মঙ্গলবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০২৪

গতজোছনার নৃত্য

 


গতজোছনার নৃত্য 

এটি আমাদের ছায়াগুদাম। সাদা আর কালো। হাড়ের তৈরি দেওয়াল। মাঝে মাঝে মন তার দেহবাস ছেড়ে এখানে আসে। দূরদূর থেকে যমদূতেরা  ছায়া খরিদ করতে চলে আসে। প্রায়ই বিনামূল্যে নিয়ে যায় সব। ছায়ার পিছন পিছন শরীরও চলে যায়, তাদের এমনি তদারকি।  আজ ওখানে নিজেকে রেখে তোর কাছে এলাম, ওদের ফাঁকি দিয়ে।  চল, আড্ডা মারি। ওদিকে চল, ওইদিকে হিজলের নারী তার পুরুষের পরাগ কামনা করে করে ঢলে গেল নদীর দিকে। বসি।

          তখন ৯৫। ১৯৯৫। তোর জন্ম হল। তার ঠিক একদশক আগে আমার। ভূমিষ্ট হয়েছি অনেক আগে, ১৯৬৯ সালে। কিন্তু কলমের ঔরসে আবার জন্মালাম  ১৯৮৫। আমরা দশকতুতো? হাসিস না। কী অত বিড়বিড় করছিস?

‘একদম জ্বলবি না। একেবারে না। আমি চাই, ওই মেয়েটা ফিরে আসুক। সমস্ত সকাল নিয়ে সে ফিরুক। আমি দেখাব তাকে এই অবস্থা। আমি হাসব হাসবই। শুধু একটিবার ফিরতে দে মা তাকে। এই নে আমার হেরে যাওয়া, এই নে আমার শতচ্ছিন্ন বুশশার্ট –– আমি তাকিয়ে থাকব ওর দিকে। আল ধরে আসব। তারপর,ছায়াবৃত্ত মেনে নিয়ে –– তুমি দিন। আমি রাত। স্টপওয়াচ শুরু হতেই বৃষ্টি নামে। সেই বৃষ্টি। তুমি ধুয়ে দিয়ে যাও! থকথকে কাদা মেখে, সঙের ভূত আমি; কাকে ধরব? কাকে ছাড়ব? আমার ঘুম পায়।

আমি ঘুমোতে চাই…

শালা, এ মৃত্যু আমাকে ঘুমোতেও দেবে না’।

          হুম। পড়েছি তোর বইয়ে। তন্ময় আর আকাশ তোর এসব গজগজ সব সম্পাদনা করে বই করেছে, জানিস? ইয়েস, সেই ‘মাস্তুল’থেকেই। ইয়েস ইয়েস, প্রচ্ছদ করেছে সেই আকাশই। সেটা পড়তে পড়তে নিজের কথা মনে আসে জানিস? শুনবি আমার লেখা :

‘তিনি আমার।
আমার মৃত্যুর দিকের আত্মীয়,
আমার মৃত্যুর।
সকালেই তাই
শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়।
আমার শ্বাসকষ্ট।
সকালেই তাই
শবদেহ হয়ে যাই।
আমার শবদেহ।
সারাদিন বহন করে
রাতে সংসারে চিতায়
এসে শুই।
আমার চিতায়।
তিনি তখন কুশল জানতে আসেন ––

তাঁর কুশল’।

(ছায়াসংগীত: ২০০৫)

 

          দশক পারের দূরে বসে আমরা একই গজগজ দুজনে করেছি। না? হয়তো সবাই করে। কী রে? কিন্তু তোকে পড়তে গিয়ে নিজেকে পড়া হল অনেকটা। সেই যে তুই বললি,

‘ছেঁড়া পাতা উড়িয়ে, ট্রেন থেকে
হারিয়ে গেল স্টেশন

এখন, দৃশ্যত মফস্‌সল পড়ে আছে পাশে
বহু দূরে একটা টিমটিমে বাড়ি

জানলা খোলা পেয়ে –– রাস্তায় মিশে যাচ্ছে
    আদর

        স্নেহ

            অন্ধকার…

অথচ এ-সব দৃশ্য দেখাবে বলে ডেকেছিলে যাকে;

তার চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে শীতকাল

এই রোগশয্যা, আমাদের কুরেকুরে খাচ্ছে’

          মনে পড়ে যায় সেই কবে লিখেছিলাম, ‘অন্ধকে ফেলে রেখে চলে গেল তার লাঠি’। কিংবা, শুনবি? এই নে।  শুনবি?

‘এইমাত্র ব্রিজ পেরিয়ে গেল দূর পাল্লার গাড়ি
একটি বাচ্চা মেয়ে সে-দিকে হাত নাড়াল,
বিকেল নেমে আসছে আর পাখিদের ওড়াউড়ি
নিয়ে চঞ্চল হচ্ছে মন,
এইমাত্র মাঝি মাটিতে পা বাড়াল
তার কালো নৌকায় গিয়ে বসল গোধূলি

এইমাত্র রাত গাড়িকে এগিয়ে দিল ঘুমন্ত স্টেশন’
[‘বাইসাইকেলের বয়স’ ২০০০, লেখাটি ১৯৯৪ সালে লেখা]

          কে তুমি শুনছ আমাদের এসব কথা, না কি পড়ছ? তাহলে আমাদের পরিচয় দিই। যার সঙ্গে কথা বলছি, তার নাম অরিত্র সোম। আমি অশোক, অশোক দেব। আমি আর অরিত্র একটা সাদা ব্রিজ পেরিয়ে এসে এখানে বসেছি। আমি আমার ছায়াটি রেখে এখানে এসেছি, আর অরিত্র সর্বস্ব নিয়ে চলে এসেছে। ব্রিজটির নাম মৃত্যু, কবে শিলন্যাস, কবে উদ্বোধন হয়েছিল তার আমরা কেউই জানি না। বাংলায় বললে, এটুকু বলা যায়, অরিত্র মরে গিয়েছে। কোনও এক পয়লা বৈশাখে অত্যন্ত বিরক্ত লেগেছিল তার। কেন? অরিত্রর ঘর থেকে এরকম কথাও মিলেছে

নির্বাক-৬

‘কোন কথা নেই, কোন অভিমান নেই
শুধু একে অন্যের পায়ের দিকে নীরবে চেয়ে থাকা…

বাকিটুকু কেবল স্পর্শের কল্পনা মাত্র’

          আসলে এ জীবন ঈশ্বরের অভিমান। এ জীবনী। একটা জীবনী লিখতে এসে আমরা তার সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাধাই। না, ঈশ্বর মানে আকাশের পারে বসে থাকা কোনো পূর্ণকৃতী কেউ নয়। তিনিই আসলে ‘স্পর্শের কল্পনা’। কারও কারও সে স্পর্শলাভের অদ্ভুত তাড়না থাকে। তোর ছিল, অরিত্র?
'আত্মহত্যার প্রতি কয়েক মিনিট

এই একটু আগে ওরা সার্চ করে বেরিয়ে গেল। আধখানা চালাঘর। দূর থেকে অস্পষ্ট
আয়ু শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টি হয়ে গেছে কদিন আগে। রাতে ঝড় বাড়ে। রাতে, জল কাঁপে।
বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো ঢিল ছুঁড়ে ভাগিয়ে দেয় কুকুর। কানে গু-লাগা কুকুর। স্টেশনে
হিসু করতে গেলে ধরা পড়ে আজকাল। পুলিশ হাসে। বন্ধুর কাছ থেকে ধার নেয়
সিগারেট। ঘরে বসে তুলে ফেলে চামড়া। উর্দির নিচে দগদগে চামড়া। ছাইদানি।
পেনশন কাগজ। স্ট্রোক এলে ফালাফালা করে গেছে প্রকাল। অন্ধকারে আয়ু আসে।
আয়ু যায়। মানুষের ফ্যান থেকে ধুলো পড়ে, বিচানা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
বিছানা–– সাদা অর্ধনগ্ন শ্মশান।

আত্মহত্যার দিকে কয়েক পা…
একটা সাইকেল।

অসময়ে কুয়ো ধরে উঠে আসা পুরুষ, গোপন

আমি প্যান্ট পরছি’।

          কী কৌতুক, সেই লোকটাকে নিয়ে যে বৃদ্ধপ্রায়, স্ট্রোক এসে যার পরকাল ফালাফালা করে গিয়েছে। তাই বুঝি জীবনের পূর্বাংশেই চলে যেতে হবে ‘প্যান্ট’পরে? কী কৌতুক অসহায় এক শ্রব্য আয়ুষ্কাল নিয়ে! তাই হয়তো এরা চলে যায়। তরুণকালে গিয়েই আচ্ছা করে ধরতে হবে মৃত্যুকে।

          ওদিকে আমার ছায়া শুকিয়ে এল অরিত্র, যাই। মোদ্দা কথা তোর কনিষ্ঠ জীবনে তুই যা যা বলেছিস, আমিও এই আয়ুর আসা যাওয়া নিয়ে তা তা-ই বলেছি। আমরা সকলে মিলে তা-ই বলছি। বলেই চলেছি। এই অকাতর গতজোছনায় নেচে চলেছি…

[ জন্মযৌবনপ্রেম আর নানারকম আলো আঁধার নিয়ে লিখেছে অরিত্র, ভ্যান ঘঘ থেকে বিটোভ্যান সবার কাছেই হয়তো আশ্রয় চাইছিল। কিংবা আশ্রয় দিতে চাইছিল তাঁদের। সবকথা বলা হল না। একটু কথা বললাম ওর সঙ্গে। আত্মহত্যা করেছে অরিত্র, কারণটা সে-ও জানে না। মৃতেরা তার মৃত্যুর কারণ ভুলে যায়, তাই তারা জীবিতের চেয়ে বেশিদিন বাঁচে।
বই: অরিত্র সোমের কবিতা
সম্পাদক : তন্ময় ভট্টাচার্য।। আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়।।
প্রকাশক : মাস্তুল। ]


 



 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন