রবিবার, ২ জুলাই, ২০১৭

সদাপুরাণ-১৯




অশোক দেব
সদাপুরাণ-১৯

একটা কাউকে টেলিফোন করতে চায় জরিনা। যে কাউকে। ‘টেলিফোনে হাসন যায়নি? হাসি উডেনি? কেউ য্যান হাসির কতা কইল, হিডা মুখ না দেইখ্যা ক্যামনে বোজেন?’ আজ কদিন ধরে এসব চলছে। পরিভাবি টেলিফোনে কথা বলতে চান।
   কার লগে কইবেন?
   যার লগে খুশি, মাইয়ালোক না
   বেডা?
   মাইয়ালোক না অইলেই অইবো
   আইচ্ছা
   আমনে খালি আইচ্ছা আইচ্ছা কন। কই কওয়ান না তো?
   আজগা বিকালে
      আজ সেই বিকাল। মাধুকে বলেছি, ঘরদোর সব গুছিয়ে দিয়ে গেল। সব ফুলদানিতে নতুন ফুল সাজালাম। আচ্ছা, মজিদভাই কি আসবে ভাবির সঙ্গে? জরিনার এসব খেয়ালে মজিদভাই থাকে না। এখন ওই পাখিটা এসেছে। ছোট। দোয়েল হবে। এইখানে ছাতে কিছু চাল, গম, আধভাঙা ডালিম আমি রেখে দিই। পাখিরা খায় এসে।  আজকাল পাখি কমে গেল। কেবল এইটা আসে। জানালা দিয়ে ভেতরে তাকায়। দেখে নেয় আমাকে। তারপর একবার খায় অনেকক্ষণ ডাকে। তারপর আবার খায়। যেন ডাকাটাই আসল। খাওয়াটা কিছু নয়। সবচেয়ে মজার কাণ্ড করে শালিখগুলো। এরা ডাকে, আর ডেকে ডেকে বুকের ভেতরে ঠোঁট ঢুকিয়ে কাকে যেন কী দেখায়। যেন বলে, ‘এইখানে, এইখানে’। এখন শালিখ আসে না। এরা এলে বেশ সরগরম হয়ে যায় ছাত। সকলে মিলে কী যেন একটা আলোচনাসভা বসায়। কত কী বলে। আর ওই, ‘কই কই’ বলে ডাকে। তারপর বুকে ঠোঁট ঢুকিয়ে দেখায়, ‘এইখানে এইখানে’। দোয়েলটা একা। সে কেবল একটা শিস বাজাতে শিখেছে। কেমন বিরহী। কেমন একাকীত্বের পাচারকারী এই পাখিটা।
      এমনভাবে বসেছি, যেন জরিনা এলে দেখতে পাই। মদের গেলাসটেলাস, বোতল, যা-কিছু সব গোছানো হয়েছে। আবার ফিট হয়ে গেলে বিপদ। কী কাণ্ড করে জরিনা। কিন্তু ফোনে কাকে ধরিয়ে দেবো? আজ দুপুরে র‍্যান্ডম কয়েকটা নম্বর লাগালাম। একটাকেও যুতের মনে হল না। আমার তো ওই কয়েকটা মাত্র নম্বর। সবই কেজো। আর জামাইবাবুদের নম্বরে দিলে তো মহা ঝঞ্ঝাট। জরিনা জানে না মোবাইল ফোন এসে গিয়েছে এখন। পাড়ায় আমার একটাই আছে। রাঙ্গাদি দিল। সেদিন সজু বিলটিলের খবর নিলো। বোঝা গেলো সেও একটা কিনতে চলেছে। ল্যান্ড ফোন থেকে আমার নম্বরটাই ধরে দেবো? আমিই কথা বলব? এসব ভাবছি, এর মধ্যেই চলে আসে জরিনা। কেমন একটা শাড়ি পরেছে। এর শাড়ি পরার ধরনটা যেন কেমন। শাড়িটা চুপ করে থাকে, শরীরই বাঙময়। আমি দরোজা খুলে দিই।
   কন
   কী কমু?
   মাইয়ালোকের লিগ্যা বইয়া থাকতে কেমুন লাগে?
   আমি তো পক্ষী দেখছিলাম
   তাইলে দেখেন, আমি যাই
     যা বলা, সেই কাজ। ফিরেই যাচ্ছে জরিনা। বেরিয়ে ঠাস করে গেট লাগিয়ে দিল। পথে গিয়ে ওকে দাঁড় করানো, সাধা, কেমন লাগবে। আমি ছাতে চলে যাই। দাঁড়িয়ে দেখি। জরিনা যে পথে এলো, সে পথেই ফিরে যাচ্ছে। এর মাথায় কী খেলা করে কে জানে! কী বলা উচিৎ ছিলো আমার? তাকিয়ে থাকি। অবাক, হঠাৎ করেই, যেন কিছু মনে পড়লো, হনহন করে ফিরে আসছে ও। রেগেছে? আমি ছুটে গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়াই। আমাকে পাত্তা না দিয়ে একপ্রকার ঠেলে ঘরে চলে আসে। একটা কেমন চটি। ও দুটোতে কেমন ওর পায়ের আকার চলে এসেছে। এমন ভাবে চটিগুলো রাখা, যেন কেউ এদের কোনোদিন পরেনি।
   জুতাত কিতা?
   না
   কতা কমু, না-দেখা মাইনসের লগে, দেন
   আইচ্ছা
আমি ওই র‍্যান্ডম একটা নম্বর টিপি। একটা লোক।
   হ্যালো
   নেন কতা কন
চোখের ইশারায় জরিনাকে ডাকি। ফোন ধরে সে। চুপ। ওদিক থেকে হ্যালো, হ্যালো করছে, শুনতে পাচ্ছি।
   আমি, আমি কইতাছি, জরিনা
ওদিক থেকে কী বলছে এবার আর শোনা যাচ্ছে না।
   আমি হাসলে আমনে দেখবেন?
লোকটার মুখ ভাবছি। কে যেনো আজ এই জরিনার খপ্পড়ে পড়েছে, কষ্ট হচ্ছে তার জন্য।
   কেরে? হাসি বুঝি ভালা লাগে না?
   এই বেদমার বাচ্চা, আমি একটা মাইয়ালোক অইয়া তোরে কই হাসতি, হাস। হাসতে টেকা লাগে না।
কী যেনো বলেছে লোকটা। জরিনা খুলে যায়। সেই হাসিটা খুলে দেয়। সেই একটু উল্টে আসা, সেই পাকিয়ে পাকিয়ে হাসিটা... সেই বুনো ঝরনা... শেষে দুম করে ছেড়ে দেয় রিসিভার। সেটা ঠক করে গিয়ে টেবিলে পড়ে। জরিনা হাসতে হাসতেই আমার কাঁধে হাত রাখে, যেনো ইয়ারদোস্ত।
   সদামিয়াঁ
   কন
   এই টেলিফুন দিয়া আমনে কিতা করেন?
   কতা কই
   কার লগে?
   দিদিরা, মা, জামাইবাবু, বন্ধুবান্ধব... কাজে...
   কী কাজ?
   কতই তো...
   একটা কন
   এই যেমুন খবরাখবর করা...
   আমনের খবর কী সদামিয়াঁ?
   কী খবর?
   টেলিফুনে য্যান কন, এমুন একটা খবর কন আমারে
   ভাবি...
   কন, কন, আমনের খবর কন... কেমুন আছেন... আজগার খবর কন, কালকার খবর কন। আইচ্ছা আইয়ে কালকার খবর কন।
   হিডা আমি ক্যামনে জানুম?
   বিষ্টি আইবো
   মানে?
   এট্টু পরে বিষ্টি আইবো
আমি জানালার দিকে তাকাই। পাখিটা নেই। আমার কাচের ঘরের ভেতরে এসে বাতাস পড়ছে হুমড়ি খেয়ে। কালকের খবরের কাগজ লতপত করছে। ঠিকই একটু মেঘলা করেছে আকাশ। সত্যিই একটু ঠাণ্ডা বাতাস বইছে সঙ্গে। জরিনা কাচের ঘরে আসে। একটু হাঁটে। ছাতে গিয়ে দোলনাটায় বসে। নিজেকে দোলায়। আমাকে হাতের ইশারায় ডাকে। গিয়ে দাঁড়াই।
   বন
আমি কোথায় বসবো, ভাবছি। জরিনা পা দিয়ে দেখায়, ওর পায়ের সামনে, ছাতের মেঝেতে বসতে। বসি। আমার কোলে সে তার পায়ের পাতা দুটি রাখে।
   দেখেন
   কিতা দেখুম
   দেখেন, আমনে জানেন কিতা দেখবেন...
   পা চিনেন?
   মানে কিতা?
   দেখেন, পর্বত দেখেন? ইডাত দেখেন উপরের দিকে... দেখছেন? আইচ্ছা এইডাত দেখেন পদ্মপুষ্প দেখছেন? শঙ্খ? রথ দেখেননি? মীন দেখছেন? অঙ্কুশ দেখছেননি একটা?
   কিতা কও পরি? আমি তো বুঝিনা
ছোট করে একটা ঠেলা দিতেই আমি পড়ে যাই। তখুনি দূর হতে ছুটে বৃষ্টিটা এলো। স্পষ্ট দেখতে পেলাম ছুটে এলো বৃষ্টির ফোঁটাগুলি। আমিও ছুটে কাচের ঘরে চলে যাই। জরিনা ওখানেই বসে থাকে। আর জোরে জোরে বলে, ‘হ্যালো, হ্যালো...’ কী করবো আমি?
     দুলে দুলে বৃষ্টি হচ্ছে। এদিক থেকে প্রথম আসছে, পরেই ওদিক থেকে হচ্ছে। একটা কেমন বাতাস এসব করছে। কামরাঙা গাছটা আনন্দে কুটিকুটি। দূরে গোমতীর বুকে কেমন সাদা ফুটফুট এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। ঢেউও। আকাশ বলতে কিছু নেই এখন। যেন কখনও ছিলো না। বৃষ্টিই আসল। ‘হ্যালো, হ্যালো... হ্যালোর বাইচ্চা...’ চিৎকার করছে জরিনা... দুলে দুলে ভিজছে... কখন চুল খুলে দিয়েছে যেন। এইসব বাতাস, এইসব বৃষ্টি যেন ওর ভেজাকেই সঙ্গত করছে। আমি কি যাবো? আমি যে আছি, সেটা পরিভাবিকে দেখে বুঝবার উপায় নেই। কেউ কি আছে পৃথিবীতে? আর কেউ? সব কাচ ঝাপসা হয়ে গেলে সিঁড়ি বেয়ে কে যেন ওপরে উঠে এলো। সোজা আমার সামনে। মারতেই কিছুক্ষণ অন্ধকার দেখলাম। ওই একটুকু সময়েই আমি প্রথম শুনলাম বৃষ্টির শব্দটা। আবার কী করতেই আমি চোখ মেলে সোজা হয়ে দাঁড়াই। সজু। ও পরপর আমাকে মেরে চলেছে। মেরেই চলেছে। আমি এদিকে ওদিকে মার খেতে খেতে দেখি, জরিনার কিছু যায় আসে না। দুলছে আর ভিজছে। একসময়, সে আবার বলে, ‘হ্যালো...।’ সজু থামে। ওইদিকে যায়। একেবারে কোনার দিকে দাঁড়ায় গিয়ে জরিনা। সজু প্রায় ছুটে যায়। আজ যেনো ওকেই মেরে ফেলবে। কাছে যেতেই ঘুরে দাঁড়ায় জরিনা, ‘হাস’
   কিতা?
   হাসতি কইসি তোরে, হাস...
জরিনা সজুকে কাতুকুতু দেয়। ‘আমার সজুসা, আমার আল্লাদিডা মস্তান অইয়া গেছে’ কাতুকুতু দেয়।‘আমার আদরটা, আমার ভোমাগুড্ডি’ সারা ছাতে ওরা খেলছে। হাসছে এবার সজু। ও খালি চাইছে, কোনওমতে জরিনাকে জাপটে ধরতে। মাথা টনটন করছে আমার। এতক্ষণ লড়াই করে ভাসটা আর পারলো না। ফুল সহ মাটিতে পড়ে যায়। ভাঙে না। দোলে, দুলে দুলে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। একবার লাল ফুলটা ওপরে আসছে, আবার নীচে চলে যাচ্ছে। কী একটা শব্দ হতেই দেখি সজু নেই। ছাতের থেকে টপ করে পড়ে গিয়েছে সে। ওইদিকে পাশের বাড়ির পুরনো একটা একচালা। টিনের। তারই শব্দ হল। হতেই ‘কু, কু’ করে ওঠে জরিনাভাবি। ওর এই শব্দটা অন্যরকম। এতে ইয়ার্কি নেই। কাছে যাই।
   হ্যালো...
   কন
   নিজের খবর লন। নিজের... কিতা চান, কিতা কইতেন চান, কইতে শিখেন... কেডায় একটা কুই দিলো, আর আমনে বোরখা পইরা লান
   না, মানে...
   কিছু মানে নাই...
   ভাবি
   ফরমাইয়ে
   পায়ের মইদ্যে কী দেখাইলা?
   পইড়া লইয়েন। ঘর ভর্তি বই আর ওই কতা কওনের টেলিফুন... এই বালছাল দিয়া কী করবেন? নিজেরে পড়েন, নিজের সংবাদ লন। চলেন আমি যামু, নীচে লামেন
     নেমে আসি। কী করব? এমন ভেজা শরীরে ভাবিকে যেতে দেওয়া ঠিক হবে? জরিনাও নেমে আসে। রিসিভারটা এমনি এমনি তুলে বলে, হ্যালো... তারপর মায়ের আলমারি খুলে একটা শাড়ি টেনে নেয়। আরও কয়েকটা পড়ে যায়। সাদা। ওঘরে গিয়ে পাল্টে আসে। সোফায় বসে। দূরে গিয়ে বসি। চুল সব মুছছে। ঝোলানো একটা টাওয়াল থাকে এখানে। মা এলে লাগে। সেটা দিয়েই চুল মোছে। ফাঁক করে করে একটা একটা গোছা করে মুছে চলেছে। ব্লাউজ নেই। বারবার বুকের কাছে কী যেনো ঢাকছিলো জরিনা। বারবার চুলের জন্য মুখ তুলে দিচ্ছিলো ওপরের দিকে। যেন সেই শালিখ পাখি, বারবার বলছে, ‘কই কই?’ বারবার বুক দেখিয়ে নিজেই বলছে, ‘এইখানে এইখানে’।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন