অশোক দেব
এক.
দুলে দুলে, এদিকে একটু এসে, একটু দূরে সরে
গিয়ে পাতাটা পড়ল। জলে। জল রিনিঝিনি একটা ঢেউকে
পাঠালো। ছোট। সে প্রথমে আনন্দে ছুটতে শুরু করল। গোলাকার তার পথ। যেতে যেতে ক্লান্ত
হয়ে জলের সঙ্গে
মিশে গেল। যেমন
মাতার কোলে গিয়ে
ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ে
শিশু। সবটা দৃশ্য
একটি রবীন্দ্রসংগীতের জন্ম দিল। সে গান ইচ্ছে
করলেই গাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ লেখেননি এমন অনেক
গান প্রকৃতিতে রবীন্দ্রসংগীত হয়ে ছড়িয়ে
আছে। সে-কথা
সুখেন্দু জানে। ছেঃ। নিজনাম মনে হতেই
সুখেন্দু একটা টায়ার-পোড়া গন্ধ পায়। নিজের নামটাকে ঘৃণা করে
সে। নাকে এসে
টায়ার-পোড়া
গন্ধ লাগে। সেটা
এড়াতেই একটা পাতার
দিতে তাকায়। ছোট ছোট পাতা
এই সোনাল গাছটার। চৈত্রের দিকে তার
সবজে হলুদ ফুল
ফোটে। এবার তার
ইচ্ছশক্তির খেলা শুরু হবে।
তাকিয়ে থাকা পাতাটাকে
পড়ে যেতে আদেশ
করে সুখেন্দু। সেটি ঝরে
যেতে রাজি হয় না। কী আর বয়স তার! এখনও তাজা তরুণ সবুজ, শুধু একেবারে আগার দিকে একটু
হলদে ভাব এসেছে। এমন কার না আসে, এই সময়ে! সুখেন্দু পাতাটার দিকে একদৃষ্টে
তাকিয়ে থাকে। সেই
যে গানটা, যেটা রবীন্দ্রনাথ লেখেননি, সে গান টা সে গাইতে
চায়। মনে মনে। মনের আরেকটা কোনায় সে পাতাটাকে
বসায়। মনটাকে ধনুক বানায়, মনকেই বাণ করে
তোলে। মনের ছিলা
টানটান করে মন ছুঁড়ে মারে পাতাটাকে
লক্ষ্য করে। একটু
কম্পন জাগে, হঠাৎ আসা একটা বাতাসের সঙ্গে ওই ক্ষুদ্র
সোনাল পাতা যুঝে
নেয়। পারে না। দুলে দুলে এদিকে
একটু এসে, একটু দূরে সরে গিয়ে পাতাটা
পড়ল। জলে।
সুখেন্দু একটা সিগারেট
ধরায়। একটা ইচ্ছাপূরণ
হলে একটা সিগারেট। সিনেমার আগে আজকাল
ধূমপানবিরোধী বিজ্ঞাপন দেখায়। মানুষের ফুসফুস নিকোটিনে নিটোটিনে গাড়ির গ্যারেজের ন্যাকড়ার মত হয়ে
যায়। সেটাকে নিংড়ে পুরনো মবিলের মত নিকোটিন
বের করে দেখায়
ওরা। আসলে সেটা
একটা প্রতীক। মৃত্যুর প্রতীক। পৃথিবীতে সকলই মৃত্যুর
প্রতীক হয়ে বিথারিত
হয়ে আছে। থাকাটা
কেবল একটা ইচ্ছা। কার ইচ্ছা? সুখেন্দু ভাবে
না। শুধু ইচ্ছাপূরণ
হলে যেন মৃত্যুর
দিকেই একটু সরে
যাওয়া যায়। সিগারেট
খাওয়া যায়। এই খেলাটা সুখেন্দুর একার খেলা। গোপন। নিজেকে ছাড়া আর কাওকে এ খেলার
সঙ্গী করে না। জানে, ইচ্ছাকে সংহত
করতে পারলে অসাধ্য সাধন করা
যায়। ছোটবেলা থেকে সে এটা করে এসেছে। অনেক পরীক্ষার আগের রাত্রিতে
সে প্রশ্নপত্র দেখে ফেলেছে
স্বপ্নে। শুধু ঘুমোবার
আগে মনকে সংহত
করে প্রশ্নের দিকে ছুঁড়ে
মারত তখন। মন পুরো প্রশ্নটা নিয়ে স্বপ্নে
ফিরে আসত।
ঢেউয়ে ঢেউয়ে সেই ক্ষুদ্র
পাতাটি এখন অনেক
দূরে। রাজ আমলের
এই পুকুরটা এখন দারুণ
নির্জন। মানুষেরা খাদ্যের জন্য বাড়ি
চলে যায়। বিশ্রামের
জন্য। অফিস ছুটির
পরে সুখেন্দু এখানে চলে আসে। বেশ করে সন্ধ্যা
হয়ে গেলে বাড়ি
যাবে। কেউ নেই
বাড়িতে। জাকিবাবা থাকতে পারে। আর, সারা ঘরে ছড়িয়ে থাকবে খেয়া। তার
মৃত্যুসমেত খেয়া এই বাড়িতে ছড়িয়ে আছে। বিস্তৃত
হয়ে আছে। ছেয়ে
আছে একটা গানের
মত। সে গান
কেউ লেখেনি, কেউ গায়নি কোনওদিন।
পৃথিবীর অজান্তে তার সন্ধ্যা
চলে আসে। আর সুখেন্দুও বাড়ি ফেরে। সব খোলা। লোহার
গেট, বাগান পেরিয়ে গ্রিল, গ্রিলের গেট, ঘরর মূল দরোজা, সব খোলা। সুখেন্দু
তালা লাগায় না আর। জাকিবাবাকেও মানা করে
দিয়েছে। এই ঘর, এই বাগান, এই যে পাখিদের জন্য বাগানের
আড়ালে রেখে দেওয়া
ফুটো করা কলস, সব খেয়ার। সেই কলসের আস্তনায় দুটি বুলবুল ঠিক বাসা
করেছিল। খেয়া কেন
যে এদের পিসি
আর পিসেমশাই ডাকত! এইসব কি তালাবন্ধ রাখা যায়? খেয়া নেই। ২৬ জুন থেকে খেয়া
নেই। তাতে কী? এমন তো অনেক
দৃশ্য, অনেক নিসর্গ, অনেক বিকেল, অনেক নদীপাড় সুখেন্দুর জীবনে নেই। তারা
হয়তো
আছে দূর কোনও
মহাদেশে, কোথাও অজানা প্রান্তরে, উপত্যকায়। তাদের
জন্য তো প্রকৃতি
তালাবন্ধ করে রাখেনি
কিছু। মানুষের অহং-ই একদিন তাকে দিয়ে
তালাচাবি বানিয়েছিল।
খেয়া যাবার পর সুখেন্দু
রাতে কিছু খায়
না। কোনও কোনওদিন
মুড়ি খায়। আর জনি ওয়াকার থেকে একটু
একটু সিপ দেয়। ফেসবুকে স্টেটাস লেখেঃ
‘সে কি কেবলই বেদনাময়? ভালোবাসাকে এভাবে
কাঠগড়ায় দাঁড় করানো
ঠিক হল? আসলে একাকীত্ব বেদনাময়। অহংসৃষ্ট অভিমান বেদনাময়। অভিমান হতে আসে
অধিকার, অধিকার আহত হলেই বিরহ আসে। কাঁচা বিরহ বেদনাময়। ভালোবাসা আনন্দময়। আমরা ভালোবাসতে
জানি না। তাই
তাকে নিয়ে কুৎসা
করি।’
সুখেন্দু পোস্ট করে দেয়। আজ থেকে ১০১
দিন আগে হলে
খেয়াই প্রথম লাইক দিত। কমেন্ট করত। মেসেজ
বক্সে লিখত, ‘বুড়া, তুই এতকিছু
কখন ভাবিস? আমি আমার আসল বুড়ার থেকে ফেসবুকের
বুড়াটাকে বেশি ভালোবাসি।’ একদিন
তো স্টেটাস হিসেবে লিখে দিয়েছিল সেটা। ‘আই লভ মাই হাজবেন্ড’স ভার্চুয়াল ভার্সন মোর দ্যান
দ্যা হাজবেন্ড আই লিভ
উইথ।’ একটা স্মাইলি দিয়ে ব্র্যাকেটে
লিখেছিল ‘বোথ আর দ্যা সেম
মর্টাল বাই দ্যা
ওয়ে।’ এখন কিছু হচ্ছে না। কারা
যেন লাইক করে
যাচ্ছে। কেউ কেউ
কমেন্টও লিখছে। সুখেন্দু তাকিয়ে থাকে। যেন
কিছু হচ্ছে না। খেয়া
তাকে আদর করে
বুড়া ডাকতো। তা-ও ভালো। ওই সুখেন্দু
নামটা তার একেবারেই
পছন্দ নয়। সেটা
মনে হলে টায়ার-পোড়া
গন্ধ লাগে নাকে। তাই চিত্রভাণু। আজ ফেসবুকে
শেষতম স্টেটাস লিখলো চিত্রভাণু। এবার ডি-অ্যাক্টিভেট করে দিতে
হবে। আজ থেকে
চিত্রভাণু মিথ্যা।
দুই.
মিস ইউ। এই জিনিসটা আসলে কী? এই যে একটা
হাউ-হাউ
কান্না ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আঠার মত, এটাই কি মিস করা? মনে হয় না। এটাকে ঠিক ‘মিস ইউ’ কথাটা দিয়ে
ধরা যায় না। খেয়ার
একটা হাসি ছিল। টোল দেখানো হাসি। এই টোলটাকে সে খুবই ভালোবাসত। গালে একটু একটু
মেদ জমছিল, টোলটার আকারও বদলে যাচ্ছিল। প্রায় হারিয়ে গিয়েছে সেটা। খেয়া
বিশ্বাস করত না। ছবি তোলার সময় টোলের
গালটাকে এগিয়ে দিয়ে, একদিকে হেলে সেই হাসি। সেটাও
বেশ বুদ্ধি করে, পাছে লোকে বুঝতে পারে টোল দেখানোর
জন্যই এত আয়োজন! সুখেন্দু বুঝত। অভ্যাস
হয়ে গিয়েছে। এই যে ছবিটা, এখানে আবার চুলের প্রসঙ্গও আছে। একগুচ্ছ
চুলকে মরচে পড়া
লাল রং করেছে
কিছুদিন হল। কী করে একটা কোঁকড়ানো
ভাবও করা হয়েছে। সেটাও দেখাতে হবে। তাই
হেলে থাকাটা একটু অন্যরকম। একেবারেই অন্যরকম। সেটাকেই প্রোফাইল পিকচার করেছে খেয়া। সেই
ছবিটাই দেখাচ্ছে ফেসবুক। অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাক্টিভেট
করে গেলেই সুখেন্দু শেষ অব্দি
পারে না। কয়েকজনের
নাম আর ছবি
ভেসে ওঠে। ফেসবুক
বলে, ‘কেন ছেড়ে
যাচ্ছ? এরা তোমাকে মিস করবে’। এখন, এই প্রথম ছবিটাই খেয়ার।
এ ছবি আসলে
অনেক আগের। এখন সে আর সত্য নয়। তখন বাগানে এক রকমের
ছোট ছোট গোলাপ
ফুটেছে। লতানে গাছ। এ ছবি তখনকার। ততদিনে খেয়া পাল্টে
গিয়েছে। মাথায় একটিও চুল নেই। ভ্রূ, এমনকি চোখের পাতার চুল, সব ঝরে গিয়েছিল। তিনটে ক্যামো হল। মুখে, শরীরে বিচ্ছিরি ব্রণ। খেয়া
তখন নিজেকে ঘরের মধ্যেই
বন্দী করে ফেলেছে। সারাদিন ওই ঘরে, ওই ফেসবুক। কোনও ব্যথা
নেই, যন্ত্রণা নেই, অথচ প্যাংক্রিয়াসের ওপরে আটকে
থাকা ওই টিউমারটা
খেয়াকে ভেতর থেকে শুষে
নিচ্ছিল।
সুখেন্দু ছবিটার দিকে তাকিয়ে
থাকে। কম্পিউটারের স্ক্রিনে। স্ক্রিনের পেছন থেকে
আলো আসায় আরও
উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। এইখানেই খেয়া অছে। হাসছে। মরচে রঙের
একগুচ্ছ চুল যেন
উড়ছে। গালে একটা
আবছা টোল, হাসি। সবটা পরিবেশই হাসছে, খুশি। এমনকি পেছনে গোলাপের লতানে গাছটাও হাসছে। সুখেন্দু ডি-অ্যক্টিভেট করার পৃষ্ঠা থেকে ফিরে
চলে আসে। খেয়ার
টাইমলাইনে যায়। স্টেটাসগুলি
পড়তে থাকে। আনন্দ, আনন্দ আর আনন্দ। নিজের জীবনের সকল ঘটনাই
সে লিখে ফেলেছে। কোথাও কোনও বিষাদের
স্পর্শ নেই। সকলই
আনন্দময়, সুন্দর অনর্গল ইংরেজিতে সে লিখে
গিয়েছে। নীচে প্রায়
শত শত কমেন্ট। একটু আদিরসও আছে কোথাও
কোথাও। কে নেই তার বন্ধু
তালিকায়! কানাডার চিনিকাকা, স্কুলের বন্ধুরা, ইউনিভার্সিটির স্যার, বিখ্যাত সাংবাদিক, চিত্রশিল্পী, এমনকি
পাড়ার মুদি — সবাই আছে
খেয়ার বন্ধু তালিকায়। বিয়ের দিন পনেরো
আগে ওরা একটা
রেস্তোরাঁয় দেখা করেছিল। সেই ঘটনার আনুপূর্বিক বর্ণনা লিখেছে খেয়া। কেমন
সেজেছে, কেমন হচ্ছিল মনের অবস্থা, সম্পূর্ণ অচেনা
একটা লোকের সঙ্গে দেখা করতে
যাচ্ছে, তার ম্যানারে কী কী গণ্ডগোল
থাকলে সে মুখের
ওপর মানা করে
দেবে, এইসব। তাই
নিয়ে এখনও আড্ডা
হয়ে চলেছে। তার নীচে
কত যে কমেন্ট! এখনও হয়ে চলেছে। কেউ কেউ নিজের
বিয়ের কথা, মজার কথা লিখছে। খেযার নীরবতা নিয়েও কেউ কেউ
প্রশ্ন তুলছে। খেয়া তো নেই। এরা জনে
না। তাদের কথার দুর্দান্ত
সব রিপ্লাই দেবার মত মানুষটা
নেই। সুখেন্দু খেয়ের মেসেজের ঘরে যায়।
‘তুমি আমায় মিস
কর? আমায় মনে পড়ে?’ খেয়াকে
ইনবক্স করে। বার্তা
পাঠায়। তাকিয়ে থাকে। বার্তাটি
খেয়া যেই দেখবে
তার নীচে দুটি
ম্লান টিকচিহ্ন ভেসে উঠবে। ওঠে না। সুখেন্দু
তাকিয়ে থাকে। নীল
সেই ভার্চুয়াল বাক্সটিতে তার ইউনিকোড
বার্তাটি একা পড়ে
আছে। ‘তুমি আমায় মিস
কর’? সুখেন্দু আবার
লেখে। এবার ইংরেজিতে। আবার আবার। খেয়া
দেখে না। জাগে
না সেই চিহ্ন। মৃতরা তো ফেসবুক
করে না! সুখেন্দু স্ক্রল
করে উপরে চলে
যায়। উপরে উপরে। ঠিক ১০১ দিন
আগে শেষ কথা
হয়েছিল দুজনের।
তিন.
সুখেন্দু মোবাইলে স্বচ্ছন্দ নয়। টাইপ
করতে পারে না। খেয়াই ওসব পারে। ও খালি নতুনের
সন্ধান করে বেড়ায়। নতুন, নতুন। বিয়ের তিন মাস পরেই
আবিষ্কৃত হয় সেই
টিউমার। সব প্ল্যান
পাল্টে যায় ওদের। খেয়া সেই থেকে
নতুনের খেলায় আরও জোর
মেতে ওঠে। এই দাম্পত্যকে কোনওভাবেই পুরনো হতে দিতে
চায় না যেন। সুখেন্দুরও বেশ লাগে। প্রায় প্রতিদিন, অফিস থেকে ফিরে কিছু না কিছু নতুন দেখা
যাবেই। কোনওদিন নতুন একটা
ফ্লাওয়ার ভাস এসেছে, তাতে গুচ্ছের পাতা আর ফুল। খুব সুন্দর করে সাজানো। এতটুকু বাগানে এত বিচিত্র
গাছকে কী করে
যে জায়গা করে দিয়েছে, সে খেয়াই জানে। সার, গোবর, ওষুধ সব কোথা থেকে কীভাবে
যোগাড় হয়, সুখেন্দু কিছুই
জানে না। অবশ্য
জাকির হল খেয়ার
নিত্যসঙ্গী। ড্রাইভার। বয়স কুড়ির
এ ছেলেটি জন্মসূত্রে মুসলমান, কিন্তু কালীর একনিষ্ঠ ভক্ত। কপালে
সিঁদুরের তিলক। নিজেকে
সে হিন্দুই বিবেচনা করে। সুখেন্দুকে
অফিসে দিয়ে এসে
সারাদিন মায়ের সাথে তার
সকল কাজে সক্রিয়
সমর্থন যুগিয়ে যাওয়াই তার মূল
ডিউটি। মায়ের জন্য সে জান দিতে পারে, জান নিতে পারে। খেয়া হচ্ছে জাকিরের মা। আর, সুখেন্দুকে ডাকে স্যার। খেয়ার নতুন নতুন
নতুনত্ব আবিষ্কারের নিত্য গবেষণায় জাকির অ্যাসিস্ট্যান্ট। এই জাকিরই
উসকে দিয়ে স্মার্ট
ফোনটি কিনিয়ে দিয়েছিল। তারপর যে কত মডেল, কত রঙের মোবাইল খেয়া কিনেছে, ইয়ত্তা নেই। নতুন
একটা আসে, পুরনো মোবাইল চলে যায় জাকিবাবার
দখলে। জাকিবাবা, কালীভক্ত জাকির
হোসেন গাজীর মাতৃদত্ত নাম। খেয়া
তাকে মাঝে মাঝে
শুধু বাবা বলেই
ডাকে।
একদিন দেখা গেল
জাকিবাবার চরণতলে বসে আছেন
খেয়ামাতা। দুজনের হাতে দুটি
স্মার্টফোন। ঘটনা কী, সেটা বোঝার আগেই ঝিরঝির
করে ওঠে খেয়া, ‘তুমি আমার ফ্রেন্ড
রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করলে না কেন? আর নিজের নাম না দিয়ে
ওই চিত্রভাণু লাগালে যে?’ সুখেন্দু
বুঝতে পারে জাকিবাবাই
নাটের গুরু। ঘোর
এক বৃষ্টির দিনে অফিস
থেকে ফেরার কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছিল না। জাকিরকে
ফোন করে করে
না পেয়ে ফেসবুকে
মেসেজ করতে হয়েছিল। কাজ হল তাতে। আর সেই সূত্রেই
স্যারের ফেসবুক পরিচয় জেনে গিয়েছিল
জাকিবাবা। সুখেন্দু জাকিবাবার দিকে তাকায়। কিছু বলে না।
— ধুর, অফিসে কি কেউ ফেসবুক করে নিকি?
— কেন, তোমার মোবাইলে নোটিফিকেশন আসেনি?
— আমার মোবাইলে
নেট কানেকশন কেটে
দিয়েছি, তাইলে সারাদিন ভার্চুয়ালই থাকতে অইব।
— তা’লে এক্ষুণি কম্পিউটার খোল, আমাকে অ্যাকসেপ্ট করে নাও।
জাকিবাবা মাতাজিকে ফেসবুক দুনিয়ায় দীক্ষা দিলেন বোঝা গেল। আর খেয়ার মত নতুনের
অভিযাত্রীর কাছে প্রথম
প্রথম ফেসবুক আসা মানে
তো নবজন্ম। অফিস থেকে
অটোতে ফেরে সুখেন্দু। অফিসের গাড়িটাতে কী একটা
গন্ধ। খুব দরকার
না হলে সেটা
ব্যবহার করে না। ফেরার সময় জাকিবাবাও
যায় না আনতে। সুখেন্দুই মানা করেছে। খেয়ার কখন কোথায়
যাবার বাই চাপে! তাছাড়া জাকিবাবা সঙ্গীও ভালো। এই একটা টাই, সুখেন্দু একদম
পছন্দ করে না। গরমের মধ্যে গলায় এই ফাঁস পরে থাকা
যে কী বিরক্তিকর! অফিস থেকে ঘরে
এসে প্রথমে এটাকে খুলে ছুঁড়ে
দেয় সুখেন্দু। আজ সেটাও
করা গেল না। তার আগে ডেস্কটপ
খুলতে হল। ফেসবুকে
লগইন করে খেয়াকে
গ্রহণ করতে হল। একতাল ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। এদের নিতে
হলে সময় দরকার। প্রোফাইল চেক করতে
হবে, দেখতে হবে পরিচয়। সুখেন্দু বিরক্ত হয়, ‘মানুষের যে কত আজাইরা সময়’।
—
অ্যাই, তুমি আবার ভাষা
করছ?
বাঙাল কোনও শব্দ
বুঝতে না পারলেই
খেয়া সেটাকে স্ল্যাং মনে করে। স্ল্যাং বলা মানে ভাষা করা। ‘ভাষা করা’টাও
জাকিবাবার দান। খেয়া বড় হয়েছে
রাণাঘাটে মামাবাড়িতে। বাবা মায়ের
ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল। কলেজের চাকুরিটা নিয়ে ত্রিপুরায়
ফিরে এসেছিল সে। সবই
তার ভালো লাগে, কেবল ওই ভাষাটাকেই
পাল্টাতে পারেনি। সেই টিউমার
আবিষ্কারের পর চাকরিটাও
ছেড়ে দিয়েছে। কেউ তাকে
অসুখ নিয়ে কিছু
জিগ্যেস করে, সেটা ও মানতে চাইত না। সুখেন্দু বাধা দেয়নি।
—
আজাইরা
মানে ফালতু। মানুষের কত ফালতু
সময় ... কত ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখলা না?
—
শোন, আমি তোমার ফেসবুক লাইফে উঁকি দেব
না। মানে, স্ত্রী টাইপের উঁকি... তুমিও আমার ওখানে ছোঁক ছোঁক করবে না। আমরা কেবলই বন্ধু, ফ্রেন্ড,
বুঝলে?
সেটাই হতে পারেনি
সুখেন্দু। নিজেদের মধ্যে তেমন কথাই
হয় না। খেয়ার
মামা আর মামীমা
চলে গেলেন ছেলের কাছে, আমেরিকায়। এক জাকিবাবা ছাড়া তার
আর কেউ রইলো
না। এই ফেসবুক
খেয়াকে দারুণ আনন্দ দিয়েছিল। সারাদিন ওই নিয়েই
মেতে থাকত। ফ্রেন্ড
হবার রাতেই দেখা গেল
চিত্রভাণুর সব স্টেটাসে, নোটসে লাইক দিচ্ছে
খেয়া। সুখেন্দু প্রায় সারা রাত
জাগে। এই ঘরটা
ওর স্টাডি কাম সবকিছু।চারদিকে
খেয়ার যত্ন। একটা অভিজাত
পরিপাটি। সুখেন্দু সেটা বজায়
রাখতে পারে না। খেয়াই আবার সব গুছিয়ে দেয়। খেয়ার
অসুখ ধরা পড়ার
পরে ও নিজে
থেকে আলাদা হয়ে গেল। অসুখ সম্পর্কে কোনও কথা
হয় না দুজনের। নিয়মিত ওষুধ খাওয়া, ডাক্তারের কাছে যাওয়া, হায়দ্রাবাদ যাওয়া, মুম্বই যাওয়া সবই হয়। কিন্তু
অসুখের কথাটা একদম উহ্য
থাকে। শুধু খেয়ার
খেয়াল বেড়ে গিয়েছে
আরও। জাকিবাবা সব জানে। কিছু বলে না, মা যেমনি চান, সেটি তামিল করে দেওয়াতেই তার আনন্দ। ফেসবুক আসার পর এই এক খেলা
খেয়ার। সারারাত ধরে মেসেঞ্জারে
কথা বলা। সুখেন্দুর
মেসেঞ্জার নেই, সে এঘর থেকে ডেস্কটপে মেসেজ বক্সেই থাকে। রাতের
খাবার শেষে সুখেন্দু
নিজের কাজ করে, পড়াশুনো করে। অফিসের
বিষয়াদি, অর্থনীতি নিয়ে
ব্লগ লেখে। ফাঁকে
ফেসবুক খুলে রাখতে
হয়। নোটিফিকেশন আসে। মেসেজ
বক্স খুললে দেখা যায়, খেয়া
—
বুড়া
—
হুম
—
আই মেড আ হেল
আউট অব ইয়োর
লাইফ
সুখেন্দু ছুটে খেয়ার
ঘরে যায়। বিছানায়
শুয়ে আছে। হাতে বেশ বড় একটা ফোন। সুখেন্দু
তার চোখে চোখে
চোখ রাখে।
—
উঁহু, ফেসবুক ফেসবুকই। ওখানকার বিষয় নিয়ে
এখানে কোনও কথা
হবে না। যা বলার ওখানে বল।
বলেই খেয়া
উল্টো দিকে ফিরে
শোয়। সুখেন্দু জড়িয়ে ধরতে চাইছিলো, বুকে নিয়ে আদরে
আদরে ভরিয়ে দিতে চাইছিলো। পারে
না। একটা অদ্ভুত
দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। যেন অনেক দূরে
একটা কোথাও খেয়ার বসবাস। সেখানে যেতে পারে
না সুখেন্দু। সে খালি
প্রমোশনের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়। টাকা
চাই। খেয়াকে আমেরিকা নিয়ে যেতে
হবে।
চার.
হল না। তার আগেই শেষ
হয়ে গেল সব। ২৬ জুন। এত দ্রুত সব ফুরিয়ে
যাবে অনুমান করেনি সুখেন্দু। আগামী মার্চেই তো আমেরিকা
যাবার সব ঠিকঠাক
ছিল। হল না। খেয়া সময় দিল
না।
সুখেন্দু তাকিয়ে থাকে খেয়ার
মেসেজ বক্সের দিকে। খেয়ার ছবিটার দিকে। মনকে সংহত
করে। ধনুক বানায়। ইচ্ছাকে সূচীমুখ করে তোলে। মনকেই করে তোলে
বাণ। টানটান মনের ছিলায়
তাকে পরায়...
টুং করে
একটা শব্দ হয়। নোটিফিকেশন। সুখেন্দু মেসেজের ঘরটাতে তাকায়। গা কাঁপতে
থাকে তার।
—
ডিড
ইয়ু এভার লভ মি, বুড়া?
হা-হা করে ওঠে সুখেন্দুর
সারা শরীর। ঘামতে
থাকে। কী বলবে
সে? কী বলা যায়! এ কি সত্য? আবার শব্দ হয়। নোটিফিকেশন।
—
ইচ্ছাশক্তি
ফলাচ্ছ?
সুখেন্দু দেখে। কেমন
অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে
সব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন