজ চোখ বেঁধে লক্ষ্যভেদ করে। এক থেকে নিরানব্বই লেখা লক্ষ্য। কলা গাছের কেটে
আনা কাণ্ডে সেসব নম্বর লিখে সাজিয়ে দাঁড়
করিয়ে রাখা। দূর হতে তীর ছোঁড়া হয়। যেটাতে লাগে সেটাই বিজয়ী। সে নম্বরে যে এক টাকা
লাগিয়েছিল সে ছিয়াত্তর টাকা পাবে। যারা রহিম মিয়াঁর নম্বরে টাকা লাগায়, তাঁদের
কেউ না কেউ জেতে। তাঁকে কিছু দিতে হয় না, মসজিদে দানবাক্সে
দেওয়া যাবে। চাপাচাপি নেই। দিলেও আচ্ছা না দিলেও আচ্ছা।
স,
এই করে লোকেদের ঠকায় মরুর ভাই সজু আর এই গপিস্ট বুড়া। আমি বুঝি। তবু যাই শুক্রবারে তাঁর নখদর্পণের দরবারে। বসে থাকি। বিশ্বাস করতে মন চায়। যে তুমি আসলে নেই, সে তোমাকে কি দেখাতে পারে না রহিম মিয়াঁর নখদর্পণ? তোমার ওই ভ্রূজোড়া— ঈশ্বরের রচিত দুটি উর্দু পঙক্তি — আমি দেখতে চাই। দেখতে চাই তোমার দুটি চোখ।তোমাকে দেখতে চাই, যে তুমি নেই।তাঁর সেই বুড়ো আঙ্গুলের কালো চকচকে নখে আমি তাকাই। কী যেন ভেসে ওঠে, ছায়া ছায়া কে যেন আসে চলে যায়। কার যেন মুখচ্ছবি দেখি। সে তুমি নয়, কে যেন। একটা মিথ্যে হবে, কিংবা মৃত্যু।ইতি ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪
এই করে লোকেদের ঠকায় মরুর ভাই সজু আর এই গপিস্ট বুড়া। আমি বুঝি। তবু যাই শুক্রবারে তাঁর নখদর্পণের দরবারে। বসে থাকি। বিশ্বাস করতে মন চায়। যে তুমি আসলে নেই, সে তোমাকে কি দেখাতে পারে না রহিম মিয়াঁর নখদর্পণ? তোমার ওই ভ্রূজোড়া— ঈশ্বরের রচিত দুটি উর্দু পঙক্তি — আমি দেখতে চাই। দেখতে চাই তোমার দুটি চোখ।তোমাকে দেখতে চাই, যে তুমি নেই।তাঁর সেই বুড়ো আঙ্গুলের কালো চকচকে নখে আমি তাকাই। কী যেন ভেসে ওঠে, ছায়া ছায়া কে যেন আসে চলে যায়। কার যেন মুখচ্ছবি দেখি। সে তুমি নয়, কে যেন। একটা মিথ্যে হবে, কিংবা মৃত্যু।ইতি ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪
তোমার
একান্ত
সদানন্দ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন