দংশনজাতক
এক
।
বন্ধুত্বের জন্য জন্মান্ধ শ্রেষ্ঠ। জোড়ামুন
সেকথা জীবন দিয়ে বুঝেছে। ললিতদা জন্মান্ধ। এগ্রিকালচারে চাকরি করে। কী চাকরি কে জানে।
শোভা বৌদি হাত ধরে ধরে তাকে নিয়ে যায়।নিয়ে আসে। জোড়ামুন আসে রাতে। দামি হুইস্কি আনে।
মাংস। শোভাবৌদি দুরকমের মাংস রান্না করে। চাট আর ভাতের সঙ্গে খাবার জন্য আলাদা।গোদকও
থাকে। যেদিন আসে, জোড়ামুন এখানেই খেয়ে যায়। কোনো কোনোদিন যায়ও না। এদের রান্নাঘরে একটা
ছোটো বিছানা আছে, শুয়ে পড়ে।
মাতাল হলে জন্মান্ধ চক্ষুষ্মান হয়ে যায়। ললিতভাই
ওঠে, কেমন নিজের গেলাস, ওর গেলাস তোলে, মাংসের প্লেট নেয়, তুলে রাখে। একটু জল ছিটে
দেয়। বারান্দায় ছোটো একটা ঠাকুরঘর। উঠে গিয়ে ঠিক একতারাটা আনে। গান গায়। কত গান যে
সে জানে! শোভা বৌদি এখন ঠাকুরঘরে চিনচিনে গলায় কীর্তন করছে।
— ললিতভাই
— কন
—
আজকে গান শুনতাম না
—
আইচ্ছা, গাইতাম না, থাক
—
ললিতভাই
—
কন
—
মদ খাইলে আপনে দেখতে পান?
—
না রে ভাই, চোখে কিছু দেখি না। আন্ধার দিয়া দেখি
—
আমি কেমুন দেখতে?
—
কইতাম, কই?
—
কন, চোখ বুলিয়ে শোভা বউদি কোথায় আছে একটু দেখে নেয় জোড়ামুন।
— আপনে গৌরাঙ্গের
মতন। কেবল বর্ণডা কালা, শ্রীঠাকুরের মতন। উচা নাক, চোখ ভাসাভাসা
জোড়ামুন
বাইরে চলে আসে। ললিতভাই টের পায় না। এখনো তার রূপের বর্ণনা করছে। আর থাকতে ভাল লাগছে
না এখানে। খেতের মাঝখান দিয়ে একটা শর্টকাট আছে। জোড়ামুন সেটা ধরে। বাইকটা থাকুক। পরে
এসে নেওয়া যাবে।
দুই।
জোড়ামুন
আসলে মরণ।দিদি পেটে এলে মা স্বপ্ন দেখেছিলেন, লক্ষ্মী আসছে। তারপরে যদি কেউ আসে, তাহলে
সেসব হবে রাক্ষস। অপরূপ এক বালিকার স্বপ্ন মা দেখেছিলেন। বাবাকে বলেন। শুনে বাবাও সেই
লক্ষ্মীকে দেখতে পান। একদিন সত্যই দিদি এল। একেবারে যেমন স্বপ্ন। তিনবছর পর, কে জানে
কার ভুলে মায়ের পেটে উদ্গার নিয়ে চলে এল মরণ। পাহাড়ি লতাপাতা, হোমিওপ্যাথি কিছুতেই
কিছু হল ন।মরণ মরল না। শেষে বিষ্ণু ডাক্তারের কাছে গিয়েও কাজ হল না। মায়ের রক্ত কম
ছিল।জন্মের আগে মরণকে মারা গেল না। মরণকে আসতেই হল।কিন্তু এসবের ধাক্কায় মরণ কেমন বদলে
গেল ভেতর ভেতর। জন্মাতে গিয়েও মাকে নিদারুণ কষ্ট দিয়েছে। বিরাট হয়ে গিয়েছিল সে।বের
করে আনতে গিয়ে আঁকশি দিয়ে টানল ডাক্তার।ফরসেপ না কী যেন। বেরিয়ে এলে দেখা গেল,মরণের
মাথার পেছনে উঁচু। প্রায় আরেকটি মাথা। মোটা নাক। যত বয়স হয়েছে, সেটি হাড় ছেড়ে এসে লতপতে
হয়ে ঝুলতে শুরু করেছে।বাঁদিকের কান গালের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। নীচে ঠোঁট ভারি, সারা
বাল্যকাল সে এটা সামলাতে পারেনি। লালা ঝরত। এই জ্বালার নাম বাবা মা রেখেছিল, মরণ। একটু
বড়ো হতেই সবাই ডাকে জোড়ামুণ্ড।ওর তো দুটো মাথা। শেষে জোড়ামুণ্ড হয়ে যায় জোড়ামুন। জোড়ামুন
ভুলেই গিয়েছে তার নাম মরণ।একেবারে ছোটোবেলায় লোকে তাকে দেখে বাবা মায়ের দিকে জিজ্ঞাসা
নিয়ে তাকাত।
— ফোরসেপ বেবি।
খেতের মাঝখান দিয়ে হাঁটছিল জোড়ামুন। নেশা হয়েছে।
টলছে।কিছুতেই আল থেকে নেমে খেতে পা ফেলা যাবে না। সবাই মারে। একটু এদিক ওদিক হলেই জোড়ামুনকে
লোকে মারে। বাবাও মারতেন, মা মারতেন, দিদিও। ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা বারণ ছিল। উঠলেও
বাইরে বেরোনো নিষেধ। জোড়ামুন, তার বেড়ার ঘরে বসে থাকে। ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে আলো আসে।
সূর্যোদয় হয়। প্রথমে কেমন নরম শ্যমলা আলো আসে। বোঝে এটা ভোর। ধীরে ধীরে তা একটু লালাভ
হয়। পরে হলদেটে হয়ে যখন সাদা হয়ে যায়, তখন জোড়ামুন ঘরের বাইরে যায়। ততক্ষণ প্রস্রাবের
বেগ পেলেও চেপে রাখে। ঘুম থেকে উঠে তাকে কেউ দেখে ফেললে বিপদ। যে দেখে তার দিন নষ্ট
হয়ে যায়। একদিন বাবার দিন নষ্ট হয়েছিল, একদিন মায়ের সোনার কানের হারিয়ে গিয়েছিল তাকে
দেখে ফেলায়।খুব মার খেয়েছে।দিদির পরীক্ষা খারাপ হলেও মার খেত। কেন যে মিছেকথা বলত দিদিটা।
রক্ত না এলে কিংবা ফিট না হয়ে গেলে মার বন্ধ হয় না। জোড়ামুন ইচ্ছে করে ফিট হয়ে যেতে
জানে। সবাই ভাবে, এটাও বুঝি সে জন্ম থেকে এনেছে।আসলে জন্ম থেকে কিছুই নিয়ে আসতে পারেনি
জোড়ামুন।
সেবার
দিদিকে দেখতে আসবে। জোড়ামুন দিদিকে সরাসরি কখনো দেখেনি। কিন্তু দিদিকে সে খুব দেখতে
চাইত। ছোটো থেকে শুনে এসেছে সে লক্ষ্মী।কিন্তু কারো দিকে সরাসরি তাকালেই মারে সবাই।
কিছু না হোক একটা চড় তো আছেই। সকালে অবশ্য সে বেড়ার ফাঁক দিয়ে সবাইকে দেখে। তার ঘরের
উলটো দিকে বাবার দোতলা বাড়ি। দিদি ওপরে থাকে, বাবাও। মা নীচে থাকে। সবাই একে একে ঘুম
থেকে ওঠে। বাবা সকালে সূর্যপ্রণাম করেন। জোড়ামুন বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখে, দিদি কী একটা
লম্বা মতন আসন পাকা উঠোনে পেতে নানারকম ব্যায়াম করে। জোড়ামুন দেখে। সেই দিদিকে আজ দেখতে
আসবে। বিকেলে। জোড়ামুন খুশি। মামারা আসেন ভাইফোঁটার দিনে। যাবার সময় জোড়ামুনকে ডাকেন।
জোড়ামুন মাথা নিচু করে নিজের ঘরটির সামনে দাঁড়ায়। মামার,মামাত ভাইয়েদের জামাকাপড় দিয়ে
যায় তারা। সেখান থেকে লাল একটাকে বেছেছে। আজ দিদিকে দেখতে আসবে। কিন্তু সকালবেলাতেই
জোড়ামুনকে দুবার ফিট হতে হল। লাল জামা পরে সে বেরিয়ে গিয়েছিল। দিদিকে দেখতে আসবে। লক্ষ্মীর
বিয়ে,বর না জানি কী সুন্দর হবে। জোড়ামুন বেরিয়েছিল।এবার মার খেয়ে জোড়ামুন চুপে বাড়ি
থেকে বেরিয়ে গেল। পালাল।
বৃষ্টি
হচ্ছে। এখন শ্রাবণ মাস। জোড়ামুন খেতের আল ধরে হাঁটে। নেশার মধ্যে ভিজতে ভাল। ফিক করে
হেসে ফেলে সে। বাড়ি থেকে পালিয়ে সে আবিষ্কার করল, তার দাম আছে। বাসগাড়ি ভাড়া নেয় না।
খিদে পেলে খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেই হয়। খাবার দেয়। কিন্তু ওর তো শরীরটি
খাসা। যেন পাথরের তৈরি। জনার্দন দারোগা তাই দেখেই ওকে নিয়ে এসেছে। দারোগার অনেক জমি,
রাবার বাগান। গোরু। শখের কৃষক এই জনার্দন দারোগা।বাপঠাকুর্দার রেখে যাওয়া বিশাল সম্পত্তি।
জোড়ামুন একমাসেই সব শিখে ফেলে। রাবার গাছ কাটা, রস নেওয়া, সেসবের পাতি বানানো, শুকানো
সব জানে। পাঁচজনের কাজ একা করে দেয় সে। জনার্দন দারোগা তাকে রেখেই দেন। খেতেও দেন ডাঁট
করে।
ভিজতে ভিজতে এসে
পেছন দিয়ে বাড়িতে ঢোকে জোড়ামুন।ললিতভাই আর বৌদি হয়তো অবাক হবে। হোক।পুকুর পাড়। তারপর
অনেকটা খালি জমি। ভেজা ভেজা। মোস্তাক গাছের জঙ্গল। এই গাছের বেত দিয়ে শীতলপাটি হয়।
মাঝেমাঝে জোড়ামুনও পাটি বোনে। শখ করে।মন ভাল থাকে। এখানে এসে ছোটো একটা ঢিবি।তার সামনে
নত হয়ে প্রণাম করে জোড়ামুন। এখানে থাকে রিমা আর ঝিমা।
তিন।
সব দারোগা কিন্তু দারোগা নয়।জনার্দন দারোগা
আসলে কী চাকরি করতেন কেউ জানে না। তবে গুলি লেগে ডান পা খোঁড়া হয়েছে। জনার্দনের মেয়ের
নাম বিপাশা। বিয়াস।
তখন
যুদ্ধ হবে হবে। ১৯৬৫। জনার্দনকে যেতে হবে পাঞ্জাব।গেল। পরিবার নিয়ে যাবার নিয়ম নেই।
কিন্তু জনার্দনের বউ তখন পোয়াতি। দেখার কেউ নেই। তাই নিয়ে যাওয়া গেল। ফাজিলকাতে পোস্টিং।
শুকনো একটা জায়গা। প্রচণ্ড গরম। শীতকালে মারমার শীত। বিয়াস নদীটি কাণ্ড করে। এই পাকিস্তানে
ঢুকে যায়, আবার বাঁক নিয়ে ইন্ডিয়াতে চলে আসে। সেখানেই কন্যার জন্ম। নাম তাই বিপাশা।দিনের
পর দিন কোথায় থাকে জনার্দন বউ জানেই না। সবই হল পরে পরে, নিজের বলতে স্বামীটি ছিল।
যত্ন করবে বলে এখানে এনে নিজেই বেপাত্তা।এইসব বিত্তান্ত জনার্দনই বলে জোড়ামুনকে। জোড়ামুন
ঝিমুতে ঝিমুতে শোনে। কিছু বোঝে কিছু বোঝে না। তবু বাবু এসব বারবার বলে। কেন কে জানে।
সেখানেই বড়ো হচ্ছিল
বিপাশা। বিয়াস। ৬৫ গেল। তারপরই শুরু হয়ে গেল একাত্তরের তোড়জোড়। বিপাশা তখন একটু একটু
বুঝতে পারে। বাবা যে আর্মি বা পুলিশ নয়, সেটা বোঝে।হিন্দি বলতে পারে, ইংরেজি বলে ফটফট,
পাঞ্জাবি তো যেন মেয়ের মাতৃভাষা। আর মেজাজ হল মেজরের মতন। একাত্তর গেল। বাবা কিছুদিন
বাড়িতে। ওমা আবার হারিয়ে গেল। তখন কী যেন, ভিন্দ্রাঁবালে হচ্ছিল। কী যেন খালিস্তান।বাবা
আসেন মাঝেমাঝে। মেয়েকে আড়াল করার চেষ্টা করলেও, বিয়াস ঠিক দেখে বাবা পিস্তল লুকিয়ে
রাখে। বাবা সেটাকে পিস্তল বলে না, বলে হাতিয়ার। মেয়েটিও যে দিনদিন হাতিয়ার হয়ে গিয়েছে,
জনার্দন দারোগা সেটা বুঝতে পারছিলেন?
তখন সারা দেশেই যেন দাঙ্গা। জনার্দন ব্যস্ত।প্রায়
অজান্তেই স্বর্ণমন্দিরে সেনা গেল।সেখানে ছিলেন জনার্দন? বিপাশা জানে, বাবা ছিল। সেখানেই
পায়ে গুলি লাগে। তারপরেই চাকরি শেষ হল। বিপাশার পরীক্ষার জন্য ৮৭ সাল পর্যন্ত থাকতে
হল ফাজিলকাতে।আর ছিল গান। ফাজিল খাঁ ওয়াট্টুর বংশের এক উস্তাদের কাছে গান শিখত বিয়াস।
ছুটির দিনে বাবা মেয়ে চলে যেত সাদিকি গ্রামে। সেখানে ভারত-পাক জয়েন্ট চেকপোস্ট। পতাকা
নামানোর সময় দুই দেশের সেনা কী বীরত্ব দেখায়। বিপাশা মোটরবাইকে করে বাবাকে নিয়ে এখানে
আসে। দেখে।রক্ত গরম হয়। ‘বাবা,ফির কব জং
হোগা’?
— যুদ্ধ জিনিসটা
ভালা না, মা
বিপাশা
বাবাকে একটা ঘুঁষি দেয়। সেই থেকে মেয়ের সঙ্গেই জনার্দনের যুদ্ধ। এবং পরাস্ত হতে তার
ভাল লাগে।
চার।
—
চল
—
কই, দিদি?
— রাখ তোর দিদি,
তোরে বিয়া করুম।
ঝনঝন করে ওঠে
জোড়ামুনের পৃথিবী। সে জানে বিয়াসদিদি যা বলে তা করে। কিন্তু অত সুন্দর সুমিত বসুঠাকুর?
সুমিতদাদা সুন্দর। সত্যই গৌরাঙ্গ। ডাক্তারি পড়া শেষ করেছে। কোথায় যেন একটা চাকরি পেল।
বিয়াসদিদি সেখানে যেতে দিতে রাজি নয়। সুমিতদাদা যাবেই। বিয়াস দিদি জনার্দন দারোগার
মেয়ে। অঢেল টাকা। সুমিতদাদাকে নার্সিং হোম খুলতে বলে বাবার টাকায়। সে রাজি নয়। এটুকুই
জানে জোড়ামুন। বাকি কী হল?
—
ওঠ গান্ডু, বাত নেয়ি সমঝতা?
—
দিদি
— আরেকবার দিদি
ডাকবি তোর একদিন কি আমার একদিন
লুঙ্গি
পরেই মোটরবাইকের পেছনে বসে পড়ে জোড়ামুন।প্রথমে মেয়েদের মতন একদিকে পা দিয়ে বসেছিল।
একটা চড় খেয়ে দুদিকে পা রেখে বসে আর ঘামে।একটু যেতেই, কেন যেন, এখন নিজেকে মরণ মরণ
লাগছে। সোজা শহরে, সেখান থেকে পাজামা পাঞ্জাবি। তারপরেই একটা কী মন্দিরে বিয়ে। একটাই
মন্দির আছে এখানে বাকি সব খালিস্তানিরা ভেঙেছে।
— বাবা, বাবা
ছুটে
বেরিয়ে আসেন জনার্দন দারোগা
— তারে বিয়া করছি
একটু
থমকে যান জনার্দন। তারপরেই মারতে শুরু করেন জোড়ামুনকে। জোড়ামুন ঠিক করে আজ কিছুতেই
ফিট হবে না। মার খাবে। মাইয়ার কী খেয়াল হইল, বিয়া করল, এখন বাপে মারে। মারতে মারতে
মাইরা লাক। মরণ ঠিক করে, আজ সে মরে যাবে।‘আর একটা কিছু করবা, খুব খারাপ হইব’, বাবাকে সাবধান করে বিয়াস। অত মার খায়
জোড়ামুন, কোনোদিন কাঁদে না। এইমাত্র সে কান্না কী জিনিস বুঝতে পারছে। তবু মাটি থেকে
ওঠে না, যদি আবার মারবার ইচ্ছা হয় জনার্দনের।
—
তোর সুমিতের কী হইল মা? এইডা একটা কাণ্ড করলি?
— তোমার সুমিতের
মা কইয়া দিছে এই বিয়া হইত না, তারা মালখাঁনগরের বসুঠাকুর। উচা বংশের মাইয়া লাগে।লাথি
মারি তারে। আমি ঠিকই করছি।
রণপাগল মেয়ের
কাছে এবারেও হার মানেন জনার্দন।
পাঁচ।
অত অত রাবার বাগান,এই অঢেল সম্পত্তি এখন
বিয়াসের।লোকে জোড়ামুনকেও মালিক ভাবে? লেবাররা কেমন সমীহ করে। বেচাবিক্রির টাকাও তার
হাতে দেয়। একটি কুটোও নষ্ট হতে দেয় না সে। প্রথমে জনার্দন গেলেন, তার তিনমাস পরেই বিয়াসের
মা। কারোই শ্রাদ্ধশান্তি হয়নি। বিয়াসের মানা।
খুব গাছপালার
শখ এই বিপাশার। সারা বাড়িতে গাছ।যেন একটা জঙ্গল। কত কত ফুল।জোড়ামুনেরও ভাল লাগে। এখানে
ভোরে উঠতে মানা নেই।বরং যত রাত থাকতে ওঠা যায়, তত কাজের লাভ। জোড়ামুন ওঠে।সবাইকে কাজে
পাঠিয়ে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখে। বিয়াসের কোন গাছের কী লাগবে ভাল করে দেখে নিয়ে ব্যবস্থা
করে ভোরেভোরেই। দূর দূর থেকে নানারকম গাছের চারা আনে। বিয়াস সেসব লাগায় না। যেমনি আনে,
তেমনি মরে যায়। প্রথম প্রথম কেমন লাগত। এখন লাগে না।তবু আনে।
এখানকার
ছেলেরা জোড়ামুনকে আরেকটা নাম দিয়েছিল। ডাবল ইঞ্জিন। এরাই ওকে ধরে ধরে নিয়ে যেত। মদ
খাইয়ে জানতে চাইত, বিয়াসের শরীর, তার সবকিছু। ডাবল ঈঞ্জিন কেবল মদ খায়,মিটিমিটি হাসে।মদটা
সে শিখে ফেলেছে বেশ। কেউ এদিকে মারে,কেউ তার দ্বিতীয় মাথাটা রগড়ে দেয়। ডাবল ঈঞ্জিন
কাউকে কিছু বলে না। খুব নেশা হয়ে গেলে গেলাস ভাঙে। সবাই জানে তার গায়ে অসুরের শক্তি।
সরে যায়। ডাবল ইঞ্জিন বাড়ি যায় না। আরেকটু মদ কিনে জন্মান্ধ ললিতের বাড়ি যায়।
ওই
ছেলেদের আসরেই একদিন সে ছবিগুলো দেখেছিল। সুমিত আর বিয়াসের বিয়ের ছবি। অনেক অনেক ছবি।
ডাবল ইঞ্জিন সেসব দেখে আর ভাবে, কী সুন্দর এই বিপাশা। বিয়াস। সকালে বেড়ার ফাঁক দিয়ে
আসা আলোর মতন। তাকিয়ে দেখে, কী সুন্দর মানিয়েছে দুজনকে। এটা কি খেলার বিয়ে? কেন যে
সবটা হল না।
বিয়াস
কী পাশ জোড়ামুন জানে না।কী সুন্দর গান গায়। জোড়ামুন ওঘর থেকে শোনে। বিয়ের পরেপরেই বিয়াসের
আরো পড়াশুনা বেড়ে গেল। কী কী পাশ দিয়ে যেন চাকরি হল। জোড়ামুন বোঝে না অত যার টাকা,
সে কেন এসব করে। বাড়িতে গুচ্ছের বেড়ালকুকুর। ওসবের সঙ্গেই সময় কাটে বিয়াসের।বাগান আছে।আর
আসত অনেক ছেলেমেয়ে। গান শিখতে কেউ, কেউ পড়া করতে।জোড়ামুন বুঝতে পারে। বিয়াস নিজেকেই
ভুলে থাকতে চাইত। এখন কেউ আসে না।গাড়ি আসে, অফিস যায়। তবু সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে
জোড়ামুনের
— আয়
রাত।
জোড়ামুন বিয়ায়সের ঘরে যেত। ওই অপার শুষ্কতার মধ্যে যাওয়া আসা করে চলে আসত ।স্পর্শহীন,
আনন্দহীন, মারের থেকেও বেশি যন্ত্রণার ছিল এই কাজটা। কেমন যেন কান্না পেত জোড়ামুনের।
ও চলে এলেই বিয়াস চান করতে যেত। বমি করার শব্দও শুনতে পেত। একদিন ছেলে হল।
ছয়।
ছেলের
মার খেতে ভাল লাগে জোড়ামুনের। অনেক বড়ো হয়েছে। ছেলে হবার পরেপরেই এই ঘরে চালান হয়ে
যায় জোড়ামুন। এখানেই কে যেন খাবার দিয়ে যায়। জোড়ামুন ললিতদাদার বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে
আসে। ঘরে এসেও মদ খায়। টলে। আর তখুনি তার রাগ চাপে। আমি শালা চেয়েছিলাম জন্ম নিতে?
আমি কি কারো কাছে কিছু চাই? দাঁড়িয়ে থাকলে খাবার দেয় দোকানদার।এখানে কে রাখে খাবার,
ছাতামাথা? প্লেট ছুঁড়ে মারে। যা-কিছু সামান্য আসবাব, ভাঙাভাঙি করে। আর কান পেতে শোনে
কখন ছেলে আসবে। ওর শব্দ শুনলেই উৎপাত বাড়িয়ে দেয়। ছেলে এসে সোজা মারতে শুরু করে। জোড়ামুনের
ভাল লাগে। একদম বাবার মতন মারে ছেলেটা। বাবাকে মনে পড়ে যায়। লতপতে নাকে মারে, গালের
সঙ্গে মিশে থাকা কানে মারে, চোখের মধ্যে পরপর মারে। জোড়ামুনের বুক ভরে যায়। আর উৎকর্ণ
থাকে, কখন বিয়াস আসবে।
— থামো, ঘরে এসো
ছেলে চলে যায়।
সাত।
সকাল।
বিয়াস ডাকে, আয়
সকালে মারবে না
হয়তো। ঘরে যায় জোড়ামুন।
— পালক ডাক্তারির
চান্স পাইছে
—
পালক কেডা? বলেই বুঝতে পারে ভুল হয়ে গেল। বিয়াসের ছেলের
নাম পালক।
—
কালকে তারে দিয়া আমু, আমি চণ্ডীগড় যামু। তোর এয়ারপোর্ট অব্দি
যাইতে হইব। অনেক মালপত্র।
—
আর শোন, আগরতলার
জমিটা খালি করতে কইবি। নার্সিং হোম হইব। আমি আইয়া সব ঠিক করুম।
আট
।
এখানে পুকুর। আর এই জমিটা ভেজা ভেজা। অনেক
মোস্তাক গাছ। সন্ধ্যা। এই ঢিবিতে থাকে রিমা আর ঝিমা। কেউটে। সবাই বলে একটাই। বারবার
দেখা যায়, তাই দুটো মনেহয়। জোড়ামুন জানে দুজন। ও শিবুর ফার্ম থেকে ছোটো ছোটো মুরগির
বাচ্চা আনে। এখানে গর্তের সামনে বেঁধে দেয়।সকালে দেয়, সন্ধ্যায় দেয়। একটু পরেই মুরগির
বাচ্চা হারিয়ে যায়। রিমাঝিমা, আমার পোলাডা ডাক্তার হইছে। আমারও পোলা, আবার ডাক্তার!
শুনছস? নার্সিং হোম করব। আমি বুড়া হমু রোগ হইব। পোলা আর মারত না, চিকিচ্চা করব।কালকে
যাইব পড়তে। বিয়াসদিদি দিয়া আইব । কই জানি চণ্ডীমার কাছে। ফিরা আইলে দিদি একলা হইব।আমরা
তখন জামাই বউ হমু।
শ্রাবণ শেষ হল।
রিমাঝিমার বাচ্চা হয়েছে মনেহয়। ওদের কেউই কাণ্ডটা করেছে।রিমাঝিমা কেউই এমন করবে না,
জোড়ামুনের পা থেকে সোজা উপরে উঠে যাচ্ছে একটা বেদনা।জোড়ামুন মাটিতে পড়ে যায়। ও ফিট
হতে জানে বটে, কিন্তু মুখে গ্যাঁজলা তো তোলে না।
__________________________
[প্রকাশিত, 'পরিচয়' ১৪২৮ শারদ সংখ্যা]
খুব ভালোলাগল গল্পটি
উত্তরমুছুন