মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১৭

কু

অশোক দেব
কু
তুমি আমার লুম্বা। লুম্বা। এটা সদানন্দের প্রিয় গালি। কিন্তু যত গালাগাল সব বুকে বুকে। মুখে নীরবতা, আমতা আমতা এবং সর্বদা ভ্যাবাচেকা-খাওয়া একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখে সদানন্দ
 না সদানন্দবাবু, আমার মনে হয় ড্রপ-আউটই লেখতে অইব।
  আমার লুম্বা লেখতে অইব। মনে মনে বলে সদানন্দ। অথচ পাঁচবার ইয়েকয়েকবার তোবারদুই না মানেএসব বলে, মুখে বলে, স্যার যে মাইয়ার বিয়া অইয়া গেছে, তারে ড্রপ-আউট স্টুডেন্ট দেখানডা কি ঠি অইব? তারে তো আমরা আর ডাইক্যা আইন্যা পড়াইতে পারতাম না। বিয়া অইয়া কই গেছে, কেডা জানে?
 তাইলে? প্রশ্ন করে হেডমাস্টার
— তাইলে লুম্বা গনো বইয়া বইয়া। তুমি হেডমাস্টার। তোমার পাডা তুমি গলা দিয়া বলি দেও, নইলে পাছা দিয়া, আমার কিতা? আবার নীরবে বকে দেয় সদানন্দ।
পড়াশুনো নিয়ে এই এক তুঘলকি চলছে আজকাল। ছাতার হেডমাস্টার, কিচ্ছু বোঝে না, জানে না কিছু। তার ওপর এই সর্বশিক্ষা অভিযান। আজ এক সার্কুলার আসে, কাল সেটা পাল্টে যায়। সদানন্দ এই প্রত্যন্ত এলাকার একমাত্র হাইস্কুলের ইংরেজির শিক্ষক বিজ্ঞানের শিক্ষক, কিন্তু পড়াতে হয় ইংরেজি। তার ওপর আবার যাবতীয় অফিসিয়াল চিঠিপত্রের বঙ্গানুবাদ করে হেডমাস্টারকে বোঝানো এবং তাদের জুৎসই জবাব লিখে দেবার বাড়তি দায়িত্ব।
দুশ ছাত্রছাত্রীর এই বৈরাগীপুর হাইস্কুল। শিক্ষক হিসেবে সুনাম থাকলেও, সদানন্দ বিচ্ছু ছেলেদের কাছে কুমাস্টার। পথেঘাটে, বাজারে, যেখানেই সদা যায়, আড়াল হতে কেউ না কেউ আওয়াজ দেবেই — কু। শব্দটি শুনলেই মাথায় আগুন রে যায় সদার। প্রথম প্রথম, উদয়পুরে, পাড়ায় যখন এর সূত্রপাত হয়, শব্দটি শুনলেই সদা তেড়ে যেত। কীভাবে যে এ ব্যাপারটা প্রচারিত হয়ে সাব্রুমের এই প্রত্যন্ত এলাকায় এসেছে! এখন অবশ্য নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করে সদা। সবসময় পারে না। কখনও কখনও হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। কখনও হেসে ওঠে জোরে জোরে। আবার মাঝে মাঝে প্রতিশব্দ করে — কু। তাতেই উৎসাহ পেয়ে যায় লোকে। সদা বোঝে। কিন্তু কোনওভাবেই এ শব্দটার আওতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না
প্রায় গৃহবন্দী জীবন তাই সদার। রবীন্দ্রসংগীত শোনা, গল্প কবিতা পড়া। আর অদৃশ্য অবাস্তব এবং স্বপ্নের প্রেমিকাকে চিঠি লেখা। এই তার যাপন। প্রায় চল্লিশ পেরিয়ে গেল। জীবনে প্রেম আসেনি সদার। বিয়ে হল না। পাঁচ দিদির পরে একটি ভাই সদা। বাড়িতে সারা জীবন সে কনিষ্ঠ। দিদিদের ভাই। তাদের বিয়ের পরে একজন করে অভিভাবক আরও বেড়ে গিয়েছেবড়দা, রাঙা, মিষ্টিদা, সোনাদা, ছোড়দা  সব জামাইবাবু। বাবা সারা জীবন অফিস আর কর্মচারী সমিতি করে কাটিয়েছেন। মা ঠাকুর ঠাকুর আর শুচিবায়ু নিয়ে। এখনও এই পঁচাত্তর বছর বয়সেও মায়ের শুচিতার দোষ কাটেনি। এর মধ্যেই দারুণ মেধাবী দিদিরা নিজেদের যোগ্যতায় সকলেই ভালো ভালো চাকরি করে। সবাই প্রেম করে আরও ভালো চাকুরির স্বামী নিজেরাই যোগাড় করেছে। সদার হল না। মেয়ে দেখা হয়েছে বহু। কিন্তু পারিবারিক মিটিঙে ভেস্তে গেছে সব। এ দিদির কাছে মেয়ের নাক পছন্দ হয় না, তো, সে দিদির কাছে স্টেটা জুৎসই লাগে না। তার ওপর জামাইবাবুদের নানারকম রসালো মন্তব্য যোগ হত, দেখা ও দ্রষ্টব্য মেয়েটিকে নিয়ে। এসব ছাপিয়ে আজ পর্যন্ত বিয়েতে যেতে পারেনি কোনও আলাপ।এখন ওসব বাদই দিয়েছে তাই।
সেই থেকে এই খাতাগুলিতে সদানন্দের প্রেমিকারা বন্দী। সে চিঠি লেখেঃ
প্রিয় শ্যামলী,
চাঁদ উঠেছে। তুমি এলে না, তবুও পূর্ণিমার চাঁদ কেমন সুডৌল। বাড়ি থেকে দূরে, এই গ্রামে, ভাড়া বাড়িতে আছি। মাটির ঘর। জানালার ওপাশে বিশাল মাঠধানের। মাঠজুড়ে শ্রাবণপূর্ণিমার চাঁদ। আকাশ জুড়ে চাঁদ উঠেছে ওই মাঠে। জানালার সামনে দিয়ে একটি জোনাকি একবার এদিকে একবার ওদিকে ওড়াউড়ি করছে। এই দুনিয়া-ছাপানো জ্যোৎস্নাতেও তার আলোটি দেখতে পাচ্ছি। একটুও ম্লান হয়নি সে। যতই বল, আলো আলোকে খাটো করে না। হয়তো নিজের মধ্যে মিশিয়ে নেয়। চাঁদের লোর কাছেও জোনাকির আলো নগণ্য নয়, একটুও। যেমন তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা, আমার প্রেম। দীপের আলোর মত যা আমাকে দীপ্ত করে ...
— কু, বাইরে থেকে কেউ আওয়াজ করে। কলম থেমে যায় সদার। তোর মারে কু... সদা মনে মনে বলে। তার ক্ষোভ কখনোই উচ্চারিত হয় নাবড়দি বলত, তোমার কারণে যাতে কারও কথা শুনতে না হয়। চুপচা যাইবা, চুপচপ আইবা। কোনও কথা না। কারোর লগে না’ সদা সেই থেকে একপ্রকার ক্ষীণবল হাসির অধীন। এ হাসি সর্বদা ঝুলে থাকে তার ঠোঁটে। এখন, বারদুয়েক তবুও, জোরে জোরে কু, কু শব্দ করে আলো নিভিয়ে দেয় সদানন্দ। বাড়িওয়ালির ঘর থেকে ছেলেমেয়েদের জোর হাসি শোনা যায়। মাদী মালকিনটাও হাসিতে যোগ দেয়।
মিষ্টিদা, জামাইবাবুদের মধ্যে সবচেয়ে হুল্লোড়বাজ। বিলোনীয়া বাড়ি। এখন উদয়পুরেও বাড়ি করেছে। বিয়ের ক’দিন পরে সদাদের বাড়ি এসে এক বেলার মধ্যেই পাড়ার ছেলেদের প্রিয়পাত্র হয়ে যায়। সবাই জামাইবাবু বলতে অজ্ঞান কিভাবে যে মানুষের সঙ্গে এমন মিশে যায় মানুষ! ক্লাবে ক্যারম খেলার আসরে মিষ্টিদার জয়জয়কার। ঘণ্টার পর ঘণ্টাসেবার ষষ্ঠিতে এসে দিদিকে বাড়িতে দিয়েই বেরিয়ে যায়। সদা কোথা থেকে আসছিল। ক্লাবের সামনে আসতেই ভেতর থেকে ডাকে মিষ্টিদা —
কু, সদা এদিকে আয়
সদা ক্লাবের ভেতরে যায়। জীবনে সেই প্রথমদিদিদের বারণ ছিল। দুটো বড় বড় পাতিলে দই এনেছে মিষ্টিদা। হাতে তুলে দিয়ে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলল। সদা দইয়ের পাতিল নিয়ে বাইরে আসে। মুখে সেই ভ্যাবাচেকা মার্কা হাসি। একটু এগোতেই মিষ্টিদা আবার ভেতর থেকে ডাকে
 কু
সদা দাঁড়ায়, তাকায়। মিষ্টিদা হাতের ইশারায় কাছে যেতে বলে। সদা যায়।
— একটা মিষ্টি দই, আরেকটা টক। বড়দিরে কইস টক দই দিয়া মাংস করতো, কেমন?
সদা ঘাড় হেলায়। বেরিয়ে আসে। কিছুদূর যায়। ভেতর থেকে আবার শব্দ আসে  —  কু
আবার থামে সদা। তাকায় মিষ্টিদা জোরে জোরে বলে, আমি গিয়াই মাংসডা করুম, দিদিরে কইস। দই ফ্রিজে তুইল্যা রাখিস, আমি আইতাছি’
সদা এই র‌্যাগিঙে বিরক্ত হয়। তবুও ঝুলিয়ে রাখে হাসি। আর ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায়। হাঁটতে শুরু করে বাড়ির দিকে। আবার আওয়াজ আসে — কু। সদা দাঁড়ায়। ক্লাবের দিকে তাকাতেই সবাই একসাথে হেসে ওঠে। এবার আওয়াজটা করেছিল ক্লাবের একটা ছেলে, মিষ্টিদা নয়। ঠিক তার পরের দিন থেকে ক্লাবের সামনে দিয়ে যেতে গেলেই  —  কু। 
সদার জীবনে অভিশাপের মত যুতে যায় এই শব্দটি। প্রচারিত হয় প্রায় সারা শহরে। এখন নিজের শহর ছেড়ে এসে গেছে গ্রামে, কর্মস্থলে। শেয়ালের ডাকের মত বিচিত্র এই শব্দটি সদানন্দের মূল ধরে টান দেয়। সদা অসহায় হাসি ঝুলিয়ে রাখে মুখে।

দুই.
সকাল। ঝমঝমে বৃষ্টি হচ্ছে। শ্রাবণধারা। লুম্বা ঘরটা এইবার ছাইরা দিমু। টিনের কোথাও ছেঁদা হয়েছে সেই কবে। গতবার থেকে জল পড়ে। বাড়িওয়ালিকে বারবার নালিশ করেও কাজ হয়নি। প্রথমে এখানে আলনাটা ছিল। গত বর্ষায় সেটা সরানো হয়েছে। গত শীতেই চোরাই সেগুনের টেবিল কিনেছে একটা। সেটার স্থান হয়েছে ছেঁদার তলায়।ঘুম ভাঙতেই সদা ছুটে টেবিলে আসে। জল পড়ে ছেৎরে গেছে গতরাতের লেখা প্রেমপত্র। মেজাজ বিগড়ে যায়। মনে মনে। মুখে সেই হাসিটি ফুটিয়ে ছাতা বার করে বাড়িওয়ালির ঘরে আসে। আবার আমতা আমতা। জল-পড়া ছাতাটি হাতে নিয়েই ঘরে ঢুকে গিয়েছিল সে। ছাতা থেকে জল পড়ছে। বাড়িওয়ালিকে চরম কথা শোনাবে, এই ছিল ইচ্ছা। কিন্তু জল-ঝরা ছাতা নিয়ে ঘরে ঢুকতেই বাড়িওয়ালি খেঁকিয়ে উঠল, ‘বাইরে বাইরে, জল দিয়া ঘরটারে ভাসাইয়া লাইাতছে, দেহ, আক্কল নাই...
দুইবার সরি সরি বলে ঘরে ফিরে আসে সদানন্দ। টেবিলের উপর স্টিলের গামলা বসায় জল বরাবর। মনে মনে বলে, লুম্বা বেডি, ছাতির জলে ভাইস্যা যায় তুমার ... আস্তা ছাতি...
সদানন্দ আজ বাড়ি যাবে। উদয়পুর। তিন ঘণ্টার জার্নি। কাল স্বাধীনতা দিবস, পড়শু জন্মাষ্টমী, পরদিন একটা সিএল নেবে, তারপর দিন আবার মনসা পূজা উপলক্ষে লোকাল হলিডে। একেবারে রবিবার পর্যন্ত ছুটি কাটিয়ে আগামী সপ্তাহে স্কুলে আসবে। আজ মঙ্গলবার, পরপর দুটি ক্লাস করে সদা বাড়ি যাবে। মা এখন দিদির বাড়িতেই থাকে। বড়দিভাইয়ের কাছে। সদা বাড়িতে গেলে একা। দিদিরা বলে তাদের বাড়িতে থাকতে। সদা যায় না। নিজে রেঁধেবেড়ে খায়। ছাতে বসে একা একা মদ্যপান করে। আর আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। এটুকু বিলাসিতায় সদা কারও শাসন মানে না।
তিন.
একটা কাপড়ের ঝোলা সদার নিত্য সাথী। সাদা শার্ট আর ধুসর ট্রাউজার্স। পার্ক এভেন্যুর ট্রাউজার্স আর অ্যারো শার্ট। এ-সব দামি পোশাকের কৌলীণ্য থাকে না সদার কাছে। কারণ, সে সর্বদা একই রঙের পোশাক পরে। আর, ওই কাপড়ের ঝোলাটি তার পোশাকের মর্যাদা আরও ম্লান করে দেয়।
আজ সদার সিএল। সেদিন ইলিশ কিনেছে। আজ একটু মাংস নিতে হবে। বোতলও শেষ। আরেকটা নিতে হবে। হান্ড্রেড পাইপার্স। এখন বেলা তিনটা হবে। বোতলটা নেওয়া হয়েছে। সদা পিডাব্লিউডি অফিসের সামনে একটা টং থেকেই এসব কেনে। মদের দোকানে যায় না। তাছাড়া ওই কু-এর কারণে সদার বাজার হাট সবকিছুই বেপাড়ায় বেপাড়ায়, অসময়ে, যখন লোকজন কম থাকে। কিন্তু পিডাব্লিউডি অফিসের সামনে রীতিমত একটা ভীড়। এখন অনেক ছেলে ঠিকাদার হয়েছে। বেকার ছেলেরা দল বেঁধে ঠিকাদারী শিকার করে। ভীড়টা দেখেও সদা এগিয়ে যায়। এছাড়া আপাতত তার যাবার রাস্তা নেই। মুখে তার ম্লান হাসিটি আছে। আগাম প্রস্তুতি হিসেবে কান বন্ধ রাখছে মনে মনে। হঠাৎই হৈচৈ বাড়ে। ভীড় বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। সব কুড়ি থেকে তিরিশ বছরের ছেলে ছোকড়া। ঠিকাদারদের আজ কোনও টেন্ডার ফেন্ডার জমা দেবার ব্যাপার আছে হয়তো। একটু এগোতে পারলেই অটো স্ট্যান্ড। একা একটা অটো নিয়ে বাড়ি চলে যেতে চায় সদানন্দ। সহযাত্রী পছন্দ করে না সে। কারণ, কেউ না কেউ অটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে যাবার সময় হয়তো বলে গেল  — কু। সদার অভিজ্ঞতা আছে।
আচমকা উত্তেজিত হয়ে পড়ে ঠিকাদার ছেলেদের দল। স্পষ্টত দুইভাগে ভাগ হয়ে যায় তারা। লাঠিসোঁটা বেরিয়ে আসে। ইঁট ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হয়ে যায়। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে অফিসের দোতলার কাচ। প্রচণ্ড শব্দে ফাটে একটা হাতবোমা। কোত্থেকে একটা পুলিশের জিপ স্পিডে এসে দাঁড়ায় এর মধ্যে। সদা রাস্তার একদম ধার বরাবর দ্রুত হেঁটে পেরিয়ে যেতে চেষ্টা করে। আরও কয়েকজন পথচারী ইতোমধ্যে তার পাশ দিয়ে চলে গেছে। সদা ছুটতে জানে না। পুলিশের গাড়ি দেখে প্রাণপণ পালাচ্ছে ছেলেরা। সদার একদম গা ঘেঁষে একটা ছেলে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ আসতেই তার ঝোলায় কিছু একটা গুঁজে দিয়ে পালালো। জিপ থেকে তড়িঘড়ি একটি পুলিশ নেমে সদাকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে বলেই ছেলেদের দিকে ছুটল। পুলিশটি হয়তো সদাকে দেখেই বুঝেছে ঠিকাদারী ঝামেলায় সে নেই। অটো স্ট্যান্ডে এসে একটা অটোতে শেষব্দি উঠতে পারে সদানন্দ। অটোও পালাতে উদ্যোগ নিচ্ছিল। সদা উঠতেই সে ছুটতে শুরু করল।
লুম্বা ঠিকাদারি। লুম্বা টেন্ডার। এতক্ষণে, সদা টে পেল, তার হৃৎপিণ্ড গলায় আটকে ছিল ভয়ে। এখন হাল্কা হয়ে গালাগাল করে নিচ্ছে। মনে মনে। বৃষ্টির জলে ভাইস্যা যায় কোটি টাকার ব্রিজ। আমার লুম্বার উন্নতি। দুর্নীতি, দুর্নীতি। সদা প্রাণভরে গাল দেয়। মুখে সেই ভ্যাবাচেকা হাসিটি।
চার.
ঘরে এসে ঝোলাটোলা রেখে স্নান করে নিল সদানন্দ। আবার। জোরে চালিয়ে দিল গান। সন্ধ্যা হচ্ছে। দূরে গোমতীর কোলে নেমে যাচ্ছে সূর্য। ছাতে উঠে এসে তাকিয়ে আছে সদানন্দ পশ্চিমে। একা একা এই থাকার মধ্যেও একটা আনন্দকে বোঝার চেষ্টা করে। কোনও দুঃখ নেই তার। হয়তো আছে। সদা নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, তেমন কিছু না।
সন্ধ্যা হয়ে গেলে ঘরে এসে ঝোলা থেকে সব বার করার উদ্যোগ করে। মাংসের পলিপ্যাক আগেই ফ্রিজে রেখেছে। রান্নার আগে একটু মদ্যপান করে নেয়া যাবোতল বের করে টেবিলে রেখে, ঝোলাটা হুকে তুলে রাখতে গিয়েই অবাক হয়ে যায়। ভেতরের জিনিসটা দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায়। মেরুদণ্ডে জমে যায় বরফকুচি। একটা পিস্তলতাড়াতাড়ি রাস্তার দিকে জানালা বন্ধ করে দেয়। খাটের নীচে বাবার আমলের একটা ট্রাঙ্ক। সেখানেই ঢোকায় সেটাকে। ছেলেটা এই পিস্তল গুঁজে দিয়েছিল তখন!
উত্তেজনায় বড় বড় দু’পেগ হুইস্কি খেয়ে নেয় সে। মাথা টলছে। বড় আলোটা নিভিয়ে ছোটটা জ্বেলে দেয়। এবার ট্রাঙ্ক থেকে পিস্তল বের করে। ঠান্ডা। প্রায় দেড় কিলো হবে ওজন। গায়ে কোম্পনির নাম লেখা। ব্রাউনিং। ট্রিগারটা টানতে চেষ্টা করল সদা, না টাইট। এটা কি ভরা? লোডেড? এক হাতে বোতল, অন্য হাতে পিস্তল আর গ্লাস নিয়ে ছাতে আসে সদা। পিস্তলটাকে সিনেমার নায়কের মত তর্জনীতে ঘোরাবার চেষ্টা করতে করতে নেমে গিয়ে জল আর সোডা আনল। দুএকবার কাল্পনিক শত্রুর দিকে তাক করে গুলি ছোঁড়ার অভিনয় করল। ছাতে এখন একটু করে চাঁদের আলো ফুটছে। টেবিলের একপাশে পিস্তলটা রাখা। পা ছড়িয়ে একটা গার্ডেন চেয়ারে বসে ধীরে ধীরে পান করে হুইস্কি। মুখের হাসিটি ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। জ্বলছে চোখ। একটু একটু করে গড়িয়ে যাচ্ছে রাত। রাতের খাবার খেয়ে পাশের বাড়ির কলতলায় কেউ মুখ ধোয়বারবার ওয়াক থু, ওয়াক থু করছে। বিশ্রী। মেজাজ বিগড়ে যায় সদানন্দের চিৎকার করে ওঠে সে, বাস্টার্ড, স্পিট অন ইয়োর মাদার্স কান্ট, ইউ ব্লাডি সান অব আ বিচ...বলেই অবাক হয়ে যায় সদা। এ কী করেছে সে? চিৎকার করে গালাগাল করেছে সদানন্দ?হঠাৎ খুলে গে জ্বালামুখ? সদানন্দ খুলে ফেলে লুঙ্গি। মাথার ওপর পিস্তলটা তুলে ধরে। সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে, কু, কু। যেন চাঁদে-পাওয়া কোনও বুনো শেয়াল। ক্ষুধার্ত। রক্তপিপাসু। প্রতিশোধকামী।
ভোরের দিকে ঘরে নেমে আসে সদানন্দ। মাথায় তার পরবর্তী ছক আঁকা হয়ে গেছে। এক বীভৎস, ভয়ঙ্কর, ধ্বংসের পরিকল্পনা। পিস্তল হাতে উলঙ্গ সদানন্দ প্রথমে বড়দিকে ফোন করে
— হ্যালো বড়দি? লুম্বা স্টেটাস দেখাইলা এতদিন। ভাই কেমন আছে খবর নেও নি? সকালে বাড়িত আইয়ো। কথা আছে, ঠিক সাতটায় আইবা। স্বার্থপর কোথাকা
ফোনের ওপারে এক বিহ্বল নীরবতা। ধাক্কা খেয়ে বড়দিভাই একটু আমতা আমতা করল। সদার হাসি পেয়ে যায়তারপরই ফোন করা হল মিষ্টিদাকে, হ্যালো ... কু... আমি সদা। শালারপুত, ‘কুকইরা ডাকো তুমি আমারে? সকাল সাতটায় আমার বাড়িত আইবা, কথা আছে। লুম্বা গাড়ি কিনছো বলে’?
ফোনের ও-প্রান্ত জুড়ে অবিশ্বাস, কেডা...কেডা তুমি?’
 আরে আমি, কু, মোবাইল টু মোবাইল, নম্বর দেখ, শুয়োরের ছাও।
একে একে সবাইকে ফোন করে সদানন্দ। শেষ ফোনটা করে স্কুলের হেডমাস্টারকে, ‘এই বুরবক, মূর্খ, লুম্বা, আমি সদানন্দ কইতাছি। সোমবার ইস্কুলে যাইতাম না, জেলে যামু। তোর লুম্বা ইস্কুল তুই সামলাইছ, ক-অক্ষর গোমাংস, মূর্খ...তারপর একটু পায়চারি করে ঘরের ভেতর। সারা শরীর যেন ঘৃণার বাষ্পতাপে জ্বলছে। একটু মাথা ঠান্ডা করে নিতে চায় সদানন্দ। সবটা কাজই করতে হবে ঠান্ডা মাথায়। টিভিটা চালিয়ে দেয়। দিনরাত খবরের চ্যানেল। মাফিয়ার সঙ্গে কেন্দ্রীয় গৃহরাজ্যমন্ত্রীর ফোন যোগাযোগ দেখানো হচ্ছে সবিস্তারে। সদানন্দ আরও ক্ষেপে যায়। ভোর পাঁচটাতেও দুর্নীতি? টিভির দিকে তাক করে পিস্তল চালায়। চলে না। কোনও একটা মেকানিজম বুঝে উঠতে পারছে না সদানন্দ। সকাল সাতটার আগেই সেটা রপ্ত করতে হবে।
পাঁচ.
সাতটা এখনও বাজেনি। দিদিরা সবাই এসেছে। বাড়ির গ্রিলে ভেতর থেকে তালা। কেউ বুঝতে পারছে না। ছোট মত একটা ভীড়ও হয়েছে বাড়ির সামনে। পাড়ার লোকজন। সবার চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। কাল রাতে নাকি প্রচণ্ড চেঁচামেচি করেছে সদানন্দ। একা একা। এরকম আর কখনও হয়নি। মিষ্টিদা সবার শেষে এসেছে। গ্রিল ভাঙা হল, দরোজা ভাঙা হল। মেঝেতে উবু হয়ে পড়ে আছে সদা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। হাতে পিস্তল। কে একজন বলল, টা নাগাদ গুলির শব্দ শোনা গেছে।

(গল্পগ্রন্থঃ সদানন্দের অসুখবিসুখ, ২০১১, অক্ষর পাবলিকেশনস, আগরতলা, গল্পটি ২০০৫ সালে রচিত) 

৭টি মন্তব্য:

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. গল্পটি আগে বহুবার পড়েছি। আজ সকালে আবার পড়লাম। গল্পটির ঋজুরেখ চরিত্র মুগ্ধকারী। নির্মেদ এর শরীর। বাচনিক স্বাতন্ত্র্য। আত্মচ্ছায়া স্পষ্ট। এ গল্পে, আমার অনুমান হয়, লেখকের কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোর অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় তাগিদ নেই, জীবন নিয়ে ভয়াবহ একসপেরিমেন্ট করার উদগ্র সাহস আছে। কবিতার রূপোলি জল তাঁর কেশাগ্র স্পর্শও করেনি গল্প লেখার সময়। সেটাই প্রার্থিত। গদ্যকার অশোক শুভায়ু হোন, কাঙ্খা করি। অনিঃশেষ মুগ্ধতা।

    উত্তরমুছুন
  3. ভালো বললে ভালো।অন্যকিছু বললে অন্যকিছু।
    তবে অন্যকিছুটা কি তাও জানা নেই।

    উত্তরমুছুন
  4. আগে যখন পড়েছিলাম তখনকার মতই একই অনুভূতি আচ্ছন্ন করল পুনঃপাঠে l নিরাসক্ত নির্লিপ্ত গল্পের বুনন l সদানন্দ মরার আগে এত স্বাভাবিক বেঁচে ওঠে যেন আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে সে...লেখক,তোমাকে স্যালুট

    উত্তরমুছুন
  5. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন