মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

সদাপুরাণ -এক

অশোক দেব
সদাপুরাণ

বাঁশ দিয়ে বানানো হলেও এটিকে আর বাঁশ বলে না কেউ। বলে, গর্জনকাঠি। চিতায় মৃতকে নাড়িয়ে দিতে, পড়ে যাওয়া লাকড়ি ঠিক মত সাজিয়ে দিতে গর্জনকাঠি লাগে। সকলে এর ব্যবহার জানে না। শিখতে হয়। আমি শিখেছিলাম এখন বিল্টু শিখেছে। শবদাহ করাও একপ্রকার লোকসেবা। সেই সেবা যে কার প্রতি  সেটাই প্রশ্নমরা মানুষ কি আর তা নেয়? তবু আমাদের ক্লাবের ছেলেরা পাড়ায় কেউ মরলেই তেতে ওঠে। একেক জনের এক রকম ইন্টারেস্ট। কেউ ঠিক করেছে জীবনে একশো আটটা মড়া পুড়বে। কেউ চক্ষুলজ্জায় গিয়ে শ্মশানে হাজির হয়। কারও মদের লোভ। কেউ কেউ কাঠ বেকার, কেউ মারা গেলে একটা দিনের স্বাদবদল হয়। আবার কেউ একদম অন্য কারণে গিয়ে মড়াবাড়িতে চলে যায়।  যেমন, কমলদা মড়া বাড়িতে যায় শোকাকুল নারীদের দেখতে। তার নাকি ভালো লাগে। কী কাণ্ড! কমলদা এমনিতেও একটু সেই টাইপের। তবুও বিলাপরত, শোকবিহ্বল নারী দেখতে একজন মানুষ মৃতের বাড়িতে ছুটে যায়! কমলদা যায়। লোলুপ তাকিয়ে থাকে ক্রন্দনরত মেয়েদের দিকে, বউদের দিকে, এমনকি বালিকার দিকে।  এখন অবশ্য সুগার হয়েছে খুব। শুকিয়ে হাফ হয়ে গেছে শরীর। কমলদা শ্মশানে, মড়া বাড়িতে যান না বিশেষ। আজ এসেছেন, সদানন্দ অদ্ভুত ছেলে ছিল তো। তার ওপর সুইসাইড কেস।
তখন সদানন্দ পুড়ছিল। সে আর সদানন্দ ছিল না তখন। লাশ। ডেডবডি। এর মধ্যে বেশ কাটাচেরা হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল বডি পেতে পেতে। আমি দেখলাম, মিষ্টিদার ভুঁড়িটা মাঝে মাঝে নিজে নিজে কাঁপছিল। মানে বেশ আনন্দ হচ্ছিল তার। দেদার টাকা ওড়াচ্ছে। লাশঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চলল মদ্যপান। এমন সময়ে দেবলের কাজ বেড়ে যায়। ব্যস্ত। মিষ্টিদা টাকা দিয়ে যাচ্ছে, দেবল মদের বোতল, চানাচুর, জলের বোতল, প্লাস্টিকের গ্লাস, সব যোগাড় করছে। ফ্রি পেয়ে সকলেই দুয়েক পাত্র ঢেলে নিচ্ছে। সেটা শ্মশানেও চলল। এপাশে লোকনাথ আশ্রম, সামনে গোমতী, পাশে বেলগাছের বন। ক্ষণে ক্ষণে বিচ্ছু ছেলেগুলি চিৎকার করে উঠছিল, কু কু...

ওই শব্দটা সদানন্দ সহ্য করতে পারত না। এখানে যারাই এসেছে, সবাই সদাকে ক্ষেপাত। আজও ক্ষেপিয়ে চলেছে। আজকাল মদ খাই না। ওই শব্দটা যত শুনছি তত মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এবার ছাড় না, মরা মানুষ তো আর ক্ষেপবে না। কেউ কানে তোলে না কথা। চরম রাগ হল বিল্টুর ওপর। সদার খুলি ফাটছিল না। বিল্টু গর্জনকাঠি দিয়ে প্রাণপণ মারছে আর চিৎকার করছে , কু... কু... কু... মাথার তার ছিঁড়ে গেল। এগিয়ে গেলাম। বিল্টুর লিঙ্গ বরাবর কষে লাথি মারলাম একটা। পড়ে গেল। তারপর থেকে এই কু শব্দটা আর নিতে পারি না। আজকাল যেখানে যাই, কেউ না কেউ ওই কু কু করে ওঠে। মাথার তার ছিঁড়ে যায়।
নন্দ দারোগা আসলে চন্দ দারোগা। চন্দ টাইটেল ওর পছন্দ নয়। তাই সে আদালতে গিয়ে নিজেকে সুবল চন্দের জায়গায়, সুবল নন্দ করে নিল। আমি তাকে চন্দই ডাকি।  ‘ চন্দদা,আমার তো রাগ ওঠে। শালারা আমারেকু কুকইরা ক্ষেপায়। আমি কিন্তু সদা না, জানেনই তো। একটা একটা কইরা খুন করুম।
      – আরে ভাই, ডেঞ্জারাস মানুষ আছিল এই সদানন্দ
    কেমন?
    ডেঞ্জারাস। বাইরে এক ভিতরে আরেক... পণ্ডিত টাইপের আছিল শালারপুতে
    যেইসব চিডি লেখছে...
    কারে?
    কারে কে জানে, শালারপুতে তলে তলে রোমিও আছিল
    ধুর
    না রে, ঠিক
    একটা কথা কই ভাই, আমনেরে এই কু-এ পাইছে। আমারেও পাইছিলো। এই কেস হ্যাণ্ডেল করতে গিয়া আমি যে কী কী পাইছি, আমনেরে কমু। আপাতত এই ডায়েরি নিয়া যান। কোন্‌ এক মাইয়ারে সদা কীসব চিডি লেখছে... মাথা মুণ্ডু বোঝেননি দেখেন

সেই সব ডায়েরি আমি নিয়ে চলে এসেছি। ছেলেটা এত গভীর আর এত প্রেমিক ছিল?দরোজা ভেঙে আমরা যখন সদানন্দের ঘরে ঢুকেছিলাম, অবাক হয়ে গেলাম।  জীবনে এত গোছানো ঘর আর দেখিনি। এত পরিপাটি, কেমন একটা মায়াবী গন্ধ।  এত বই... এত গানের ক্যাসেট, এত এত সব ছবি...
নন্দ দারোগা যে ডায়েরি দিয়েছে, তাতে দেখি অদ্ভুত সব চিঠি। একটা মানুষ এত দুইরকম হতে পারে? যে সদানন্দ বাইরে বেরোলে সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকতো, সর্বদা একটা বেকুবমার্কা হাসি ঝুলিয়ে রাখতএকই ড্রেস, একই ঝোলা, সে এসব চিঠি কাকে লিখেছে। কী লিখেছে এসব!

চিঠিঃ এক
,
ভূমিকম্প টের পেলে? কী করছিলে তখন? আমি ঝনঝন করে সামনের মাঠে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘরের কম্পন মাঠে ছিল না। শাঁখ আর উলুধ্বনিতে ঘিরে ফেলেছিল চারদিক। ঠিক তখনই আমি দেখলাম, অনেক উটের গ্রীবা। ধড়হীন। হেঁটে চলে যাচ্ছে আকাশ দিয়ে। আমিও হাঁটতে লাগলাম ওদের পিছু পিছু। তোমাদের পৃথিবীতে তখন ভূমিকম্প সেরে গিয়ে থাকবে। আমার আর মনে নেই কিছু। দেখি অনেক দূর হতে কে একটা নিভন্ত উনান কাঁধে নিয়ে আমার পাশে এসে বসেন। আস্ত পৃথিবী নীরব হয়ে গেল। একে নীরব হওয়া বলে না, কী যে বলে এই নিরেট শব্দহীনতাকে! দেখলাম, আসলে ওই লোক নিভে যাওয়া উনানে নিস্তব্ধতা রান্না করছিল। একটা কেমন হাল্কা ধোঁয়া এসে নাকে লাগে। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
দেখি, আরেকটু উঁচু হবে বলে নড়েচড়ে উঠছে হিমালয় । আজ ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১ সাল। দেখি, তরতর করে গিরিশ্রেণি হতে শিহরণ নেমে এসে ভূমিকম্প হয়ে গেল।যেন, প্রচণ্ড মার খাবার পরে ঘরে এসে কাঁপছেন পিবি শেলি। তাঁকে ধরে ধরে সবাই মারতো তো স্কুলে। তারা বলতো, "Shelley-baits" বিচ্ছুরা শেলিদের মারে কেবল। কেন মারে। মারে। কারণ, একদিন শেলিকেই লিখতে হবে, ভালোবাসার দর্শন, ‘Love’s Philosophy’ (তোমাদের রবিঠাকুর এর নাম দিয়েছিল, ‘প্রেমতত্ত্বআর কী বিচ্ছিরি অনুবাদ করেছে!)    হঠাৎ দেখি সিনেমার পর্দায় যেমন, তেমনি আকাশে ভেসে ওঠে কিছু লাইনঃ
‘See the mountains kiss high heaven 
   And the waves clasp one another; 
No sister-flower would be forgiven 
   If it disdained its brother; 
And the sunlight clasps the earth 
   And the moonbeams kiss the sea: 
What is all this sweet work worth 
   If thou kiss not me?’ 
কে যেন নাড়িয়ে দিল। জেগে উঠলাম। কারা যেন কোথা হতে আমাকে উদ্দেশ করে কু, কুকরে চলেছে। এই শব্দটা শুনলে আমি রেগে যাই কিনা, তাই ক্ষেপায়, পাগল নাচায়। আসলে এরা কিছু একটা করে হাসতে চায়। আনন্দ পেতে চায়। তাই। এটা হল সদা বেইটসআজকাল রাগ করি ন, কারণ তুমি তো আছ।
তুমি আছ। যেমন পৃথিবীতে ঠিক কোথাও একটা দারুচিনি দ্বীপ আছে। চাঁদের জোছনা পরার সাজঘর আছে না কোথাও? যেমন তুমি সাজো, তেমনি চাঁদও ঘোর অমাবস্যার শেষে, সেই দৈব সাজঘরে গিয়ে জোছনা পরে আসে। আমি তাকিয়ে থাকি আকাশে, কেমন শারদবিভা। শিশিরের আয়োজন দেখিশিশির পড়ে আজকাল। যেন বাতাসের ক্ষয়রোগ হল।এই যে শিউলির কুঁড়ি, এই যে শিশিরপাত, এই যে ঈশ্বরের কারুকাজ, এসবের কী কাজ বল? কী কাজে আসবে এসব...
What is all this sweet work worth 
   If thou kiss not me?
আমি তাই চিৎকার করি। নিজের অস্তিত্বকে অসম্মান করি। তুমি শুনতে পাও? আমি নিজেকে ক্ষেপাই, ক্ষেপিয়ে তুলি। কু, কু। ইতি
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১১

তোমার একান্ত
সদানন্দ




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন