অশোক দেব
সদাপুরাণ-১৬
সদাপুরাণ-১৬
সোনালির মা হাঁটে না। মাড়িয়ে যায়। কিছু নারী পৃথিবীকে পুরুষের পেতে রাখা বুক মনে করে। সোনালির মা-ও তেমনি হাঁটে। তার আছে একটা পোষা বৈধব্য। স্বামীটি সোনালি পর্যন্ত এসে আর নিজেকে টেনে নিতে পারেনি। ওই নারীকে ‘সোনালির মা’ করে তোলাই তার একমাত্র কাজ ছিল। ওটি করার পরেই সে মরে যায়। মরেছে নাকি উবে গিয়েছে কেউ জানে না। সোনালির মা ধাত্রী। পৃথিবীর কোথাও ধাত্রীবিদ্যা শেখানোর গোপন ক্লাস ছিল। এখন উঠে গেছে। সোনালির মা সেখান থেকেই ওসব শিখেছে।কারণ, তার আগে বা পরে এ কাজ আর কেউ করেনি এদিকে।
আর
সকলে যেমন ‘কু’ করে আমাকে ডাকে, সোনালির মায়েরটা তার থেকে আলাদা। এইটার মধ্যে শেয়ালের ডাক-টা নেই। কেমন একটা ইঙ্গিত আছে। যেন
আমি তার নাগর। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে সেই ইঙ্গিত করে যাচ্ছে। একটা লাল আছে আকাশের নিজস্ব। সূর্যোদয়ের সে লালিমায় পৃথিবীর ভাগ নেই। আকাশে
শুরু হয়ে আকাশেই শেষ হয়ে যায়। পৃথিবী কেবল দেখে, পায় না। ছাদের গাছে জল দিচ্ছিলাম। ‘কু’-র ধরন শুনেই
বুঝি নীচে সোনালির মা। কার্নিশে এসে দেখি এক ফোঁটা জল লাল হয়ে আছে। এটা একটা
গন্ধরাজ। এর পাতা বেয়াড়া রকমের সবুজ। কালো মেশানো। ওই একটি পাতা। তার ডগায় একটু একটা জল। কিছুতেই পড়ে যাচ্ছে না।
হয় সে পাতাটিকে ছাড়ছে না, নয় পাতাটি তাকে ধরে রেখেছে। সেই জলে আকাশের নিজের লাল
এসে পড়েছে। তাতেই লাল হয়ে আছে এইটুকু জল। আমি তাকেই দেখছিলাম।
‘আমনেও দেখি বেডা অইছেন আইজকাইল। উপর থিকা কী দেখেন? খোলেন। ভিতরে আইয়া দেখামু’। যে যার ভাব নিয়ে থাকে। মানুষের একমাত্র কাজ সন্তানের জন্ম দেওয়া আর তার আয়োজন করা। সোনালির মা তাই বুঝেছে।সারাক্ষণ ওইসব ইঙ্গিত দেওয়াই তার বিনোদন। এর গায়ের রঙটি প্রায় গেরুয়া। ঠোঁট নেই, কে যেন ঠোঁট এঁকে রেখেছে তার ঠোঁটে। তাতে পানের লালিমা লেগে কেমন উৎসব। সারা শরীরে তার অনেকগুলো শরীর। শাড়ি দিয়ে সেসব ঢাকে।নিজেকে ঢেকে এমন প্রকাশিত করা যায়, সেটা সোনালির মা ছাড়া আর কে জেনেছে! এখন দরোজা না খুলে দিলে পাড়া মাথায় করবে। তড়িঘড়ি নেমে যাই। খুলে দিই দরোজা।
‘আমনেও দেখি বেডা অইছেন আইজকাইল। উপর থিকা কী দেখেন? খোলেন। ভিতরে আইয়া দেখামু’। যে যার ভাব নিয়ে থাকে। মানুষের একমাত্র কাজ সন্তানের জন্ম দেওয়া আর তার আয়োজন করা। সোনালির মা তাই বুঝেছে।সারাক্ষণ ওইসব ইঙ্গিত দেওয়াই তার বিনোদন। এর গায়ের রঙটি প্রায় গেরুয়া। ঠোঁট নেই, কে যেন ঠোঁট এঁকে রেখেছে তার ঠোঁটে। তাতে পানের লালিমা লেগে কেমন উৎসব। সারা শরীরে তার অনেকগুলো শরীর। শাড়ি দিয়ে সেসব ঢাকে।নিজেকে ঢেকে এমন প্রকাশিত করা যায়, সেটা সোনালির মা ছাড়া আর কে জেনেছে! এখন দরোজা না খুলে দিলে পাড়া মাথায় করবে। তড়িঘড়ি নেমে যাই। খুলে দিই দরোজা।
আজ এনেছে দুই জোড়া দুল। একটা কাঁকন, দুটো
আংটি। সোনার।দোকান থেকে মেপে মেপে এনেছে। বেগুনি রঙের হাল্কা কাগজে মোড়ানো এইসব
গহনা। কোন্টার কত ওজন স্যঁকড়া পুটুলির কাগজে লিখে দিয়েছে। দামও। নিলাম। সকাল সকাল
ত্রিশ হাজার বেরিয়ে গেলো
— নন্দদা
— কহেন
মাঝে মাঝে নন্দ দারোগা যাত্রার ডায়লগের মতন
করে কথা বলেন। হাসি পেয়ে যায়।
— নাহ
— আরে কহেন কহেন...
— সদানন্দ সোনালির মা-র থিকা সোনা কিনতো?
— কিনতো
— সোনালির মা এত সোনা পাইত কই?
— পয়দা করতো
— ঠিক কইরা কন
— আরে ভাই, আমনে কি এই জগতে আছিলেন না? সোনালির মা কি মইরা গেছে? এখন বুড়ি
হইছে। ধাত্রীর কাম করে না। তখন করতো।
— তা তো জানি, সোনা কই পাইতো?
— ধুর মশাই, মানুষে দিত। বাচ্চা হইলে দিত। এত সোনা দিয়া কী করব, বেইচ্যা দিত
সোনালির মা।
— সদা কী করতো এত সোনা দিয়া?
তড়াক করে উঠে যান নন্দ দারোগা। পেটানো শরীরে
আজকাল মেদ জমেছে। জুলপি ছাড়া বাকি চুল কলপ করা। হাতে একটা জলের বোতল ছিল। সেটা
নিয়েই আলমারি খুলতে যান, পারেন না। বোতল রাখতে ফিরে আসেন সেন্টার টেবিলটার কাছে।
চোখ সরু করে বলেন, ‘ নারী কিতা?’
— কিতা?
— আমিও জানি না
— হঠাৎ এই কতা?
— সদানন্দ জানতো
— কেমনে বুঝলেন?
কথা বলতে বলতেই আলমারি থেকে কয়েকটা গহনার
বাক্স বের করে আনেন নন্দ দারোগা। সিনেমার স্মাগলারের মতন করে এদের ডালা খোলেন এক
এক করে। উরিব্বাস কত গয়না! একটাতে শুধু নাকছাবি। একটাতে দুল, শুধু কানের গহনা।
একটাতে নানা রকম চুড়ি। শাড়ি গাঁথার পিনও আছে। একটা বাক্সে কেবল আঙটি।
— ইডি কিতা? কার?
নন্দদা চুপ। কথা বলেন না। আমার কেমন ভয় ভয়
করছে। আমার কোলে সেই ডায়েরিটা। সোনালির মা-র এন্ট্রিটা খোলা। হঠাৎ নন্দদা সেই
ডায়েরি কেড়ে নেন। সব একে একে গুছিয়ে রাখেন। কত কত টাকার গয়না। আমি ভাবলাম, এখন উঠে
পড়াই ভালো। উঠতেই নন্দদা বলেন, ‘বন, বুঝবেন’। একটা চিঠি লেখার প্যাড এগিয়ে দেন।
সবজে শক্ত কাগজ।
স,
একটা গাছের নীচে তোমাকে প্রথম সাজালাম। নরম, বিনীত কাঁটা দিয়ে
পাতার সঙ্গে পাতা আমি জুড়ে দিয়েছিলাম। সে ছিল একটা বিকেল। সেই পাতার পোশাক তোমাকে
পরালাম। পৃথিবীতে এই প্রথম কেউ সলাজ হেসেছে। তোমার মধ্যে লজ্জা লুকনো ছিল, আমিই
সেটি আবিষ্কার করেছি। আমিই আবিষ্কার করেছি তোমার শরীর। পাতার আড়াল পেয়েই তোমার
দেহটি শরীর হয়ে উঠেছিল...
— রাখেন
— পড়ি না সবটা, দেন দেন
— না, পড়নের কাম নাই
— ইস
— এই লাল রঙের চুনি সদা কলকাতা থেকে এনেছে। দেখেন
কেমন একটা সাদাটে
সোনা। তাতে লাল দুটি পাথর। দুল। নন্দদা দুহাতে দুটি তুলে ধরেন। জানালার আলো এসে
এদের দাপটে লাল হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই মনে হল, দুফোঁটা জলে এসে সূর্যের লাল রং পড়েছে।
— বুঝলেন কিছু?
— কিতা?
— সদানন্দ গয়না গড়াইতো
— কার লিগ্যা?
— ওই স-র লিগ্যা
— স-ডা কেডা?
— নারী
— হে তো বুঝলাম, মানুষটা কেডা?
— ধুর মশাই, নারী তো নাই। পৃথিবীতে কোনও নারী নাই। থাকে না।
— কী কন, কী না?
— আমনে বুঝতেন না, আমি বুজ্জি
কথা বলতে বলতেই বেরিয়ে আসেন নন্দদা। আসলে
আমাকে বের করে দেওয়াই উদ্দেশ্য। একটা আইসক্রিমওয়ালা হেঁকে চলেছে। দূরে কাদের যেনো
ছাগল কেন যে ডাকছে। বিশাল একটা লরি কোথায় চলে যাচ্ছে দুনিয়ার বড় বড় গাছ পিঠে নিয়ে।
ওইটা সোনালির মা-র বাড়ি। যেন যন্ত্রচালিত, আমি চলে আসি।একতলা একটা বাড়ি। অযত্ন।
বারান্দায় টিন। বারান্দাটা বেশ করে সাজানো।বসে আছে সোনালির মা। রূপের বৃদ্ধ বয়স।
পুরনো সোফা। স্প্রিঙের গদি। বসি।
— তলপেটের ডাইনদিগে একটা বেদনা উঠবো। গান গাওনের আগে তবলা সুর করনের মতন।
বেডিআইতে বিছনায় যেমুন আরাম পায় প্রথমে এমন আরাম অইবো। তোমারে খাওনের আগে যেমুন
হেমুন। হেরপরে আর আরাম নাই। ভিতর থিকা শিংমাছে ঘাই দিবো। বারবার। চোখমুখ দেখলে
বুঝবা। খিচ্চা ধরবো। এরপরে একটু একটু জল ভাঙবো...
— আমার বাচ্চা অইতো না
— তাইলে কেরে আইছো?
— সদারে চিনতেন? সদানন্দ, কু?
— ও
— কিতা?
— চিনতাম... কেরে?
— এমনেই
উঠে চলে আসি। সোনালির মা কেমন যেন চোখ বুজে
তাকায়। কেমন যেন সন্দেহ...
— হুনো
— কন
— পোলাডা রবীন্ডনাথ আছিলো
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন