বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০২০

কুশল সংবাদ-২


কুশল সংবাদ- দুই


মাঝে মাঝে কয়েকজন জন্মান্ধের সঙ্গে দেখা হয়। তারা হস্তীদর্শন করে ফিরছে। তাদের কিছু জিগ্যেস করি না, নিজেই হাতির দিকে এগিয়ে যাই। যেতে যেতে অন্ধদের অনুমানগুলি মনে করি। তাদের কারও অনুমান হাতি হল একটা নরম থাম, কেউ ভেবেছেন হাতি হল একটি সজীব কুলা, কেউ মনে করে সামান্য একটা রোমঝাড়ুই হাতি... ভাবতে ভাবতে হাতির সামনে চলে আসি। এসে দেখি, কিছু দেখা যাচ্ছে না। চোখের দৃষ্টি চলে গিয়েছে। এইরকম অবস্থা হয় একটি প্রকৃত কবিতা পাঠ করলে। মনে হয়, কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না, কিছু শোনা যাচ্ছে না। বুদ্ধি ও সংস্কারনির্ভর সকল উপকরণই স্তব্ধ হয়ে যায়। বরং অন্তরে অনুমানের পাথর জমা হয়ে যায় অনেক। রঙিন সেই পাথরকেই সত্য বলে বোধ হয়। তাই কবিতা নিয়ে এত গদ্য, এত তাঁর পরিচয়নির্মাণের চেষ্টা। তথাপি, কবিতা সমান অধরা থেকে যাচ্ছেন।

যিনি বিশুদ্ধসত্ত্ব হতে পেরেছেন, তিনি যা চাইবেন তা-ই পাবেন। যা চাইবেন, তাকেই জয় করতে পারবেন। যে লোক কামনা করবেন, সে লোকেই বাস করতে পারবেন।  কিন্তু শুদ্ধতাই তো হল সবচেয়ে বড় কাম্য। সেটি পেয়ে গেলে আর তো কিছু চাইবার থাকে না! তবে? উপনিষদের কবি তাহলে কী আর চাওয়াতে চান সেই শুদ্ধসত্ত্বাধিকারীকে দিয়ে? পৃথিবীতে কত কবিতা লেখা হয়েছে। এক বাংলা ভাষাতেই কত কত কবিতা। একবার পড়লে সারাজীবন মনে তার অনুরণন বাজে  এরকম কবিতাও হাজারে হাজারে রচিত হয়ে গিয়েছে।  সেসবের পরে আর কী চাইবার আছে? নতুন করে আর কী লিখবার আছে? কিংবা একজন কবি একটি উৎকৃষ্ট কাব্যগ্রন্থ লিখে ফেললে তাঁর আর কবিতা লেখার চেষ্টা কেন? তিনি কবিতার কাছে আর কী চান? বিশুদ্ধ একটি কবিতা রচনা করাই তো সাধনা। বিশুদ্ধবস্তু তো বহু হতে পারে না। তাহলে বহু বহু কবিতা যে লেখা হচ্ছে, সে-সব বিশুদ্ধতম কবিতা নয়?

এমন একটি কবিতার সন্ধান করে চলে মানুষ, যেটি লেখ্য নয়। এমন কোনও লিপি, এমন কোনও করণকৌশল মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি, যার দ্বারা সে কবিতা লিখে ফেলা যায়। হয়তো কবিও জানেন না, তিনি এক দুর্বোধ্য, হিরন্ময় অন্ধকার পেতে চাইছেন। যা পেলে প্রাপ্তিবোধও লীন হয়ে যায়। তাই, যেদিন পেয়ে যান, সেদিনও বুঝতে পারেন না পেয়েছেন। তাই চাওয়া শেষ হয় না। চাওয়ার দৌরাত্ম্যে চিত্তও শুদ্ধ হয় না। সুতরাং একটি অশুদ্ধচর্চার নামই কাব্যচর্চা। যেমন বিজ্ঞান। এমন একটি চরম নিয়ম কোথাও আছে, যার দ্বারা সকল নিয়মকে ব্যাখ্যা করে ফেলা যায়। সে নিয়মের নিয়ত সন্ধান করে চলেছে বিজ্ঞান। হয়তো কোনো কোনো বিজ্ঞানী তা অন্তরে জেনেছেন, কিন্তু সেটিকে প্রকাশ্য কোনও মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে ভাগ করা যায় না।

কবিতাও কি যায়? যে নিগূঢ় মনোস্থিতি থেকে ভাব কিংবা ভাবরাশি শব্দবাহিত হয়ে সাদা পাতায় চলে আসে, সে ভাবটি তো শব্দদ্বারা অপরের কাছে সম্পূর্ণতঃ যেতে পারে না। ভাগ হয় না তার। মনের সাহায্যে অপরের মনের কাছে আমরা যে বার্তা পাঠাই তা-ও তো পথভ্রষ্ট হয়। কিংবা উদ্দেশ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়। এমনকি, একের উদ্দেশে প্রেরণ করা বার্তা অন্য কোনো মনে গিয়ে আহত হয়।  কারণ মানুষের অন্তরের গভীরতম প্রদেশ হতে যে বার্তা আসে, তা তো তার অন্তরেই লীন হয়ে যায়। মনের সেখানে কোনওমাত্র ভূমিকা নেই। মন একটি ভোঁতা উপকরণ মাত্র। সে উদ্দীপ্ত হতে পারে। উত্তেজনায় সাড়া দিতে পারে, সে সাড়া সে মানুষের দেহের ভিতরের আরও ভিতরে নিয়ে পৌঁছাতে পারে। যদিও তাকে সে কাজে প্রশিক্ষিত করে নিতে হয়। সে কাজ কঠিন। অন্যদিকে  কবিতা সেই উত্তেজক হতে পারে। যুগযুগ ধরে কবিতাকে তা-ই করার চেষ্টা হয়েছে। হয়তো প্রতিটি কবিই সেটি চান। কিন্তু, যেমন, হিমালয় যেতে গিয়ে পথিমধ্যে অন্য নগরের বৈভবে ভুলে যায় শৌখিন পর্যটক, তেমনি কবিও হয়তো ভুল করেন।

কী জানি কী করেন! পাঠ করতে করতে এই-ই তো মনে হয়। একেবারে ভূমিপার্থিব কোনো ঘটনার বিবরণবাচক কবিতা স্বল্পজীবী হয়ে থেকে যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে যৌবনোদ্দীপক কবিতাসকল আজ আর কাজে আসে না। কেবল সেইসব যুগের কথা, দেশের শিশুকিশোরদের মনে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করবার কাজে তাদের ব্যবহার হয়। বলা বাহুল্য, সে জাগ্রত দেশাত্মবোধ শিশুকিশোরের বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উবে যায়। কবিতা তো হেন উদ্বায়ী হবার কথা নয়!

তাই, চাই না কিছু আর। হয়তো লিখতেও চাই না। শুধু নিজেকে চাইবার মত যোগ্য করে তুলতে চাই। ধীরে ধীরে তাই কমে যাচ্ছে অভিমান। অপরের মুখ ভেবে যখন কেউ ম্লান করে দিয়ে যায় আমার মুখটি, তখন তাকে মনে মনে দেখি। নিজের প্রকৃত মুখচ্ছবি তো মানুষ দেখে না কখনও।

অনুমান করি। কোন্ মুখটা ম্লান হল? যেটিকে দর্পণে দেখি সেটি? নাকি, অপরের চক্ষুমধ্যে বিম্বিত দেখি যাকে সেটি? নাকি এসকল মিলে মনেমনে নিজের মুখের যে ছবি আঁকা হয়ে আছে সেটি? ভাবতে ভাবতে যাই। নিজের দেহের ভিতরের পথে পথে হাঁটি। যেন আমার ম্লানমুখখানিই সে হাতিটি! যদিওবা তার সামনে যেতে পারি, গিয়ে দেখি অন্ধ হয়ে গেছি। কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

এই অন্ধত্ব নিয়ে ভালো আছি।

[ 'জলজ' পত্রিকায় প্রকাশিত, ২০১৬]





পাঠের জন্য ধন্যবাদ

একনাথ ঈশ্বরণের লেখা মুখ্য উপনিষদগুলো



৪টি মন্তব্য: