অশোক দেব
জ্যোৎস্নাপট্টি
স্ত্রীধন।
স্ত্রীর জমানো ধন। কিন্তু একটু
পালটে নিয়ে যদি স্ত্রীকেই
ধন বলা যায়! হিমাগ্নেয় এক সম্পর্কের
একজনকে এমন অভিধা? ভুল
হলেও, রসময় হবে সন্দেহ নেই। সাধারণত এরা
খেয়ালী। একাধারে নারী এবং সংসারবাজারের
জ্যোৎস্নাপট্টি। এদিক দিয়ে যেতে
গেলে প্রথম দিকে শিহরণ, শেষে
সিরসির করে। যাক খেয়ালের
বশে আমার ঘরের জ্যোৎস্নাপট্টিতে
অরণ্য এল। আরণ্যক। বিভূতিভূষণের।
এই নিয়ে যে কততম
বার কে জানে। কী
যে তিনি পান, বুঝি
না। সেই তো মকাইয়ের
ছাতু খাওয়া লোকগুলির কথা। কী এত
পান আমার খেয়ালী মঙ্গলার্ধ
কে জানে!
আবার
নিলাম। বুঁদ হয়ে গেলাম।
রুক্ষ বিহার। বন কেটে জনবসতি
স্থাপন। এই তো মোটা
প্রতিপাদ্য। আসলে কি তাই?
প্রকৃতি-প্রেম বলে একটা কথা
ছোটোদের বাংলা নোটবইয়ে থাকে। সেটা বড়ো দগদগে
কথা। বার বার ঘুরেফিরে
এক জোছনার কথা বলেছেন বিভূতিভূষণ।
রাক্ষুসি, সর্বগ্রাসী, সর্বব্যাপী। ভাবতে গিয়ে দম বন্ধ
হয়ে আসে। যে দিগন্তের
কথা বারবার এসেছে আরণ্যকে, তাকে কোথায় পাওয়া
যায় আর আজকাল? বনের
মধ্য দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে
একটা লোক কোথায় চলেছে?
কোথা হতে এক সাধু
আসে মানুষের কাছে, যে কিনা আসে
আগুন ভিক্ষা করতে। মাসের পর মাস ধরে
ভাত খায়নি যে মানুষ, মকাইয়ের,
কলাইয়ের ছাতু আর জল
খেয়ে যারা বেঁচে থাকে,
তাদের সকলের সঙ্গে দেখা হয়। আজকাল
তত্ত্ব-সর্বস্ব সাহিত্যচর্চা আর বাণিজ্যমুখর ফ্যালফ্যালে
লেখালেখির ফাঁকে হয়তো, এ বয়সে এসে
আবার আরণ্যক ধরা নিছক দারিদ্র্য।
হয় এদিকে নয় ওদিকে। আরণ্যক
কোনদিকে? ভালোবাসারও এক তত্ত্ব আছে।
ইস্তেহারনিরপেক্ষ সেই তত্ত্বে সাহিত্য
নয়, টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ। ছোটো
ছোটো মানুষের আধা আধা জীবনে,
মায়াজোছনার জগতে আমাকে নিয়ে
ঢুকিয়ে দিলেন বলে মঙ্গলার্ধকে ধন্যবাদ।
সেই
এক আদি রাজার কথা
পড়ি। আলগোছে খেয়াল করি বিভূতিভূষণের রাজনৈতিক
মন্তব্য। ইতিহাসকে দূর হতে তিনি
নিরীহ প্রশ্নের সামনে দাঁড় করান। যে
বিজিত, স্থানীয় গোষ্ঠীপতিরা আগন্তুকের কাছে হেরে আরও
আরও গভীর জঙ্গলে চলে
গেছেন, আরও আরও অন্ধকারে,
তাদের কথা ইতিহাস বলে
না। হয়তো তারা এইসব
অরণ্যের নাভিশাসন করেছেন একদিন। কিন্তু তাদের থেকে বনটাই কেড়ে
নেওয়া হল। ‘সাবঅল্টার্ন’।
মনের গভীরে এসে প্রক্ষিপ্ত হয়,
এই অভিজাত শব্দটি। কত আগে ভেবেছেন
কেউ? হয়তো সে ভাবনার
দাম নেই আজ। ভাবালুতা
আজ আর গুণ নয়।
হয়তো কোনও কালেই ছিল
না। তবু ভাবালুতাই তো
আমাদের মানুষ করেছে একদিন। একদিন ধূপের ভাবে, কিংবা তিলের ভাবে আকুল হয়ে
আমরা ধরতে চেয়েছি মহাকালের
রশি, কিংবা পিতৃপুরুষের আত্মার অবশেষ।
সেই
থেকে এক জোছনাকাম জেগেছে।
একধরণের ভ্রমণের নেশা চেপেছে। কোথাও
কি সেই অপার রুক্ষতা
আজ আছে ভাগলপুরে, কিংবা
সেই যে ছোটো ছোটো
জনপদগুলো তিনি গড়ে দিয়ে
এসেছিলেন তারা আজ কীরকম
হয়েছে? আমি ঘরকুনো। জানি
যাব না। অনুমান করি
সেইসব গঞ্জের মাথায় আজ মোবাইলের টাওয়ার।
শুনেছি এমন টাওয়ার আর
টিনের ঘরের জন্য গৌতম
ঘোষ বড় বিপাকে পড়ে
গিয়েছিলেন তার ‘মনের মানুষ’
শ্যুট করতে গিয়ে বাংলাদেশে।
ভাগলপুরের
সেইসব এলাকার আজকের প্রজন্ম কি বিভূতিভূষণকে জানে?
কী জানি! না আমি কোনো
মর্মরমূর্তির দাবি তুলব না।
প্রকৃতি যে নিজে একটি
গঁতছাড়া উপন্যাসের প্রধান চরিত্রে এসে এক শান্তি
আর নেশার পাঠ্যবস্তু হয়ে উঠতে পারে,
তা ধরা পড়েনি নিতান্ত
বালক বয়সে পড়া আরণ্যকে।
এখন দেখলাম। দেখলাম কোনও চালাকি না
করে, আরোপ না রেখে
এমন এক গদ্যভাষায় কথা
বলা যায়, যা হয়তো
বিদেশিপাঠতুষ্টদের কাছে জলো ঠেকবে।
কিন্তু আমাদের ভালো লাগে, যারা
ততটা বিদ্যা ধরি না। আমদের
সংখ্যাও তো কম নেই
আর। ভাবি কে চেয়ে
আছে সেই পুরাতন চাঁদের
দিকে, যে চাঁদ বাংলা
সাহিত্য থেকে আর অবসর
নিলেন না। এমনকি তার
সিন্থেটিক ভ্যারাইটিও এসেছে বাংলা কবিতায়।
সেই
লোকটির কথা মনে পড়ে।
আধপাগল এক বৃক্ষবিলাসী। নানা
জায়গা থেকে ফুলের, লতার
চারা এনে এক মায়াবী
হ্রদের পাশে পুঁতে দিয়ে
যায়। কেউ তাকে বলেনি।
কোনও এনজিও নাই তার, কোনও
অনুদান পায়নি। কোনও সেমিনারবিদ্যায় সে
পারঙ্গম নয়। কেবলই ভালোবাসায়
আপ্রাণ জিইয়ে রাখতে চায় বনের বৈচিত্র্য।
লেখকও তার সঙ্গে জুটে
গিয়েছিলেন। সেইসব লোকেরা কমে গেছে। কেন
যে তারা খালি হারিয়ে
যায়। কেননা হারিয়ে গেছে বন। এখন
দিগন্তবিস্তারী পূর্ণিমা নেই। তার পথের
সামনে প্রমোটার দাঁড়িয়েছে। হয়তো এ কারণেই
হারিয়ে গেছে সেইসব বেকুব
লোকেরা।
নিজের
রাজ্যটির দিকে দেখি। আরণ্যক
এই তিনদিনে বারবার আমাকে এই জন্মভূমির দিকে
চোখ তুলে তাকাতে প্ররোচনা
জাগাল। সেই লাল মাটির
টিলাগুলো নেই। ড্রজার এসে
দিনরাত মাটি কেটে নিয়ে
যাচ্ছে উন্নয়নের দিকে। দেশি চামলের বন
নেই আর। ধনেশের উড়াল
নেই। এসেছে রাবারের সুদূর ব্রাজিল ভ্যারাইটি। তাদের কোমরের কাটা ঝোরা বেয়ে
নেমে আসে টাকার তরুক্ষীর।
হয়তো এতে ধনী হয়ে
গেছি আমরা। আমাদের টাকা বেড়েছে। কিন্তু
উঁচুনিচু সেইসব লাল টিলাগুলো সমতল
হয়ে গেলে পর পাহাড়ি
ঝরনাগুলি জলাভাবে পড়ে গেল। ছোট
ছোট পাহাড়ি নদী, যাদের আমরা
ছরা বলি, তারা শুকিয়ে
যেতে লাগল। হায় কোথায় যাব?
আজ বর্ষায় যা-ও একটু
ক্ষীণধারা দেখা যায়, সে-ও হারিয়ে যাবে।
শহর থেকে দূরে গেলে
এক একটু নিঃসীম
নীরবতার সঙ্গে দেখা হত। এখন
আর নেই। এটাই হয়তো
নিয়ম। আজকের সুষমা কাল থাকবে না।
কিন্তু
সেই দোবরু পান্না সত্য। সত্য সেই রাজকুমারী।
রহস্যময় এক সমাধিক্ষেত্রে যে
নিয়ে গিয়েছিল আরণ্যকের কথককে। একদিন এই সসাগরা পৃথিবীর
মালিক ছিল তার পূর্বপুরুষ।
আসলে যেদিকে চোখ যায় নিবিড়
অরণ্যে ঘেরা এক ছোট্ট
পরিসরকে তারা ভেবেছিল পৃথিবী।
সে-ই ভাল ছিল।
আজ যে সসাগরা পৃথিবীকে
ধরে এনে ছোট্ট পরিসরে
বাঁধার চেষ্টা করা হচ্ছে, বরং,
তাতেই যেন শ্বাস আটকে
যায়। ভিলেজ করে তুলছি, একীকরণের
ব্যর্থ খেলাকে ভাবছি জয়। একদিন হয়তো
সেটা আরও বেশি সত্য
হবে। আমরা একের বিদ্যা অপরকে দিয়ে দিতে পারব।
একের গুণ দেব, নেব।
মিলাব-মিলিব নয়, মিলেমিশে যাব।
একের রোগ দেব অপরকে।
তোমার গান এসে আমার
গানকে খাদ্য করবে। তোমার বাদ্য এসে আমার বাজনাকে।
সেই যে নানারকম নৃত্য
শেখা ছেলেটি, যাকে একদিন কলকাতায়
নিয়ে আসবেন ভেবেছিলেন বিভূতিভূষণ, তার মত হবে।
একদিন রেলপথের ধারে তাকে দেখা
যাবে আত্মহত্যা করে মরে আছে।
কেন? কেউ জানে না।
নাচতে নাচতে সে কি বুঝতে
পেরেছিল এই নৃত্য আর
দেখবে না মানুষ? তার
কদর নেই আর। কে
জানে? হয়তো আমাদের মোবাইল
টাওয়ার আকীর্ণ আকাশে এখন আর খুঁজলেও
তার দীর্ঘশ্বাস পাওয়া যাবে না। কিংবা
এমন কোনও যন্ত্র নেই,
যাতে অতীতের বেদনার সন্ধান ফিরে পেতে পারে
মানুষ। সেই পাহাড়ি রহস্যময়
সমাধিস্থলে লেখক, সেই আদি রাজকন্যাকে
একটি প্রথা শিখিয়েছিলেন। ফুল দেওয়া। মৃতদের
উদ্দেশে ফুল দেওয়া। সেই
রীতি শিখে বেশ খুশি
হয়েছিল শ্যামলা সেই রাজকন্যা। সে
বারবার তার পূর্বপুরুষের উদ্দেশে
পুষ্প অর্পণ করেছে। হয়তো কোনো এক
রীতিতে আমরাও সেইভাবে আমাদের পূর্বপ্রকৃতিকে স্মরণ করব। কারণ যে
গরম, হাঁশপাশ প্রকৃতি আমরা গড়ে তুলছি
তাকে একদিন লাথি মারতে ইচ্ছে
করবে এই আমাদের। তখন
আর সময় থাকবে না।
আবার শখের ভ্রমণের দিকেও
মন যাবে না আমাদের।
কেননা, ভ্রমণের ডেসটিনেশন ইতিমধ্যে ক্রাউডেড হয়ে পড়ছে। সবাই
ভার্জিন চায়। ভার্জিন প্রকৃতিকে
লালসায় এনে ফেলতেই তো
আনন্দ!
[ ছবি : অশোক দেব]
এই মকাইয়ের ছাতু দিয়ে রুটি খাওয়া মানুষগুলিকে আমি খুব ভাল করে চিনি। মকাইয়ের ছাতু দিয়ে রুটি বানাতেও পারি। ওই রুটির সঙ্গে লঙ্কার আচার আর অর্ধেকটা পিঁয়াজ পেলে ওদের খাওয়া হয়ে যায়। সে বেশ রাজকীয় খাওয়া। মুর্গী-মাটন কোফতা কাবাব না পেলেও দিব্যি চলে। চালিয়ে নিতে জানে ওরা। আমাদের মত এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপ্রাপ্তিগুলো নিয়ে মন খারাপ করেনা। কেননা এগুলো আদতে অপ্রাপ্তিই নয় ওদের কাছে। যতক্ষণ নদী আছে, নদীতে জল আছে, জঙ্গলে জন্তুজানোয়ার এবং ফলমূল আছে, পাহাড়ে হাওয়ার তান্ডব এবং খরস্রোতা ঝর্ণা আছে আর তাতে সূর্যের বাসাবাড়ি আছে - ততক্ষণ আর কিছুরই প্রয়োজন নেই ওদের। তবে, এইসব তো আমরা ক্রমশই গ্রাস করে নিচ্ছি। মকাইয়ের পরিধি পেরিয়ে আরো অনেক দূরে ওই শীতের দেশ আলাস্কাতেও জলস্তর বাড়ছে। সব হারিয়ে আমরা পুড়ে যাব না। ডুবে যাব। আবার একজন নোয়ার জন্ম হবে। আমাদের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে আরেকটি জাহাজ চতুর্থ পৃথিবী থেকে এগিয়ে যাবে পঞ্চম পৃথিবীর দিকে। আরেকবার নতুন করে জন্ম নেবে প্রকৃতি।
উত্তরমুছুনলেখাটা পড়ে মন খারাপ হল, অশোক দা। আমার বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো ছোটবেলার দিনগুলি মূহুর্তে সামনে এসে গেল। সেইসব জায়গা আর চেনা যায়না এখন। আমবাগানগুলোও আর একটাও নেই। মাঠের মধ্যে উঠে গেছে বাড়ি। পুকুরের জায়গায় মাঠ। তাতে নোংরা প্লাস্টিক জমে উঠছে রোজ। সকলের জায়গা বদলে দিচ্ছি আমরা। যেন অনন্তের চেকার্স খেলা ! কিন্তু ওই নক্ষত্ররাজি তো আমাদের হাতের মুঠোয় নয় ! এই প্রখর শূন্যতাকে ভয় পাই আজকাল। খুব ভয় পাই।
সেই কবের মন্তব্য। দেখেওছিলাম। এমন সুন্দর একটা মন্তব্যের জবাব দিইনি! ভালোবাসা, দোলন।
মুছুনএমনিতেই পেছনপথে ফিরে ফিরে যাই.....তার ওপর এমন লেখা এসে আবার পথরোধ করে।বলে,ভবিষ্যৎ তো দূর..... বর্তমানেও ঠাঁই মিলবে না তোর শৈশবশেকলে বাঁধা দুরছাই মনের। এটাই নিয়তি।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ
উত্তরমুছুন