রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১

বারো চুয়াত্তরের হ্যান্ডিম্যানের সানগ্লাস পরার দিন

বারো চুয়াত্তরের হ্যান্ডিম্যানের সানগ্লাস পরার দিন

‘এক্কেরে বিশ্বঅরমা রে, বিশ্বাস কর।’ এখানে বিশ্বঅরমা একজন দেবতার নাম। তার নামে দিব্বি দেবার সময় মোটরশ্রমিকেরা স্বভাবসিদ্ধ অপভ্রংশে বিশ্বকর্মাকে বিশ্বঅরমা করে দেন। অটো-গাড়ি-রিকশা থেকে সেলাই মেশিন সবই বিশ্বকর্মার দান। কম্পিউটার থেকে মহাকাশ যানও তারই তৈরি।এমন বিশ্বাসেই আজ, বিশ্বকর্মা পূজার আগের দিন গ্যারেজে গ্যারেজে ধোয়-মোছা চলছে গাড়ি থেকে অটো। দোকানে দোকানে ঝাড়পোঁছ চলছে বাটখারা থেকে কম্পিউটারের। 

  বিশ্বকর্মা পূজা দেখতে যেতে হয় রাতের দিকে। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। ঢাকী থেকে গাড়ির ক্লিনার তখন বাবার আরাধনায় নৃত্যরত। কেউ সদ্য দেখা সিনেমা থেকে হিরোর নাচের ব্যর্থ কপি করতে ব্যস্ত, কেউ এসবের ধার ধারেন না। অষ্টবক্র হয়ে প্রায় লালা ঝরাতে ঝরাতে তার আরতিনৃত্য। তিনি ছাড়া এ নৃত্য কাউকেই হয়তো আনন্দ দিচ্ছে না। তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। থোড়াই কেয়ার। আজ আমাদের দিন - আমরা যারা হাতের তালুতে কড় তুলে পরিশ্রম করি। 


  বিশ্বকর্মা পূজার আরেকটা শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে অসম্ভব খিস্তি। গাড়ির শ্রমিকেরা এমন সব খিস্তি বানাতে পারেন, সেটা আর কোনও ভাষাবিদের পক্ষে সম্ভব নয়। যেকোনও সম্পর্ককে দৈহিক কার্যক্রমে নিয়ে গিয়ে তারা যে কারওর কান লাল করে ছেড়ে দিতে পারেন। তারা বন্ধুকে ভালোবেসে এমন শব্দে সম্বোধন করেন, শিষ্টজনেরা যা অতিবড় শত্রুর বিরুদ্ধেও ব্যবহার করতে পারেন না। নিজের ছেলেকে আদর করে তারা শুয়োরের বাচ্চা বলার সাহস রাখেন।

   বিশ্বকর্মা পূজায় বড় বড় মালিকেরা সরল হয়ে যান। তাদের গাড়ির চালক থেকে শুরু করে একেবারে প্রায় অচেনা হ্যান্ডিম্যানটি পর্যন্ত ন্যূনতম আনন্দ করার রসদ পান। আপনার বাইকটি আপনি সংস্কারবশত পূজার আগের দিনে একটু ধোয়াতে নিলেন, মেকারের পোলাপান সেটাকে ধুয়েটুয়ে দিল। টাকা দেবার সময় তারা আপনার কাছে একটু বেশি কিছু আবদার করবে। ‘দাদা আনন্দ করুম।’ বিশ্বকর্মা পূজার আনন্দ কিনতে পাওয়া যায়। গাড়ির মালিকের বউয়ের কাছেও সেই আনন্দের আবদার গিয়ে দাঁড়ায় অনেকসময়।‘বৌদি আনন্দ করুম, কিছু দেন।’ বৌদিও আনন্দ বাবদ কিছু দেন। সেটা দিয়ে আনন্দ কিনে এনে শুরু হয় পূর্বোক্ত আরতিনৃত্য।

  মাঝিরা বেশ রোম্যান্টিক হন। তাদের সেই সুন্দর প্রেমিক মন আমাদের উপহার দিয়েছে অনেক ভাটিয়ালি ও নদীনির্ভর গান। সে গানগুলির অধিকাংশ আসলে প্রেমের গান। দেখা গেছে, যারা পারাপারের কাজ করেন, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ক্রমাগত যেতে হয় যাদের তারা বেশ প্রেমিক। কারণ, তাদের পিছু পিছু হাঁটে বিরহ। বড় বড় লরি হোক কি দূরপাল্লার বাসের ড্রাইভার, সকলেই আধুনিক মাঝি। মাটির মাঝি। তাদের হাতে এসেছে মোবাইল। মোবাইলের ওপারে থাকে মালতি আর শেফালিরা। বিশ্বকর্মা পূজার দিনটা হল ‘পিয়া মিলন কি রুত’। 
   আজ গাড়ির হ্যান্ডিম্যান রাতেরবেলা বেশ কালো সানগ্লাসটি চোখে লাগিয়ে মালতিকে সাথে নিয়ে, মাথার চুল তেল দিয়ে স্পাইক করে বেশ গম্ভীরভাবে হেঁটে যায়। পৌরুষবশত সে হাঁটে আগে আগে আর মালতি দু-কদম পেছন পেছন, তারা ‘ভুগনি বিরানি’ খায়। হঠাৎ হাইহিল আর সেই নায়কের ক্রমাগত আঁধারের দিকে নিয়ে যাবার প্রবণতায় জেরবার মালতি শুধু এটুকু বলতে পারে, ‘ না গো, না গো, তইলে বাড়িত যামুগা।’

  এইসব অষ্টবক্র নাচিয়ে, বারো চুয়ান্নর ড্রাইভার, আঠাশ একত্রিশের ক্লিনার, গাড়ি ধোয়ার গ্যরেজের ‘পেডেভাতে’ কর্মচারি, মালতি, হ্যান্ডিম্যানদের নিয়ে আমাদের বিশ্বকর্মা আসেন। ফাঁকতালে একটু উঠতি শহুরে যুবকেরাও পূজার আগে একটা স্টেজ রিহার্সাল মেরে দিতে পারে। কোনও বন্ধু বাড়ি ফেরার তাড়া দিতেই হয়তো সে-ও বলে, ‘বিশ্বঅরমা রে আরেকটু নাইচ্চা লই।’ জয়বাবা বিশ্বকর্মা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন