শুক্রবার, ১৭ জুলাই, ২০২০

কুশল সংবাদ- তিন




কুশল সংবাদ-তিন 

ফলশ্রুতি। শব্দটি অর্থের দিক থেকে পালটে গিয়েছে। তীর্থ করে আসা মানুষের কাছে তীর্থের বর্ণনা শুনে, অথবা ব্রতকথা শুনে শ্রোতার যে পুণ্যফল হয়, তা-ই ফলশ্রুতি। শ্রুতি হতে প্রাপ্ত ফল। আজ শব্দটি ব্যবহৃত হয় ফলস্বরূপ  অর্থে। এতে কি তার মনখারাপ  হয়? শব্দটি একা বসে কোথাও কাঁদে? মাঝেমাঝে শব্দের ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পাই আজকাল।

কাল সারারাত তিতির শব্দটি কেঁদেছে। ভোরের দিকে চলে যায়। তখন গুটিসুটি ঢুকে পড়ল বিরহ শব্দটি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। কাঁদে কেন তারা? শব্দের আবার কিসের দুঃখ! আমাকেই কেন তাদের কান্না শোনাতে আসে? না, কে তাদের অর্থবদল করে দিচ্ছে, তা নিয়ে একটুও বিচলিত নয় তারা। কারণ বিকৃতার্থ করা হয়েছে, এমন তো একটি শব্দও আসে না। আসেনি এতদিন। দু-একবার এলেও কাঁদেনি। বিদ্রুপ করে ফিরে চলে গেছে। তবে?

শুয়ে শুয়ে শব্দের সঙ্গে খেলি। দেখি, আমার বিছানার চারদিকে, ওপরে ও নীচে, পাশে, পায়ের কাছে অযুত শব্দমালা এসে জড়ো হয়েছে। কেউ পৃথুল, কেউ শীর্ণ। কারো মন খারাপ কেউ বা অজীর্ণ রোগে ভুগছে। চোখ বুজে তাদের গায়ে হাত বোলাতে যাই। বসন্ত শব্দটিকে ধরতে বামদিকে হাত বাড়াই। হাতে কী যেন চটচটে একটা শব্দ এসে লাগে। চোখ মেলে দেখি, যক্ষ্মা।

অথবা, সংগীত থেকে শব্দকে তুলে নিয়ে একটু আদর করতে ইচ্ছে করে কখনো। সকল সংগীত নয় শব্দময়। কোনও সংগীতের শব্দ থাকলেও তা ঠিক শব্দ তো নয় ধ্বনি। শব্দরূপে থাকলেও সে-সব শব্দ থাকে ধ্বনির আগেপিছে। যেন ধ্বনিটিই আসল। শব্দেরা তার দেহসচিব। ধ্বনি অভিজাত। বহুবিভাময় এবং অহঙ্কারী। ধরা দেয়, কিবা দেয় না। দিলেও কাছে থাকে না। তখন নিজেকে এক জন্মান্ধের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে করে। সে কী মর্মে ধ্বনিকে বিবেচনা করে? জন্মান্ধরা কেন স্বভাবে বাঁশিওয়ালা, কেন তারা এত সংগীতপরায়ণ? তবে কি চক্ষু শব্দের আত্মীয় নয়? যে মানুষ আজ মাত্র তিতির পাখি দেখেছে, তার অন্তরে তিতির শব্দটির কী পরিণাম হল? শব্দটির যে ইতিহাস এতকাল তার মনে লেখা হয়েছে, তার কী হবে? তিতির দেখার আগে ও পরে শব্দটি কি একই থাকছে? হয়তো বদলে যায়। নিশ্চিত, বদলে যায়।  সেটাই অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু জন্মান্ধের শব্দের ইতিহাস পালটায় না। তার কাছে জমা থাকে ধ্বনি ও শব্দের ধ্রুবপরিচয়। এ জগতের সকল শব্দমালা তার কাছে  ঈশ্বররচিত ধ্রুবপদ

উট দেখিনি আমি। মরুদেশে যাইনি কখনও। তবে কি উট শব্দে আমার অধিকার নেই? মাঝে মাঝে দেহের সকল গ্রন্থি গুছিয়ে নিয়ে, এই যে, অন্তরে কান পাতি তখন কাকে দেখি? এক গভীর নিস্তব্ধতাকে কাঁধে নিয়ে কারা যায়? কিংবা নিঃসঙ্গতাকে? শরীরের শ্মশানের দিকে কারা যেন নিস্তব্ধতাকে নিয়ে যায়, অনন্তযাত্রায়। তখন প্রহরনিরপেক্ষ রাত্রির জন্ম হয়, দেহের ভিতরে। সেখানে একা একটি কাটা চাঁদ জেগে ওঠে। তার জ্যোৎস্নার ঘ্রাণ ফেরি করেন কে যেন, তখনই দেখা হয় উটের সঙ্গে, তার গ্রীবার সঙ্গে। এইখানে এক শব্দপ্রদর্শকের কথা উঠবে অবধারিত ভাবে উঠবে কবি।

কবি কোন্ শব্দমালা নিয়ে কাজ করেন, চক্ষুষ্মানের শব্দ, না জন্মান্ধের? কোনো মানুষের দ্বারা এক জীবনে কোনও একটিমাত্র শব্দেরও সঠিক পরিচয় পাওয়া কি সম্ভব? যে ব্যক্তি বিরহদহনে আত্মহত্যা করেছে আর যে জীবিত এখনও বিরহানলে দগ্ধ হচ্ছে, তাদের কাছে বিরহ শব্দটির কি একই পরিচয়? কে পারেন এদের জন্য এই শব্দটিকে নির্বিশেষার্থে পরিবেশন করতে? কবি কি পারেন? কত অসহায় একজন কবি, হায়! সারা জীবন তাই একজন কবিকে শব্দের ক্রন্দনধ্বনি শুনে যেতে হয়। যেন এক গণকবরের পাশে বসে থাকেন তিনি। তাকে ঘিরে কান্নার আলেয়ানৃত্য চলতে থাকে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজের শবের ওপর বসেই কবি আয়োজন করেন শবসাধনার। যিনি তাতে সিদ্ধ, শব্দের অপরিচয় ঘুচে যায় তার। তিনি তখন নৈঃশব্দ্যের আলোকপ্রদেশে চলে যান। যিনি সেই সাধনায় চিরনিমগ্ন থেকে কেবলই বিস্ময়ে বিমূঢ় থেকে যান, থাকার যোগ্যতা অর্জন করেন, তিনি কবি হয়ে ওঠেন। হয়তো পৃথিবীতে তাই, কেউ কেউ কবি। সকলে নয়। বাকিরা শব্দের ম্যানেজার।

মাঝে মাঝে কোনও একটি কবিতার দিকে তাকিয়ে থাকি। পাঠ করা নয়, তাকিয়ে থাকা। তার শরীর হতে একটি একটি করে শব্দ তুলে নিয়ে পাশে রাখি। তখন কাগজের সাদা পড়ে থাকে। সেই নির্বিরোধ অথচ ক্রূর, নিষ্ঠুর এবং হিংস্র সাদাটুকুই কি কবির অভিপ্রায়? ভয় হয়। তাড়াতাড়ি আবার শব্দগুলি সাজিয়ে দিতে চেষ্টা করি। হয় না।  আগে যেমন ছিল ঠিক সেরকম হয় না। একই শব্দ কবিতে-আমাতে ভিন্ন যে! এবারও একটি কবিতা সৃজিত হয়। নতুন। সেই কবি, যিনি এত আয়োজন করে শব্দমালা স্থাপন করে দিয়েছিলেন, তিনি তখন উহ্য হয়ে যান। এদিকে, তাঁর রচিত শব্দমালা ছিল অপরিচিত, তারা এবার বদলে গিয়ে আত্মীয়ের মত করে আসন গ্রহণ করে। আমার আত্মীয়। এখন তাদের সঙ্গে একটু আলাপচারিতা চলে। সেই আলাপে, কই,  সেই পূর্বোক্ত কবির নাম তো একবারও আসে না।  হয়তো এই প্রক্রিয়ারই সাধারণ নাম পাঠ করা। তাহলে পাঠ করাও শিখতে হয়? শব্দেরাই একজন মানুষকে পাঠক করে তোলে? কিংবা তারাই পাঠ করে পাঠক কিংবা কবিকে? এত শক্তিধর জগতের শব্দরাশি! তবে কাঁদে কেন তারা, আজকাল?

আজকাল শব্দের ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পাই। তাই ধীরে ধীরে অন্তরালে চলে যেতে ইচ্ছে করে। এই কোলাহলমুখর পরিচয় ছেড়ে অন্তরালে চলে যেতে ইচ্ছে করে, ধ্বনিনির্মিত  ভিন্ন এক অন্তরালে। ধ্বনিই শব্দের জননী। তাঁর কাছে গিয়ে একা, অহংবিবর্জিত হতে চাই। কোনো একটি শব্দকে আমার নিজের আয়তনে নামিয়ে আনে কে? নিসর্গ শব্দটিকে কে সিনারি' হিসেবে বিবেচনা করে? সেই অহং।তাকে হত্যা করতে হবে। তাই সেই আদি, প্রথমা ধ্বনির কাছে যাই। দেহের সকল দরোজা বন্ধ করে দিলে সেই ধ্বনি বাজবেন। সে ধ্বনি সংগীতের নয়, বাতাসের নয়, চিৎকারের নয় কিংবা পক্ষিরব নয় তা। বাস্তব পৃথিবীতে তাঁর কোনও মৌলিক বাহ্যরূপ নেই। তিনি একা।সকল ধ্বনি-নীরবতার সম্রাজ্ঞী। তাঁর দিকে কান পেতে রাখি। হয়তো ধ্বনিত হচ্ছেন। তিনি তো নিয়তস্বনক। আছেন এবং ক্রমাগত হচ্ছেন। ধরতে পারি না। এই বাহ্যশ্রুতি দ্বারা তাঁকে নির্দেশ করা যায় না। নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে সব। কিন্তু সে-ও তো শব্দময়!  বুঝতে পারি এ জীবন শব্দদূষিত। সে প্রকৃত ধ্বনিকে অনুধাবন করার যোগ্য হয়নি আজও। কারো কারো হয়। কারো কারো জীবন সে ধ্বনিকে অবলম্বন করার মত যোগ্য হয়। এখনও সেই যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। তাই কান্না।এই কান্না আমার। অহংচালিত নিজের কান্নাকেই মনে হয় শব্দের। অহং এসে দিশাবদল করে দিচ্ছে।কাঁদছে জীবন, শুনতে পাচ্ছি শব্দের ক্রন্দনধ্বনি।

তবুও তো হচ্ছে কিছু। ঠা-ঠা হননহাস্য শোনার থেকে নিরবধি ক্রন্দনের সঙ্গে আছি। বেশ আছি। ভাল আছি।



['জলজ' পত্রিকায় প্রকাশিত, ২০১৬]

পাঠের জন্য ধন্যবাদ 

[ তখন উপনিষদ পড়ছিলাম খুব। কিন্ডল ছিল না। হার্ডকভার। এখন কিন্ডল এসে গেল] 

বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০২০

কুশল সংবাদ-২


কুশল সংবাদ- দুই


মাঝে মাঝে কয়েকজন জন্মান্ধের সঙ্গে দেখা হয়। তারা হস্তীদর্শন করে ফিরছে। তাদের কিছু জিগ্যেস করি না, নিজেই হাতির দিকে এগিয়ে যাই। যেতে যেতে অন্ধদের অনুমানগুলি মনে করি। তাদের কারও অনুমান হাতি হল একটা নরম থাম, কেউ ভেবেছেন হাতি হল একটি সজীব কুলা, কেউ মনে করে সামান্য একটা রোমঝাড়ুই হাতি... ভাবতে ভাবতে হাতির সামনে চলে আসি। এসে দেখি, কিছু দেখা যাচ্ছে না। চোখের দৃষ্টি চলে গিয়েছে। এইরকম অবস্থা হয় একটি প্রকৃত কবিতা পাঠ করলে। মনে হয়, কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না, কিছু শোনা যাচ্ছে না। বুদ্ধি ও সংস্কারনির্ভর সকল উপকরণই স্তব্ধ হয়ে যায়। বরং অন্তরে অনুমানের পাথর জমা হয়ে যায় অনেক। রঙিন সেই পাথরকেই সত্য বলে বোধ হয়। তাই কবিতা নিয়ে এত গদ্য, এত তাঁর পরিচয়নির্মাণের চেষ্টা। তথাপি, কবিতা সমান অধরা থেকে যাচ্ছেন।

যিনি বিশুদ্ধসত্ত্ব হতে পেরেছেন, তিনি যা চাইবেন তা-ই পাবেন। যা চাইবেন, তাকেই জয় করতে পারবেন। যে লোক কামনা করবেন, সে লোকেই বাস করতে পারবেন।  কিন্তু শুদ্ধতাই তো হল সবচেয়ে বড় কাম্য। সেটি পেয়ে গেলে আর তো কিছু চাইবার থাকে না! তবে? উপনিষদের কবি তাহলে কী আর চাওয়াতে চান সেই শুদ্ধসত্ত্বাধিকারীকে দিয়ে? পৃথিবীতে কত কবিতা লেখা হয়েছে। এক বাংলা ভাষাতেই কত কত কবিতা। একবার পড়লে সারাজীবন মনে তার অনুরণন বাজে  এরকম কবিতাও হাজারে হাজারে রচিত হয়ে গিয়েছে।  সেসবের পরে আর কী চাইবার আছে? নতুন করে আর কী লিখবার আছে? কিংবা একজন কবি একটি উৎকৃষ্ট কাব্যগ্রন্থ লিখে ফেললে তাঁর আর কবিতা লেখার চেষ্টা কেন? তিনি কবিতার কাছে আর কী চান? বিশুদ্ধ একটি কবিতা রচনা করাই তো সাধনা। বিশুদ্ধবস্তু তো বহু হতে পারে না। তাহলে বহু বহু কবিতা যে লেখা হচ্ছে, সে-সব বিশুদ্ধতম কবিতা নয়?

এমন একটি কবিতার সন্ধান করে চলে মানুষ, যেটি লেখ্য নয়। এমন কোনও লিপি, এমন কোনও করণকৌশল মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি, যার দ্বারা সে কবিতা লিখে ফেলা যায়। হয়তো কবিও জানেন না, তিনি এক দুর্বোধ্য, হিরন্ময় অন্ধকার পেতে চাইছেন। যা পেলে প্রাপ্তিবোধও লীন হয়ে যায়। তাই, যেদিন পেয়ে যান, সেদিনও বুঝতে পারেন না পেয়েছেন। তাই চাওয়া শেষ হয় না। চাওয়ার দৌরাত্ম্যে চিত্তও শুদ্ধ হয় না। সুতরাং একটি অশুদ্ধচর্চার নামই কাব্যচর্চা। যেমন বিজ্ঞান। এমন একটি চরম নিয়ম কোথাও আছে, যার দ্বারা সকল নিয়মকে ব্যাখ্যা করে ফেলা যায়। সে নিয়মের নিয়ত সন্ধান করে চলেছে বিজ্ঞান। হয়তো কোনো কোনো বিজ্ঞানী তা অন্তরে জেনেছেন, কিন্তু সেটিকে প্রকাশ্য কোনও মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে ভাগ করা যায় না।

কবিতাও কি যায়? যে নিগূঢ় মনোস্থিতি থেকে ভাব কিংবা ভাবরাশি শব্দবাহিত হয়ে সাদা পাতায় চলে আসে, সে ভাবটি তো শব্দদ্বারা অপরের কাছে সম্পূর্ণতঃ যেতে পারে না। ভাগ হয় না তার। মনের সাহায্যে অপরের মনের কাছে আমরা যে বার্তা পাঠাই তা-ও তো পথভ্রষ্ট হয়। কিংবা উদ্দেশ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়। এমনকি, একের উদ্দেশে প্রেরণ করা বার্তা অন্য কোনো মনে গিয়ে আহত হয়।  কারণ মানুষের অন্তরের গভীরতম প্রদেশ হতে যে বার্তা আসে, তা তো তার অন্তরেই লীন হয়ে যায়। মনের সেখানে কোনওমাত্র ভূমিকা নেই। মন একটি ভোঁতা উপকরণ মাত্র। সে উদ্দীপ্ত হতে পারে। উত্তেজনায় সাড়া দিতে পারে, সে সাড়া সে মানুষের দেহের ভিতরের আরও ভিতরে নিয়ে পৌঁছাতে পারে। যদিও তাকে সে কাজে প্রশিক্ষিত করে নিতে হয়। সে কাজ কঠিন। অন্যদিকে  কবিতা সেই উত্তেজক হতে পারে। যুগযুগ ধরে কবিতাকে তা-ই করার চেষ্টা হয়েছে। হয়তো প্রতিটি কবিই সেটি চান। কিন্তু, যেমন, হিমালয় যেতে গিয়ে পথিমধ্যে অন্য নগরের বৈভবে ভুলে যায় শৌখিন পর্যটক, তেমনি কবিও হয়তো ভুল করেন।

কী জানি কী করেন! পাঠ করতে করতে এই-ই তো মনে হয়। একেবারে ভূমিপার্থিব কোনো ঘটনার বিবরণবাচক কবিতা স্বল্পজীবী হয়ে থেকে যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে যৌবনোদ্দীপক কবিতাসকল আজ আর কাজে আসে না। কেবল সেইসব যুগের কথা, দেশের শিশুকিশোরদের মনে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করবার কাজে তাদের ব্যবহার হয়। বলা বাহুল্য, সে জাগ্রত দেশাত্মবোধ শিশুকিশোরের বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উবে যায়। কবিতা তো হেন উদ্বায়ী হবার কথা নয়!

তাই, চাই না কিছু আর। হয়তো লিখতেও চাই না। শুধু নিজেকে চাইবার মত যোগ্য করে তুলতে চাই। ধীরে ধীরে তাই কমে যাচ্ছে অভিমান। অপরের মুখ ভেবে যখন কেউ ম্লান করে দিয়ে যায় আমার মুখটি, তখন তাকে মনে মনে দেখি। নিজের প্রকৃত মুখচ্ছবি তো মানুষ দেখে না কখনও।

অনুমান করি। কোন্ মুখটা ম্লান হল? যেটিকে দর্পণে দেখি সেটি? নাকি, অপরের চক্ষুমধ্যে বিম্বিত দেখি যাকে সেটি? নাকি এসকল মিলে মনেমনে নিজের মুখের যে ছবি আঁকা হয়ে আছে সেটি? ভাবতে ভাবতে যাই। নিজের দেহের ভিতরের পথে পথে হাঁটি। যেন আমার ম্লানমুখখানিই সে হাতিটি! যদিওবা তার সামনে যেতে পারি, গিয়ে দেখি অন্ধ হয়ে গেছি। কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

এই অন্ধত্ব নিয়ে ভালো আছি।

[ 'জলজ' পত্রিকায় প্রকাশিত, ২০১৬]





পাঠের জন্য ধন্যবাদ

একনাথ ঈশ্বরণের লেখা মুখ্য উপনিষদগুলো



বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০২০

ডোবারম্যান



অশোক দেব

ডোবারম্যান


এক

শুয়ে অন্ধকারে চোখ মেলে থাকাটাই ঘুম। সদানন্দের নিদ্রা। চোখের সাম্নে নানা রঙের বলয় তৈরি হতে থাকে। কখন ভোর হবে ভাবতে ভাবতে ভোর হয়। পাখি ডাকে, ঠিক তখন কিচ্ছু না জানিয়ে সদার ঘুম আসে।

সদানন্দ স্বপ্ন দ্যাখে। দ্যাখে, একটি ঘর, মেঝে একদম তকতকে, মন্দির যেমন। ছাদ থেকে ঘণ্টার মতো ঝুলছে অসংখ্য রাবারের তৈরি পুরুষাঙ্গ। দুলছে। কখনো, কোনো কোনো সময় এসবকে আসল বলে মনে হয়। গা বেয়ে রক্তও ঝরতে দেখা যায়। মেঝের মাঝখানে শুকনো রক্তের আলপনা। তাতে বসে আছে রানী মাসি পদ্মাসনে। নগ্ন, টান টান। চোখ আধবোজা। পুরো ঘরটার একটা উলটো ছবি মেঝের মধ্যে বিম্ব। সদানন্দ ঘুম ভেঙে তড়াক করে উঠে বসে।

ভয়ে ভয়ে নিজেকে একবার আঁতিপাঁতি খুঁজে দেখে স্বপ্নটাকে ভুলে যায়।
এসব আবার আরেকজন জানে কীভাবে? জানি, কারণ, সদা এমন একজন যে, অনেক সময় সে শুধু ঠোঁট নাড়ে, কথাগুলো বলে দিই আমি। সিনেমায় যেমন গান হয়।

সকাল হল। সবকিছু ওপাশে রেখে বেজে ওঠে নটার সাইরেন। ওয়াটার সাপ্লাইয়ের কল তিনবার হেঁচকি তুলে জল দেয়া বন্ধ করল প্রায়। খড়ধোয়া। অফিস টান দিল হ্যাঁচকা টানে পায়খানার লাইন। কোথাও জাগল হরতাল। কাশ্মীর জাগল। পাঞ্জাব জাগল। খবরের কাগজ জেগে ওঠে আর সদানন্দ বিড়ির কৌটোকে ডাকে। দেশলাই ডাকে। কাঁথায় পিঁচুটি মোছে, বিড়িজল খেয়ে বাইরে যায়। প্রথমে বাতকর্ম। পরে ইত্যাদি। সঙ্গে সঙ্গে চায়ের দোকান নাম ধরে ডাকবে ওকে।

সদানন্দ ভাড়া থাকে। অর্থাৎ বাপের সঙ্গে শেষব্দিও মেলানো গেল না। মনে হয় জন্ম থেকেই এরা খিঁচড়ে ছিল। সদানন্দের সুখের নাম কী? কী কৌতুক আর কী যে কান্না!

আমার গত এক হপ্তা ধরে নখ দাড়ি বাড়ছে না

হাঃ বলে কী, ডাক্তার দেখা

এটা রোগ নয়, স্থায়ী মানবজন্ম

গাছ নড়চড়ে উঠলো বাতাসের খেয়ালে। কখনো ইংরেজি, হিন্দি কিংবা কখনো বাংলায় সদানন্দ কথা বলে। এইখানে মাঠ। তাতে ঝাঁকড়া এই এক বটগাছ। তাঁর নীচে সদানন্দের বিকেল হয়।

আজকাল আর তেমন ডিম দেখা যায় না, যার কুসুম এই অস্তের সূর্য। বটগাছের কোনো ভাষা নেই। সদার সান্ধ্য ঠিকানা। তারপর ছেলে পড়াতে যাবে। পথে কোনো এক ফকিরের দরগা আছে। সদানন্দ মোম চুরি করে এবং ঘরে এসে বাল্ব নিভিয়ে মোম জ্বালে।

দৈনিক কাগজ, কম্পিটেটিভ পরীক্ষা দেবার বই। একটা টেবিল লাইট হাত দিলে শক্‌ করে, এই হল টেবিল। কিছুদিন পরেই চাকরির পরীক্ষায় বসা যাবে না। বয়স সীমা ছাড়িয়ে যাবে। তবু দিন হয় দিন আর রাত হয় রাত।

এক পেট জল স্বাভাবিক। কখনো ভাত লঙ্কা আলুসেদ্ধ হলে হলে ঢেঁকুর ওঠে। সদা হাঁটতে থাকে। দরোজায় লাগানোর তালা ছিল। তার চাবি নিরুদ্দেশ।
রাস্তার সব ইট উড়তে থাকে, সব সুরকি, জোনাকি।
সদানন্দ রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব কোন দেশের লোক?

 ইজিপ্ট, না... না... হ্যাঁ ইজিপ্ট।
Mr. Sadananda, do you know the story of genesis in the Bible? How man came on earth as per the Bible? Do you agree that man was created by God?

কী জানি! পা কাঁপে আমার। পেটের ভেতর কোঁৎ করে শব্দ হয়। খাইনি কিছু।

বরং একটি জন্মের কথা ধরা যাক। সদা একদা সমুদ্র দেখেছিল। তার বাঁ পাশে মা আর ডান দিকে বাবা। সামনে যতদূর চোখ যায় এ কী! কিসের সামনে দাঁড়ালাম! মা তারপর কী? সন্ধ্যা হচ্ছে, মা আর বাবাকে অনেক দূর হেঁটে যেতে দ্যাখে সদানন্দ।

সদা ঘরে ফিরে আসে। ঘড়ি বারো পেরিয়ে গিয়েছে। এই রাতে যাবার জায়গা বলে এক পায়খানা। বিড়ি দেশলাইও যায়। অযথা বিড়ি টানে। গর্তের মুখে সিমেন্টের স্ল্যাব। এই হল পায়খানা। নীচে জলের মধ্যে শব্দ হয়। কাতারে কাতারে মশা আর আরশোলা বেরিয়ে স্ল্যাবের মুখ দিয়ে। আজগের খবরের কাগজ মনে করে সদানন্দ। আজ একটি কিশোরকে পাওয়া গেছে একটি ডোবার জলে। তার নাকে রক্তের দাগ। পচে গন্ধ।
Q.11. Polyandry means
সদা পায়খানা থেকে বেরিয়ে আসে।

দুই.


ঘরের কোনে ফিতে ছিঁড়ে যাওয়া হাওয়াই, এক পাটি আরেক পাটির সঙ্গে হাসছে। আজও সকাল হয়েছিল। সন্ধ্যা হয়েছিল। আর রাস্তা থেকে চটি হাতে ফিরে আসে সদানন্দ। ছেলে পড়ানো হয় না। ঘরে এসে গভীর রাতের জন্য অপেক্ষা করা হল। বাইরে থেকে বেড়ার একটু তার ছিঁড়ে এনেছে সদা। কিছু কিছু মানুষ সব কাজ গভীর রাতের জন্য রেখে দেয়। তার দিয়ে ছেঁড়া ফিতে জোড়া লাগালে চটির হাসি বন্ধ হল। পা গলিয়ে ঘরেই একটু হেঁটে নেয়, তারপর বিছানায় যায় সে। বিছানা হল তার টাইম মেশিন। ওটাতে করে অতীতে যাওয়াটাই সদানন্দের পছন্দ।

সদানন্দ ভেবে দেখেছে যৌবন আসার আগে সকলে মৃতই থাকে। কারণ, একজন যুবকই ভাবতে পারে, বড়লোকের ডোবারম্যান যেমন, আমাদের ঘরের ছেলেরাও তা। ঘেউ। কাকে ঘেউ? কেন? তবু ঘেউ।

তথাপি একটি নদীর কাছে যাতায়াত। গোপনে আমি আছি তোমার হয়ে। তোমার জাতের নই, তাতে কী? ওই চোখের কী জাত? প্রতিদিন একটি করে চিঠি লেখা। স্বপ্নের রং কখনো নীল কখনো ঘোর স্কারলেট। বাড়িটার নাম হবে বৃষ্টি। সামনের দেয়ালে আমিই এঁকে দোব ছবি। সদর দরোজা থেকে দুধারের সার বাঁধানো দেবদারু। হাওয়ায় এরা দুলবে আরামে। ঘরের রং হবে  চাপা সবুজ। আমাদের শোবার ঘর হাল্কা নীল। আমাদের মনে থাকবে আমাদের বাস। মায়ের ঘরের সঙ্গে ঠাকুর বাবার ঘরে আস্ত লাইব্রেরি। তোমাকে নিয়ে যাব প্রতিদিন এক নদীর কাছে।

কিন্তু সব চুল ছেড়ে দিলে নারীকে কেমন মনে হয়? প্রশ্নের সাথে সাথেই সদানন্দের মনে হয় সমস্ত ঘরটা ঝুপ করে শব্দ করল। সদা টাইম মেশিনে উবু হয়ে শোয়।

টাইম মেশিন। অতীতকাল। সব চুল ছেড়ে দিলে নারীকে কেমন দেখায়? তার চুলে লাগানোর গার্ডার কোথায়? রানিমাসি দাঁড়িয়ে আছে সোজা। তার শাড়ি হল হাওয়ার প্রতীক। সদানন্দ দূর মাঠ ধরে ছুটে আসছে। তার কানে কোনও ডাক এসে পৌঁছায় না

তোর নাম টা বিচ্ছিরি। এ নামে আমি ডাকব না।

সদানন্দ নিজের নাম পাল্টে ফেলে মনে মনে। প্রকাশ্যে পারে না। সকলের তো সব হয় না। নিঝুম হয়ে সদা রানিমাসির পায়ের কাছে বসে। তার নখ থেকে খুটে খুটে রং তুলে নেয়।

ঘরের মেঝেতে খপ করে একটা টিকটিকি পড়ল। সদা পাশ ফিরে তাকে দেখে। সঙ্গে সঙ্গে পাশের বাড়িতে ক্যাবল টিভির শীৎকার কানে আসে। আবার টাইম মেশিন।

রানিমাসি সদাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসে। ঘর মানে সুযোগ। সন্ধ্যা মানে রানিমাসি পেছন ফিরে কাপড় তোলে। টেবিলে কনুই রেখে দাঁড়ায়। সদানন্দকে পেছন থেকে টেনে নেয় অদ্ভুত কায়দায়। এবার একটা ডোবারম্যান ঘোঁত ঘোঁত করে। সব শিথিল করে তারপর বাতাস আসে। অ্যাতোক্ষণ এইসব কোথায় ছিল? এই ঘর, এই হাওয়া? আলো জ্বলে। ঘেউ ঘেউ। পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে সদানন্দ দেয়, মাসি,

আমাকে বৌদি ডাকলি না কেন, প্রথম থেকে? কী রে?

প্রতি সন্ধ্যায়, নিয়মিত যে, প্রতিটি সন্ধ্যায় এইভাবে সদানন্দ একটি ডোবারম্যানকে ভালো করে বুঝে উঠতে পারে না। কার চিঠি কাকে দিয়ে ফেলে! অথচ সদার কাছে একটি নদীও ছিল।

সদা আপনমনে চলে আসে এক শহরে। একপ্রান্তে তার ঘর অন্যদিকে দুনিয়া। কাঁহাসে কাঁহা পহুঁচ গয়া! বাইরে এক জ্যোৎস্না। সদা আকাশের দিকে মুখ তুললে সারারাত ঊর্ধ্বদৃষ্টি কাটিয়ে দেবে। গাছের আনাচে কানাচে তাই জ্যোৎস্না দেখে, আকাশে তাকায় না। কে কাক, ডাকছ? কাকে? রাতকে তোমার দিন মনে হয়?

শহরের বড় বড় বাড়িতে এখন কিছু লোক জাগছে। সদানন্দ আদের চেনে। খবরের কাগজ চেনে। এ সপ্তাহে সদা মোট ১০ জন মানুষের মৃত্যু জেনেছে। এখন রাস্তায় বলে বলে বিক্রি করে কিছু ছেলে। গৃহবধূ ধর্ষিতা, শ্বশুর গ্রেপ্তার। তছলামারায় সাত ব্যক্তি খুন। ওই লোকগুলোর কাছে রাত্রি এক রকম। কাউয়া কা। আমার কাছে এক। কাউয়া কা। সদা এদিক ওদিক হাঁটে। এদিকে ঘাস আছে ওদিকে উঠোন। সদানন্দের পায়ে হাওয়াই চটি। সদ্য লাগানো লোহার সরু তার ব্যথা দিচ্ছে খুব। ঘরে চলে এসো। আসার আগে সদা আকাশে তাকায়। চাঁদ, তুমি নীল আর্মস্ট্রংকে চেন?

বিছানা।

   মাসি, স্কুলে তুমি কী পড়াও?
মাসি স্নানঘর থেকে এসেছে। একটু গায়ে থাক তুই, মাসি অমন করে

   ভালোওওবাসা

   চুল খুলে দাও। আমি গন্ধ নেব। দেবও। আসলে সদা জমিয়ে রাখা থুতু মাখায় চুলে।

বিড়ি দেশলাই। সদা রাত কাটাতে যায়। পায়খানার দরোজায় একটা ব্যাঙ। ওকে দেখে লাফাতে লাফাতে নিরাপদ অন্ধকারে চলে যায়। আজকের কাগজে যে বউটির কথা, তার শ্বশুরের সাথে স্বামীও জড়িত ছিল।

তিন.

Q.5. where are days and nights equal throughout the year and why?

জানি না তো, আহা, সমান?

এই তার শেষ বছর। আর কোনও পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। চাকরির আশা হত হল। সদা চারদিকে তাকায়। মেয়েটির চশমাটা টেবিলে উলটো হয়ে মেয়েটিকে দেখছে। তার কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। ওই ছেলেটি বাচ্চা। জানালাগুলো এদিকেরটা ওদিকেরটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাতাস খাচ্ছে। ওই মেয়েটির চুল ছেলেদের মত ছাঁটা। একটি ছেলে রোগা, আর এটি হয় ধামসা। ধুর।সদা বেরিয়ে যায়। দরোজা কানে কানে বলে, এসো এসো, দুগগা দুগগা। মহিলাদের কলেজে ছিল পরীক্ষা। সদা সেটি ছেড়ে এসে এখন রাস্তায়।

বাহ, আহা, আর সংবাদপত্র দরকার নেই। কম্পিটিশন সাকসেস পড়ার প্রয়োজন নেই। পরীক্ষা নেই। এখন আমি যেমন খুশি। রাস্তায় এখানে ওখানে গর্তে জল জমে আছে। সদা পেরিয়ে পেরিয়ে হাঁটছে সেদিক দিয়ে। এমন একটা সময় ছিল আমরা ওকে ছবি আঁকতে দেখেছি। এমনও দিন গেছে সে ম্যান্ডোলিন বাজাত। সদা এমন ভাবে দাঁড়াতে জানত, দেখলে মনে হত দেবে যাচ্ছে মাটি। এখন, এখন হাঁটতে হাঁটতে শিস বাজাচ্ছে, সুর নেই তাতে।

শহরে এক যে ছিল রাজা। তার প্রাসাদ এখনও আছে। পতাকা পাল্টে গেছে। প্রাসাদের সামনে রাজপুকুর। মাঝে রাস্তা দুপাশে দুটি।  এক পাশে টুপ করে বসে পড়ে সদা। পকেটে কটি টাকা আছে। সেগুলোকে  ঘাসের ওপর কলমচাপা দিয়ে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে নিল। পাড়ে উঠে পোক্ত করে বসেছে, যতক্ষণ না জামা কাপড় শুকিয়ে যায়।

কোথাও কিছুক্ষণ বসে থাকার যো নেই। ভিজে কাপড়ে খুব জোর সি পেয়েছে। পেছনে রাস্তা, সামনে পুকুর। কোথায় যাব, আড়াল নেই। খুব জোর। সদা দাঁড়াতে দেরী কর্মটি হয়ে যেতে দেরী হয় না। আমাদের স্থায়ী মানবজন্ম নিজগাত্রে প্রস্রাব করে এবার নাইতে নেমেছে। একবার সাঁতার শিখলে কেউ তা আর ভোলে না।

আমাদের বাড়ির সামনে একটি পুকুর ছিল। সদানন্দ ডুব দিয়ে পুকুরকে একটা গল্প বলে। আমাদের বাড়ির সামনে একটি পুকুর ছিল। তোমার মতন বড় কিন্তু নয়। তবে অনেকে সাঁতার কাটতে আসত। যেমন ধরো, বিনু, রাধে, বিলাস। আমারও কপাল থেকে চাঁদের টিপ মুছে গিয়েছিল। তারপর একদিন পুকুরে চাঁদের বিম্ব হল। আমি দেখলাম। আমার শরীরে বিদ্যুৎ এসে খেলা করে যায়। কেমন মায়া লাগে। রানিমাসি যে, মাসি এ কথা বুঝতে পেরেছিল। আমাকে ডাকত। কেমন মন্ত্রের মতন কাজ। আমি যাই। মাসি তার দুধ খুলে খেতে দেয়। অনেক চুষতাম । দুধ নেই। অন্য বুকে মাসির ছোট ছেলেটা দুধ খেত। কী জানি দুধ আসত কি না। রানিমাসির বাড়িতে একটা রাক্ষসও ছিল। সেলফিশ জায়েন্ট। তার হয়ে মাসি রক্ত শুকিয়ে তারপর গুঁড়ো করে কপালে লাগিয়ে রাখত। নইলে রাক্ষস রাতেরবেলা তাকে পিষে ফেলতে চায়। মাসির অনেক কষ্ট। তাই রাক্ষসকে দেখিয়ে দেখিয়ে সে আমাকে আহ্লাদ করত। সন্ধ্যায় নিজে পুকুর হয়ে আমাকে বলত, সাঁতার কাট। এত কথা একসাথে বলে সদানন্দের জলের নীচে শ্বাস আটকে আসে। ওপরে উঠে এলে ভেসে ওঠে রাস্তা, মানুষ, রাজপ্রাসাদ। হিহি, ধ্যুত, আমি না খুব মিথ্যে বলি। রাজপুকুরকে বলে। আমি একটা ল্যাজকাটা ডোবারম্যান। হি। ঘেউ ঘেউ। পুকুরের খুব মায়া হয়। বলে, সন্ধ্যা হল, বাড়ি যাও।

শহরের সব রাস্তাকে ঘুরেফিরে সদানন্দের বাড়ির পথের কাছে আসতে হয়। ওদিকে হাসপাতাল আছে। হাসপাতালে রাত হয় অন্ধকার। ওই হাসপাতাল ছাড়া এ শহরে আর কোনও গণিকাপল্লী নেই। সদানন্দ যেকোনও একটি পথে হাঁটে। একটি চকচকে ভ্যানিটি ব্যাগ হঠাৎ পথের কোন্‌ থেকে ডাক দেয়। ও কাছে যায়, কলম আর টাকা রয়ে গেছে পুকুরের পাড়ে। পেছন ফেরে না, বরং আরও কাছে যায়। যেতেই মুচকি মুচকি হাসে ব্যাগটি। সদাও হাসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে নজর করে দেখে ব্যাগটিকে। দেখে কী, ও এখন মুখ কালো করে তাকিয়ে আছে। পড়ে থাকা ব্যাগ দেখলে পুলিশে খবর দিন। ওই, ওই। মাথায় আতস। পালা, পালা। দৌড়। শ্বাস। আহা আহা। হা হা। কানে কোনও শব্দ বেজে ওঠে না। তবু সে ছুটছে। তার ঘরটিও ছুটছিল তার দিকে। নাহয়, এ পথ সদা এল কী করে ইশারায়?

আজ রোববার। বাড়িঅলা অন্য জায়গা থেকে ফিরে আসে। এই যা। আজ সদারও ছুটি। এই তো স্টোভের সামনে  ঘরের ভেতর। ইনিয়ে বিনিয়ে বলে, আজ জ্বল ভাই, কাল থেকে অত জ্বলতে হবে না। স্টোভও না পারতে জ্বলছে। তার কী দোষ। সদা ভাবে, এসবের মানে কী? আমি কেমন করে হাঁটতে পারি। ঠান্ডা ঘরে ঢুকে অবলীলায় বলতে পারি, গুড মর্নিং স্যার। ফিরে আসার সময়, এনি মোর কোশ্চেন,প্লিজ? না, কোনও প্রশ্ন তো থাকে না। হিহি করে হেসে ওঠে একটা বাটি। সদা সেটাকে তুলে নিয়ে তাল বাজায়। দূরে টেবিলে সকল কাগজপত্র নাচতে থাকে। সংবাদপত্র, খুন, ধর্ষণ নাচে, নাচে উগ্রপন্থী নাচে। সম্পাদক নাচে। নাচে প্রতিদিন নাচে, নাচে কারেন্ট অ্যাফেয়ারস নাচে। সদার পায়ের ঠিক নেই। চুপ। চিড়চিড় স্টোভ জ্বলছে। একটা অদ্ভুত আলো ঘরের ভেতর। বিদ্যুতের আলো কখন চলে গেছে। একটি একটি করে সব কাগজ সদা স্টোভের ওপর ছুঁড়ে মারে। সব, খবরের কাগজ, লেখার কাগজ, কম্পিটিশন সাকসেস। সারটিফিকেটস। অনেক কাগজের নীচে পড়ে বোধহয় সদার স্টোভ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল। নাহলে দাউ দাউ আগুন জ্বলল না কেন?

চার.

হাসপাতালের কিছু গন্ধ পোষ্টবক্সটির ভেতরেও ঢুকে আছে। তবু এ নিয়েও লাল ডাকবাক্স ঠায় সেঁটে থাকে দেয়ালে। যে লোকটি এগিয়ে আসে, তাকে দেখলেই বোঝা যায় তার একটি বাড়ি আছে, ভাড়া খাটে। চিঠিখানি বাক্সে পড়ে শব্দ করল। লোকটা খানিক তাকাল বাক্সের দিকে। তারপর চলে যায়।

সদার দিনের বেলা পিঁপড়ে আর রাতের বেলা আরশোলা। সারা দিনরাত ঘরে থাকে সে। টিকটিকিদের তার বিশ্বাস নেই। শহরের টিকটিকি মিছেকথায় তিন ডাক ডাকে।

মাঝে মাঝে কাঁদে সদানন্দ। মাঝে মাঝে চেয়ে থাকে। হাসি পেলে থামে না। প্রথমে চেয়ে থাকে, যেমন এখন,  স্থির, যেন সত্যিই দেখতে পাচ্ছে উড়ে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে কাক, চড়ুই, শালিক। ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে কান।

আবার নীরবতায় হাহা করে চারদিক। বনপায়রা এসেছে মরতে। মাথা গুঁজে মরে আছে অনেক পাখি। গম খেতে এসেছিল তারা। সিরাজ মিয়াঁ  ক্ষেতে ওষুধ দিয়েছিল। সদানন্দ এর পেছনে ছুটে যায়, ওর পেছনে যায়। সন্ধ্যা হল এভাবে। সদা অনেক পাখির শব কুড়িয়ে এনেছে। গর্ত খুঁড়েছে। অনেক বড়। সবাইকে সেটাতে মাটি দিল। রাত হয়ে গেছে। গম ক্ষেত অন্ধকার। একটা কড়া গন্ধ হচ্ছে বাতাসে। সদার মাথায় রক্ত উঠে যায়। বাড়ি হতে নিয়ে আসে একটা দেশলাই, কেরোসিন। গম ক্ষেত জ্বলে ওঠে দাউদাউ।

ধরতে পারে ওরা, ধরতে পারে। বাবা গো মেরো না। সদা যেন স্পষ্ট ব্যথা পায় এখনও। অশরীরী হয়ে বাবা তাকে এখনো মারছেন। এইসব দেখে কেঁদে ওঠে সদানন্দ। সে জানে না একটা ডাকবাক্সও আজ তার জন্য কেঁদেছে। নীল একটা ইনল্যান্ড লেটার পড়ে নিয়েছিল সেই ডাকবাক্স।

আপনাদের পুত্র শ্রীমান্‌ সদানন্দের আচরণে একপ্রকার সন্দেহ হইতেছে ।তাহার চুলে জটা ধরিয়াছে এবং চোখেও অদ্ভুত দৃষ্টি আসিয়াছে ।কাহারো সহিত কথা বলে না।নিজে নিজেই হাসিয়া এবং কাঁদিয়া উঠে ।মাসখানেক ধরিয়া স্নান খাওয়া প্রায় বন্ধ করিয়া দিয়াছে ।আপনারা আসিয়া একবার দেখিয়া যাইবেন ।অন্যথায় আপনাদের পুত্রের এই দায়িত্ব গ্রহণ করিতে পারিবনা ক্ষমা করিবেন ।

ডাকবাক্সের কষ্ট হয়েছিলো ।সদারও কত খাম সে দেখেছিলো ।বায়োডাটা, ব্যাঙ্কড্রাফট,বয়েসের মানপত্র, সার্টিফিকেটসের জেরক্স, কয়েকখানা সদ্য তোলা ছবি।সদা তো আর অপরিচিত কেউ নয় ।

 

পাঁচ

মার সঙ্গে বাবাও এসেছিল ।মাথায় হাত রাখে বাবা, মনে হয় মাথা ফুঁড়ে সমস্ত অভিমান আজ বেরিয়ে যাবে ।এমন হয়না ।শুধু কৌতুক, না-কি সদা এমন হাসা হাসলো, এত লজ্জা এ্যাতো কাঁদলো ।

এদিকে আমাদের শহরে মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে একদিন ।অনেকের বিয়ে হয়ে গেলো।রাতের বেলা আকাশ দিয়ে এরোপ্লেন যায় ।শীত পড়লো খুব ।আমরা তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসতাম ।

অনেকদিন সদাকে আমরা মনে রাখলাম না ।আমাদের অনেক বাইরে যে সদা অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিয়ে আসে, তারও কেবল তিনজনকে মনে আছে ।আজ ফিরে আসার পর তাদেরকে মনে করে না সে। তবু তার মনে আছে ।সদা এখন ভাবে তিনজন বলতে একজন মহিলা, জান্‌লায় দাঁড়িয়ে থাকে সারাদিন ।বিকেল হলে কাঁদে আর কাকে যেন টাটা দ্যায় ।তার বয়েসী একটি ছেলে সারাদিন ধ্যানে বসে থাকে ।ধ্যানেই তাকে জোড় করে খাওয়াতে হয় ।ধ্যানেই তার সবকিছু ।আর ওই ডাক্তার ।টাক হলে মানুষের চেহারা যেমন গম্ভীর হ্য়, তারও তেমন ।এমন একটি লোকই সদাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো,

Do you know who Jocasta was?

   রানি মাসি ।

এ প্রথম ফিরে আসার পর সদা বেশি করে হেসে ওঠে ।

 

তার ঘর ।সব ঠিকই পায় সে ।সারাদিন আড্ডা মারতে ইচ্ছে করে এত ঝরঝরে হয়েছে সদা ।তবে কারো কথা জিজ্ঞেস করলোনা ।সন্ধ্যায় আমরা দুজন নদীর পাড়ে অনেক পাখির ডাক শুনলাম ।ওর প্রিয় ব্র্যাণ্ডের সিগারেট খেলাম ।আরো ধীরে সন্ধ্যা কালো হয় ।সদাকে বাড়ি দিয়ে আসা ঠিক হবে ।

 

আজও ও আলো নিভিয়ে দ্যায় ।মোম নিয়ে পুরোনো ছবিগুলিকে দেখলো ।একটু একটু হাসলো ।ড্রয়ার থেকে অনেকগুলি পুরোনো চিঠি বের করে আনে ।টেবিলের সাম্নে বসে ।

 

চেয়ারটাকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে আগের আরাম পর্যন্ত যায় ।একটি বই নিয়ে শব্দ করে পড়েহুঁ হুঁ সমস্ত বেগই আপেক্ষিক বেগ ।কারণ পৃথিবীতে প্রকৃত স্থির বলিয়া কোন বস্তু

হেসে ওঠে ।পড়ার সুরটাও বেশ মনে আছে ।মোম জ্বেলে দেয়ার পরই ওকে ভালো করে চোখে পড়ে ।তবু এতক্ষণ না দেখার ভান করেছে ।এবার হাত দিলে তার শব্দও আগের মতো খসখসে ।আজকের কাগজ-ই তো ! সদা প্রথমে হেডলাইন দেখে ।দুলাইন সম্পাদকীয় পড়ে ।এ পাতা ও পাতা ।বিজ্ঞাপন ।রোববারের আলাদা পাতা ।না, নাই-তো ।আগের মতো নাই-তো ।ওসব এম্নিতেই চোখে পড়ে অত দেখতে হয়না ।তবু দেখে সদা ।বাইরে আকাশে আজও  জ্যোৎস্না ।ওঘরে একটু টিভি দেখে আসা হলো ।আবার, খস খস ।না-নাই ।ধর্ষণ, খুন, হত্যা ।নাই ।অন্য, অন্য রকম সবকিছু ।মোমের কাছে অনেক পোকা আসে ।সদা তাদেরকেও ভালো মতো দ্যাখে ।তাদের ডানার রঙ জলের মতো ।বারবার আগুনে লেগে যাচ্ছে কই পুড়ছে না তো ।এবার স্যুইচ টেপে সদা ।আঙুল দিয়ে কলামের ওপর থেকে নীচ অব্দি আসে।না।স্যুইচ অফ্।আবার মোম জ্বালে ।কাগজটি বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে ফিক্‌ ফিক্‌ হাসে ।

 

রাত্রি নীরব হয়ে ওঠে ।খেয়ে আসার পর ।বিছানার দিকে যেতে ভয় করে সদার।কাগজটা আছে। তবু হাতে নিয়ে চোখের সাম্নে ধরে রাখে ।দ্যাখে না ছাই-ও।

রানিমাসি এখানে নেই ।রক্তও না ।মাসিকে অপারেশন করে নারীর কম করা হয়েছিলো মনে আছে ।মাসিও মুটিয়ে গ্যাছিলো ।তার যেন যন্ত্রণাই কমে গ্যাছিলো অনেক ।সব যন্ত্রণা কি ঐ অপারেশনে কেটে গিয়েছে? কাগজটিকে ফেলে রাখে সদা।বাবাও এখন আর ততো রাগী নয় ।

 

মোম নিভে গেলে ঘরের মধ্যে সব অন্ধকার ।বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে ।

 

মা চা না দিলে সদা ঘুম থেকে ওঠেনা ।বাইরে থেকে ডাকলে উঠে গিয়ে চা নেয় ।কুঁজো থেকে জল নিয়ে মুখ ধোয় ।আজও কুঁজো ঘরের কোনে, মায়ের বাঁ পায়ের শব্দ ডান পায়ের চেয়ে বেশি হয় ।কুঁজো তা শোনে আর ভয় পায় ।আস্তে দু তিনবার মা ডাকে ।দরোজা খোলে না ।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঠেলা দ্যায় ।ভেজানোই ছিলো ।খুলে গেলে একরাশ আলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে মেঝের মাঝখানে উল্টে রাখা চেয়ারে ।হাত থেকে কাপ প্লেট প্রথম শব্দগুলি করে, তারপর মা ।দরোজার এক পাটে হেলান দিয়ে মা স্থির হয়ে যায় ।বুকের কাছে এসে যায় চিবুক ।চোখ বন্ধ ।নীরব ।ঘরের কোন্‌ থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে জলের কুঁজো ।মায়ের পায়ের কাছে এসে কাত হয়ে জল দিতে থাকে ।তার ভেতর সমুদ্র ছিলো, ভেসে যাচ্ছে গতকালের কাগজ ।The king is dead, long live the king. সমুদ্রের সকল ঢেউ মেঝের সামান্য ওপরে সদানন্দের পা-ও স্পর্শ করে ।   

[প্রকাশিত : পদক্ষেপ, ১৪০১]


পাঠের জন্য ধন্যবাদ। এই অতিমারির কালে গাছের সঙ্গে সময় দারুণ কাটে 

               

 


সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

একাকিত্ব — আত্মবিচ্যুত মানুষের রক্তগীতিকা






সেই বৃক্ষের কথা ভাবি। সুখসাগর জলার মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে থাকত। ছোটো একটা ডাঙা, সে ছাড়া আর কেউ নেই। বর্ষায় নাচন-নাচন জল তার পদতলে ঢেউ সমর্পণ করে।হেমন্তে কেটে নেওয়া ধানের মস্ত একাকিত্বের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে থাকত। দূর হতে দেখতাম। হয়তো পিতার সঙ্গে অভিমান করে অস্থায়ী গৃহত্যাগ করেছি। তখন জাতীয় সড়কের ওপর দিয়ে কেবল নীরবতা যাতায়াত করত। অতসব গাড়িঘোড়া ছিল না। ঘামের গন্ধ ফেলতে ফেলতে চলে যেত সাইকেল চালক কিংবা রিকশাওয়ালা। টুংটাং বেজে চলত ঘণ্টি। ঘণ্টি মাত্রই নিজে বাজে। রিকশায় লাগানো কেরোসিনের বাতিটি আলো কম বিষাদ ছড়াত বেশি। আমি ওই দূরের বটবৃক্ষের কাছে কত কী নালিশ করতাম। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার কারণে সে নিকট হয়ে উঠত। যেন তার পাতার নাচন দেখতে পেতাম। অনেকক্ষণ বসে থাকতাম। অনেকক্ষণ। ধীরে মন শান্ত হয়ে যেত। আকাশের অস্তানুষ্ঠান শুরু হলে দেখতাম রঙের চড়কমেলা। এক রং অন্যকে অভিবাদন করে, আলিঙ্গন করে। নিজেদের একেবারে মিশিয়ে ফেলে অন্ধকার হিসেবে পুনর্জন্ম নেয়। তখন ফিরে আসি। মনের মধ্যে কে যেন গান করে। অপূর্বরচিত, অপূর্বগীত সেই গান আমি নিজেকে শোনাই। অভিমান উবে যায়, আমি আর গান মিলে দুইজন হই, আমি আর একাকী থাকি না।
এই যে প্রাচীন বৃক্ষটি। এই যে আলোকযজ্ঞের আকাশ। এই যে পথিকবিরল পথ। এরা একা? তাহলে আমি কেন এমন একাকী? তবু আমি এমন একাকী। এ দুটি পঙ্‌ক্তি সেই কবির নির্জনতার কবি বলে যার অভিধা জুটেছিল। বাংলা কবিতায় একাকিত্বকে অত করুণ সুরে আর কেউ বাজাননি।
কিন্তু কী এই একাকিত্ব? কী তার পরিচয়? এই একাকিত্ব শব্দটির জন্মই-বা কবে। ইংরেজিতে দেখলাম, loneliness শব্দটির ব্যবহার ১৮০০ সালের আগে বিরল। প্রায় নেই। ১৬০০ সালের আশেপাশে lonely শব্দটিকে দেখা যায়। কিন্তু সেটা আজকের একাকিত্ব নয়। আজকের একাকিত্বকে বলা হচ্ছে একুশ শতকের কুষ্ঠ। অর্থাৎ একটা কঠিন ছোঁয়াচে রোগ। একটা মহামারি, নিজেই। এই করোনাকালে যে একাকিত্বে আমরা বাস করছি, সেই করোনার থেকে বয়সে প্রাচীন এক মহামারি নিয়ে কথা বলতে বসেছি একাকিত্ব। আবার যদি সেই নির্জনতার কবির কাছে যাই? মাথার ভেতরে এক বোধ জন্ম লয়মড়ার খুলির মতন আছাড় মারিতে চাইআমি তারে পারি না এড়াতে। কী সে? এর জবাব কি অনেক পরে আমেরিকা থেকে পাব আমরা? সে আরেক একাকীর কাছ থেকে? সিলভিয়া প্লাথ। করুণ এক কবি। একাকিত্বের মার জীবনভর সইতে সইতে শেষে আত্মহত্যা করলেন। ২০১৭ আর ২০১৮ সালে দুই খণ্ডে তাঁর চিঠিগুলো প্রকাশিত হয়। মায়ের কাছে লেখা, পত্রমিত্রের কাছে লেখা, ধাত্রীর কাছে লেখা এবং মনোচিকিৎসকের কাছে লেখা। সেইসব চিঠির একটিতে বলছেন ‘I am so lonely, this single room is so lonely’. একাকিত্বের বোধ সিলভিয়ার ভাষায়, উঠে আসে ‘from the vague core of the self – like a disease of the blood’. তাহলে এ এক অজানা রোগ? দুজন একাকী মানুষ, একজন ১৯২৯ সালের আশেপাশে যাকে বোধ বলতে চাইছেন, তাঁর থেকে বহু পরে এসে এক আমেরিকান কবি তাকে রোগ বলছেন? তাহলে একাকিত্ব আসলে কী?
১৬০০ সালে রচিত একটি অভিধানে lone শব্দটি আমরা পাই। কিন্তু বাংলা একাকিত্ব শব্দটি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত বঙ্গীয় শব্দকোষে এখনও নেই। নেই। নেই জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধানেও। কারণ সে ছিল না। যে গাছ দেশে জন্মায় না, তার নাম কী করে রাখবে মানুষ? সংস্কৃতে কৈবল্য আছে কিন্তু সেই শব্দের কেন্দ্র ও পরিধি ভিন্ন। নিঃসঙ্গ শব্দটি কি ছিল না? ছিল না নির্জন? ইংরেজিতেও অনুরূপ অর্থবাহী শব্দ ছিল, বাংলাতেও আছে। সেসবের অর্থ ঠিক একাকিত্ব নয়। নিঃসঙ্গ, নির্জন প্রধানত শারীরিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক। কিন্তু একাকিত্ব মনোশারীরিক, তারপর বাকি সব।
এখন রাত্রিকাল। একটা সবুজ রঙের আলো আছে বাইরে। আগামীকাল পূর্ণিমা। মেঘের রঙের সঙ্গে চাঁদের জোছনা মিশে শ্যামল হয়েছে। বারান্দায় বসে বাইরে তাকিয়ে আছি। আমাদের বাগান নেই। যে যেমন জন্ম নিয়েছে তেমনি কিছু গাছ আছে।বেশ অনেক। তারাও আলোকের মধ্যে নিজেদের সবুজ মেশাচ্ছে।আমি নিঃসঙ্গ, নির্জন। যার যার ঘরে শুয়ে আছেন মা, পুত্র, স্ত্রী, বাকি পরিজন। একটু আগে কথা হল তমাল ও মেঘ অদিতির সঙ্গে। আরো কিছু ফোন এসেছিল, ধরিনি। এখন কি গান শুনব? কিন্তু এই লেখাটা তো লিখে শেষ করতে হবে।
গানের কথা ভাবতেই মনে এল এলানর রিগবিকে। সেই বিখ্যাত গান, বিটলস। সেখানেই হয়তো প্রথম জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল,
All the lonely people
Where do they all come from?
All the lonely people
Where do they all belong?’
এই গানটা কবে লেখা হয়েছিল। একটু ঘাঁটতেই দেখলাম, ঠিক ১৯৬৬ সালে লেখা হয়েছিল এ গান। আমার জন্মের তিন বছর আগে। এর আগে এই জিজ্ঞাসা জাগেনি কোনও শিল্পীর? কোথা হতে আসে এইসব একাকী মানুষ? তারা কাদের? বাংলা কোনও গান আছে এমন? ঠিক, মান্না দে। আমি আজ আকাশের মত একেলা। কত সাল? জানি না, অনুমান সে-ও গত শতকের ছয়ের বা সাত দশকের কোনো সময়ে হবে। এই সময়টা থেকেই একাকিত্ব মহামারির রূপ নিতে শুরু করে সমাজে।
একেলা, বললেই মনে আসে তিনজন মানুষকে। জীবনানন্দ, সিলভিয়া প্লাথ আরও দূর ভিনসেন্ট ভ্যান ঘঘ। এঁদের জীবনে কী মিল! নিদারুণ একাকিত্বের শিকার সকলে। সকলের সারাজীবনের কাজে অসাধারণ মৌলিকতা। সঙ্গলোভে চিঠি বা ডায়েরি লেখা আর শেষে অস্বাভাবিক মৃত্যু। তাঁরা কোথা হতে এলেন, কোথায় তাঁরা বিলং করেন?
ঘঘের জন্ম ১৮৫৩ মৃত্যু ১৮৯০। জীবনানন্দ ১৮৯৯ সালে জন্মান, মৃত্যু হয় ১৯৫৪ সালে। প্লাথের জন্ম ১৯৩২ সালে। মারা যান, ১৯৬৩ সালে। তাহলে এটা কি ঠিক অষ্টাদশ শতাব্দীতেই একাকিত্বের জন্ম, যা একুশ শতকে এসে মহামারির রূপ নিয়েছে আজ? ঠিক। সত্য। সমাজতাত্ত্বিক, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির ইতিহাসবিদ সকলে এই সময়টাকে একাকিত্বের জন্মকাল বলে চিহ্নিত করেছেন।
নিঃসীম একাকিত্বের কথা এর আগে সাহিত্যেও তেমন পাইনি আমরা। হ্যামলেটের দীর্ঘ সলিলকিতে বেদনার এমন ব্যক্তিগত রূপ আমরা পাই না। আত্মহত্যার কথা ভাবছে বটে সে, কিন্তু সেটা ঈশ্বরের দ্বারা অনুমোদিত নয় বলে বাদ দিচ্ছে সেই ভাবনা। আর যে একাকিত্বের, নিজের সঙ্গে নিরন্তর কথা বলার আধুনিক রূপ, সেটা হ্যামলেটের সলিলকিতে নেই। তাহলে? আচ্ছা যক্ষের একাকিত্ব তবে কী? বিরহকাতর যক্ষও তো একপ্রকার চিঠিই লিখছে। যেমন লিখেছেন ভ্যান ঘঘ, জীবনানন্দের ডায়েরি কিংবা সিলভিয়া লিখছেন মনোবিদের কাছে। কিন্তু মেঘদূতে যক্ষ একাকী হলেও একাকিত্ব তার সমস্যা নয়। রামগিরি পর্বতে একাকী যক্ষের অনেক পরে আমরা আরেকজন একাকী মানুষকে পাব। ইংরেজি সাহিত্যে। রবিনসন ক্রুশো। ফ্রাইডেকে পাবার আগে পর্যন্ত মানুষ হিসেবে ক্রুশো বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপে একেবারে একা। কিন্তু যে একাকিত্বের হাতে খুন হয়ে যান সিলভিয়া, তা তো ক্রুশোকে আক্রমণ করল না। অত ভিড়ে থেকেও সিলভিয়া একাকিত্বের শিকার আর সত্যকার একা থেকেও ক্রুশো তা নয়? সত্য যে, ক্রুশো ডিফোর কল্পনাপ্রসূত চরিত্র, প্লাথ বাস্তব। হলেও, ডিফোর মাথায় একাকিত্বের অপশনটি আরোপ করবার চিন্তা তো এল না।
মজার কথা হল, এই সেদিন সম্ভবত, ২০০০ সালে একটি ছবি হয় আমেরিকায়। ‘Castaway’। এর উৎস ডিফোর রবিনসন ক্রুশো। কিন্তু কাস্টএওয়ে তে দেখা গেল একাকী নায়ক একটা ভলিবলে  রক্তাক্ত একটি মুখচ্ছবি এঁকে তার নাম রাখল উইলসন। আর এই উইলসন আসলে একটা ক্রীড়াসামগ্রীপ্রস্তুতকারী কোম্পানি। ছবিটি জনপ্রিয় হলে তারা উইলসন নামে একটা বলও বিক্রি করতে শুরু করে। তাতে সেই মুখটা আঁকা। এইখান থেকে একাকিত্ব নিয়ে আমাদের আড্ডাটা পাল্টে যাবে।
যদিও এই কথাটি বলতে অতকিছু বলবার দরকার ছিল না একাকিত্ব নামক মহামারিটি আসলে আধুনিকতার পার্শ্বফল তবু বললাম কারণ, প্রতি তিনজন বন্ধুর মধ্যে দুজন এতে ভোগেন দেখতে পাই। আমি নিজে ভুগেছি। মনোবিদের কাছে গিয়েছি। এই আধুনিক সমাজ আমাদের কী দিয়েছে? যন্ত্র, শিল্পোদ্যোগ আর বাজার। আমাদের অসুখবিসুখও এই হাঁ-মুখ বাজারের কাছে পণ্য। এই সমাজ আসলে সিলভিয়ার বেলজারে ঢাকা পৃথিবী
তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী।
এই প্রশ্ন এবং স্বীকারোক্তিতে আসার আগে কবি কী বলছেন? বলছেন
সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর
পরে?
সহজ নেই আর মানুষ। এই যন্ত্রসভ্যতা আমাদের প্রথমেই জটিল করে দিয়েছে। শরীর থেকে মাটির গন্ধ কেড়ে নিয়েছে। যৌনতা, বিবাহ, প্রেম পরকীয়া সব জটিল হয়ে গিয়েছে।  আর ডিজিটাল বিপ্লব আমাদের একেবারেই ঘরে বন্দি করে দিয়েছে আজ। আমরা নিসর্গচ্যুত।
জীবনানন্দ তাঁর রূপসীবাংলা থেকে বিচ্যুত। প্লাথ তাঁর আধাশহর থেকে বিচ্যুত। ঘঘও বারবার বিচ্যুত। আজকের মানুষ জন্ম ও কৈশোরকালীন নিসর্গ থেকে বারবার বিচ্যুত হয়। কেবল নগরের দিকে ছোটে। কিংবা নগর ছুটে আসে তাদের কাছে। যে নৈসর্গিক সঙ্গ একাকিত্বকে আন্দময় করে তোলে, সে নেই আর।  তাই, যে আকাশকে আমার এই ২০২০ সালে একেলা মনে হয় না। আলো আর রঙের উৎসব বলে মনেহয়, তাকে আধুনিক গানের গীতিকার একেলার উপমা করে কেন বলেন, আমি আজ আকাশের মত একেলা? কারণ আমার আকাশ বিশাল, বিস্তৃত এখনও। এখনও আমার আকাশ বহুতলের ফাঁক দিয়ে আমার দিকে উঁকিঝুঁকি দেয় না।আমি নিসর্গচ্যুত নই। তবে যে আমিও মনোবিদের কাছে গেলাম? কারণ একাকিত্ব ছোঁয়াচে। এমন যে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে গ্রেট ব্রিটেন ‘Mninister of Loniless’ তৈরি করে। জো কক্স ছিলেন এই দফতরের  প্রথম মন্ত্রী। একাকিত্বকে মহামারির মতন করে বিচার করেছে তারা। তাই আধাশহরবাসী আমাকেও নাগরিক রোগে আক্রমণ করে কিংবা আমিও সংক্রমিত হই। কারণ,আমরা  আজকাল  সহজে আত্মবিচ্যুত হই। আশা করি। বিবাহের কাছে, সমাজের কাছে, বন্ধুর কাছে আমাদের আশার অন্ত নেই। আশাহত হই। পিতার কাছে আশাহত হয়ে গিয়ে সুখসাগর জলার কাছে বসি। কিংবা, আমরা অতীতচারী হয়ে পড়ি। আর নস্টালজিক হয়ে পড়াকে একাকিত্ব সংক্রমণের প্রথম উপসর্গ বলে চিহ্নিত করেন অনেক মনোবিদ। আত্মবিচ্যুত মানুষের অন্তর একেবারেই শুকিয়ে যেতে থাকে।ভারি হয়ে যায়। শেষে এই দেহ, যেটার ভেতরে শুকনো একটা অন্তর তাকে শেষ করে দিয়ে ভাবি, যাক বাঁচা গেল। কিন্তু মৃতেরা কি ভাবতে শিখেছে?
তাহলে? আরেকরকম একাকিত্ব আছে। ভাবনা করবার একাকিত্ব। Solitude. এই শব্দের সঠিক বাংলা আমি জানি না। একান্ত?  আমাতে শেষ। আমি একজনেই অন্ত। সেই একান্তে বসেই ভগবান বুদ্ধ আবিষ্কার করেন অন্তহীন জরার থেকে মুক্তির উপায়। তারও আগে উপনিষদ ভাবিত ও রচিত হয়। ভগবান মুহম্মদের কাছে আসেন ঐশী কোরআন। ভগবান যিশু পান প্রেমের বারতা। রবীন্দ্রনাথ পান মানসী লেখার ছন্দরূপ। তাঁরা আত্মসম্পৃক্ত হতে পেরেছিলেন। আধুনিকতা আমাদের দিয়েছে আত্মবিচ্যুতির নানাহ উপায়। আমরা তাদের দ্বারাই একাকিত্বে সংক্রমিত হই।

এই মহামারিকালে আমাদের জোর করে একাকী করা হয়েছে। এখন সুযোগ ছিল, আত্মস্মপৃক্ত হবার। আমরা কেন সেই সুযোগ না নিয়ে, ডিজিটাল সমাজ বানিয়ে সেই সশব্দ হাহাকার দিয়ে একাকিত্বকে প্রচার করছি? একান্তে বসে এই আমার জিজ্ঞাসা।

(যখন ভুগছিলাম, তখন একাকিত্ব নিয়ে খুব ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। পড়েছি। নিজেকে সামলেছি। সেইসব পাঠ এ লেখাটায় কাজে এসেছে) 

......................................................................................................................................................


কিছুদিন আগে এক বন্ধুর সূত্রে এই বইটির সন্ধান পাই। পড়ে মান্য করলে জীবন পাল্টে যাবে। (অ্যামাজন এফিলিয়েটেড)

রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৯

নয়নতারার ঘ্রাণ




নয়নতারার ঘ্রাণ

অশোক দেব 

অন্ধকার। কিন্তু ওই যে শোনা যাচ্ছে সে কি ধ্বনি নাকি আলোর ধ্বনিরূপ? রাইচাঁদ বাজাচ্ছে। অন্ধকারে দেখতে পান? আমি পাই। রাই যখন বাজায় তখন আলো বিচ্ছুরিত হয়। সেই অদ্ভুত আলোতে কী দেখা যায়? দেখা যায় আমাদের রাইচাঁদ কাঁদছে। অবিরল ধারায় ঝরছে অশ্রু। রাইয়ের বাদ্যের আলোকে স্পষ্ট হয় সামনের আসন। উদ্বাহু শ্রীচৈতন্য, নিতাইচাঁদ আর একটু ওপরে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি। এখন যে তাল বাজাচ্ছে রাই, তা আসলে কোনও তাল নয়। কথা বলছে সে। শ্রীখোলই বলে দেয় তার কথাগুলো। মাঝে মাঝে যখন অশ্রুর তোড় আসে, তখন বামের থেকে গুমগুম করে ওঠে। তারপর এই মাটির তৈরি বাদ্যযন্ত্র বিলাপ করতে শুরু করে। আনন্দময় শ্রীখোলের কান্না যে শোনেনি, সে কী শুনেছে?
একটা বটগাছ আছে। তার বয়স কত? তার নীচে একটা দালান আছে। চারদিক খোলা। আর আছে ঠাকুর। সেই শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগল। সন্ধ্যায় সেখানে লোকে কাঁদতে আসে। কারণ, কীর্তন হয়। সবার থেকে বেশি কাঁদে বাবুলের মা। বাবুলের মায়ের ষাট হবে বয়স। কিন্তু, বাবুলকে কে দেখেছে? কবে কোন অতীতে সে জলে ডুবে মরে যায়। বাবুলের বাবা সেই থেকে কথা বলে না। নিজের কাজটুকু করে যায়। কথা বলে না। কেউ তাকে কথা বলতে শোনেনি। কী এমন ছিল বাবুল যে, সে চলে গেলে একজন মানুষের কাছে পৃথিবীকে বলবার মত আর কিছু থাকে না? বাবুলের মায়ের কান্না কেমন? ওই রাইচাঁদ দাসের বাজনার মতন? না। তিনি তাকিয়ে থাকেন শ্রীবিগ্রহের দিকে। শ্রীরাধিকাকে একদৃষ্টে দেখেন। পায়ের দিকে নয়। মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন। আর তার অশ্রুর খনি খুলে যায়। অবিরল। এদিকে কীর্তন গেয়ে চলে যায় হারুর বাবা, নিতাই গোস্বামীর পাঠও শেষ হয়, শেষ হয় মালতির নৃত্য এবং প্রণাম। সবাই চলে গেলে আমাদের রাইচাঁদ বাবুলের মায়ের সামনে যায়। বসে।
      এত কিরে কান্দো?
      জানি না রে বাপ, আমার উথাপাথাল অয়
      বাবুলরে মনে পড়ে বুঝি?
      পোলাডারে দুধ খাওয়াইতে পারলাম না আমিমাত্র হামা দেওন শিখছিল। ক্যামনে যে গিয়া কুয়াত পইরা গেল...
      ইস
      তে যাওনের পরে কী যন্ত্রণা, কী টনটন, বুকে দুধের চাপ...
হাহাকার করে ওঠে বাবুলের মা। প্রায় চিৎকার করে জড়িয়ে ধরে রাইচাঁদকে। রাইও তখন কাঁদে। হা প্রভু, হা প্রভু। ঠিক কী রকম হতে পারে এই টনটন? স্তন্যপান কেমন? জন্মকালে মাতৃহারা রাই জানেও না স্তন্যপান ঠিক কী রকম হয়।
          দয়াল সংঘ। রাইচাঁদের দল। তারা ঘুরে ঘুরে নামকীর্তন করে। দূর দূর থেকে ডাক আসে। বছরে একদিনও বাদ পড়ে না প্রায়। শীতকালে তো একদমই না। তখন রাইচাঁদের শরীর লতানে হয়ে যায়। শ্রীখোলের তালে তালে সে তার নরম পা মাটিতে বোলায়। আর পৃথিবীকে তালবাদ্য শেখায়। যারা গায়েন, মাঝে মাঝে তারা রাইকে আসর ছেড়ে দেয়। ওপর থেকে ঝুলে থাকা মাইকের নীচে প্রায় ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় রাই। বাজায়। সারা মাঠ জুড়ে উলুধ্বনি গুঞ্জরিত হয়। এমন যে এমন, সামান্য বয়সের বউরাও তাতে যোগ দেয়। রাই তার শ্রীখোলকে নিয়ে খেলা জুড়ে দেয়। এদিকে কাত হয়, গমক গমক। সোজা হয়ে একটু নরম নরম কথা বলিয়ে নেয়। তারপর একটু হাহাকার যোগ করে দিয়ে ফিরে আবার মূল তালে আসে। আবার গায়েনের দিকে তাকিয়ে নেয় একটু। তারপর ঝলমল করে এসে সম-এ পড়ে। হরিবোল, হরিবোল। রাইয়ের বাবরি চুলে তুফান থামিয়ে একটু দাঁড়ায়। সে ঠেকায় ঠেকায় গায়েনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়এ বাদ্য দূর হতে শুনেছে যে, সে বাড়িতে থাকতে পারে না। রাত দশটার পরে মাইক বাজানো নিষিদ্ধ। কিন্তু রাইকে বাজনায় পেলে আয়োজকেরা ধার ধারে না এসব। বড়োবাবু আসে, তবুও না। এরপর আসেন খোদ এসপি সাহেবা। লম্বা। পুলিশের পোশাক পরা জাঁদরেল মহিলা। উত্তরপ্রদেশ না কোথাকার। হিন্দি বলে। তিনি যখন আসেন, তখন আমাদের রাই তার শ্রীখোলের সঙ্গে নিজের আত্মীয়তা বাজিয়ে দেখাচ্ছিল। গাড়ি থেকে নেমে সেই যে দাঁড়ালেন এসপি, নড়নচড়ন নেই। একজন পুলিশ আসে। রাইয়ের কাছে যায়। একটা হাজার টাকার নোট তার পাঞ্জাবিতে গেঁথে দিয়ে এসপি সাহেবাকে দেখায়মানে, উনি পাঠালেন। রাই শ্রীখোল তুলে নমস্কার জানায়। কিন্তু তার বাদন বন্ধ হয় না।  ফিরে যায় পুলিশ। আবার মাঠজুড়ে উলুধ্বনি।
          কিন্তু, এই যে একা বসে অন্ধকারে বাজাচ্ছে রাই, কী বাজায়? তার বাজনার থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। খালি গা। রোমহীন পেলবকান্তি। ভক্তিলাবণ্য? গোহালে কয়েকটি গাভী, তাদের বাছুর। জল নেই সামনের পাত্রেতারা ডাকে। রাইচাঁদের খেয়াল নেই। বাজায়। বছরে যে-কদিন বায়না থাকে না, রাইচাঁদ মাখন বিক্রি করে। ধলী, কালী, ললিতা, বিশখা তার আদরের গাই। রাইয়েরা আসলে ঘোষ। বাবার মিষ্টির দোকান ছিল। বেশ নামডাক। দাদারা মিলে সব ভাগাভাগির তাল তুললে রাই সেসব থেকে সরে আসে। স্বেচ্ছায়। একটুকু ভিটে, দুতিন কানি ধানের জমি আর গাইগুলো তার ভাগে আসে। না চাইতেই দিয়ে যায় দাদারারান্নাবান্না স্বপাক। একেবারে সামান্য। কিন্তু সকাল সন্ধ্যা মিছরি দিয়ে দুধ খেতে হয়, এক ঘটি। কাঁসার একটি ঘটি আছে। সোনার মতন চকচক করে। ঠাকুরের তৈজস সহ রাইয়ের সকল কিছু কাঁসার। নিজেই মেজে মেজে সোনার মতন করে রাখে। রাইচাঁদের ঘরদোর দেখলে তত বড় গিন্নিও লজ্জা পাবে, এমন পরিপাটি।  মাটির ঘরে থাকে সে। ঠাকুর থাকেন ইটের দালানে। বাহারি করে বানানো ঠাকুরঘরের সামনে ছোট্ট একটা নাটও রয়েছেরয়েছে প্রদক্ষিণ করবার মতন চারবারান্দাওরাই ঠাকুরঘরের দরোজা বন্ধ করে দিয়ে অন্ধকারে শ্রীখোল দিয়ে আত্মকথা রচনা করে। সে কথা সে রাধাকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য, নিতাইচাঁদকে শোনায়। শোনায় গোপালজীকে। সামনের ছোট পেতলের আসনে শ্রীগোপাল হাসি-হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছেন রাইচাঁদের দিকে। রাইচাঁদ ঘোষ, দীক্ষা নিয়ে দাস হয়েছে।
          রেলগাড়ি এসেছে এখন। নতুন। সকালে আগরতলা হতে আসে একটা গাড়ি। আবার সাড়ে আটটার দিকে ফিরে যায়। এখানে দূর দূর মাঠ। সেটা পেরিয়ে গেলে টিলা, রাবারের বাগান। তার কোনো আড়াল দিয়ে রেলগাড়িটা আসে যায়, রাইচাঁদ জানে না। সে তো রাতে ঘুমায় না। ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে গোহালে গিয়ে গরুগুলো দেখে আসে। হাফ ওয়াল করে পাকা করা গরু ঘর। উপরে টিন। সিলিঙ্গে ফ্যান আছে। বাছুরের জন্য আলাদা ভাগ করা আছে ঘরে। ভোরের দিকে গিয়ে ফ্যান অফ করে দিতে হয়। গরুর ঠান্ডা লেগে যায়। এসব করে এসে রাই যখন বিছানায় আসে, ভোরকীর্তনের সময় হয়ে যায়। তার আগে আধ ঘণ্টাটাক তন্দ্রা-তন্দ্রা, ঘুম ঘুম। আজকাল আর ভোরকীর্তনে কেউ বেরোয় না। আগে অর্চনা বৈষ্ণবী আসত। তার বাড়িতে এলে সঙ্গে রাইও বেরিয়ে পড়ত তার সঙ্গে। একটা টিমটিমে ধোঁয়া-ওঠা হ্যারিকেন হাতে নিয়ে অর্চনা এবাড়ি ওবাড়ি যেত। তার বুঝি দেনা শোধের বিষয় আছে, যেন এই ঘুমন্ত মানুষগুলো তাকে তাড়া দেয়। অর্চনা বৈষ্ণবী গেয়ে গেয়ে বেড়াত। তত মধু ছিল না তার কণ্ঠে। কিন্তু আদর ছিল। গ্রামটা পুরো মুখস্থ তার। কার বাড়ির ছেলেটার জ্বর, কোন বাড়ির বউ বাপের বাড়ি গিয়ে আর ফিরছে না, কার বাড়ির মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে... ভোর হলে অর্চনাকে মনে পড়ে রাইয়ের। কোথাকার কে যেন তাকে নিয়ে গিয়েছে। কেউ তো নেই, শেষকালে কী হবে খুব ভাবত সে। এখন বোম্বাই না কোথায়, কাদের ঘরে ছেলে রাখে সে। কী করে যে তার ভোরকীর্তন ফেলে রেখে চলে গেল। ঘুম আসে না। পাশের অত বড় করই গাছটাকে একটা মাধবীলতা পুরো দখল করে নিয়েছে। আসল গাছ আর দেখাই যায় না। মনে হয় মাধবীলতাই আসল। তার আড়াল থেকেই প্রথম পাখি ডাকে। রাই আরেক দফা বাজিয়ে নেয়। যেন সে বাজনা ছাড়া অর্থহীন, যেন বাজনাটাই আসল রাইচাঁদ। রেলগাড়ির শব্দ শোনা গেলে থামে। স্নান করে। ঠাকুর জাগায়। গাই দোহাতে যায়।
          কে বলে নয়নতারার গন্ধ নেই? রাইচাঁদের সারা বাড়িতে নয়নতারার গাছ শিশুর মতন খেলে, বাড়ে। সারা বাড়িতে ফুটে থাকে। হাসে, দোলে। গাই দোহাতে গেলে রাই এর সুগন্ধ পায়। সুঘ্রাণে ভরে যায় এমনকি তার ভেতরটাও। গাইগুলোর নানা জাত। পালা করে দুটিতে দুধ দেয়, দুটি গর্ভবতী থাকে। ধলী আর কালী দেশি। ললিতা নেপালি আর বিশখা জার্সি। এখন ওরা গর্ভবতী। রাই ধলীর কাছে যায়। তার বকনাটার নাম বংশী। তাকে ছেড়ে আসে। ছুটে এসে মায়ের স্তনের বোঁটায় জুটে যায় বংশী। পৃথিবীতে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য কি আছে? রাইচাঁদের সাদা রঙের গাভী সারা পৃথিবীর পুলককে তার চোখে ধারণ করেছে। আর অবশ হয়ে যেতে থাকে রাই। এত বাৎসল্য এই অবলা প্রাণে কোথা হতে আসে? একটু একটু করে সে চেটে দেয় সন্তানের শরীর। আর ওই বাছুর অযথা ঠুসে দেয়, আঘাত করে মায়ের দুধের ভাণ্ডে। কোথাও একটা গিয়ে লাগে রাইয়েরও। কেমন একটা ঝিম ধরানো পুলক লাগে তার। আর সেটা সে দেখে ধলীর মধ্যেও। দুগ্ধের ধারাস্রোত আরও বেড়ে যায় তখন। আনন্দে ঘন ঘন লেজ নাড়ে বাছুরটি। হুহু করে ওঠে রাইচাঁদের বুক। কোথাও একটা আনন্দ হয়, আবার কী যেন হারিয়েও যায়। হাফওয়ালের ফাঁক দিয়ে দূরের গাছপালার দিকে তাকায় রাই। সারা বাড়িতে ছড়িয়ে থাকা নয়নতারা দেখে। দুলছে, হাসছে। তারাও তো সন্তান, বসুন্ধরার দুধ খেয়ে বেঁচে আছে। রোদের দুধ খেয়ে। কী যেন মনে পড়ে রাইয়ের। ছুটে চলে আসে ঠাকুরঘরে। গোপালজী কি অপরাধী? রাইচাঁদ গিয়ে তাঁকে ধরে।
      আমি কী দোষ করলাম ঠাকুর? সবাইরে দও আমারে দও না। আমি কী আর এমন কঠিন জিনিস চাইলাম?
গোপালজী তাকিয়ে থাকেন। চোখে হাসি, ঠোঁটেও। রাইচাঁদের কথা শুনে যেন আরো বেশি করে হাসেন। 
        আমাদের রাইচাঁদ নারী হতে চায়। আসলে স্তন্যদানের পুলক পেতে চায়। নিজের বুকের দুধ সে খাওয়াতে চায় স্বয়ং গোপালজীকে। এ কথা কেউ জানে না। রাই জানে আর জানেন গোপালজী। নিজে তো পারে না। তাই সে বাজনায় বাজনায় স্তন্যদান করে। সেই সুমধুর বাদ্যধারায় সে গোপালজীকে তৃপ্ত করতে চায়। আর সেই একই গোপন আর্জি পেশ করে চলে তার গোপালজীর কাছে। আজও, সেই ভুলেই গেল দুধ দোহাতে। চলে এল ঠাকুরঘরে। বাৎসল্য আর আনন্দ তাকে ঠেলে গোহাল থেকে বের করে দিয়েছে। কিন্তু এই যে একই প্রার্থনা সে জানিয়ে যাচ্ছে, সে কবে থেকে? যেদিন সে জেনেছে, মায়ের দুধ পায়নি সে ধাত্রীও জোটেনি। যেদিন এ কথা জেনেছে, সেদিন থেকে? জানে না। বরং বুড়ো হয়ে যাচ্ছে রাইচাঁদ। যা কখনো হয়নি সে হচ্ছে আজকাল। অনেক্ষণ বাজালে তার কাঁধে ব্যথা হচ্ছে। কিন্তু আসল কাজ তো হল না। কবে হবে? কবে?
          আজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে রাই। বৃথা এই চেষ্টা। আমাকে তুমি দেবে না, আমিও তোমাকে দেব না আর। আজ থেকে ঠাকুরকে আর বাজিয়ে শোনাবে না। বাদ। ঠাকুরঘরে যাবে না। সেই কবে কোন বালক বয়স থেকে সে বাজায়। নিজেই শিখেছে। নদীয়া থেকে এসেছিল গোপাল গোস্বামী। তার বাজনা শুনেই পাগল হয়েছিল রাই। তার পিছু পিছু ঘুরে সে শিখেছে। তখন বাবা ছিলেন। কী করে নদীয়া থেকেই আনিয়ে দেন শ্রীখোল। দুটো। একটা বালক রাইয়ের জন্য। আরেকটা রাই যখন বড় হয়ে যাবে, তার জন্য। বাবা কী করে জেনেছিলেন, রাইয়ের ভাগ্য বাঁধা হয়ে গেল এই শ্রীখোলের সঙ্গে! তখন, যখন তখন বাবা বলতেন, ‘বাবা এট্টু বাজাইয়া শোনা’কোনো গান নেই, কিছু না। কেবল শ্রীখোল। সেই বাজনা শুনেই বাবার চোখে অবিরল নেমে আসত অশ্রু। কৈশোরে দীক্ষা হল। কণ্ঠীধারণ কল রাই। বাবরি চুল হল। আর পৃথিবী থেকে উবে গেল রাইচাঁদ। এ আরেকজন রাই। সে কেবল নারী হতে চায়। একবার মাত্র গোপালজীকে দুধ খাইয়ে মরে গেলেও কিছু যায় আসে না। কিন্তু একথা জানেন গোপালজী আর জানে রাই। পৃথিবী জানে না।  কোনো নারীর কোলে শিশু দেখলে হা-হা করে কোলে তুলে নেয়লুকিয়ে তার মুখটি চেপে ধরে নিজের অস্পষ্ট স্তনের ওপর। একপ্রকার পুলক ঘিরে ধরে তখন। একটু পরেই সে মিথ্যা হয়ে যায়। মিথ্যা মনে হয়। ঠাকুর ঘরে যায় সে, আর একই প্রশ্ন, ‘কবে ঠাকুর, কবে’, কবে আর?’
          আজ পূর্ণিমার কাজ ছিল। লম্বা  আসর হল কীর্তনের। বটতলায়। গ্রামের সকলে এল। বাইরে থেকেও অনেকে এসেছে। কিন্তু কিছুতেই বাজাতে রাজি হল না রাইচাঁদ। শেষে বাবুলের মা এসে বলে, ‘তুমি না বাজাইলে তো আমার কান্দন আইতো না বাপ। আমি আমার বাবুলরে তোমার বাজনার তালে তালে হামা দিতে দেখি। বাবুল তো বাজনা অইয়া গেছে।‘ মন ভিজে গেল রাইয়ের। তুলে নেয় শ্রীখোল। ‘মাথুর হোক’ আদেশ করে সে। দূর বনকর থেকে এসেছে একটা অতিথি কীর্তনিয়ার দল। আসলে রাইচাঁদের বাজনার ভক্ত দূর দূর জায়গার দলগুলি। তারা একবার অন্তত রাইকে শুনিয়ে নিতে চায় তাদের কীর্তনঅথবা, তারা ভাবে রাইয়ের সঙ্গে না গাইতে পারলে গেয়ে কী লাভ।
          বটতলার নাটমন্দিরে এখন মাথুর চলছে। এই দলের মালিক শম্ভু শর্মা। আসলে ব্রাহ্মণখোদ নবদ্বীপ থেকে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে এনেছেন। বউটির কী মধুর কণ্ঠ! কী শিক্ষিত। কী উচ্চারণ! প্রথমে গোবিন্দবন্দনা করে শ্লোক বলল ওই মধুক্ষরা কণ্ঠে। কী ভক্তি! এবার...শ্রীরাধিকা অমঙ্গল ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন। তাঁর দক্ষিণ নয়ন নাচে। কুলক্ষণ। পাখিরা কাঁদছে। ওদিকে যাত্রামন্ত্র গাওয়া হচ্ছে। শ্রীহরি ছেড়ে যাচ্ছেন। নিশ্চিত। এত সম্ভ্রান্ত গায়কী পেয়ে রাইচাঁদ ভরে ভরে যাচ্ছে। অক্রূরকে রাধিকা বলছেন,  ‘নিয়ো না, নিয়ো না পরাণবল্লভকে...’ ‘কোথা যাও, কোথা যাও, কোথা যাও হে পরাণ রাখাল, মুখ তুলে চাহ চাহ চাহ একবার... আবার দেখা হয় না না হয়... পরাণখানি যায় না ছেড়ে... তুমি না বলেছিলে ব্রজ ছেড়ে যাবে না’‘আমি আজ যাব কাল আসব ফিরে, মথুরা নয় বহু দূরে, দাও গো আমার পথ ছেড়ে’ বলে শ্রীগোবিন্দ আশ্বস্ত করছেন...
          আজ রাইচাঁদ এ কী বাজাচ্ছে! এদিকে মাঝে মাঝে সংস্কৃত শ্লোক বলছে শম্ভু শর্মার পুত্রবধূ এই হল আসল জিনিস। মানুষ কান্না ভুলে গেল, নাকি কান্না এখন আরো গভীরে চলে গিয়েছে? পালার পর্বে পর্বে পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে রাগ। পাল্টে যাচ্ছে সুর। ভাব। আমাদের রাইচাঁদও কোথা হতে সোনা এনে জুড়ে দিচ্ছে বাজনায়। আবার কখনো মনে হচ্ছে বাজনায় সে মেখে দিচ্ছে মহার্ঘ চন্দন। সকলকে অবাক করে দিয়ে বউটি গান থামিয়ে এসে রাইচাঁদের গলায় নিজের পুষ্পমালাটি পরিয়ে দিল। বিনিময়ে রাই তাকে আলিঙ্গন করে, নমস্কার জানায়না, মাথা নুইয়ে নয়। বাজিয়ে। তাতে বউটির ভাব আরও গভীর হল। শ্রীগোবিন্দের রথ চলে গিয়েছে দৃষ্টির বাইরে। এখন আর ধূলাও দেখা যাচ্ছে না। এখন শ্রীরাধিকা বান্ধবশূন্য হলেন। সখীকে ডেকে বলছেন, ‘এতদিনে বান্ধবশূন্য হলাম। এখন যাইতে যমুনার জলে তমালের নীচে সে আর জ্বালাবে না। সেই সুমধুর জ্বালাতন আর কে করবে’?
          একমসয় শেষ হল পালাএবার কাঁদছে সকলে। মনেহয় বৃক্ষটিও কেঁদে নিয়েছে। তার অযুত পাতায় পাতায় জোছনা। এ আবার আরেক আনন্দ ছড়িয়ে আছে গাছের পাতায়, পাতায়। একটা অন্যরকম বটবৃক্ষের মতন নাটমন্দিরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে রাইচাঁদ। কাঁপছে। আজকে প্রথমবারের মতন শ্রীবিগ্রহের সামনে অন্যসকল মানুষকে প্রণাম করল বাবুলের মা। বয়সের ব্যবধান রাখল না। আর ওই সুমধুর সংগীতের জননী, শম্ভু শর্মার পুত্রবধূ গলবস্ত্র হয়ে পাশে রাখা শ্রীখোলকে প্রণাম করল। কণ্ঠ হতে বহুমূল্য সোনার হারখানি খুলে শ্রীখোলের উপর রাখল। কৃষ্ণ কৃষ্ণ হে, কৃষ্ণ কেশব হে... আজকের আসর শেষ হল। সকলে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। আবার, আবার প্রণাম করে। সাষ্টাঙ্গ হয় যুগল বিগ্রহের সামনে। আর স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে রাই। আজ যেন সে নেই এইখানে। ভেতর থেকে কে যেন শুষে নিচ্ছে তাকে, কিংবা কী একটা যেন প্রবেশ করছে শরীরে। আনন্দ? নাকি কী একটা পুলক? একে একে বাড়ির দিকে রওনা হয় সবাই। শম্ভু শর্মার দল একটু দূরে থাকবে শহরে। তাদের গাড়িও চলে যায়।
          একটু এগিয়ে গেলে একটা তমাল গাছ। প্রাচীন গ্রাম। এখানে কেউ উদ্‌বাস্তু নয়। মহারাজের আমল থেকে এ গ্রাম বৈষ্ণব। মণিপুর থেকে  মহারাজের কোন এক আত্মীয় এসে এই গ্রাম প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। কবে কোন সনে কেউ জানে না। এই তমাল তরু সেই লোকের লাগানো। রাইচাঁদ একা বাড়ি ফেরার সময় তমালকে শাসায়, হয় আজগা, নইলে নাই।
          আজ আর ঠাকুরঘরে যায় না রাই। একবার নিয়মরক্ষার নিদ্রা দিয়ে আসে। কয়েকটা করবী গোটা এনে হামানদিস্তায় ছেঁচে নেয়। পেতলের সেই ঘটিতে দুধের সঙ্গে মেশায়। আজ হয় হবে, নাহলে বিদায়। শুধু তখন, যখন এ প্রাণ ছেড়ে যাবে, একবার এসে শিয়রে দাঁড়িও ঠাকুর। ঘটিতে দুধ ধীরে নীলবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। রাইচাঁদ ধূপ জ্বালিয়ে দেয় ঘরে। জানালা খুলে দিলে দূর আকাশের আলো এসে তার মেঝেতে খেলা করে। একটা কী পাতা বাতাসে নাচছে। তার দোলনের ছায়া এসে ঘরের মেঝেকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলছে। একটু জিরিয়ে নেবে ভাবে রাই। তারপর ওই দুধ খেয়ে শুয়ে পড়বে যা হোক হবে...
          পূর্ণিমার চাঁদ কখন সরে গিয়েছে। কেমন আধো অন্ধকার হয়েছে ঘর। কোন ফাঁকে ঘুম এসে গেল রাইয়ের। তার মুখের পেলবতা আরেকটা জোছনা তৈরি করেছে। কেমন একটা হাসি শুয়ে আছে রাইয়ের মুখে। বুকে একটা চাপ চাপ আরাম। একটু কি ব্যথা? যন্ত্রণা? মাঝে মাঝে কেমন পুলকবেদনার চিহ্ন ফুটে উঠেছে তার চোখেমুখে।  কখনো মুচকি হাসছে। কখনো ভ্রূ কুঁচকে যাচ্ছে তার। ত্বরিতে উঠে দাঁড়ায়। তার বুক দুটো ভরভরন্ত স্তন। টনটন করছে। রাই বুঝতে পারে স্তনে দুধ এসেছে। এসে চাপ দিচ্ছে তাকে। তার আবাল্যসাধনা আজ পূর্ণ হল। ছুটে ঠাকুরঘরে যায়। আজ কপাট লাগাতেও ভুলে গিয়েছিল। অসময়ে নিদ্রা থেকে তোলে গোপালজীকে। চেপে ধরে তাঁর ঠোঁট ওই সদ্য জাগা স্তনের বোঁটায়। অজ্ঞান হয়ে যায়। আবার জ্ঞান ফিরে আসে। আবার অজ্ঞান হয়। বারবার সে গোপালজীকে খোঁজে। রুপার তৈরি গোপালঠাকুর তো দুধ খেতে জানেন না মনে হয়।  ওই তো, কে ও? বাবুল, হামা দিয়ে আসছে? সে এসে স্তনের বোঁটায় মুখ লাগায়? অসহ্য চাপ কমে যাচ্ছে এবার। কী সুখ, কী সুখ! কুট করে কামড়ে দেয় বাবুল। জ্ঞান ফিরে আসে রাইয়ের। শিয়রের কাছে পেতলের ঘটি। তাতে বিষ হয়ে যাওয়া দুধ। রাই নেশাগ্রস্তের মতন হাঁটে। উঠোনের এককোণে একটু জোছনা। রাইচাঁদ উপুড় করে দেয় সেই  ঘটি।

প্রকাশিত : উৎসারণ পূজা সংখ্যা, ২০১১
(একটি বই পড়লাম। অ্যামাজনের এফিলিয়েটেড)