রবিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১১

মিশ্রাজির পাথরচোখ

মিশ্রাজির পাথরচোখ


বিস্মৃতির গোপন প্রাণ আছে। সপ্রাণ সেই বিস্মৃতি জেগে ওঠে মাঝে মাঝে। বিভীষিকা না আনলেও, তার সঙ্গে আগ্নেয়গিরির তুলনা টানা যায়। নিবিড় এক নিদ্রা হতে সে যেন জেগে ওঠে অকস্মাৎ।
         একজন হিন্দি শিক্ষক ছিলেন আমাদের পাড়ায়। হিন্দি মাস্টার। তিনি কিরীটবিক্রম ইনস্টিট্যুটে হিন্দি পড়াতেন। মিশ্রাজি তার নাম। নিরামিষাশী। বাঙ্গাল পাড়ায় শুঁটকি রান্না হত এবাড়ি ওবাড়ি। তখন মিশ্রাজি পাড়ার বড় পুকুরটির ধারে দ্রুত পায়চারি করতেন। বিড়বিড় করে বাঙ্গালরা যে তেমন হিন্দু নয় সে বিষয়ে আত্মবক্তৃতা দিতেন। তার একটি চোখ পাথরের। সেটি নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে সামনের ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে থাকত। বাংলা মিডিয়াম স্কুলে তেমন কেউ হিন্দি নিত না। তিনি প্রায় কাকুতি মিনতি করে কয়েক জন হিন্দি নিতে প্ররোচিত করতেন। সফলও হতেন। কারণ মিশ্রাজির ছিল তিনটি পরির মত সুন্দর মেয়ে। তার স্ত্রীর সৌন্দর্যও বেশ চর্চিত ছিল পাড়ায়। পাকা বলে সে-সব আলোচনার সারমর্ম আমরা বুঝতে পারতাম। মিশ্রাজি নিজে অতিশয় বাজে বাংলা বলতেন। কিন্তু তার মেয়েরা দারুণ কথ্য বাংলা বলত। তার স্ত্রী অবশ্য ডাহা বাংলাকানা ছিলেন।
     মিশ্রাজি পাটনা থেকে আসার সময় একটি দড়ি বাঁধা চারপাই নিয়ে এসেছিলেন। গরমেকালে রাতেরবেলা তিনি দিব্যি সেটাতে ঘুমোতেন বাড়ির উঠোনে। তাতে তিনি কখনো নিরাপত্তার অভাব দেখেননি। কিন্তু অপরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছেন।
      একজন ভিনরাজ্যের ঠিকাদার এসে আমাদের পাড়াতে এসে কী সব কাজ করতেন। তরুণ, সুন্দর। তিনিও হিন্দিভাষী। পাড়াতে আসার কিছুদিনের মধ্যেই হিন্দি মাস্টারের বড় মেয়েটিকে তার সঙ্গে এখানে ওখানে দেখে যেতে লাগল। তিনি মিশ্রাজির পাথরচোখের কথা হয়তো কোনও কারণে জানতেন না। তবে তাদের প্রেমে মিশ্রাজির স্ত্রীর সায় ছিল।
           দীপাবলির রাত। মিশ্রাজির বাড়ি সেই পুকুরের পাড়ে। পুকুরের পরেই তার উঠোন। উৎসবের রাতের শেষে ভোরবেলা কোনওভাবে সেই প্রেমিকপ্রবর তার বাড়িতে গিয়েছেন। তাদের অভিসার শেষে সেই সুদর্শন যুবক বাড়ি থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে আসছেন... হঠাৎ তার চোখ যায় ঘুমন্ত মিশ্রাজির দিকে। তার পাথরচোখ নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে প্রেমিকের দিকে। নীরব, প্রায় নিষ্প্রাণ সেই দৃষ্টি তাকে এমন ভয় পাইয়ে দেয় যে, ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় সোজা পুকুরে পড়ে যান।
           বেচারা সাঁতার জানত না। তার চেঁচামেচিতে লোক জমে যায়। একজন তাকে তুলে আনে। মিশ্রাজি তার চেহারা দেখেই বুঝতে পেরে থাকবেন সে হিন্দিভাষী। ‘তুম কৌন হো?
          আমি পাকা। পেছন থেকে বলেছিলাম ‘আপকা দামাদ’ সঙ্গে সঙ্গে একটি থাপ্পড় এসে আমার ঘাড়ে পড়ল। পেছন থেকে দিদি সেটা দান করেছে। মিশ্রাজি আমার দিকে তাকালে তার পাথর চোখটিকে দেখলাম নীরব। বরং ভালো চোখটি থেকে যেন আগুন বেরুচ্ছিল। দীপাবলি এলে মিশ্রাজিকে মনে পড়ে।
           সে পুকুর এখন ভরাট হয়ে গেছে। মিশ্রাজির বাড়িটি এখন অনেকগুলো ছোট ছোট বাড়িতে ভাগ হয়ে বাঙালিদের আবাস হয়েছে। মিশ্রাজি অবসরের পর চলে গেছেন। তার পরিমেয়েগুলিসমেত। কিন্তু মিশ্রাজির পাথরচোখ এখনো দীপাবলি এলে আমার দিকে তাকায় মাঝে মাঝে। মাঝে মাঝে এরকম একটা দৃষ্টির সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন