শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০১৭

আকাশে ভোমা পরনে মারু
সদানন্দের চোখে কী পড়েনি? সারা পাড়া ঘুরে ঘুরে এসব সে সংগ্রহ করে গিয়েছে এইসব মানুষ তো আমরাই সদা আমাদের দেখেছে, আমরা ওকে দেখিনি কী দেখেছিল সেই রাতে সদানন্দ?
অশোক দেব
সদাপুরাণ -
ওই যে নিচু আকাশে একটা লণ্ঠন উড়ছে, সেটা ঘুড়িতে বাঁধা। ভোমাগুড্ডি। এই বিশাল ঘুড়ির নাম ভোমাগুড্ডি। গপিস্ট রহিম এই একটি কাজ নিজে হাতে করেন। হাল্কা ধুতির কাপড়ে ভোমাগুড্ডি বানান কত তার করণকৌশল, কত আয়োজন, কত হেল্পার।কিন্তু কোথা হতে তিনি জেনেছেন, ঘুড়ি ওড়ানো হারাম। তাই এই ভোমা ওড়ে নগুসার বাড়ি থেকে। একবার উড়িয়ে দিতে পারলে সে সারারাত স্থির হয়ে ওড়ে। তখন শক্ত মোটা টুইল সুতোয় গাছের সঙ্গে বেঁধে দিলেই হল। বাঁশের দুটো কঞ্চি কায়দা করে  ঘুড়ির কানের সঙ্গে জোড়া। বাতাসে আহত হয়ে এরা শব্দ করে।  একটানা একটা শব্দযেন গোঙায়। সেই শব্দের নীচে নগুসার ভাঙা সংসারের উঠোনের দোলবেদীতে বসে আছে তার বড় ছেলে। সজল। সজু। ঘুড়িতে বাঁধা লণ্ঠন। সে আকাশের ছোট্ট একটি টুকরোকে আলোকিত করেই ফুরিয়ে যায়। সেই আলোর নীচে বসে আছে জরিনা। তার থুতনি সজুর হাঁটুর ওপর রাখা। সেটি দিয়ে মাঝে মাঝে সে জোরে চাপ দেয়। একটু ব্যথা পায় সজু। মধুর সে ব্যথা সে থাইয়ের পেশি শক্ত করে চাপটা নেয়। এটা একটা খেলা। জরিনা খেলে। জরিনার গায়ের গন্ধ খাচ্ছে সজু। তার জন্যেই আসে জরিনা।
মজিদ মিয়াঁ তার স্বামী। সে তার লালুকুত্তাকে বসিয়ে রাখে ঘরের সামনে। আর সারারাত ধ্যান করে। মাঝে একবার ওঠে, কোনও লোহা যেমন তার চুম্বকের দিকে ধায়, তেমনি ধেয়ে যায় মজিদ। আকাশের দিকে ধায়। যেন আকাশ তাকে আকর্ষণ করে। ওপরের মাদা অন্ধকারের দিকে মুখ তুলে তাকায়। কাকে যেন বলে, ‘আর কত? আর কত?’ এক সময় ফিরে এসে একটি শীতল পাটি পেতে শুয়ে পড়ে। বালিশ নেই। লুঙ্গির গিঁট খুলে সেটাকেই জড়িয়ে নেয় গায়ে। পাশে তাদের সেগুন কাঠের খাট। বাহারি। খুব সুন্দর করে সাজানো। যেন চিরবাসর। সেটি খালি, পাশাপাশি দুটো বালিশ। আছে। নির্বিকার। মজিদের বাবার দেওয়া স্ত্রী তখন ঘরে নেই। সে নগুসা-র দোলের সিঁড়ি করা মাটির বেদীতে বসে আছেসজুর খোলা থাইয়ে থুতনি দিয়ে চাপ দেয়। সজু আজকাল শর্টস পরে।বারমুডা প্যান্ট এদিকে এটাকে বলে মারু হাফ প্যান্ট।
জরিনা স্পষ্ট করে হাসে না। তার ওপরের পাটির দাঁতের মাঝে একটু ফাঁক। সেটাকে খুঁত মনে করে সে। আসলে সেটি যে তাকে আরও সুন্দর করেছে তা বুঝেছে সজু। জরিনার রান্না করার বাতিক। খাওয়ানোরও। খেতে বসে কোনও একটা পদ নিয়ে বললেই হল, ‘নাহ্‌, জমল নাহাহা হাসিতে ফেটে পড়ে জরিনা।তার রান্না খারাপ হয়েছে, এমন হাস্যকর কিছু যেন পৃথিবীতে নেই। ধরা যাক বনপথে পথভ্রষ্ট কেউ হঠাৎ একটা ঝরনার কাছে গিয়ে পড়ল। সেই বুনো ঝরনার মত হাসি তার। সে হাসি হাসলেই সজু বলবে, ‘দেইখ্যা লাইছি, দেইখ্যা লাইছি
  কী দেখলেন সজুমিয়া?
  দাঁড়ি
  দাঁড়ি মানে কিতা?
  লেখার শেষে থাকে যে, ইংরাজিতে ফুলস্টপ, বাংলায় দাঁড়ি
  কই দেখলেন?
  আমনের দাঁতের ফাঁকে। য্যান আল্লায় একখান কবিতা লেখছে, আপনের দাঁতের ফাঁকখান তার দাঁড়ি। আমনেরে লেইখ্যা আল্লামিয়াঁ আর কবিতা লেখেছে না।
তখন আমাদের পাড়ায় নতুন কারেন্টের লাইন আসে। ইলেকট্রিক। সেদিন রহিম মিয়াঁর বাড়িতে লাইন দিল। আলো জ্বলল। হলুদ উপোস করা একটা বাল্ব। তথাপি তার আলো হ্যারিকেনের থেকে চমৎকার। সে উপলক্ষে আমাদের খাওয়াল জরিনা। কী সুখাদ্য, কী সুখাদ্য! সেই আসরেই  জরিনা-সজুর এইসব কথা শুনলাম। আমি তো সদা। কুউউ। আমাকে কেউ গা করে না। আমি ওই মুখ নিচু করে থাকি। কিন্তু মজিদ ভাই? লালুমজিদ? ওরা তাকেও গা করে না।কেয়া বাত, কেয়া বাত। আমনে কী সোন্দর কথাডা কইলেন সজুভাই... আল্লার লেখা কবিতা, বাহ্‌বরং উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে লালুমজিদ।
  আমনে খালি হুইন্যা যানঝামটা মারে জরিনা। লালু চুপ। আমিও।
সেই জরিনা এখন, এই রাতে, আধো জোছনায় সজুকে লেপটে বসে আছে। জরিনা স্বামীর অনুমোদন ছাড়া আসে না। সজু আকাশে ভোমা ওড়ালেই সাজ শুরু হয় তার। আর  শুরু হয় গালিগালাজ।
  ওই নিব্বংশিয়া ডাকে আমারে
  যান, আমনেরে ভালাপায় তো
  লাজ লাগে না আমনের? বুকে আগুন জ্বলে না?
  কেরে জ্বলব, আমনেও তো ভালাপান, যান
  না, আমি যাইতাম না।
  আইচ্ছা, তাইলে থাক
এর পরেই শুরু হয় জরিনাবিবির দারোগাগিরি। এমন কোনও গালি নেই সে লালুমজিদকে দেয় না। এটা ছোঁড়ে, সেটা ভাঙে। লালুমজিদ উদাসীন তাকিয়ে থাকে। যেন জরিনাবিবি তার বাজাতে না পারা বাঁশি। কিংবা তার অসাধ্য সুর। একসময় হার মানে জরিনা।
  হুনেন
  কন
  আমরারে কত কাম কইরা দেয়, বাজার আইন্যা দেয়। আমি তো এমনেই যাই, খারাপ কিছু তো নাই
  মানুষের কাছে মানুষ যাইব, খারাপ কিতা থাকব?
  যাই?
  যান
          এক ছুটে চলে যায় জরিনা। সোজা সজুর কাছে। সজুটা কথা বলে না। যখন বলে, দারুণ বলে। তীর খেলা, ফেন্সিডিল ছাড়া তার আরেক নেশা আছে। বই। সে কত পড়ে কে জানে!
আজ ভোমাগুড্ডির সেই গোঙানির  নীচে আমি তাদের দেখি। আকাশে একটা নিয়মরক্ষার চাঁদফালি। এখানে একটা বাঁশের বেঞ্চ। বাঁশের চারটে খুঁটির ওপর মুলিবাঁশ শুইয়ে বানানো। বসে আছি।  ওদের দেখি। আমি সদানন্দ। আমি কুউউ। আমাকে কেউ গা করে না
  আমনেরে একটা কথা কই’? জরিনা বলে
  কও
  আমনে খুব স্বাদ। ওই যে ইংরাজিতে কন...টেস্টি...
  কোন সময় খাইলেন আমনে আমারে?
  হিহিহি
মানুষকে মানুষ বলছে স্বাদ। সুস্বাদু? অবাক।
  আমনে আমারে বিয়া করেন
  করুম
  এক্ষণ করেন
সজু উঠে দাঁড়ায়। চাঁদের আলো এসে জরিনার দুধে আলতা গাত্রবর্ণের কাছে ক্ষমা চেয়ে সরে যাচ্ছে। সজু তার পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে বসে। ছাত্রদের নিলডাউনের মত। জরিনাকে জড়িয়ে ধরে কোমরে। এর পরেই শুরু হয়ে যায় সেই উদ্ভট কাণ্ড। জরিনা কাঁপতে থাকে, তারপর দুলতে থাকে, তার কেশদাম নাচাতে থাকে। যেন একটা পাগলি। তার আঁচল সরে যায়। হয়তো কোনও বক্ষবন্ধনী নেই ভেতরে, দুলতে থাকে তার ছোট কিন্তু সুডৌল স্তনযুগল। এরা তার শরীর ছেড়ে সজুকে গিয়ে মারবে যেন। এ কী? আমি কি করব? ছুটে গিয়ে ধরব ওকে? সজু কিছু করছে না কেন?
এটাই শেক বাড়িতে মনসা পূজার রহস্য? গপিস্ট রহিম শ্রাবণ মাসে বেশ ঘটা করে মনসা পূজা করান। পুরো শ্রাবণ মাস জরিনা শাঁখা-সিঁদুর পলা পরে। বাইরে একটা মাটির ঘর। সারা বছর বন্ধ থাকে। শ্রাবণে খোলা হয়। সেখানে পদ্মাপুরাণ গাওয়া হয় সারা শ্রাবণ। গপিস্ট জগতকে এটা বোঝাতে পেরেছেন, তাঁর রূপসী পুত্রবধূর শরীরে ভর করে মনসা। আসলে তিনিই মনসা।কাগজে খবর হয়, মুসলমানের বাড়িতে হিন্দুদেবীর পূজা...
একসময় ধপাস করে পড়ে যায় জরিনা। আকাশের ভোমা তখনও গোঙায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় জরিনার চাপা গোঙানিও। সে কী যেন বলে।শালারপুত মজিদ্যা, লালু, কুত্তা একটা, মজিদ্যাকুত্তা... শালার শালা ধ্যান মারায়... আকাশের লগে কথা কয়...আমনে বেডা আমনে বেডা... আমনে টেস্টি, আমনে টেস্টি... স্বাদ সজু ওকে কোলে তুলে নিয়ে এদিকে  আসছে। হয়তো বেঞ্চে  শুইয়ে দেবে। আমি উঠে চলে আসি।
,
সেই সজনে গাছেই ফাঁসি দিয়েছিল নগুসার বউটা। তার ডালের সঙ্গেই বাঁধা ছিল ভোমাগুড্ডি। গোঙাচ্ছিল। যেন সে গোঙানিটাই ফেলে গিয়েছে নগুসার বউ।সেই শব্দের সঙ্গে শক্ত টুইল সুতায় সজনে গাছ যেন নিজেকে ফাঁসিতে ঝোলালো।আমি চলে এলাম। আমি জানি, জরিনার কী হচ্ছিল। শুধু সবটা দেখার সাহস হল না।
এই সাহস নেই বলেই আমি সদানন্দ। কুউ।এখন এসে নিজের শরীরকে জিগ্যেস করি, তার নেই পুরুষ হবার ক্ষুধা? শরীর আসলে বেশি বেশি বলে। সে-ও গপিস্ট। শরীর একটা অতিকথন, জানো? রোজ ক্ষয়ে যেতে থাকা একটা নদীর চরা। মাটি। মাটি বলেই সে আগাছা জন্ম হতে দেয়। কিন্তু মজিদ কী জিগ্যেস করে আকাশকে? ‘আর কত, আর কত?’
জানি না, আজ অবশ লাগছে। একটু হুইস্কি খাব। ইতি ৫ মার্চ ১৯৮৪
তোমার একান্ত
সদানন্দ






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন