মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০১৭

অশোক দেব
সদাপুরাণ-৯
নবকুমার ঘুঙুর হইলেন গিয়া প্রথম ঘুঙুর। তাইনের আগে জগতে কুনু ঘুঙুর আছিল না। গোমতীর থিকা একটা চিকন ছরা  আৎকা কইরা বাইর হইয়া গেল। যুমুন গোমতীই তারে ত্যাজ্য কইরা দিছে। আবার ওই একটু পরে নিজেই নিজের বুকের পানি ডাইক্যা কোলে তুইল্যা নিল। হেই ছরার নামও ঘুঙুর। এই ঘুঙুর আর গোমতীর মইধ্যখানে ধনুকের মতন যে চরা পড়ছে, হেইডা একটা গেরাম হিডার নামও ঘুঙুর। বছরের বেশির ভাগ সময় জলপানিতে প্যাক প্যাক হইয়া থাহে। এল্লিগ্যা কেউ বসত করল না। কই থিকা একদিন এই বেডা আইলো। নবকুমার। তাইনের নাম নবকুমার ঘুঙুর। তাইনে য্যান ইহানে আইছে, কেউ কইতে পারত না। না আমরা, না দেশের কেউ। বেডা একলা। তাইনেও আইলো চরাও শুকনা। প্যাক নাই কাদা নাই। বেডা চাষবাস করে না। ভিক্ষাও করে না। শুধু কই কই ঘুরে।  যে গেরাম দিয়ে ঘুইরা যায়, হেই গেরামে মাইনসেরে কিয়ে জানি পায়। তাইনের পিছন পিছন পুতুলের মতন হাইট্যা যায় মানুষ। যুমুন জাদু করছে। হগলে যায় না। দুনিয়াত কিছু কিছু মানুষ আছে ঘুঙুর স্বভাবের, তারা যায়। নবকুমার ঘুঙুরের পায়ের মইধ্যে  সোনার ঘুঙুর ঝুলে অনেকটি বান্ধা না, হইয়া রইছে। যুমুন গাছের শরিল থিকা ফুইটা থাকে অনন্তশয্যা ফুল, তেমন। নবকুমার হাইট্যা গেলে ঝমক ঝমক, রুনুর ঝুনুর। আমি অক্করে সিউর, হেই ঘুঙুরেই জাদু আছে।
তয়, আমি একদিন করলাম কিতা, ধরলাম গিয়া বেডারে । ক্যামনে জানি আমার মুখ দিয়া বাইর হইয়া গেল, গুরুদেব। হেই থিকা গুরুদেব ডাকি। জিগাই, নাম কিতা আমনের? বেডা কয় নবকুমার, নবকুমার ঘুঙুর। চোখ দিয়া চায় নাথুইয়া রাখে চোখ দুইডা। য্যান দেখনের আর কিতা আছে এই জগতে? যার যার তাইনেরে দেখানের ইচ্ছা, তা তা তাইনের চক্ষের সামনে আমনেই ভাসব। তহন অনেকেই আইয়া ঘুঙুরে নয়া একটা গেরাম বানাইয়া লাইছে। পুরুষ স্ত্রীলোক সবই আছে। কই থিকা এত ফকফকা সব মানুষ আইছে কেউ জানে না। সবাই ঠাউর দেবতার মতন। বেডিডি সব হুরি।পরী। যার লগে যার দেহা হয়, বুকে টাইন্যা লয়। বাইচ্চার মতন আদর করে। হগলে, হগলেরে। নারী পুরুষ ভেদাভেদি নাই। যুমুন মানুষ হগলে। এরা জানি কেমন, দেখলে মনে হয় সেবার থিকা আইছে, মনে হয় সব বুঝি কই জানি যাইবকই জানি কোন গানর আসরে যাইব তারাসবাই ঝিম মাইরা থাহে। গান গায়
   যদি তুমি একটি সত্যের সন্ধান পাও, তোমার পায়ে একটি সোনার ঘুঙুর আপনি জুড়ে যাবে।
এত কঠিন ভাষা তো আমি বুঝি না, ছাতা। বেডা কয়। আমি হুনি আর জিগাই, ‘কেডা পিন্দায়া দেয়, ঘুঙুর? কই থিকা আইয়েসইত্য কিতা?
   তুমি সত্য, আমি সত্য। আবার আমরা কেউই সত্য না।
আমি লাজে মইরা যাই। বেডায় আমারে ধইরা লাইলো নিকি? মিছা দিয়া বানাইয়া আমি য্যান এই আছি, হিডার কতা কয়? আমি কি একটা মিছাকতা?
   গুরুদেব আমার পা-ও কি ঘুঙুর দেওন যায় একখান? বড় সোন্দর, মিঠা আওয়াজদিবেন?
   আমি তো দেবার মালিক নই। তুমি চেষ্টা করো সত্যের কাছাকাছি যেতে। তোমাকে তিনি ঠিক ঘুঙুর পরিয়ে দেবেন। একটা সত্য কথা বল তো দেখি।
   আমি একদিন মরুম
আৎকা ফট কইরা এই কতা বাইর হইয়া গেল। আর এই ডান পাওডাত একটা আরাম অইলো। হেরপরে দেহি ঘুঙুর। ইট্টু কতক্ষণ আছিলো, হের পরে নাই।
   গুরুদেব, গেলো গা দেহি?
   তিনি দেন, তিনিই ফিরিয়ে নেন। তুমি তো অর্ধসত্য বললে, তাই...
   কেডা? কেডা দেয়, কেডা নেয়, পুরা সইত্য কিতা?
   সেটাই জানার চেষ্টা কর আগে। তাহলেই হবে।
এই কতা হুইন্যা আমি আইয়া পড়ছি। ঘুঙুরে যাওন, ঘুঙুর থিকা আওনও বড় এক রঅইস্য। ঘুঙুর যামু কইয়া তুমি গাঙের জলে পাও দিবা, জল কইম্যা ইদ্দুর। হাইট্যা যাইবা গা। গিয়া যেই ঘুঙুরের মাডিত পাও রাখবা, গোমতী আবার বোগলাইয়া বোগলাইয়া উঠব।
একবার ত রাইত্তা বেলা গেলাম। গিয়া দেখি সাপের মণি ঘরে ঘরে। য্যান কারেন্টের লাইট। ফকফকা আলো। হগলেই গান গায়। হুনা যায় না এমুন গান। গুরুদেব নাই। আকাশে দুইখান চান। এক চান্দে পুন্নিমা, এক চান্দ ঈদের। আমি ফিট হইয়া গেলাম। পরে যে ক্যামনে বাড়িত আইছি, মনে নাই।
আজ এলাম এই ঘরে। সদানন্দের ঘর। নন্দ দারোগার কাছে যাই আজকাল। আমাকে সদায় পেয়েছে। নন্দদাকেও। সদানন্দ যে মরে গেল, সেটা তার দিদিরা ভুলে গেছেভুলেছে  তার জামাইবাবুরাও। যতদিন সদার মা ছিলেন, ততদিন এই বাড়িতে এসে মাঝে মাঝে থাকতেন। এখন আর কেউ নেই। খালি। পুলিশ সিল করলো, এই বলে নন্দদা এই ঘর দখল করেছেন। মাঝে মাঝে আসেন, আর সদানন্দকে খোঁজেন। যেমন যেমন ছিল ঘরটা, তেমন তেমন রাখেন। কী বিচিত্র ছিল এই ছেলে! এতক্ষণ যে অংশটা বললাম, ওই ঘুঙুর, সেটি একটা খাতার অংশ। সদা লিখে রেখেছে। নাম রেখেছে, ‘গপিস্ট বুড়ার কল্পজগৎ’। সেই খাতাটার একটা ভূমিকার মতনও লিখে রেখেছে সে।
‘অনেক কল্পনা জমে গিয়ে একটা মানুষের জন্ম হয়। রহিম মিয়াঁও এরকম একটা মানুষ। গপিস্ট। নিজেকেই তিনি সারাক্ষণ কল্পনা করেন। যে তিনি আছেন, তাতে তাঁর হয় না। তিনি কল্পিত রহিম মিয়াঁ হয়ে থাকতে চান। আর চোখ ঢুলু ঢলু করে সেসব বলেন। পৃথিবীর প্রতিটি জীবন আসলে গল্প, গপ। রহিম মিয়াঁ গপ বলেবাস্তব রহিম মিয়াঁ নিজেকে সাজিয়ে রাখেন। মিথ্যা সোনার চশমা পরেন, মিথ্যা কোরআন উদ্ধৃত করেন। মিথ্যা দামি হুঁকো সাজানআমি যাই তাঁর কাছে। বসে সব শুনি। কী অসাধারণ তাঁর কল্পনাশক্তি! তিনি যে যে কথা বলেন, তা যদি সত্যি হত, তাহলে এ পৃথিবী আরও আনন্দময় হত। তাঁর সব কথা এইখানে লেখা থাক’
আমি আর নন্দ দারোগা এই ঘরে এসে বসি। সদানন্দের ঘর। এই ঘরটাতেই বেশি বেশি সদানন্দ। বেশি করে উপস্থিত। সব তকতক ঝকঝক।বই, বই, বই আর বই। পড়ার টেবিল, দামি টেবিল লাইট। দেওয়ালে অনেক সুভাষিত লেখা। কত রকমের।
‘যে মানুষ মাথা নিচু করে হাঁটতে শিখেছে, সে নিজের পা দেখতে পায়। দেখতে পায় কোথায় দাঁড়িয়েছে’
   সদানন্দ দাশগুপ্ত
‘পৃথিবীর বাতাসে কথা ভাসে। গুপ্তনাসিকা দিয়ে সেসব নিশ্বাস করতে হয়’
   সদানন্দ দাশগুপ্ত
এমন স্বরচিত বাণী সে লিখে রেখেছে। বাঁধাই করে দেওয়ালে লাগিয়ে রেখেছে।
‘একা হতে হতে এমন হতে হবে যাতে, নিজের কথা স্পষ্ট শোনা যায়’
   সদানন্দ দাশগুপ্ত
আমি এইসব দেখি। তাহলে যে সদানন্দ লিখত, সে কেমন? ওই গপিস্ট বুড়া, ওই লালুমজিদ, জরিনাদের এত কাছের থেকে দেখেছে সে। তাদের কথা লিখে রেখে গিয়েছে সে লেখক সদানন্দ কেমন ছিল? একা? কতটা একা? সে নিজের কথা স্পষ্ট শুনতে পেত?
নন্দ দারোগার ভাব এমন যেন, এটি তাঁর মালিকানা। সদানন্দের ঘরবাড়ি, তার এইসব জিনিসপত্র, সবেতে যেন তাঁর অধিকার, একার। এদিকে বসলে মানা, ওদিকে যেতে গেলে, সাবধান সাবধান।
   দাদা, এইসব জিনিস তো ছাপান দরকার। মাইনসেরে জানান দরকার... বলি আমি
   একদম, একদম, এল্লিগ্যাই তো আপনেরে আনি। আসলে কিতা জানেন?
   কন
   সদানন্দ একটা অলটারনেটিভ জীবন বাইছ্যা নিল। ওই আমরার যন্ত্রণায়, ইনসেনসিটিভ সমাজের যন্ত্রণায়যেদিকে যায় হেদিকে কু... একধরনের টুঁটি চাইপ্যা ধরন... আইচ্ছা এই জিনিসটা পড়েন, নেন
আমাকে একটি পকেট ডায়েরি দেন নন্দদা। সদার ডায়েরি। কী সুন্দর হাতের লেখা। এটা আসলে হিসেবের খাতাবিচিত্র হিসেব
১৭-০১-১৯৮৩, সকাল, ডাকবাংলো রোড। ৪+২+২+১, দুটি বাচ্চা ছেলে, একটা রিকাশাওয়ালা, আর বাকিদের দেখা যায়নি।
১৭-০১-১৯৮৩, দুপুরবেলা, বাসে করে যাবার সময়, ২+১, একটা ড্রাইভার, একজন ফেরিওয়ালা
এরকম সব লেখা। ‘এইসব কী হিসাব, নন্দদা’? জিগ্যেস করি আমি
   বুঝলেন না? সদানন্দরে মাইনসে ক্ষেপাইত, রাইট?
   হুম, ক্ষেপাইত
   কী কইয়া ক্ষেপাইত?
   ওই... কুউউ কইরা একটা আওয়াজ দিত... আমিও দিছি দুই একবার...
   হেইডাই... আপ্নেরটাও লেখা আছে। ডেইট দিয়া, কোন সময় কোনখানে, জাগার নাম দিয়া...
   এইসব সদানন্দ হিসাব রাখতো?
   তাই তো দেখতাছেন
   ক্যান?
   হো হো হো, এই দেখেন
বলে ওই ছোট ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠাটা খুলে ধরেন...
‘We live bit by bit… by killing others… bit by bit. I count every bit’
মাথা ঝিম ঝিম করছে আমার। ছেলেটাকে শ্মশানেও ওই কুউ কুউ শুনতে হয়েছে। অবশ্য সে তখন নেই। সে তখন শেষবারের মত জ্বলছিল। তাই সেদিন আর কাউন্ট রাখতে পারেনি... সেদিন শ্মশানে আমার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। আমারও ওই কুউউ শব্দটা শুনে রাগ হল, হয়তো সেদিন থেকেই বাঁচতে শুরু করলাম। বিট বাই বিট...
কেমন নিজেকে অচেনা লাগে। এইসব কিসের মধ্যে আটকে আছি? এইসব হাউস লোন, ইএমআই, ইলেকশন...
নন্দ দারোগার  ডাকছিলেন।শুনতে পাইনি। তাই হ্যাঁচকা টান দিলেন। টেনে একটা ঘরের সামনে নিয়ে আসেন। একটু ছোট সেই ঘর। দরোজার পাশে অফিস ঘরের মত সাইন লাগানো, ‘MATING WITH MUSIC’. আমার ভয় হল, ফিরে চলে আসি সে ঘরের সামনে হতে। সেই খাতাটা খুলি, সেই গপিস্ট বুড়ার কল্পজগৎঃ
আমার বড় পোলাডা কিছুডা ঘুঙুর, কিছুডা সংসারী। বিয়া করে আর ছাড়ে। তে গিয়া ক্যামনে ঘুঙুরে পড়ল।নিয়া আইলো এই জরিনা মা-রে। পারলো না। ক্যামনে পারব? মাইনসে কি পরীর লগে পারে? দিতে গেল তালাক, পারল না। আমি রাইখ্যা দিলাম। মজিদের কাছে দিলাম তাইনেরে। মজিদ আমার পুরা ঘুঙুর...
  কুউ কুউ কুউ
চমকে উঠলাম। কোথা হতে এলো এই শব্দটা? একটু থতমত খেয়ে পরে বুঝলাম, সেই ঘর হতে, ‘মেটিং উইথ মিউজিক’ছুটে যাই। একটা দেওয়াল জুড়ে নিচু একটা শো-কেস। তার ওপরে বিদেশি মিউজিক সিস্টেম। বাজছে। একটা আরাম কেদারা। বসে আছেন নন্দদা। চোখ সজল। আমি ঢুকতেই ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন। নীরবে শুনতে বললেন। মিউজিক সিস্টেমে একটা ফিতার ক্যাসেট পরানো। বাজছে। সদার শান্ত কণ্ঠস্বরঃ
‘সুপ্রভাত সদানন্দ। যাও, নতুন দিনটাকে টুঁটি চেপে ধরো। তুমি একা নও। তুমি দুর্বল নও। এই বিদ্রূপে তোমার কোনও হাত নেই। তুমি একা নও
তোমার সঙ্গে পুরো ঘুঙুর গ্রাম রয়েছেতুমি ভুল করে এখানে চলে এসেছ
একটুক্ষণ চুপ। তারপর সদাই সদাকে বলে, ‘ কুউউউ... কুউউউ...’
সদার সারা ঘরে সেই শব্দ আছুড়িপিছুড়ি হয়ে সদাকে খোঁজে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন নন্দ দারোগা।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন