মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০১৭

অশোক দেব
সদাপুরাণ-৯
নবকুমার ঘুঙুর হইলেন গিয়া প্রথম ঘুঙুর। তাইনের আগে জগতে কুনু ঘুঙুর আছিল না। গোমতীর থিকা একটা চিকন ছরা  আৎকা কইরা বাইর হইয়া গেল। যুমুন গোমতীই তারে ত্যাজ্য কইরা দিছে। আবার ওই একটু পরে নিজেই নিজের বুকের পানি ডাইক্যা কোলে তুইল্যা নিল। হেই ছরার নামও ঘুঙুর। এই ঘুঙুর আর গোমতীর মইধ্যখানে ধনুকের মতন যে চরা পড়ছে, হেইডা একটা গেরাম হিডার নামও ঘুঙুর। বছরের বেশির ভাগ সময় জলপানিতে প্যাক প্যাক হইয়া থাহে। এল্লিগ্যা কেউ বসত করল না। কই থিকা একদিন এই বেডা আইলো। নবকুমার। তাইনের নাম নবকুমার ঘুঙুর। তাইনে য্যান ইহানে আইছে, কেউ কইতে পারত না। না আমরা, না দেশের কেউ। বেডা একলা। তাইনেও আইলো চরাও শুকনা। প্যাক নাই কাদা নাই। বেডা চাষবাস করে না। ভিক্ষাও করে না। শুধু কই কই ঘুরে।  যে গেরাম দিয়ে ঘুইরা যায়, হেই গেরামে মাইনসেরে কিয়ে জানি পায়। তাইনের পিছন পিছন পুতুলের মতন হাইট্যা যায় মানুষ। যুমুন জাদু করছে। হগলে যায় না। দুনিয়াত কিছু কিছু মানুষ আছে ঘুঙুর স্বভাবের, তারা যায়। নবকুমার ঘুঙুরের পায়ের মইধ্যে  সোনার ঘুঙুর ঝুলে অনেকটি বান্ধা না, হইয়া রইছে। যুমুন গাছের শরিল থিকা ফুইটা থাকে অনন্তশয্যা ফুল, তেমন। নবকুমার হাইট্যা গেলে ঝমক ঝমক, রুনুর ঝুনুর। আমি অক্করে সিউর, হেই ঘুঙুরেই জাদু আছে।
তয়, আমি একদিন করলাম কিতা, ধরলাম গিয়া বেডারে । ক্যামনে জানি আমার মুখ দিয়া বাইর হইয়া গেল, গুরুদেব। হেই থিকা গুরুদেব ডাকি। জিগাই, নাম কিতা আমনের? বেডা কয় নবকুমার, নবকুমার ঘুঙুর। চোখ দিয়া চায় নাথুইয়া রাখে চোখ দুইডা। য্যান দেখনের আর কিতা আছে এই জগতে? যার যার তাইনেরে দেখানের ইচ্ছা, তা তা তাইনের চক্ষের সামনে আমনেই ভাসব। তহন অনেকেই আইয়া ঘুঙুরে নয়া একটা গেরাম বানাইয়া লাইছে। পুরুষ স্ত্রীলোক সবই আছে। কই থিকা এত ফকফকা সব মানুষ আইছে কেউ জানে না। সবাই ঠাউর দেবতার মতন। বেডিডি সব হুরি।পরী। যার লগে যার দেহা হয়, বুকে টাইন্যা লয়। বাইচ্চার মতন আদর করে। হগলে, হগলেরে। নারী পুরুষ ভেদাভেদি নাই। যুমুন মানুষ হগলে। এরা জানি কেমন, দেখলে মনে হয় সেবার থিকা আইছে, মনে হয় সব বুঝি কই জানি যাইবকই জানি কোন গানর আসরে যাইব তারাসবাই ঝিম মাইরা থাহে। গান গায়
   যদি তুমি একটি সত্যের সন্ধান পাও, তোমার পায়ে একটি সোনার ঘুঙুর আপনি জুড়ে যাবে।
এত কঠিন ভাষা তো আমি বুঝি না, ছাতা। বেডা কয়। আমি হুনি আর জিগাই, ‘কেডা পিন্দায়া দেয়, ঘুঙুর? কই থিকা আইয়েসইত্য কিতা?
   তুমি সত্য, আমি সত্য। আবার আমরা কেউই সত্য না।
আমি লাজে মইরা যাই। বেডায় আমারে ধইরা লাইলো নিকি? মিছা দিয়া বানাইয়া আমি য্যান এই আছি, হিডার কতা কয়? আমি কি একটা মিছাকতা?
   গুরুদেব আমার পা-ও কি ঘুঙুর দেওন যায় একখান? বড় সোন্দর, মিঠা আওয়াজদিবেন?
   আমি তো দেবার মালিক নই। তুমি চেষ্টা করো সত্যের কাছাকাছি যেতে। তোমাকে তিনি ঠিক ঘুঙুর পরিয়ে দেবেন। একটা সত্য কথা বল তো দেখি।
   আমি একদিন মরুম
আৎকা ফট কইরা এই কতা বাইর হইয়া গেল। আর এই ডান পাওডাত একটা আরাম অইলো। হেরপরে দেহি ঘুঙুর। ইট্টু কতক্ষণ আছিলো, হের পরে নাই।
   গুরুদেব, গেলো গা দেহি?
   তিনি দেন, তিনিই ফিরিয়ে নেন। তুমি তো অর্ধসত্য বললে, তাই...
   কেডা? কেডা দেয়, কেডা নেয়, পুরা সইত্য কিতা?
   সেটাই জানার চেষ্টা কর আগে। তাহলেই হবে।
এই কতা হুইন্যা আমি আইয়া পড়ছি। ঘুঙুরে যাওন, ঘুঙুর থিকা আওনও বড় এক রঅইস্য। ঘুঙুর যামু কইয়া তুমি গাঙের জলে পাও দিবা, জল কইম্যা ইদ্দুর। হাইট্যা যাইবা গা। গিয়া যেই ঘুঙুরের মাডিত পাও রাখবা, গোমতী আবার বোগলাইয়া বোগলাইয়া উঠব।
একবার ত রাইত্তা বেলা গেলাম। গিয়া দেখি সাপের মণি ঘরে ঘরে। য্যান কারেন্টের লাইট। ফকফকা আলো। হগলেই গান গায়। হুনা যায় না এমুন গান। গুরুদেব নাই। আকাশে দুইখান চান। এক চান্দে পুন্নিমা, এক চান্দ ঈদের। আমি ফিট হইয়া গেলাম। পরে যে ক্যামনে বাড়িত আইছি, মনে নাই।
আজ এলাম এই ঘরে। সদানন্দের ঘর। নন্দ দারোগার কাছে যাই আজকাল। আমাকে সদায় পেয়েছে। নন্দদাকেও। সদানন্দ যে মরে গেল, সেটা তার দিদিরা ভুলে গেছেভুলেছে  তার জামাইবাবুরাও। যতদিন সদার মা ছিলেন, ততদিন এই বাড়িতে এসে মাঝে মাঝে থাকতেন। এখন আর কেউ নেই। খালি। পুলিশ সিল করলো, এই বলে নন্দদা এই ঘর দখল করেছেন। মাঝে মাঝে আসেন, আর সদানন্দকে খোঁজেন। যেমন যেমন ছিল ঘরটা, তেমন তেমন রাখেন। কী বিচিত্র ছিল এই ছেলে! এতক্ষণ যে অংশটা বললাম, ওই ঘুঙুর, সেটি একটা খাতার অংশ। সদা লিখে রেখেছে। নাম রেখেছে, ‘গপিস্ট বুড়ার কল্পজগৎ’। সেই খাতাটার একটা ভূমিকার মতনও লিখে রেখেছে সে।
‘অনেক কল্পনা জমে গিয়ে একটা মানুষের জন্ম হয়। রহিম মিয়াঁও এরকম একটা মানুষ। গপিস্ট। নিজেকেই তিনি সারাক্ষণ কল্পনা করেন। যে তিনি আছেন, তাতে তাঁর হয় না। তিনি কল্পিত রহিম মিয়াঁ হয়ে থাকতে চান। আর চোখ ঢুলু ঢলু করে সেসব বলেন। পৃথিবীর প্রতিটি জীবন আসলে গল্প, গপ। রহিম মিয়াঁ গপ বলেবাস্তব রহিম মিয়াঁ নিজেকে সাজিয়ে রাখেন। মিথ্যা সোনার চশমা পরেন, মিথ্যা কোরআন উদ্ধৃত করেন। মিথ্যা দামি হুঁকো সাজানআমি যাই তাঁর কাছে। বসে সব শুনি। কী অসাধারণ তাঁর কল্পনাশক্তি! তিনি যে যে কথা বলেন, তা যদি সত্যি হত, তাহলে এ পৃথিবী আরও আনন্দময় হত। তাঁর সব কথা এইখানে লেখা থাক’
আমি আর নন্দ দারোগা এই ঘরে এসে বসি। সদানন্দের ঘর। এই ঘরটাতেই বেশি বেশি সদানন্দ। বেশি করে উপস্থিত। সব তকতক ঝকঝক।বই, বই, বই আর বই। পড়ার টেবিল, দামি টেবিল লাইট। দেওয়ালে অনেক সুভাষিত লেখা। কত রকমের।
‘যে মানুষ মাথা নিচু করে হাঁটতে শিখেছে, সে নিজের পা দেখতে পায়। দেখতে পায় কোথায় দাঁড়িয়েছে’
   সদানন্দ দাশগুপ্ত
‘পৃথিবীর বাতাসে কথা ভাসে। গুপ্তনাসিকা দিয়ে সেসব নিশ্বাস করতে হয়’
   সদানন্দ দাশগুপ্ত
এমন স্বরচিত বাণী সে লিখে রেখেছে। বাঁধাই করে দেওয়ালে লাগিয়ে রেখেছে।
‘একা হতে হতে এমন হতে হবে যাতে, নিজের কথা স্পষ্ট শোনা যায়’
   সদানন্দ দাশগুপ্ত
আমি এইসব দেখি। তাহলে যে সদানন্দ লিখত, সে কেমন? ওই গপিস্ট বুড়া, ওই লালুমজিদ, জরিনাদের এত কাছের থেকে দেখেছে সে। তাদের কথা লিখে রেখে গিয়েছে সে লেখক সদানন্দ কেমন ছিল? একা? কতটা একা? সে নিজের কথা স্পষ্ট শুনতে পেত?
নন্দ দারোগার ভাব এমন যেন, এটি তাঁর মালিকানা। সদানন্দের ঘরবাড়ি, তার এইসব জিনিসপত্র, সবেতে যেন তাঁর অধিকার, একার। এদিকে বসলে মানা, ওদিকে যেতে গেলে, সাবধান সাবধান।
   দাদা, এইসব জিনিস তো ছাপান দরকার। মাইনসেরে জানান দরকার... বলি আমি
   একদম, একদম, এল্লিগ্যাই তো আপনেরে আনি। আসলে কিতা জানেন?
   কন
   সদানন্দ একটা অলটারনেটিভ জীবন বাইছ্যা নিল। ওই আমরার যন্ত্রণায়, ইনসেনসিটিভ সমাজের যন্ত্রণায়যেদিকে যায় হেদিকে কু... একধরনের টুঁটি চাইপ্যা ধরন... আইচ্ছা এই জিনিসটা পড়েন, নেন
আমাকে একটি পকেট ডায়েরি দেন নন্দদা। সদার ডায়েরি। কী সুন্দর হাতের লেখা। এটা আসলে হিসেবের খাতাবিচিত্র হিসেব
১৭-০১-১৯৮৩, সকাল, ডাকবাংলো রোড। ৪+২+২+১, দুটি বাচ্চা ছেলে, একটা রিকাশাওয়ালা, আর বাকিদের দেখা যায়নি।
১৭-০১-১৯৮৩, দুপুরবেলা, বাসে করে যাবার সময়, ২+১, একটা ড্রাইভার, একজন ফেরিওয়ালা
এরকম সব লেখা। ‘এইসব কী হিসাব, নন্দদা’? জিগ্যেস করি আমি
   বুঝলেন না? সদানন্দরে মাইনসে ক্ষেপাইত, রাইট?
   হুম, ক্ষেপাইত
   কী কইয়া ক্ষেপাইত?
   ওই... কুউউ কইরা একটা আওয়াজ দিত... আমিও দিছি দুই একবার...
   হেইডাই... আপ্নেরটাও লেখা আছে। ডেইট দিয়া, কোন সময় কোনখানে, জাগার নাম দিয়া...
   এইসব সদানন্দ হিসাব রাখতো?
   তাই তো দেখতাছেন
   ক্যান?
   হো হো হো, এই দেখেন
বলে ওই ছোট ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠাটা খুলে ধরেন...
‘We live bit by bit… by killing others… bit by bit. I count every bit’
মাথা ঝিম ঝিম করছে আমার। ছেলেটাকে শ্মশানেও ওই কুউ কুউ শুনতে হয়েছে। অবশ্য সে তখন নেই। সে তখন শেষবারের মত জ্বলছিল। তাই সেদিন আর কাউন্ট রাখতে পারেনি... সেদিন শ্মশানে আমার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। আমারও ওই কুউউ শব্দটা শুনে রাগ হল, হয়তো সেদিন থেকেই বাঁচতে শুরু করলাম। বিট বাই বিট...
কেমন নিজেকে অচেনা লাগে। এইসব কিসের মধ্যে আটকে আছি? এইসব হাউস লোন, ইএমআই, ইলেকশন...
নন্দ দারোগার  ডাকছিলেন।শুনতে পাইনি। তাই হ্যাঁচকা টান দিলেন। টেনে একটা ঘরের সামনে নিয়ে আসেন। একটু ছোট সেই ঘর। দরোজার পাশে অফিস ঘরের মত সাইন লাগানো, ‘MATING WITH MUSIC’. আমার ভয় হল, ফিরে চলে আসি সে ঘরের সামনে হতে। সেই খাতাটা খুলি, সেই গপিস্ট বুড়ার কল্পজগৎঃ
আমার বড় পোলাডা কিছুডা ঘুঙুর, কিছুডা সংসারী। বিয়া করে আর ছাড়ে। তে গিয়া ক্যামনে ঘুঙুরে পড়ল।নিয়া আইলো এই জরিনা মা-রে। পারলো না। ক্যামনে পারব? মাইনসে কি পরীর লগে পারে? দিতে গেল তালাক, পারল না। আমি রাইখ্যা দিলাম। মজিদের কাছে দিলাম তাইনেরে। মজিদ আমার পুরা ঘুঙুর...
  কুউ কুউ কুউ
চমকে উঠলাম। কোথা হতে এলো এই শব্দটা? একটু থতমত খেয়ে পরে বুঝলাম, সেই ঘর হতে, ‘মেটিং উইথ মিউজিক’ছুটে যাই। একটা দেওয়াল জুড়ে নিচু একটা শো-কেস। তার ওপরে বিদেশি মিউজিক সিস্টেম। বাজছে। একটা আরাম কেদারা। বসে আছেন নন্দদা। চোখ সজল। আমি ঢুকতেই ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন। নীরবে শুনতে বললেন। মিউজিক সিস্টেমে একটা ফিতার ক্যাসেট পরানো। বাজছে। সদার শান্ত কণ্ঠস্বরঃ
‘সুপ্রভাত সদানন্দ। যাও, নতুন দিনটাকে টুঁটি চেপে ধরো। তুমি একা নও। তুমি দুর্বল নও। এই বিদ্রূপে তোমার কোনও হাত নেই। তুমি একা নও
তোমার সঙ্গে পুরো ঘুঙুর গ্রাম রয়েছেতুমি ভুল করে এখানে চলে এসেছ
একটুক্ষণ চুপ। তারপর সদাই সদাকে বলে, ‘ কুউউউ... কুউউউ...’
সদার সারা ঘরে সেই শব্দ আছুড়িপিছুড়ি হয়ে সদাকে খোঁজে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন নন্দ দারোগা।




অশোক দেব
সদাপুরাণ-
বুনো খরগোশের শুচিবায়ু আছে। স্পষ্ট, মসৃণ পথ ছাড়া তারা হাঁটে না। জলকাদায় যায় না। বানরের পালে থাকে একজন নেতা। গোদা। বানর বাংলা মদ ভালোবাসে। হনুমান তো জাতমদতি। বনরুই পিঁপড়ে শুষে খায়। পুরনো সিঁদল আর রাবগুড়ের মণ্ডে জমা পিঁপড়ে পেলে তো কথাই নেই সারাদিন নিজেই নিজের মধ্যে একটা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে বনরুইযেন এ পৃথিবী একটা কিছু না। গোধূলি হল বনমোরগের জন্য সবচেয়ে বিভ্রান্তির সময়। তখন এদিকে তাড়ালে ওরা ওদিকে যায়। খাটাশ যেদিক দিয়ে হাঁটে, সে জায়গার গন্ধ মৃত্যুর মত। বাইদ্যারা এসব জানে। এরা এলে বন সচকিত হয়ে যায়। জনপদ সাবধান থাকেবাঞ্জারা বালক গাভীর বাঁটের নীচে বসে নিশ্চিন্তে দুধ টেনে খেয়ে নেয়। কিংবা একটা ছোট লাঠি ছোঁড়ে জলের হাঁসের দিকে। ঘুরতে ঘুরতে সে লাঠি গিয়ে হাঁসের ঠিক গলায়হাঁস প্রথমে ডুবে যায়, পরে ভেসে ওঠে। মৃত। টুকে করে তাকে তুলে আনে বাইদ্যা বালক। নিয়ে যায়। তাই সকলে কানখাড়া রাখে।
বাঞ্জারার দল আসে। এরা ঘরে সিঁদ কাটে না, হাজার টাকা পড়ে থাকলে নেয় না। কিন্তু তুলতুলে কোনও পায়রা দেখলে তাকে জাদু করে। আকাশ হতে পেড়ে কোঁচড়ে করে নিয়ে যায়। পৃথিবীর কোন্‌ গভীরে ডুমো ডুমো পিঁপড়েরা সাদা সাদা ডিম পেরেছে তারা জানে। সুরেশ করের পুরনো বাগানের কোন গাছে বস্তার মত ঝুলে আছে মধুভরা মৌচাক, তারা জানে। কার বাড়ির গাভী কখন দুধের তাড়নায় দূরে বেঁধে রাখা বকনাকে ডাকে, জানে তারাতারা জানে কোথায় বসেছে শালিখের আলোচনা সভাএরা যেন বাতাস হতে সেসব সংবাদ পায়।
কিছু পিঁপড়ে আছে পৃথিবীতে, কালো। ডুমো। এদের চেহারা কংগ্রেসের নরসীমা রাওয়ের মত। কজন বাইদ্যা পুরুষ এদের সরু, প্রায়গুহ্য গুহার মুখে সিঁদল আর রাবগুড়ের মণ্ড রাখে। তারপর একটা শিখাবিহীন, জ্বলন্ত কাঠের চ্যালাকে পৃথিবীর গায়ে বোলায়। সে তাপ পিঁপড়ের বাড়িঘর গরম করে দিলে এরা বেরিয়ে আসে। এসেই দেখে সুস্বাদু মণ্ড। লহমায় ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে পিঁপড়েওই গোলক তখন কালো হয়ে যায়। এরা সকল ভুলে বাকিদেরও গর্ত হতে ডেকে আনে। পিঁপড়ে ক্ষুদ্রপ্রাণ, হয়তো নির্বোধ। এরা বুঝতে পারে না একটা বাঁশের আঁকশি করে এদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে শ্যামকান্তি শিকারী। সে এখন গোমতীর ওপারে জঙ্গলে চলে যাবে। এইসব পিঁপড়ের ব্যাঞ্জন সে আবার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করবে। সারাদিন পিঁপড়ে সেই মণ্ডকেই জগৎসংসার ভাবেতারই গায়ে ঘোরাফেরা করেএকটু এদিক ওদিক যায়, নিজেদের বাসাটি খোঁজে। আবার ফিরে সে মণ্ডের গায়ে হুটোপুটি করে।  হয়তো তারা গানও গেয়ে থাকে। এদিকে লতপত করতে করতে বেরিয়ে আসবে বনরুই। পিঁপড়ের আনাগোনা তাকে শুয়ে থাকতে দেয় না। তার ওপর পুরনো সিঁদলের গন্ধ। খাদ্য এমনই লোভাতুর করে। খাদ্যের টান এমনই টান। সে আসে। প্রথমে শুষে শুষে পিঁপড়ে খায়। পরে সবটা মণ্ড খেয়ে ফেলে। খেয়ে কেমন নিস্তেজ হয়ে যায়। কারণ সে মণ্ডের গভীরে ছিল কী জানি কী পাতা। বাঞ্জারা পুরুষ সে মূর্ছিত জন্তুকে নিয়ে ফিরে আসে। এসব আঁশে ঢাকা কিম্ভূত প্রাণী দিয়ে কী করে কে জানে।
 বনে এইসব ষড়যন্ত্র চালাতে হলে বানর আর হনুমানকে শান্ত করতে হয়। নইলে নীচে শিকারী দেখে এরা গাছে গাছে এমন চেঁচামেচি করে, সকল প্রাণী সাবধান হয়ে যায়।  শিকারী বাঞ্জারা সেটি জানে। ওরা সকলেই হরবোলা। সেই বিদ্যা দিয়ে বানরকে ডাকে। হনুমানকে ডাকে। ওরাও ঠিক আসে। প্রথমে দূরে দূরে থাকে। একসময় কী এক জাদুতে পালের গোদার সঙ্গে ভাব করে নেয় বাইদ্যা পুরুষ। মাটির বড় একটা গামলায় সে বাংলা মদ বেড়ে দেয়। একে একে জমে যায় সেই পানের আসর। স্ত্রী, পুরুষ, একেবারে আবালবৃদ্ধবণিতা, সকলেই কিছুক্ষণের মধ্যে নেশায় চুর। পুরো বন খালি করে চলে আসে সব। তারপর এদিক ওদিক ঘুম। মাতাল বানরের নিদ্রা যে দেখেনি, সে জানে না নিদ্রিত বন্যতা কী নিষ্পাপশান্ত হয়ে যায় বন। এই শান্তির মধ্যে স্পষ্ট সরল পথের ওপর মিহি ঘাস ছড়িয়ে দেয় বাইদ্যা।  ছড়িয়ে দেয় কী গাছ থেকে তুলে আনা চাপা চাপা কিশলয়। খরগোশ আসে। খেতে খেতে চলে যায় একটা তারের কুণ্ডলীর মধ্যে। বেড়া বাঁধার লোহার সরু গুণা দিয়ে সেটা বানানো। খরগোশের পেছনের পা লম্বা গোটানো। জড়িয়ে যায় সেই হিজিবিজি তারের গোলাকার জালে। নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে আরও জড়িয়ে যায় খরগোশশেষে লাল লাল ডালিমের বীজের মত চোখ তুলে তাকায় চারদিকে। সে যেন বিশ্বাস করে এখুনি কেউ তাকে মুক্ত করে দেবে। ফিরে যাবে সে। কিন্তু ফিরে যেতে পারে না। মৃত্যুর দিকে যায়। বাঞ্জারা পুরুষের হাতে ঝুলতে ঝুলতে, নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে যেতে যেতে খরগোশের চোখেমুখে এমন ভাব, যেন বাবার সঙ্গে মেলায় যাচ্ছে। কিছু প্রাণী আছে মৃত্যু বলে যে কিছু আছে, জানেই না।
এইসব করে তারা। বাঞ্জারা বাইদ্যার দল। আর তাদের রমণীরা যায় শহরের পথে পথে। গলিতে গলিতে এরা হাঁক দেয়, ‘দাঁতের পোক খোয়াই, মাজার ব্যাদনা সারাই, শিঙা লাগাইকোনও কোনও বৃদ্ধ, কোনও কোনও পুরুষ এই ডাক শুনলে কামার্ত হয়ে ওঠে। বাঞ্জারা রমণীর মত নদীতুল্যা নারী পৃথিবীতে নেই আরশ্যামা। গোমতীর মাটির সঙ্গে রূপার গুঁড়ো মিশিয়ে যেন এদের রূপটি সাজানোপৃথিবীকে ছন্দ শেখাতে এরা হাঁটে। এদের গায়ের ঘ্রাণ এমন এক পুষ্পের মত, যে পুষ্প বৃক্ষাতীত। তারা নিজেরা সেটা জানে। তাই হাঁক দেয়। তাদের কণ্ঠ হতে বন্য উস্কানি ছড়িয়ে পড়ে। আর তখনই দুনিয়া কাঁপিয়ে কোনও পুরুষের মাজা চিড়বিড় করে ওঠে, দাঁতে শিনশিন করে। ডেকে আনে বাইদ্যানিকে।
রহিম বুড়ার এসব নেই। তিনি পুরুষ। তিনি ডাক শুনে ডাকবেন কেন? তিনি নিজে লোক পাঠিয়ে ডেকে আনেন কোনও বেদেনীকে। এবার মিট্টিকেই তাঁর মনে ধরেছে। সে আসে। কর্পূর মেশানো কী তেল যেন মালিশ করে। সারা গায়ে।  সবটা তেল শরীরের অন্দরে ঢুকিয়ে দিতে হবে। পারিশ্রমিক কুড়ি টাকা, প্রতি মালিশ। আর কানে সুড়সুড়ি আলাদাকয়েকটা সরু সরু ধাতব শলাকার মাথায় রুই লাগিয়ে কানের খোলও পরিষ্কার করে মিট্টিসেটার জন্য আলাদা টাকা। তথাপি একিদন রহিম মিয়াঁর কাছে এসব ক্লান্তিকর লাগবে। তার আগে মিট্টির মালিশ, তার স্বেচ্ছাকৃত শারীরিক টুকটাক তিনি সবটা নেবেন। ততদিন নেবেন যতদিন মিট্টিকে তাঁর অত্যন্ত কুৎসিত মনে না হয়। ততদিন, যতদিন মিট্টির গায়ের গন্ধ তাঁর কাছে খাটাশের মত না লাগে।  যেদিন ক্লান্তি লাগবে, যেদিন তার আর এসব ভালো লাগবে না, তিনি খবর পাঠাবেন দূরে। ময়ালে। সেখান থেকে আসবে গহীনকুমার জমাতিয়া, আসবে শুক্লসাধন, আসবে রবিচধ্রি। খাওয়াদাওয়া হবে। মিথ্যা সোনার চশমা পরবেন গপিস্ট বুড়া, তাঁর মিথ্যা হুঁকোতে বৃথা আগুন জ্বলবে। তিনি বলবেন
   কবে তোমরার হুঁশ হইব কও দেখি? বন তো বিধবা কইরা দিতাছে... নিপেনদা জানলে ব্যাপারটা ক্যামন অইব, বুঝনি কিছু... না?
ব্যাস,বাঞ্জারাদের দিন শেষ। গপিস্ট বুড়া নৃপেন চক্রবর্তীকে নিপেনদা ডাকেন।তিপ্রা মানুষের কাছে নৃপেন চক্রবর্তী মানুষ নন। মন্ত্র। গপিস্ট বুড়া সেটা জানেন। তাই নামটা বলেন। সঙ্গে মিশিয়ে দেন একটা নৈকট্যের মিথ্যা। ফল হাতে হাতে।  একদিন গোমতীর চরা হঠাৎ খালি। বাঞ্জারা যে এসেছিল, তার কোনওমাত্র চিহ্ন থাকবে না।
লালুমজিদ তার বাপের এইসব জারিজুরি জানে। কিন্তু মিট্টিকে তারও তো বড় প্রয়োজন। মেয়েটার কাছে গান আছে। আজ সে দূর হতে মিট্টিকে দেখে। সে তার পিতার ব্যাদনার উপশম সাজাচ্ছেকিন্তু সেই গান তো তার শেখা হল না। সেদিন রাতে এক গান মিট্টি গেয়েছিল। এক কন্যা তার বুকের পাতা দিয়ে মুকুট বানাবে। সে মুকুট মাথায় পরবে এক পেশল প্রেমিক। তারপর তারা দূর দেশে গিয়ে হীরামন পাখি শিকার করবে। হরিণের মাংস রেঁধে খাবে। এইসব কথা ছিল সেই গানেসে গানের সুর সোঁদা সোঁদা। মজিদের সে সুর চাই। চাই যে সেটা মিট্টিও জেনেছে। তাই কাছে আসে না। গপিস্ট বুড়ার গায়ে তেল মাখতে মাখতে ইতিউতি স্তনের চাপ দেয়। মজিদকে দেখিয়ে দেখিয়েআর মিটি মিটি হাসে। এদের সমাজে সব কেমন খোলামেলা। কেমন নির্লজ্জ। এদিকে, মজিদের তো  শরীরের চাপ চাই না। গান চাই। মিট্টি যে রাগে রাগাতে চায়, সে রাগে রাগে না মজিদ। বেসুরে বাঁশি বাজায়। একসময় অসহ্য ঠেকে তারসে এগিয়ে যায়বলে
   ইধার আইয়ে
মায়ের ওপর রাগ করা কিশোরের মত সে মিট্টিকে ডাকেযেন তার কত অধিকার! মিট্টি ছাপিয়ে হাসে। হাসে। হাসতেই থাকে। তার শরীরে যতটা পুরুষ, সবটা এক জায়গায় এনে লালুমজিদ চড় মারে মিট্টিকে ব্যাস। যেন ঘুমন্ত সিংহীকে কে আঘাত করেছে। মিট্টি এখন যে ভাষায় চিৎকার করছে সেটা হিন্দি নয়। সে মজিদের প্রায়লাল গায়ে আঁচড়ে আঁচড়ে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে তাকেচড় মারছে, বারবার। চড়ের পর চড়, ঘুঁসিও। হিন্দিতে বলে, ‘শালা না-মরদ কঁহিকা ...’ লালুকুত্তা এসব দেখে হিংস্র হয়েছে। সে প্রাণপণ ছুটে আসছিল। তার প্রভু আক্রান্ত। দূর হতেই সেটা বুঝেছে মিট্টি।খাড়ে রে উধারিসে সরাইল্যাকে আদেশ করে লালুকুত্তা কী বোঝে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে। কুঁইকুঁই করে।
   ক্যা চাহিয়ে বোল, বোল কেয়া চাহিয়ে? বোল শালে...
   গানা... গানা চাহিয়ে... বো বালা গানা, হীরামন বালা ... গাওগে?
যেন কিছু হয়নি। যেন কেউ তাকে হিংস্রভাবে মারছে না। লালুমজিদ এমন ভাবে বলে। সরে আসে। সেই গান একবার শুনে সে যতটা শিখেছিল, সেটাই গেয়ে ওঠে। গান ধরে মজিদআপসে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে চলে আসে প্রিয় চালতা তলায়। গান গায় আর তার দুচোখ কাঁদে। অবিরল ধারা।
জরিনা এসব দেখছিল। তার নাটঢিল স্বামী পরনারীর মার খেয়ে এসে বসেছে। গান গাইছে। কী ভাষার গান এটা? এমন দরদ কোথা হতে আসে? মানুষের কান্নার মত সুন্দর কী কিছু নেই? কী ভাষায় কোন এক বুনো গান গাইছে মজিদ, মানে বোঝা যায় না। অথচ কেমন নেশা ধরে যাচ্ছে। তার পুরুষটি কেমন! কী এত দুঃখ তার? জরিনা বোঝে না। এসে তার মজিদের সামনে বসে। মোহিত হয়ে যায়। যেন পুরুষের আসল কাজ নারীকে মোহিত করা। বৃথাই এরা যুদ্ধে গিয়েছে, বৃথাই এরা পেশী ফোলায়।
মজিদের গান ভুল হচ্ছিল। একবার মাত্র শুনেছিল খালিএক মানুষের গান অন্য মানুষের অন্তরে শুয়ে থাকা গানকে ডাকে। সেই টানে টানেই হয়তোবা গেয়ে ওঠে মিট্টি। কী উদ্ভাস আজ গপিস্ট বুড়ার উঠানে ফুটে ওঠে এই বিষণ্ণ দুপুরে! মজিদের সামনে এসে বসে মিট্টিঅবাক করে দিয়ে জরিনাকে তুলে দাঁড় করায়গান গায়। কী একটা নাচপৃথিবীর মানুষ কখনও নাচেনি সে নাচ করে। আর কাঁদে। সেই গানে কী ছিল... লালুসরাইল্যা সব বোঝে। সে-ও লেজ নাড়ে আর ঘুরে ঘুরে নাচে।
   ইতনা রো তা কিঁউ হ্যায় আপ?
মজিদকে এই কথা বলে চলে যেতে উদ্যোগ করে মিট্টি। পড়ে থাকে তার বেদেনীর ঝোলা, তার সর্বস্ব। পড়ে থাকে সেই কাঁচামিঠে আমগাছের নীচেযাবার আগে একবার কাছে চলে আসে। তার কোমরে রূপার বিছে। শরীরের ঢেউ যেন কী কারণে এইমাত্র পরাজিত। মজিদের কানের কাছে মুখ নেয় মিট্টিজরিনাকে শুনিয়েই বলে, ‘ফির আউঙ্গি, রো নে আউঙ্গি। ফির কব রুলাওগে, জান? রোতে হুয়ে আচ্ছা লাগতা হ্যায়... মালুম নেহি থা... আবার কবে কান্দাইবে... হামি আবার আসবে
জরিনা কী বোঝে, হাউহাউ করে গিয়ে মজিদকে জড়িয়ে ধরে। যেন কে এসে কেড়ে নিচ্ছে বালিকার খেলনা। কে যেন তার আকাশ হতে সাধের পায়রা  জাদু করে নিয়ে যায়কে যেন তার হংসের দিকে ছুঁড়ে মেরেছে অস্ত্র। যেন এই বেদেনী কী এক ফাঁদের লোভে কুণ্ডলী হতে জাগিয়ে তুলছে মজিদকে। সে তার ফ্যাঁৎকাঁদুনে পুরুষটিকে নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে চায়। সান্ত্বনা তো দেওয়া যাবে না। কারণ, মজিদের কষ্টটি তো জানে না কেউ। এদিকে নাটঢিল মজিদও বোঝে না কিছু। সে তার দারোগাবেডির ভাবসাব বোঝে না। তাই গান ছাড়ে না। গান গায়।
,
এইমাত্র ফিরে এলাম গোমতীর চরা থেকে। এই মানুষগুলি অদ্ভুত। এদের যা নেই, তা হল দুঃখ। কারণ, এরা প্রতিযোগিতা করতে জানে না। বসে ছিলাম। ওপাড়ে শ্মশান। সেখান থেকে চিতা ধোয়া আধপোড়া কাঠ নদীতে এসে পড়ছিল। কারা যেন দাহ শেষে চিতা ধোয়াচ্ছে। এদিকে একটু একটা চরায় কিছু মানুষ। এদের নির্দিষ্ট জীবন নেই, তাই বাঁধা শ্মশানও নেই। কিংবা এদেরই আছে প্রকৃত জীবন, তাই এরা মৃত্যুকে হিসাবে রাখে না। শ্মশান হতে মরাকান্না ভেসে আসছে তখনও। যে গেল সে এই শেষ কাঁদাচ্ছে তার স্বজনকে। আর সে কাঁদাতে পারবে না কাউকে। হয়তো তার স্মৃতি কাঁদাবে কিছু কিছু। কিন্তু মৃত মানুষটি আর কাঁদবে না। এটাই তার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল। মৃত্যুর ওপাড়ের মানুষই সবচেয়ে ভালো। কিংবা এমন নির্মল জীবনে যারা ভাসে, এইসব বাঞ্জারার দল, তারাও। কিছু পেতে চায় না, তাই প্রতিযোগিতা নেই। যেমন আমিও পেতে চাই না তোমাকে, তাই প্রতিযোগিতা নেই কারও সাথে। যে নেই, তাকে কী করে পাব? এই কথা আজ নিজেকে বলেছি।   ইতি ২২ মার্চ ১৯৮৪


তোমার একান্ত
সদানন্দ