এলোমেলো লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
এলোমেলো লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৫

শিল্পীর চাপাতি


সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে ভেদ আছে। থাকলেও বহুকাল এদের মধ্যে বিভেদ ছিল না। মানুষের বৌদ্ধিক উন্মেষ ধর্মকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। কাব্য, সংগীত, চিত্রকলা, যূথনৃত্য, নাটক এমনকি দার্শনিক যুক্তিবাদও ধর্মকেন্দ্রিক চর্চাই ছিল। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ কাব্যে রচিত। ন্যয়বিদ্যা হোক কি গ্রীক দার্শনিক যুক্তিবিদ্যা সবই ধর্মের পার্শ্ববিদ্যা। এমনকি বাস্তুবিদ্যা, নির্মাণবিদ্যাও ধর্মকে কেন্দ্রে রেখেই বিকশিত হয়েছে। কারণ ধর্মই তখন মানুষের জীবনের সাংস্কৃতিক পরিচয় ছিল।
তখনও গ্রন্থনির্ভর ধর্ম গড়ে ওঠেনি, লোকে প্রকৃতির শক্তিগুলিকেই পূজ্য বিবেচনা করত। অথবা, নিজেদের থেকে কোনও উন্নত, শক্তিশালী, বিচক্ষণ মানুষকে দেবতায় উত্তীর্ণ করে গোষ্ঠীনির্মাণ করত। কালে কালে সেই স্বাভাবিক ধর্মের বিলোপ হল। গ্রন্থনির্ভর ধর্ম এল। একটি লিখিত বইকে কেন্দ্র করে লোকে তাকেই নিয়ামক মেনে নিয়ে গোষ্ঠীবদ্ধ হতে শুরু করল। এই বইগুলি অধিকাংশই দুর্বোধ্য ভাষায় লিখিত। ফলে, তাদের প্রতিপাদ্য হয়ে গেল গুহ্য। সে কিছু মানুষের চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। ফলে, প্রতিটি গ্রন্থনির্ভর ধর্মেই পুরোহিতশ্রেণীর বিকাশ হল। তারাই ধর্মকে সংগঠিত করলেন, সংস্কৃতি হতে তাকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। এইখান থেকেই গোল শুরু হল।

ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুধর্ম বলতে যে ধর্মকে বোঝানো হয়, তা কোনও একটি গ্রন্থনির্ভর ছিল না। কোনও গ্রন্থই ছিল না। শ্রুতিমাধ্যমে কিছু বিধি, কিছু দার্শনিক চিন্তা অনুসরণ করত এদিকের মানুষ। প্রকৃতিই ছিল তাদের প্রধান আরাধ্য। কোনও এক সময়ে কে বা কারা মহাভারতের একটি অধ্যায়কে সরিয়ে আলাদা করে গীতা নাম দিয়ে এদিকের মানুষকে তার অধীন করার চেষ্টা করল। সংগঠিত করল। এখন বহু-বহু সাংস্কৃতিক অনুশীলনের বৈচিত্র্যময় ধর্মানুসরণ একটি ‘হিন্দু’ নামে বিলীন হয়ে গেল।
এই পুরোহিততন্ত্রগুলো মানবসভ্যতাকে দিয়েছে ধর্মযুদ্ধ, ফতোয়া, রক্তপাত, উচ্চনীচ ভেদ, অন্ধত্ব। চোখে, মননে ঠুলি লাগানো মানুষ পুরোহিতদের (মোল্লা, পাদ্রী ইত্যাদি সকলকে এই নামেই ডাকা যাক) স্বার্থরক্ষা করতে চাপাতি নিয়ে স্বধর্মের লোকেদের গলা নামাচ্ছে, জরাজীর্ণ মসজিদ ভেঙে উল্লাস করছে, প্লেন নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে বহুতলে।

এতসব কথা মনে করিয়ে দিলেন পার্থদা। তাঁর একটি ছবি দেখে এইসব কথা মনে এল। নদীকেন্দ্রিক মানব সভ্যতায় স্বভাবতই ধর্মেও নদীর ভূমিকা বিরাট। কোনও কোনও ধর্মে নদীকে দেবীরূপে পূজা করা হয়। সেই নদী আবার বহমান সময়ের সাক্ষী, নীরব কিন্তু সবল সাক্ষী। একটি বহমান নদীতীরে একটি ধর্মবৃক্ষ, সে বটসদৃশ হলেও দৃশ্যত তার পরিচয় দেননি শিল্পী। হয়তো সে নিজেই ধর্ম। শোণিতলাল হয়ে গিয়েছে সে, সন্তানের কত রক্ত দিয়ে যেন স্নান করানো হয়েছে তাকে। ক্ষীণকায় হয়ে যাওয়া সময়-নদের পারে একা নিরুপায় দাঁড়িয়ে আছে রক্তছায়া নিয়ে একটি রক্তবৃক্ষ। একটি চরা কিংবা স্থলভাগ। সে-ও যেন ক্ষীণকায় হয়েছে। একটি সাপের ফণা কিংবা বুকে হাঁটা কোনও কীটের উত্থিত মাথার মত জেগে আছে। কোনও মানুষ নেই। কোথাও নেই তারা। নদীতেও দেখা যাচ্ছে মাঝিবিহীন নৌকাগুলি যথেচ্ছ এদিক-ওদিক যাচ্ছে। একধরণের নীরব, হতশ্বাস নৈরাজ্য চলছে। আর সেই মানবরহিত স্থলভাগে পড়ে আছে একা ধর্ম। প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক দিনে আসতে আসতে মানুষ যত ধর্মীয় মোটিফের রচনা করেছে, পার্থদা প্রায় সকলের স্থান দিয়েছেন এখানে। কিন্তু মানুষ নেই। কী করে থাকবে, তারা তো ইতিমধ্যে নিজেদের নিজেরাই খুন করে করে নিকেশ করে দিয়েছে। শিউরে উঠি এই বিচিত্র স্থলভাগটি দেখে। শিল্পী যে সাবধানবানী উচ্চারণ করলেন, তা যদি সত্য হয়ে যায়? ধর্মকে নিয়ে মারামারি করে সকলে মরে গেলে পরে একা ধর্মই পড়ে থাকবে। সে ধর্ম কী করবে তখন? কার কাজে লাগবে? উঃ।
কলেজজীবন থেকে পার্থদার কাজ দেখে আসছি। মাধ্যম, কন্টেন্ট আর দৃষ্টিকোণ নিয়ে তিনি নিরলসভাবে নিজেকে প্রায় প্রতিটি ছবিতে পাল্টে ফেলেন। এই ছবিটিতে একটি ব অনুজ্জ্বল পট নিয়েছেন তিনি। কম্পিউটারের স্ক্রিনে দেখে মনে হচ্ছে হাতে বানানো নেপালি তুলোট কাগজ। তাতে নানা মাধ্যমের মিশ্রণ দিয়ে কাজটি করেছেন। দ্রুত করেছেন, যার ফলে ছবিটিতে একটি চাপা অস্থিরতাও আঁকা হয়ে গিয়েছে। যেন একজন মেধাবী কবি, তার লেখাটি লিখে তাকিয়ে আছেন, ছবিটি দেখলে শিল্পীর উপস্থিতিও টের পাওয়া যায়।

কিছুকাল ধরে পার্থদা একধরণের নিসর্গ তৈরি করেন। যেন ওপর থেকে দেখা, যেন বহুদূর কোনও গ্রহ হতে। সেই ছবিগুলো আমার প্রিয়তম। মার্কিন শিল্পী ওয়েন থেইবো-র (wayne thiebaud) কাজেও, বিশেষ করে নিসর্গচিত্রে, এই ধরণের দৃষ্টিকোণ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু পার্থদার কাজগুলি আরও কাব্যিক। সেগুলো নিয়েও কথা হবে। পরে।

সোমবার, ২৩ মার্চ, ২০১৫

যন্ত্রবলদ ও আমাদের রক্তক্ষরণ


আমাদের বাড়ি ঘিরে গুণে গুণে সাতখানা ছোটবড় পুকুর ছিল। প্রায় সব বাড়িতেই একেকটা করে। এদের পাড়ে পাড়েই আমাদের নানাকিছু বড় হয়েছে, বেড়ে উঠেছে। সে-সব পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। সারারাত ধরে এ যন্ত্রগুলির পাশবিক গোঙানি সহ্য করেছে অসহায় পুকুর। এইসব যন্ত্রবলদের (আমাদের পিতার দেওয়া অভিধা) নীচে চাপা পড়ে গেছে কত রূপসীর স্নান। কিছু করার নেই। মেনে নিতে হবে এই দ্বিধাহীন নগর-আগ্রাসন। তথাপি শেষ পুকুরটির ওপর যখন যন্ত্রবলাৎকার চলছিল ( ১ম ছবিতে) তখন মনে হয়েছে টুঁটি চেপে ধরি। পারিনি।
সেটাই পেরেছেন শিল্পী পুষ্পল দেব। রং আর তুলিতেই তিনি টুঁটি চেপে ধরেছেন যন্ত্রনির্ভর নগরায়ণকে। আমাদের গেরুয়া টিলাগুলি, শ্যামল টিলাগুলি কেটে সমান করে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তার প্রয়োজনে, রেলের প্রয়োজনে। যেন যেখানে এইসব টিলাভূমি নেই সেখানে রেল হচ্ছে না, রাস্তা হচ্ছে না। ফাঁকতালে, হারিয়ে যাচ্ছে ত্রিপুরার নৈসর্গিক পরিচয়। এতে যন্ত্রের দোষ কম। কিন্তু সে-ই দৃশ্যমান রাক্ষস। তার মৃত্যুকামনা করেই শিল্পী তাঁর বিরাগ প্রকাশ করেছেন। মৃত্যু তার কিন্তু চারদিকে যে রক্ত ছিটিয়ে আছে, তা কি মানবরক্ত? না মনে হয়। কারণ পট ছিদ্র হয়ে বেরিয়ে আসছে সেই রক্ত। ছবিতে পটের মালিক শিল্পী। সুতরাং এ রক্ত তাঁরই বুকের ক্ষরণ, সেটি বুঝতে অসুবিধা হয় না। আর শিল্পী চিরকালই একটি মানবাতীত সত্ত্বা। তাই শুধু তাঁরই রক্তপাত হচ্ছে না, আকাশের নীল রক্তও ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সেই পট ফুঁড়ে। বেরিয়ে এসে স্তব্ধ হয়ে মিইয়ে আছে।
আর আছে এক ক্যামেলিয়ন (chameleon)। সে তার দীর্ঘ রসনা ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশের শূন্যতায়। যেন এইসব কাণ্ডকারখানার সে-ই কারক। একদিন তার বর্ণিল দেহটি রক্তশূন্য হবে। ভূমি ছেড়ে দিয়ে আকাশের দিকে ছড়িয়ে দেবে তার লোলজিহ্বা। মাটি ছেড়ে সে আমাদের নৈসর্গিক আকাশেরও দখল নিতে চাইবে। সে দিন বড় ভয়ংকর।
সাম্প্রতিককালে ত্রিপুরার কোনও শিল্পীর কাজে এমন কঠোর, নির্মম বাস্তববয়ান, আমি অন্তত দেখিনি। একজন শিল্পীর ব্যক্তিগত রক্তপাত যে কত গভীর ও হৃদয়বিস্তারী হতে পারে, এ তার উদাহরণ। অন্তত আমার কাছে তা মনে হয়েছে। শিল্পীকে ধন্যবাদ।

পুষ্পলের ছবি নিয়ে আবার...
কবিতার ছন্দ স্ক্যান করে দেখানো, অন্যবিধ প্রকরণাদির খোলসা করে দিলে যেমন তার রসহানি হয়, কবির রান্নাঘরে উঁকি মারা হয়ে যায়। তেমনি চিত্রশিল্পীর কাজের জ্যামিতিক সজ্জা, কম্পোজিশনের আগপাশ নিয়ে কথা বললেও, তাঁর অন্দরমহলে উঁকি মারা হয়ে যায়।
সেলিমদার আদেশ পুষ্পলের ছবিটি নিয়ে সে কাজটি করতে হবে আমাকে। ছবিটির গূঢ়জগতে যাবার চেষ্টা করেছি আরেকটি পোস্টে। এখানে তার দৃশ্যমান সৌন্দর্যের কথা বলবার চেষ্টা করব। সাধ্য ও জ্ঞানমত, বলাই বাহুল্য।

পুষ্পল ইদানিং যে শিল্পানুশীলন করছেন, তা ক্ষীণভাবে একটি তত্ত্বের অধীন। সে তত্ত্বের নামোল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করি না। শুধু এটুকু বলা যায় এর একটি চিহ্ন ঐতিহ্যানুগমন। এই ছবিটির কম্পোজিশন( শব্দটির বাংলা কী?) নির্মাণ করতে গিয়ে পুষ্পল অতিশয় গতিশীল বারক (Baroque) পদ্ধতিটির আশ্রয় নিয়েছেন। এই পদ্ধতিটির বিকাশ সেই ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে। সেই থেকে মোটামুটি ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই টেকনিকটি ইওরোপের শিল্পীদের মাতিয়ে রেখেছে। ত্রিভুজাকৃতির মধ্যে দৃশ্যবস্তুকে সন্নিবেশিত করার মধ্যে যে স্থবিরতা ছিল, যে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা ছিল, তার থেকে বেরিয়ে আসেন শিল্পীরা। যদিও তখনও তাঁরা ধর্মভিত্তিক কাজই করছিলেন, কিন্তু জ্যামিতিক সজ্জার বদল করে ফেলাতে, ছবিতে অসম্ভব আবেগ আর গতির সঞ্চার হল। ছবি যেন পট ছেড়ে দর্শকের সামনে এসে দাঁড়াল। এতকালের দৃষ্টিনিবদ্ধীকরণের যে বিশ্বাস ছিল তাকে নস্যাৎ করে দেওয়া হল। ত্রিভুজাকার সন্নিবেশ থেকে তারা সরে এসে পটের আড়াআড়িভাবে স্থিত (ডায়াগোনাল) একটি কল্পরেখার আশ্রয় নিলেন। সে-ই হয়ে গেল ছবির মেরুদণ্ড, তার থেকে সমকোণে সরে, সমান্তরালে, সমদূরত্বে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলি সাজিয়ে দেন শিল্পী। গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলি রাখেন। নির্ভুলভাবে। যেন প্রায় স্কেল ধরে ধরে। আসলে তা নয়, শিল্পীর আবেগই তাঁকে দিয়ে এই কাজটি করিয়ে নিচ্ছে।
Baroque composition এর মূল চালিকাগুলির মধ্যে আবেগ ও অসন্তোষ অন্যতম। এই টেকনিক পুষ্পল কত সার্থক ভাবে ব্যবহার করেছেন, তা কিছু ছবির মাধ্যমে বললাম। তুলনামূলক ভাবে। সপ্তদশ শতকে সক্রিয় ইতালিয়ান শিল্পী Guido Reni ছিলেন এই টেকনিকের রাজা। তাঁর দুটো ছবি (২য় ও ৩য় ছবি) আর পুষ্পলের ছবিটির( চতুর্থ ছবি) জ্যামিতিক ইন্টারপ্রিটেশন করে দিলাম। আর একটি ছবি baroque composition এর আগের। সেটি রেনেসাঁ যুগের র‍্যাফায়েলের(১ম ছবি)




মঙ্গলবার, ৪ মার্চ, ২০১৪

অক্রিকেটিয়





ভারতীয় উপমহাদেশে যে বিষয়ে প্রায় প্রতিটি মানুষ বিশেষজ্ঞ, তার নাম ক্রিকেট। জীবনে যে মাঠে নামেনি, সে-ও সূক্ষ্মতম বিষয়ে অধিনায়ককে উপদেশ দিতে পারে। জননাঙ্গে, বুকে, মাথায়, হাতে, থাইয়ে এবং পায়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে যে খেলা খেলতে হয় তার নাম ক্রিকেট। মাঝে একবার খেয়ে, জলপান করে, ধীরসুস্থে সেজেগুজে যে খেলা দর্শকদের জন্য পরিবেশন করতে হয় তার নাম ক্রিকেট। নাচার উঠানটিকে টিপে, ফাটাফুটি পরিমাপ করে, মাঠযত্নকারীর জাদুহস্তের আশীর্বাদ নিয়ে ক্রিকেটনৃত্য পরিবেশন করতে হয়। বায়ুপ্রবাহের গতি ও অভিমুখ, শিশিরের পরিমান ও ঘনত্ব, দেশ না বিদেশ, ইত্যাদিও বিবেচনা করতে হয়। বিবেচনা করতে হয় ছুঁড়ে দেওয়া বলের বয়স। পুরাতন হয়ে গেলে এক ফল নব্যবলের আরেক ফল। থুতু দিয়ে, জামায় মুছে, প্যান্টে মুছে সেই বলটিকে চকচকে করে তুলতে হয়। তারপর খেলার আয়োজন।
আয়োজন হলেই গলিতে ঘুপচিতে জেগে ওঠে ফেউ। তারা ফোনে ঠিক করে দেয় কাকে ছেড়ে দিতে হবে হাতে আসা ক্যাচ। কে বল করার আগে নাচিয়ে দেবে ধবল রুমাল, কিংবা কে অকারণ ওয়াইড করে যাবে। ‘মানুষ বেকুব চুপ’। টিভির সম্মুখে। ‘কেমন মোচড় দিয়া ট্যাকা নিয়া যায় বাজিকর’। এদিকে ভারত হল ক্রিকেটের বারাক ওবামা। প্রচুর টাকা। টাকা যার খেলা তার। চাপ দিয়ে নিয়ম পাল্টানোর গুর্দা আছে ভারতের। ১২৫কোটি অলস আছে দেশে। সুতরাং ক্রিকেটের বাজার এখানে ভালো হবেই। চারা হবে চাষ হবে। গ্রামে গঞ্জে, মহকুমা শহরগুলিতেও ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন গড়ে উঠেছে। টাকা উড়ছে। গ্রামের ছেলেদের খেলার মাঠ লিজে নিয়ে যাচ্ছে ক্রিকেটের মাতব্বরগণ।
কাঁধে নিজের থেকে বড় কিটব্যাগ নিয়ে সাইকেলে বিকাল আসে পাড়ার ছেলেটির। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে সে প্রণাম করে এসেছে ভারত রত্ন শচিনের ছবিতে। সে একটি জালের মধ্যে আবদ্ধ করে নিজেকে। অবিরাম তার দিকে ছুটে আসে লালসাদা বল। সে ঠুকে যায়, ঠোকা শেষে ঠোকার ভঙ্গি করে আরও কিছুক্ষণ, তারপর মেশিনের মুখ থেকে গবাৎ করে বেরিয়ে আসে আরেকটি বল, আরেকটি... আরেকটি... সে নীরবে ঠোকে। বাড়িতে এসেও তার বিরামহীন ঠোকা শেষ হয় না। বারান্দায় দড়িতে ঝোলানো বল সে সময় পেলেই ঠোকে। কোনও ঘাম নেই, খেলার আনন্দ নেই, হই নেই হুল্লুড় নেই। যেন সে এক ক্রীড়াবিদ্যালয়ে এসে জুটেছে। স্যারের চাপের থেকে এসে কোচের চাপে পড়েছে। মাঝে মাঝে পেছনে ওজন বেঁধে দেওয়া হয়। সে জোয়ালে বাঁধা গরুর মত সেটাকে টানতে টানতে ছোটে। যেন মার্কিন মুলুকের সেই নিগ্রো ক্রীতদাস সে।
প্রাণের আনন্দে পাড়ার সকল ইয়ারবান্ধবদের ডেকে এনে জাম্বুরা নিয়ে ফুটবল খেলা অতএব স্মৃতি হয়েছে। খেলোয়াড় হতে নয়, জয়ী হতে নয়, কেবলই আনন্দ উদযাপনের জন্য যে ক্রীড়াবিলাস, তাকে হত্যা করা হয়েছে ক্রিকেটের রক্তচোঁয়া টাকায়। যে ছেলে তেমন ডাক্তার হবে না, তেমন ইঞ্জিনিয়ার হবার আশা যার নাই, তাকে নিয়ে শীতার্ত বাবা ক্রিকেট কোচের কাছে দাখিল করেন। অন্তত একটা রঞ্জি খেলে ফেলতে পারলেও তো দাঁড়িয়ে যাবে ছেলেটা।
হয়তো এ এক বিকল্প জীবিকার আলো। কিংবা এ এক নিরানন্দ অন্ধকার। কেননা, একটি খেলার সাথে ইতিমধ্যে জুড়ে দেওয়া হয়েছে রাজনীতির জাদুটোনা। যে ছেলে পাড়ায় ভদ্র, নম্র, শিক্ষিত, সে ক্রিকেটে পাকিস্তানিদের জয়কে যে ভাষায় গালি দেয়, তাতে বোঝা যায় আসলে তার মধ্যে রয়েছে এক অসভ্য রাক্ষসের বসবাস। ক্রিকেট তাকে কী করে তোলে?
আর কিছু না হোক উপমহাদেশের অলসাংশে ক্রিকেট আছে। যে খেলায় শ্রম লাগে, মেধা লাগে, উপস্থিত বুদ্ধি লাগে, আর আত্মস্বার্থসর্বস্ব রেকর্ডক্ষুধা যেখানে অর্থহীন, সেসব খেলা আমরা খেলতে পারি না। আমরা একটা এমন খেলা পারি, যে খেলা একটি সামন্ত দিনযাপনের উপায়বিশেষ।

বুধবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১১

নদী ও আকাশ


নদী ও আকাশ


নদীর কাছে যাওয়া একটা সু-অভ্যাস। আকাশের দিকে তাকানোও। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই অভ্যাস কমে যেতে থাকে। সেটা নানা কারণে হয়ে থাকে। এই কারণগুলোকে কোনও শ্রেণিতে বিন্যাস করা যায় না। প্রকৃত অর্থে এদের কারণও বলা যায় না। নদী বয়ে চলে যায়। এই তো, একদম বাড়ির কাছে, অথবা একটু দূর দিয়ে। আকশের ব্যক্তিত্বও এই একইরকমের। তার দিকে না তাকালে তার কিছু যায় আসে না। একা নদীর পাড়ে গিয়ে, অথবা সদ্য জেগে ওঠা বালির চরায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকালে মাথা ব্যথা কমে। মাথা ব্যথা একটা সংকেত। সে আসলে একটা ফল। তার কারণ অন্যতর ব্যথার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। সেটা আকাশ আর নদী জানে। তারা তার নিদানও জানে। তাই নদীর বুকে চরা জাগে। চরা শব্দটি সুন্দর। তার সঙ্গে চরাচরের যোগাযোগ থাকতে পারে। চর যদি সদর্থক হয়, তবে অচর কী? এরা দুজন মিলেই তো চরাচর? এইসব অচর বেড়ে গেলে আমরা আর নদী দেখি না, আকাশ দেখি না। জায়গা মাপি, বাড়ি বানাই। সিমেন্টের আঠার টানে ঘুমোতে যাই, ইটের লালে জেগে উঠি। বাড়ির পেছনে বয়ে যায় গোমতী। নদী। সূর্যাস্তে তার কাছে গিয়ে দেখি, অস্তরাগ আসলে নদীর মুচকি।

শনিবার, ২০ আগস্ট, ২০১১

এখানে এসে ভাবব বসে। বন্ধুদের আমন্ত্রণ।

এখানে এসে ভাবব বসে। বন্ধুদের আমন্ত্রণ।