বুধবার, ২ নভেম্বর, ২০১১

আমাদের নৌকাপ্রাপ্তি


গোমতী আমাদের পাড়ার পেছনে



গোমতী, বাংলাদেশে



গরু শান্ত। শান্ত নদীর নাম হোক গোমতী। এই বিশ্বাস থেকেই কি কেউ আমদের নদীটির নাম গোমতী রেখেছিল? জানা নেই। কিন্তু এটি যে ত্রিপুরার আদিভাষা ককবরক শব্দ নয়, সে নিশ্চিত। আমাদের নদীটি শান্ত।
জীবনের কাছাকাছি একটি নদী থাকা ভাল। গোমতীর প্রশ্রয়ে সে কথা বুঝেছি। যেখান থেকে সে আসত, তার নাম তীর্থমুখ। সেখানে রাইমা সরমা নামে দুটি ঝোরা তাকে পুষ্ট করত। সেই রাইমা আর সরমার জল নিয়ে গোমতী বহুকাল তার নামের বিপরীত কাজ করে গেছে। তারপর তাকে বাঁধা হয়েছে। উৎসে বিরাট ড্যাম হয়েছে। ডম্বুর। আমদের এদিকে মহারানি একটি জায়গার নাম। সেখানে গোমতীকে আবার বাঁধা হয়েছে। প্রথমে বিদ্যুতের জন্য, পরে সেচের জন্য। গোমতী তাই এখন ক্ষীণতোয়া হয়েছে। তবু সে কোথায় চলে যায়? গুগল ম্যাপে তার পার ধরে ধরে সেদিন একটা খেলা খেললাম। নদীটিকে ফলো করতে করতে আমি আর আমাদের পুত্র উদয়পুর থেকে চলে গেলাম একেবারে বাংলাদেশের গভীরে, যেখানে গোমতী মিশেছে অন্য একটি নদীতে। এই ভার্চুয়াল ভ্রমণের কালে কত কথা মনে এল।
হেমন্তে গোমতী কুয়াশা পরিধান করে। তার বুক থেকেও হাল্কা পরিসাজবাষ্প বেরুতে থাকে। আমি তখন একজনের দুর্দান্ত প্রেমিক। সন্ধ্যাকালে তার জন্য গোমতীর পাড়ে অপেক্ষা করতাম। যথারীতি সে দেরি করে আসত। আসার সঙ্গে সঙ্গে কপট অভিমানের কথা হত কতক্ষণ। সে শুনে গোমতীকে আমি হাসতে শুনেছি।
আমাদের শহরের গোমতীতে গুণ টানা নৌকা সেদিনও দেখেছি। বছর কুড়ি আগে। এখন নেই। আরও আগে উদয়পুর যখন রাজধানী ছিল, গোমতী ধরে কুমিল্লা থেকে পসরা নিয়ে মুরপঙ্খী নৌকা আসত, পড়েছি। এখন গোমতীর বুক ছেনে নির্মাণবালু তোলার নৌকা ছাড়া কোনও নৌকা নেই। গুগল ম্যাপ ধরে যখন গোমতীর ভাটিতে গেলাম ক্রমশ নৌকার সংখ্যা বাড়তে লাগল। এক জায়গায় রীতিমত স্টিমার দেখতে পেয়ে ছেলে চিৎকার করে ওঠে।
পরীক্ষা শেষ হলে দল বেঁধে নদীতে স্নান করতে যাওয়াটা ছিল একটা উৎসবের মত। এপার ওপার করা, পাশের ক্ষেত থেকে শসা খাওয়া আর, জল তোলপাড় করা। এরকম একদিন নদীর ঘাট থেকে একটু দূরে সামান্য গভীর জলের তলায় পাওয়া গেল একটি ডুবে যাওয়া নৌকা। বেশ বড়। ওপর থেকে লাফ দিয়ে নদীতে পড়ে ব্যথা পেয়ে একজন তার অস্তিত্বের কথা বলে। সকলে ডুব দিয়ে দিয়ে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেল। বড়দের সেটা জানানো হবে স্থির করে আমরা উঠে এলাম।
জানানো হল। সেটাকে তোলার নানা ব্যর্থ চেষ্টা করা হল। পরে কোথা হতে একজন লোক এসে সে নৌকা দাবি করেন। তিনি মাটির পাতিল ইত্যাদির কারবারি। প্রমাণিত হয় নৌকা তার। চৈত্র মাসে জল কমে গেলে নৌকা তোলা হবে এটা স্থির করে তিনি চলে যান।
দোল এল। রং খেলে আমরা নদীতে স্নান করতে নদীতে গিয়ে দেখতে পাই তাকে তোলার তোড় চলছে। পাড়ার একজন উঠতি মস্তানদাদা সব তদারকি করছেন। সেই পাতিলের কারবারি পাড়ে দাঁড়ানো। ধীরে ধীরে এক বিরট নৌকাকে শেকল দিয়ে বেঁধে বহু লোকে মিলে ঘাটের কাছে নিয়ে এল। ‘পোলাপানে প্রথম পাইসে দাদা, তারারে কিন্তু খাওয়াইতে হইব’। আমদের দেখিয়ে দাদাটি বলেন।
রাতে আমাদের একটি বাড়িতে যেতে বলা হয়। সন্ধ্যার ক্যারম-আড্ডা সেরে আমরা সে বাড়িতে গেলাম। সেখানে মাংস রান্নার বিরাট আয়োজন হচ্ছে। আমাদের দাদাটি পান করে ভীষণ গরম গরম কথা বলে চলেছেন। আমদের একজনকে তিনি হঠাৎ-ই জিগ্যেস ক্রলেন, ‘তোরা ইহানে ক্যান’? মাংস খামু, নৌকা তো আমরা পাইছি। দাদা তাকে সপাটে একটি চড় কষান।
আমরা চলে আসি। বাড়িটি আলাদা একটি জায়গায়। ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে আলরাস্তা ধরে যেতে হয়। আমরা একটি জুতসই জায়গায় দাঁড়ালাম। কেউ কোনও কথা বলছে না। অনেকক্ষণ পরে দাদটি শিস দিতে দিতে টলতে টলতে সেখানে এসে, আমরা ছুডু পোলাপান এখনও কেন বাড়ির বাইরে – এই সংক্রান্ত শাসন শুরু করতেই, কে যে স্টার্ট করেছিল মনে নেই। দাদাটির যাবতীয় হম্বি ধানের ক্ষেতে সমাধিস্ত করা হল। তার হাত জোড় করে ক্ষমা চাইবার দৃশ্য আজও মনে পড়ে। আর কোনোদিন দাদাটি বা আমরা কেউ সেই ঘটনা মনে করিনি

পরে ডুবন্ত নৌকাটিকে আলকাতরা মেখে কী কী সব করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে আর ফিরে আসেনি। গোমতী আজ একটিও নৌকা দেখে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন