রবিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সদাপুরাণ-২৪



অশোক দেব
সদাপুরাণ-২৪

গপিস্ট কি সত্য বলেন নাকি মিথ্যা? তাঁর মতে সত্যনারায়ণ একাধারে হিন্দুর দেবতা আবার মোছলমানের পীরযা-ই হোক, এখন জোছনাকে লাগছে সত্যনারায়ণ পূজার সিন্নির মতনআকাশ হতে কুয়াশার পাত্রে পরিবেশিত হচ্ছে জোছনা যেন প্রসাদ। মনের মতন করে সাজানো নৌকাটি পেট ভরা আনন্দ নিয়ে ভাটির দিকে যাচ্ছে। নদীর যেটুকু প্রবাহ, সেটাই তার গতি। হাল ধরে আছে মাধব। সে কি পুরুষ না খোজা কেউ জানে না। কেবল মুচকি মুচকি হাসে। সেই হাসিটুকু ছাড়া আর কোনও ভাষা জানা নেই তার? তবে সে নদীর ভাষা জানে। নদীকেই সে মাগী বলে। আর কাউকে মন্দ বলে না। খায় কী যেন সারাক্ষণ। কী যেন চিবাতে থাকে। মুদ্রাদোষ। ‘মাধবাদা, সারাদিন কিতা চাবাও?’ মাধবের বাঁধা উত্তর, ‘লাইফ’হয়তো সে একটিই ইংরেজি শব্দ জানে। হাল ধরে আছে। মুচকি মুচকি হাসছে আর লাইফ চিবুচ্ছে। এ ছাড়া নৌকা কেউ বাইছে না। বৈষ্ণবীর চর হতে এসেছে নিখিল। নৌকায় মানুষ নেই। সকলে ঘুঙুর। এমনকি নৌকাটি নিজেও। নিখিলও ঘুঙুর, আগে জানতাম না জোছনা এসে নদীর দুপারে হঠাৎ গাঢ় হয়েছে। পাড়ের একেবারে ধার ঘেঁসে যে জোছনা সেটি হাল্কা। তার সুর আকাশের সঙ্গে মেলানোইতিউতি শেয়াল আছে। ছোট ছোট ঝোপ হতে মুখ বের করে। আবার লুকিয়ে যায়। নিশ্চয়ই আছে কোনও পেঁচা ওই যে অশ্বত্থ গাছে। তার কাছে আঁধার আর জোছনায় ভেদ নেই। সে-ও আসলে ঘুঙুর। একটা কোম্পানি চেয়ারে বসে আছেন গপিস্ট বুড়া। এটা কোন এক চা বাগানের ম্যানেজারের ছিল। চেয়ারটা গপিস্টের পছন্দ হলে নিয়ে আসেন। তিনি যা চান, সেটা চান। চেয়েছেন মানে হাসিল করেছেন। প্রাণকৃষ্ণ আচার্য এসেছেন। তিনিও ঘুঙুর। গান গাইবেন। দূরে দূরে মানুষের বাড়িঘর এখন আলয় হয়ে আছে। ছোট ছোট আলো। জ্বলতে হবে বলে জ্বলে আছে। গপিস্ট চারদিকে তাকান না। চোখ বুজে থাকেন। জরিনার মানা পেরিয়ে মজিদভাই আসতে পারল না। আমি এলাম। আমার জন্যও একটা বাহারি চেয়ার এসেছে। বসে আছি। সত্যই বলেন গপিস্ট। নদীর নিজস্ব গান আছে। জল হতে উত্থিত একটি শব্দও আসলে নয়েজ নয়। মিউজিক। যাত্রীরা সব একটা আনন্দ পরিধান করে আছে। আমার কেবল মনখারাপ। কেন মানা করেছিল জরিনা? এ নৌকাটা কি মৃত? নৌকার শবদেহে বসে ভেসে চলেছি আমরা? যেমন মৃত গবাদির বহমান শরীরের ওপরে বসে ভেসে যায় শকুন।
          এখন ছাতারিয়া গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছি। আগে ওই গ্রামে যাবার একমাত্র উপায় ছিল সাঁতরে যাওয়া। সাঁতারিয়া। সেই থেকে ছাতারিয়া। বাঁদিকে বৈষ্ণবীর চর। অনেক অতীতকালে গোমতীর নিজের খাতবদলের দরকার পড়েছিল। যেমন সর্পিণীর খোলশ পাল্টানোর প্রয়োজন হয়। গোমতী তাই একটা মড়াগাঙ ফেলে রেখে এইখানে চলে আসে। সেই খোলশ ছেড়ে এই পশ্চিমে আসার সময় নদী বিশাল এক চরা প্রসব করেছিলনতুন সেই চরায় কোথা হতে এক বৈষ্ণবী আসে। আখড়া গড়ে। সূর্যাস্তের মতন গায়ের রং ছিলো তার। ক্ষীপ্রতায় তিনি পানক সাপ। তার আখড়ায় অচেনা ছেলেরা আসে। তারা সারাদিন ঘুমায়। রাতে জাগে। রাত জেগে কী সব করে। এইসব কথা গপিস্টের কাছে শোনা সত্যমিথ্যার মালিক ওই গপিস্ট, রহিম মিয়াঁ। তিনি বলেন বৈষ্ণবী আসলে অনুশীলন সমিতির লোক ছিলেন। আর ছেলেরা রাত জেগে অস্ত্রচালনা শিখতো। রাজা সব জেনেও বাধা দিতেন না। সেই হতে এই এলাকার নাম বৈষ্ণবীর চর। বৈষ্ণবীর চরের নিখিল পাল আসলে নাকি ব্যর্থ প্রেমিক। এখন ঘুঙুর আর প্রাইমারি টিচার। গান গায় এমন যেন সে গানের সঙ্গে সঙ্গম করছে। তাই করে করে ব্যর্থ প্রেমের শোধ তোলে নিখিল।
          সোনালীর মা তার রূপের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে যাননি এখনও।  দক্ষিণ স্তনখানি একটু দেখিয়ে শাড়ির আঁচল সাজানো। যেন আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখা ওই শাড়ির পাড়একটুও সরে না। সরলেই যেন আঁচলকে শাস্তি দেওয়া হবে। সোনালীর মা-ই নৌকার সকল নারীদের নেত্রী।  এরা সবাই মিলে গোমতীর ঢেউয়ের সঙ্গে কী একটা মিশিয়ে দিয়েছে আমার খুব নেশা হচ্ছে। কেমন তন্দ্রা পাচ্ছে কামরাঙাতলী পেরিয়ে যাচ্ছে নৌকা। গপিস্টের পায়ে একরকমের মোজা। না হ্লুদ, না লাল। না সুতা না উল। এ যেন কী দিয়ে তৈরি। কেউ এসে গাঁজার কল্কি তাঁর সে মোজায় ছুঁইয়ে নিচ্ছে। কেউ এসে মদের পাত্র। সোনালীর মা ব্যস্ত। মেয়েরাই এসবের প্রধান ব্যবস্থাপক। ‘আরেট্টু গেলেই তো কুর, মনে আছেনি রে মাধব’গপিস্ট হাওয়ার মধ্যে বলেন। মাধব লাইফ চিবানো একটু বন্ধ রাখে। হাসিটি আছে। ‘আমরা কুরের কাছে গেলে এনা কুর। না গেলে কিয়ের কুর? আমনে আমারে নি শিখান গুমতির ঢং? মাগীরে আমি তিলে তিলে চিনি’কামরাঙাতলীর বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে বাঁদিকে হঠাৎ একটা টিলা। ওপরে মাটি নীচে পাথর। সেখানে এসে গোমতী বাঁক নিয়েছে। আর প্রায় তিন কিলোমিটার ব্যাপে একটা ঘূর্ণি গড়েছে। কুর। জল ঘুরে ঘুরে কেবল নীচের দিকে চলে যায়। টেনে নেয়। মাঝিরা এখানে সাবধান থাকে। কারা যেন নদীর পাড়ে বাঁশের মাথায়  লণ্ঠন বেঁধে রাখে। এখন নেই। মহারানি ব্যারেজ হবার পর নদীতে আর নৌকা চলে কই?
নিখিল গাইছেঃ
‘দেখবি যদি সেই চাঁদেরে
যা যা কারণ সমুদ্রের পারে
।।
যাস নে রে মন সামান্য নৌকায়
সেই নদী বিষম তড়কায়
প্রাণে হবি নাশ, থাকবে অপযশ
পার হবি যদি সাজাও প্রেমের তরীরে
।।
তারণ্য কারণ্য আড়ি
যে জন দিতে পারে পাড়ি
সেই বটে সাধক, এড়ায় ভবরোগ
বসতি হয় তার অমর নগরে’
।।

          আমার নেশা হচ্ছে? কিসের নেশা? চোখ বুজে আসছে। সোনালীর মায়ের গায়ের গন্ধেই আমার এই নেশাটা হচ্ছে? নাকি তার কথা শুনে, ‘হগলে মনে করে আমি নিরক্ষর। না। হগলে মনে করে সোনালীর বাপ আসলে সোনালীর বাপ। না। সোনালীর বাপ আসলে এক চেডেরবাল খানসেনা। আমি তহন ষোলো বছর পার অইয়া গেছি। বাপের চোখের মণি আছিলাম। বাড়ির থিকা তুইল্যা নিল আমারে। বাপে টেকা সাদলো, সোনা সাদলো, খানে নিল না। আমারে নিল। সারা রাইত আমারে বারে বারে, বারে বারে... সকালে আমি একটা লেংডা। দেহনের মতন জিনিস। খানসেনার থিকা খারাপ হেই মানুষের গোল অইয়া দারাইয়া থাহন। দেখন। কেউ মাথা নোয়াইয়া দেহে আমার নীচে দিয়া রক্ত পড়েনি... আমি কুমারী আছলামনি... আমার বাপে আর আইলো না। বাড়ির থিকা কেউ আইলো না। আমি য্যান ক্যামনে এই দেশে আইছি... ঘুমাও নিকি’?
- না, কন
- আমি তোমার ঘরে যাই। তোমার হাতের লেখা তো বিরইন ধানের মতন। আর কী সোন্দর হগলের কতা লেইখ্যা রাহ। হুনো, মাইনসে কু কু করলে গাও মাখবা না... এমন বহুত কু আমি হুনছি। অহন যে শরিলে শরিল নাই, অহনও হুনি। জগতে তুমি যত দুব্বল অইবা, জগৎ তত খানসেনা অইব। কেউ রক্ত বাইর করব, কেউ নুইয়া দেখবো রক্ত বাইর অয়নি... তোমার লেখা বড় ভালো লাগে বাপ... তুমি আমাগো রবিন্ডনাথ।
          আমার চোখ বুজে আসছে। কে যেন ঠিকই ঝুলিয়ে রেখেছে একটা লণ্ঠন নদীর পাড়ে। আকাশপ্রদীপের মতন। দুলছে আলো টা। সজুর ভোমা ঘুড়ির কথা মনে পড়ে। সে-ও একটা ছোট লণ্ঠন আকাশে দুলিয়ে দিতো ওই বিরাট ঘুড়ির সঙ্গে বেঁধে। আর সেই টুইল সুতার একঘেয়ে  একটানা শোঁ শোঁ শব্দ। কে দুলছে এখন? লণ্ঠন নাকি নৌকা? কোথা হতে শব্দটা আসছে? কে যেন এত আনন্দ, এত বাদ্যযন্ত্র, এত এত গানসমেত নৌকাটাকে টানছে। কে? একটা আলোর টানেলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে একটা নৌকা। একটা না-পুরুষ তার হাল ধরে শূন্যতা চিবিয়ে চলেছে। কে যেন গান গাইছেঃ
‘মায়ার গিরাপি কাট
ত্বরায় প্রেমতরীতে ওঠ
কারণ সমুদ্রের নাও, পার হয়ে হুজুর দাও...’
          ধীরে ধীরে সে গানও যেন কোথাও ডুবে যাচ্ছে। একটা রমণীয় ঘ্রাণ ছড়িয়ে সোনালীর মা তার ডানস্তনের কিছুটা ভাস্বর করে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমার লেখা ভুলে যাওয়া কবিতা সে বলে। গড়গড় করে বলে। আমি কেন লিখেছি সেসব? নেই এমন এক নারীকে আমি চিঠি লিখি। সোনালীর মা সেসব থেকে গড়গড় করে বলে। শেষে বলে, ‘বুজলা রবিন্ডনাথ, এমুন কেউ মাইয়ালোক আসলে থাকলে তোমার লেখতে মনে লইত না। তুমি একলা থাহনের জাদুডা শিখ্যা লাইছো...’
          আমি একা হয়ে যাই। সর্বস্ব মিথ্যে হয়ে যায়। সোনালীর মায়ের গায়ের ঘ্রাণে কে যেন জল মিশিয়ে সোঁদা করে দিচ্ছে। এমন তীব্র সে গন্ধ যে, আমি শ্বাস নিতে পারছি না। তারপর আর কিছু মনে নেই।

          সকাল। মাথা ধরে আছে। অনেকক্ষণ লেগে গেল এটা বুঝতে যে আমি আছি মেলাঘর হাসপাতালে।

‘ইয়েস’ বলে লাফিয়ে ওঠেন নন্দ দারোগা। ‘ইয়েস, একটা নৌকাডুবি হইসলো, থ্রি ডেড, ওয়ান মিসিং... ইয়েস... যামুগা, যামুগা... ইয়েস, ইট ওয়াজ রহিম দ্যা গপিস্ট... ইয়েস, হি ওয়াজ মিসিং...’




1 টি মন্তব্য: