মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০১৭



অশোক দেব
সদাপুরণ-১৩

মাচ্ছা স্বপন ডেঞ্জারাস। চাইলে সে শুকনো ডাঙার থেকে মাছ ধরে দেখাতে পারে। ঘোর অন্ধকারে জলের দিকে তাকিয়ে থাকে স্বপন। শ্বাস নেয় না। গভীরে মাছের চলাচল জলে যে কম্পন তোলে তার কাঁপ স্বপনের শরীরে এসে বাজে। ঝুপ করে জলে লাফায় স্বপন। নিঃশব্দ। মাছের থেকেও নিঃশব্দে সে জল কাটতে পারে
ঝাঁপ দেয়, ডোবে। মাছ তুলে আনে। হয়তো কোনও সোমত্ত রুইহয়তো একটি তরুণ কাতলামাছ। তন্বী মৃগেল।স্বপন জল থেকে ছিনতাই করে আনলে মাছ কিছু মনে করে না।স্বপনের হাতে একটু লাফালাফি করে। যেন কেউ কাতুকুতু দিচ্ছে হাসে। মনে করে খেলা। শেষে বুঝতে পারে স্বপন আসলে নিষ্ঠুর। বাতাসের মাঝখানে থেকে বাতাসের অভাবেই মাছ মরে যায়। মরার পরেও অভ্যাসবশত কানকোর হাপড় নাচায় কিছুক্ষণ। মাচ্ছা স্বপন হাসে।
     তৃতীয়ার চাঁদ অলস। সে তার খণ্ডিত কলা আকাশে রেখে বাকিটা জরিনার শরীরে সরিয়েছে। একটা আলোকের মত দাঁড়িয়ে থাকে জরিনা। তাই দেখতে বয়স্ক দিনের কোলে নিজের ভগ্নাংশ নিয়ে উঠে এলো চাঁদ। এটা জরিনার স্নানের পুকুর। আজকাল অসুবিধে হচ্ছে। জলে নামলেই মাছের শিশুরা তার পায়ে এসে ছোট ছোট কামড় দেয়। এমনকি জঙ্ঘায় উঠে এসে আলতো ঠাট্টা করে। কিছুক্ষণ ভালো লাগে। বেশিক্ষণ কিছুই ভালো লাগে না তার সে ঘোষণা করে, তার স্নানের পুকুরে একটাও মাছ থাকা চলবে না। চলবে না, মানে চলবে না। গপিস্টের কানে যেতেই জেলেদের খবর দেওয়া হল। রহিম মিয়াঁ গপিস্টের জরিনা-মা আকাশের চাঁদ চাইলে রহিম মিয়াঁ পাঁচটা চাঁদ এনে দেবেন। কিন্তু জেলেরা তো আজ আসি কাল আসি করে আসে না।দু-বেলা স্নানের অভ্যাস তার, জরিনার মন খারাপ।মাছ, মাছধরার খবর স্বপনের কাছে বাতাসে বলে দেয়সংবাদ সে  শুনেছে। সে নিজেই একটা ভোঁদড়, উদমানুষ। উদবেড়াল হতে গিয়ে মানুষ হয়ে গিয়েছে।আজকাল প্রতিদিন আসে। অদ্ভুত কায়দায় মাছ তুলে আনে।দুটো তিনটে মাছ এভাবে সে সকলের পুকুর থেকেই তোলে। সেগুলো বেচে দিতে পারলেই দিনের রাজা। কেউ কিছু বলে না। স্বপন রাতে পুকুরে পুকুরে ঘোরে বলে বড় চোরেরা তফাৎ থাকে।  আজকাল জরিনার পুকুরে তার বিস্ময়কর শিকার চলছে জরিনা দাঁড়িয়ে দেখে। একদিন, দুদিন। তিনদিন।
     আজ তৃতীয় দিনে যখন মাচ্ছা স্বপন এসে জরিনার ঘরের সামনে দাঁড়ালো, যখন সে গলা খাঁকাড়ি দিল, জরিনা বাড়িতে নেই ভেবে উদ্বিগ্ন হল, যখন স্বপন অকারণ পায়চারি করছিল, যখন সে বারবার জরিনার ঘরের ভেতরে সোজা না তাকিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল,  যখন তার কেমন অস্থির অস্থির লাগছিল, তখনই হেসে ওঠে জরিনা। সেই হাসিটা, যে হাসিটা আসলে একটা বুনো ঝরনার শব্দ।  স্বপন ভ্যাবাচেকাচলে যাচ্ছিলো। হুনেন, যান কই?জরিনা ডাকে। স্বপন পড়া না পারা ছেলের মতন এসে দাঁড়ায়। আমি আর মজিদ ভাই একটু হেঁটে এসেছি। এখন বেলের পানা খাবো। জ্বালে জ্বালে প্রায় লাল হয়ে যাওয়া দুধতার সঙ্গে বেলের লালচে হলুদ মাংস মিশিয়ে তাতে মাতারবাড়ির পেঁড়া মেখে জরিনা এই অমৃত বানায়। আপাতত মজিদভাই সেটা খাচ্ছেন বড় পেতলের জামবাটি গোল একটা গভীর চামচ।এসব সকালে খাওয়া ভালো। কিন্তু জরিনার খেয়ালে সকালটাই যদি বিকাল হয়, কে কী করবে? লালুসরাইল্যাও চেটে চেটে খাচ্ছে তার নির্ধারিত স্টিলের পাত্র হতে। জরিনা এই কুকুরকে নির্বিচারে সব খেতে শিখিয়ে ফেলেছে। আমার খাওয়া স্থগিত হল। আমি ওইদিকে তাকিয়ে আছি, যেদিকে জরিনা তার হাসিটি থামালো। মাচ্ছা স্বপন আসলে ধরা পড়েছে। সে উদমানুষ, জানে না, তার ভেতরের নড়াচড়া আসলে ধরে ফেলছে কেউজরিনা তাকে এখন জল থেকে তুলে বাতাসে রাখবে।
   গান গাইতে পারেননি আমনে?
এই প্রশ্ন শুনে কিছু না বলেই স্বপন শুরু করে গান।জিসকি বিবি মোটি, উসকা ভি বড়া নাম হ্যায়সে তার কণ্ঠে একটা আলগা ওজন দিয়ে অমিতাভ বচ্চন হতে চায়। বেতাল, বেসুর। আমার হাসি পেল। হেসে উঠি। শুনেই স্বপন থমকে যায়।
   এই কু, কুউউ, শালারপুত, হাসলি ক্যারে?
পরীভাবি ক্ষেপেছে। আমার হেসে ফেলা উচিৎ হয়নি। আর আমার হাসিটাও নোংরাহা হা হা। এটা শুনলেই জরিনা বলে, ‘হাসতেও শিখন লাগে, এমনে হিয়ালের মতন হাসেন কেরে?’ এখন, মানুষের মতন হাসতে তো পারি না। আর শেখা হল না, আমি কী করি! আর যার হাসি ঝরনার মতন, তার কাছে সব হাসিই শেয়ালের হাসি। গান থামিয়ে রাখা মাচ্ছাস্বপন বুঝতে পারছে না কী করতে হবে। একটা খিলখিল এলো হঠাৎ। তারপর জরিনা তাকে টেনে নিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে
   স্বপইন্যা, তোর বাপের নাম মনে কর শেষবারভুলনের সময় অইছে
মজিদভাই রসিকতা করলে সেটাতে হাসি ওঠে না। পুলক জাগে।
   পোলাডা কই থিকা আইছে সদাভাই, জানেন? আগে দেখছি না তো।
   রাইয়াবাড়ির থিকা বলে, দাঙ্গার পরে, নতুন আইছে।
   দাঙ্গা কথাডা কন কেরে? শুননে মে ঠিক নেহি লাগতা
   অইছে দাঙ্গা, কিতা কমু?
   কিতা কইবেন... ঠিকই তোমানুষ এতো লরে কেরে কন তো?একবার হিন্দুস্তান পাকিস্তান, একবার টিপরা বাঙালি... কত লরে?
    নিজের ঘরে বসে বেলপানা খাচ্ছিলেন রহিম মিয়াঁ। বাটি হাতে বেরিয়ে এসেছিলেন, এঁটো কিছু তিনি নিজের ঘরে রাখেন না। এরা পিতার সামনে বসে না। রহিম মিয়াঁ আসতেই মজিদভাই উঠে দাঁড়ায়যেন সৈনিক। আমিও দাঁড়াই।‘বইয়েন বইয়েন, কতা আছে’। আমরা দুজনে বসি। রহিম মিয়াঁর ঘরে সজু যে ছিলো, সেটা এতক্ষণ বোঝাই যায়নি। এখন সে একটা চেয়ার এনে রহিম মিয়াঁকে বসতে দেয়। চোখের গতি বেড়ে যায় রহিম মিয়াঁর। পিটপিট। পিটপিট। বোঝা যায় তিনি এখন গপিস্ট হবেন, এখন তিনি বলবেন। ভাবছিলাম কী বলবেনএর মধ্যেই শুরু হয়ে গেলঃ
     তহন আমি পাইখ্যল। পাখি ধরি। খোয়াইয়ের জঙ্গলে অস্ত্র পাইলাম। হেডির সুতা ধইরা দেখা অইলো আমার গুরুর লগে।নবকুমার ঘুঙুর। পাখি ধরন ক্ষেমা দিয়া আমি ছায়ার মতন গুরুর পায়ে পায়ে ঘুরি। আমার মনে অইলো গুরুর শত্রু আছে। আমরার লাইঠ্যলের বংশ। বাপদাদারা রাজার লাইঠ্যল আছিল। আমি নিজে নিজেই অইয়া গেলাম গুরুর লাইঠ্যল। সেইবার গুরু যাইবেন আসাম। তহন দেশভাগ অইয়া গেছে। কিন্তু পাসপোর্ট ভিসা নাই। ডেলি ডেলি মানুষ আইয়ে পাকিস্তান থিকা। রিফুজি। গুরু মনতলা স্টেশন থিকা রেলে উঠলেন, পাকিস্তানি রেল।ইন্ডিয়ার কাছে আইয়ে। ভিতরে ঢোকে না। লস লসই, খাইল্যা রেল ফিরা যায়। য্যান কাইজ্যা লাইগ্যা আইঅন যাওন বন্ধ করছে ভাইয়ের বাড়িত ভাই।এদিগে আবার ইন্ডিয়ার রেল। রেলের চেয়ারা একই। পাকিস্তানে পাকিস্তানি চানতারা মার্কা টিকেট, ভারতের টিকেটের চেয়ারা মনে নাই। মনতলা থিকা লাটু, লাটু থিকা মহিষাসন। তারপর গুরু হেই রিফুজি মাইনসের ছদ্মবেশ ধরে। আমিও। পোটলাপুটলি লইয়া রেললাইন ধইরা হাইট্যা গিয়া আমরা যাই এক ঘুঙুরের বাড়িত। বেড়ার ছোট্ট একটা ঘর। সারা ঘরে, সারা বাড়িত মাছের গন্ধ। কৈবর্ত। সোনারাম ঘুঙুর। রাইতে গুরু ঘুমাননা। ডর আছে। আমিও জাইগা থাকি। হুনি, সোনারামরে তার বউয়ে কী জানি কয়। কয়, ক্যামনে চলবো? জাল বন্ধক, চাল নাই। হের মইধ্যে অতিথি দুইজন।থাকবো চাইরদিন। সোনারাম কয়, আমি তো জাল ছাড়া পারি না। আমি কি উদবিলাই? আমি কিতা করতাম? আমি হুনি। গুরু হুনেন। আমার গুরু নবকুমার ঘুঙুর। একটা মড়া নেওয়ার খাটেই তাইনের বিছনা। তাইনে শোয়া, আমি বইয়া আছি। য্যান একটা কেডা চুতরা পাতা লাগাইয়া দিছে গুরুর শইলে। মাইনসের কষ্ট হুনলে তাইনে চেইত্যা যানগাকার উপরে জানি চেতেন। সারারাত উসখুস উসখুসআকাশে ভোরের ফর অইতেই গুরু কন, ‘ডাকো’
   সোনারাম
   গুরু, কন
   কত টেকা?
   দেরশো
   নও
সোনারাম নিতে চায় না। গুরু চোখ দিয়া তারে লেইপ্যা দেন, যেমন বেডিয়াইতে মাটির ঘর লেপে। সোনা টেকা নেয়।
   দুইদিনে তোমার টেকা আইয়া পড়বো। শুকনাত খেও দিলেও মাছ পাইবা
     সোনারাম বেকুবের মত গুরুর দিকে চায়। আমি তারে আবার কইলাম, ‘শুকনাত খেও দিলেও মাছ পাইবা, গুরু তো কইয়া দিলেন যাও জাল ছুডাও খেও দেও, খেও দেও’।
     গপিস্টের কথার মাঝেই জরিনার ঘরের থেকে সে হাসি ছুটে আসে। তার সাথে বেরিয়ে আসে মাচ্ছা স্বপন। থরোথরো। কাঁপে। মজিদভাই আবার রসিকতা করে, ‘ইডা ছোবলের কাঁপ না। তারে খালি শ্বাসের বাড়ি দিছে’। আমি হাসবো না চুপ থাকবো ভাবতেই বেরিয়ে আসে জরিনা। মজিদভাইয়ের করাতের লুঙ্গি পরেছেকামলাদের মত হাঁটুর ওপরে শক্ত করেপেছনে নিয়ে গোঁজা। যেন মল্লযোদ্ধা। একটা লাল গামছায় ব্লাউজের ওপর স্তনযুগল টাইট করে বাঁধা। যেন ত্রিপুরী রমণী। বাকি উন্মুক্ত শরীর হতে কী একটা ঠিকরে বেরোচ্ছে। আলোও হতে পারে, ঊষাও হতে পারে। এই দৃশ্য দেখে চোখ সরিয়ে রাখেন রহিম। আমার কৌতুক হল। কিন্তু হাসে কোন শালা! জরিনা সোজা চলে আসে মজিদভাইয়ের সামনে। পিছু পিছু চলে আসে মাচ্ছা স্বপন, শ্বাসের বাড়ি খেয়েছে সে। নিরুপায়।
   আমি সাতার শিখুম। স্বপনভাই শিখাইবো।
   শিখেন, আচ্ছাই হোগা। ছানের ঘাটেও আর বেড়া দিয়া রাহন লাগতো না।
   স্বপনভাই আমারে একদিনে সাতার শিখাইবএকদিনেই শিখ্যা লামু।
     স্বপনের কাঁপ বাড়ে। যেন সে সারাজীবনের সাঁতার জরিনার পায়ে এখুনি ঢেলে দেয়। কী জানি কী বুঝে সে বলে, ‘চলেন জলে যাই’।আর এতেই লেগে যায় আগুন। সজু এসে মাচ্ছা স্বপনের ঘাড়ের কাছে লাথি মারে। সজু আবার সিনেমা দেখে ক্যারাটে শিখেছে। লাথি খেয়ে পড়ে যায় স্বপন।এসব আসলে তার গায়ে লাগে না। কিন্তু আপাতত উঠবে নাকি মাটিতেই শুয়ে থাকবে,বুঝতে পারে না। করুণ করে জরিনার দিকে তাকায়। চোখ দিয়ে বলে, ‘আরও মারতে বলো, মার খেতে সুখ’। তাতেই সজু আবার মারে। মজিদভাই এসব দেখছিল। মজিদভাই নীরবতাকেই কেমন করে যেন কথা করে তোলে। সেই নীরবতাকে আরও নিরেট একটা শব্দে বদলে নিয়ে মজিদভাই বলে, ‘থামেন’। সজু স্থির।
   মারেন কেরে?
   সাতার শিখলে আমি শিখামু, তে কেডা?
   আমনে কেডা?
   না, মানে...
   কুনু মানে নাই। যে শিখতে চায় তে ঠিক করব কার থিকা শিখবো, আমনে যান
     যেন ভিজে গেছে দেশলাই। সজু। সে তরতর করে বেরিয়ে যায়। কী বুঝে সে জরিনাকেই বলে, ‘দেইখ্যা দিমু’।
    দেইখ্যা দিবেন? দিয়েন দিয়েন। ভালা কইরা দেইখ্যা লইয়েন দেওনের আগে।
তারপর সেই ঝরনাটা খুলে দেয় জরিনা। হাসে। স্বপনকে টেনে নিয়ে সোজা জলে ছুঁড়ে মারে।
     সুর কেটে যায়। কেবল রহিম মিয়াঁ তাঁর গপের থেকে বেরোতে পারেন না। ‘এই পোলাডার গাওয়ে হেই গন্ধডা আছে’।
   কোন গন্ধডা?
   ওই যে মাচ্ছা গন্ধ
   আইচ্ছা আমনের সব বুঝি, ঘুঙুর বুঝি না।
   সব বোজেন?
   না, মানে... ঘুঙুর কয় রকম?
   আমনে লালনের নাম হুনছেন?
   হুনুম না ক্যান
   লেলিন?
   লেনিন?
   ওই অইলো
     বলেই নিজের ঘরে চলে যান রহিম। আমার বেলের পানাটা আর খাওয়া হল না। এতক্ষণে কেমন একটা থকথকে ভাব এসে গেছে। এদিক দিয়ে ছোট একটা বেগুন ক্ষেত। তার মাঝখান দিয়ে একটা শর্টকাট। চলে আসি।
***
এখন খুব গরম। সদার এই মদ্যপানের ঘর। পাগলের মতন বাতাস। এই তার কাপড়ে বাঁধাই করা খাতা। এটাতে চিঠিগুলো নেই। তারিখও না। সবটা পড়ি। বারবার পড়ি।  দেয়ালে একটা ছবি আছে সদানন্দের। বেশ বড়। সাদাকালো। সেটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। হাসছে। এ হাসিটা তাচ্ছিল্যেরযেন সে জগতকে পাত্তা দিচ্ছে না। যেন সে এখন আমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে গালি দিচ্ছে। উল্টে আমার রাগ চড়ে যায়, ‘তুই কুত্তারবাচ্চা, শালারপুত,বাঞ্চোত, বাঞ্চোত’আমি চিৎকার করছি না এখন। আমার সবটা শরীর চিৎকার হয়ে গেল। সে চিৎকার সদার ছবির দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে সেই শব্দ... কু কু কুউউ...
 


   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন