কুশল সংবাদ-তিন
ফলশ্রুতি। শব্দটি অর্থের দিক থেকে পালটে গিয়েছে। তীর্থ করে আসা মানুষের কাছে
তীর্থের বর্ণনা শুনে, অথবা ব্রতকথা শুনে শ্রোতার যে পুণ্যফল হয়, তা-ই ফলশ্রুতি। শ্রুতি
হতে প্রাপ্ত ফল। আজ শব্দটি ব্যবহৃত হয় ‘ফলস্বরূপ অর্থে। এতে কি তার মনখারাপ হয়? শব্দটি একা বসে কোথাও কাঁদে? মাঝেমাঝে শব্দের
ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পাই আজকাল।
কাল সারারাত তিতির শব্দটি কেঁদেছে। ভোরের
দিকে চলে যায়। তখন গুটিসুটি ঢুকে পড়ল বিরহ শব্দটি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। কাঁদে কেন
তারা? শব্দের আবার কিসের দুঃখ! আমাকেই কেন তাদের কান্না শোনাতে আসে? না, কে তাদের অর্থবদল
করে দিচ্ছে, তা নিয়ে একটুও বিচলিত নয় তারা। কারণ বিকৃতার্থ করা হয়েছে, এমন তো একটি
শব্দও আসে না। আসেনি এতদিন। দু-একবার এলেও কাঁদেনি। বিদ্রুপ করে ফিরে চলে গেছে। তবে?
শুয়ে শুয়ে শব্দের সঙ্গে খেলি। দেখি, আমার
বিছানার চারদিকে, ওপরে ও নীচে, পাশে, পায়ের কাছে অযুত শব্দমালা এসে জড়ো হয়েছে। কেউ
পৃথুল, কেউ শীর্ণ। কারো মন খারাপ কেউ বা অজীর্ণ রোগে ভুগছে। চোখ বুজে তাদের গায়ে হাত
বোলাতে যাই। বসন্ত শব্দটিকে ধরতে বামদিকে হাত বাড়াই। হাতে কী যেন চটচটে একটা শব্দ এসে
লাগে। চোখ মেলে দেখি, যক্ষ্মা।
অথবা, সংগীত থেকে শব্দকে তুলে নিয়ে একটু
আদর করতে ইচ্ছে করে কখনো। সকল সংগীত নয় শব্দময়। কোনও সংগীতের শব্দ থাকলেও তা ঠিক শব্দ
তো নয় — ধ্বনি। শব্দরূপে থাকলেও সে-সব শব্দ থাকে ধ্বনির আগেপিছে।
যেন ধ্বনিটিই আসল। শব্দেরা তার দেহসচিব। ধ্বনি অভিজাত। বহুবিভাময় এবং অহঙ্কারী। ধরা
দেয়, কিবা দেয় না। দিলেও কাছে থাকে না। তখন নিজেকে এক জন্মান্ধের সঙ্গে তুলনা করতে
ইচ্ছে করে। সে কী মর্মে ধ্বনিকে বিবেচনা করে? জন্মান্ধরা কেন স্বভাবে বাঁশিওয়ালা, কেন
তারা এত সংগীতপরায়ণ? তবে কি চক্ষু শব্দের আত্মীয় নয়? যে মানুষ আজ মাত্র তিতির পাখি
দেখেছে, তার অন্তরে তিতির শব্দটির কী পরিণাম হল? শব্দটির যে ইতিহাস এতকাল তার মনে লেখা
হয়েছে, তার কী হবে? তিতির দেখার আগে ও পরে শব্দটি কি একই থাকছে? হয়তো বদলে যায়। নিশ্চিত, বদলে যায়। সেটাই অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু জন্মান্ধের
শব্দের ইতিহাস পালটায় না। তার কাছে জমা থাকে ধ্বনি ও শব্দের ধ্রুবপরিচয়। এ জগতের সকল
শব্দমালা তার কাছে ঈশ্বররচিত ‘ধ্রুবপদ’।
উট দেখিনি আমি। মরুদেশে যাইনি কখনও। তবে
কি উট শব্দে আমার অধিকার নেই? মাঝে মাঝে দেহের সকল গ্রন্থি গুছিয়ে নিয়ে, এই যে, অন্তরে
কান পাতি তখন কাকে দেখি? এক গভীর নিস্তব্ধতাকে কাঁধে নিয়ে কারা যায়? কিংবা নিঃসঙ্গতাকে?
শরীরের শ্মশানের দিকে কারা যেন নিস্তব্ধতাকে নিয়ে যায়, অনন্তযাত্রায়। তখন প্রহরনিরপেক্ষ
রাত্রির জন্ম হয়, দেহের ভিতরে। সেখানে একা একটি কাটা চাঁদ জেগে ওঠে। তার জ্যোৎস্নার
ঘ্রাণ ফেরি করেন কে যেন, তখনই দেখা হয় উটের সঙ্গে, তার গ্রীবার সঙ্গে। এইখানে এক শব্দপ্রদর্শকের
কথা উঠবে— অবধারিত ভাবে উঠবে — কবি।
কবি কোন্ শব্দমালা নিয়ে কাজ করেন, চক্ষুষ্মানের
শব্দ, না জন্মান্ধের? কোনো মানুষের দ্বারা এক জীবনে কোনও একটিমাত্র শব্দেরও সঠিক পরিচয়
পাওয়া কি সম্ভব? যে ব্যক্তি বিরহদহনে আত্মহত্যা করেছে আর যে জীবিত এখনও বিরহানলে দগ্ধ হচ্ছে, তাদের কাছে বিরহ শব্দটির কি একই পরিচয়? কে পারেন এদের জন্য এই শব্দটিকে
নির্বিশেষার্থে পরিবেশন করতে? কবি কি পারেন? কত অসহায় একজন কবি, হায়! সারা জীবন তাই
একজন কবিকে শব্দের ক্রন্দনধ্বনি শুনে যেতে হয়। যেন এক গণকবরের পাশে বসে থাকেন তিনি।
তাকে ঘিরে কান্নার আলেয়ানৃত্য চলতে থাকে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজের শবের ওপর
বসেই কবি আয়োজন করেন শবসাধনার। যিনি তাতে সিদ্ধ, শব্দের অপরিচয় ঘুচে যায় তার। তিনি
তখন নৈঃশব্দ্যের আলোকপ্রদেশে চলে যান। যিনি সেই সাধনায় চিরনিমগ্ন থেকে কেবলই বিস্ময়ে
বিমূঢ় থেকে যান, থাকার যোগ্যতা অর্জন করেন, তিনি ‘কবি’ হয়ে ওঠেন। হয়তো পৃথিবীতে তাই, কেউ কেউ
কবি। সকলে নয়। বাকিরা শব্দের ম্যানেজার।
মাঝে মাঝে কোনও একটি কবিতার দিকে তাকিয়ে
থাকি। পাঠ করা নয়, তাকিয়ে থাকা। তার শরীর হতে একটি একটি করে শব্দ তুলে নিয়ে পাশে রাখি।
তখন কাগজের সাদা পড়ে থাকে। সেই নির্বিরোধ অথচ ক্রূর, নিষ্ঠুর এবং হিংস্র সাদাটুকুই
কি কবির অভিপ্রায়? ভয় হয়। তাড়াতাড়ি আবার শব্দগুলি সাজিয়ে দিতে চেষ্টা করি। হয় না। আগে যেমন ছিল ঠিক সেরকম হয় না। একই শব্দ কবিতে-আমাতে
ভিন্ন যে! এবারও একটি কবিতা সৃজিত হয়। নতুন। সেই কবি, যিনি এত আয়োজন করে শব্দমালা স্থাপন
করে দিয়েছিলেন, তিনি তখন উহ্য হয়ে যান। এদিকে, তাঁর রচিত শব্দমালা ছিল অপরিচিত, তারা
এবার বদলে গিয়ে আত্মীয়ের মত করে আসন গ্রহণ করে। আমার আত্মীয়। এখন তাদের সঙ্গে একটু আলাপচারিতা
চলে। সেই আলাপে, কই, সেই পূর্বোক্ত কবির নাম
তো একবারও আসে না। হয়তো এই প্রক্রিয়ারই সাধারণ
নাম পাঠ করা। তাহলে পাঠ করাও শিখতে হয়? শব্দেরাই একজন মানুষকে পাঠক করে তোলে? কিংবা
তারাই পাঠ করে পাঠক কিংবা কবিকে? এত শক্তিধর জগতের শব্দরাশি! তবে কাঁদে কেন তারা, আজকাল?
আজকাল শব্দের ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পাই।
তাই ধীরে ধীরে অন্তরালে চলে যেতে ইচ্ছে করে। এই কোলাহলমুখর পরিচয় ছেড়ে অন্তরালে চলে
যেতে ইচ্ছে করে, ধ্বনিনির্মিত ভিন্ন এক অন্তরালে।
ধ্বনিই শব্দের জননী। তাঁর কাছে গিয়ে একা, অহংবিবর্জিত হতে চাই। কোনো একটি শব্দকে আমার
নিজের আয়তনে নামিয়ে আনে কে? নিসর্গ শব্দটিকে কে ‘সিনারি' হিসেবে
বিবেচনা করে? সেই অহং।তাকে হত্যা করতে হবে। তাই সেই আদি, প্রথমা ধ্বনির কাছে যাই। দেহের
সকল দরোজা বন্ধ করে দিলে সেই ধ্বনি বাজবেন। সে ধ্বনি সংগীতের নয়, বাতাসের নয়, চিৎকারের
নয় কিংবা পক্ষিরব নয় তা। বাস্তব পৃথিবীতে তাঁর কোনও মৌলিক বাহ্যরূপ নেই। তিনি একা।সকল
ধ্বনি-নীরবতার সম্রাজ্ঞী। তাঁর দিকে কান পেতে রাখি। হয়তো ধ্বনিত হচ্ছেন। তিনি তো নিয়তস্বনক।
আছেন এবং ক্রমাগত হচ্ছেন। ধরতে পারি না। এই বাহ্যশ্রুতি দ্বারা তাঁকে নির্দেশ করা যায়
না। নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে সব। কিন্তু সে-ও তো শব্দময়!
বুঝতে পারি এ জীবন শব্দদূষিত। সে প্রকৃত ধ্বনিকে অনুধাবন করার যোগ্য হয়নি আজও।
কারো কারো হয়। কারো কারো জীবন সে ধ্বনিকে অবলম্বন করার মত যোগ্য হয়। এখনও সেই যোগ্যতা
অর্জন করতে পারিনি। তাই কান্না।এই কান্না আমার। অহংচালিত নিজের কান্নাকেই মনে হয় শব্দের।
অহং এসে দিশাবদল করে দিচ্ছে।কাঁদছে জীবন, শুনতে পাচ্ছি শব্দের ক্রন্দনধ্বনি।
তবুও তো হচ্ছে কিছু। ঠা-ঠা হননহাস্য শোনার
থেকে নিরবধি ক্রন্দনের সঙ্গে আছি। বেশ আছি। ভাল আছি।
['জলজ' পত্রিকায় প্রকাশিত, ২০১৬]
পাঠের জন্য ধন্যবাদ
[ তখন উপনিষদ পড়ছিলাম খুব। কিন্ডল ছিল না। হার্ডকভার। এখন কিন্ডল এসে গেল]
['জলজ' পত্রিকায় প্রকাশিত, ২০১৬]
পাঠের জন্য ধন্যবাদ
[ তখন উপনিষদ পড়ছিলাম খুব। কিন্ডল ছিল না। হার্ডকভার। এখন কিন্ডল এসে গেল]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন