জল-আত্মীয়তা
নমস্কার। আমি অশোক দেব। ত্রিপুরায় থাকি। আমার পাড়ার নাম গোমতী পল্লী। জেলার নাম গোমতী। আমাদের বাড়ি থেকে গোমতী নদী ৭০০ মিটার পশ্চিমে। এটা গোমতীর নবধারা। আগে সেটি আর পুবে বইত। সে খাতটির নাম মরাগাঙ। গোমতী পাহাড় থেকে এসে যেখানে একটু সমতলভূমিতে পড়েছে সে জায়গার নাম তীর্থমুখ। সেখানে পৌষমেলা হয়, মানুষ তর্পণ করে। লক্ষ মানুষের সমাবেশ হয়। তীর্থমুখেই এসে ডম্বুর বাঁধের জল পড়ে। গোমতীর একা কোনও উৎসমুখ নেই। একাধিক ঝর্নাপ্রতিম ধারা এসে এক হয়ে গোমতী নাম নিয়েছে।
গোমতী ত্রিপুরার বৃহত্তম নদী। দীর্ঘতম মনু নদী। উৎস থেকে সোনামুড়া পর্যন্ত গোমতী ত্রিপুরায় বয়। তারপর বাংলাদেশে যায়। গোমতীর উৎস এবং ডম্বুর আমাদের পার্শ্ববর্তী জেলা ধলাইয়ের গন্ডাছড়া মহকুমায়। গাড়ি চালিয়ে সেখানে যেতে ২ ঘণ্টার মতন সময় লাগে। ১৯৬৮ সালের দিকে গোমতী ব্যারেজ তৈরি হয়। তখন অনেক দেশের জন্ম হয়নি। গোমতীতে বাঁধ দেওয়ার উদ্দেশ্য দু’টি। বিদ্যুৎ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ। বিদ্যুৎ হত তিনটি টারবাইনে তিন করে ৯ মেগাওয়াট। এখন ড্যামে জল থাকে না, তাই একটি টারবাইন কোনওমতে চলে, তাতে ৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ হয়। ডম্বুর প্রজেক্টের কারণে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সেটি আমাদের একটি স্থায়ী সমস্যা হয়েছে। তারা এখনও এধার ওধার ছড়িয়ে আছেন। যেখানে প্রতিস্থাপিত করার কথা ছিল, সেখানে সবার সংকুলান হয়নি। বন্যা নিয়ন্ত্রণে ডম্বুর অত্যন্ত কাজে এসেছে। একদা কুমিল্লার দুঃখ বলা হত গোমতীকে এখন তা নয়।
ডম্বুর থেকে থেকে অন্তত দু’শো ছোটোবড়ো জনপদ দিয়ে গোমতী বয়ে গিয়েছে। জেলা হিসেবে,ধলাই, গোমতী এবং সিপাহিজলা দিয়ে গোমতী গিয়েছে। উল্লেখযোগ্য শহর করবুক অমরপুর, উদয়পুর, কাঁকড়াবন, মেলাঘর, সোনামুড়া। সোনামুড়া পেরিয়ে গোমতী বাংলাদেশে গিয়েছে। ভারতীয় অংশে গোমতীর ক্যাচমেন্ট এরিয়া ২,৪৯২ বর্গকিলোমিটার। তার মধ্যে কেবল ৫৭১ বর্গকিলোমিটার সমতলে, বাকিটা পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। ভারতীয় অংশে গোমতীর দৈর্ঘ্য ১৬৭.৪ কিলোমিটার।
ডম্বুর থেকে নেমে এলে গোমতীর উপনদীগুলোর নাম ( নদী বলতে এরা একেবারেই স্বল্পদৈর্ঘ্যের নালার মতন, পাহাড়ি। আমরা বলি ছড়া) : একছড়া, হাতিছড়া, গঙ্গাছড়া, পিত্রা ছড়া, ছনগাঙ, মৈলাকছড়া, সুরমা ছড়া এবং কাচিগাঙ। এরা সবাই ডম্বুর প্রকল্পের নিম্নধারায় গোমতীতে মিশেছে। সুতরাং এরা বাঁধের আওতায় আসেনি। বাঁধের ফলে যে জলাধার তৈরি হয়েছে তার আয়তন ৪০ বর্গকিলোমিটার। গড় গভীরতা ৩০ মিটার।
ডম্বুর থেকে ৫০ কিলোমিটার নীচে এসে গোমতীর উপরে একটি কৃষিবাঁধ আছে মহারানিতে। সেখান থেকে দুপাড়ে বহু ক্যানাল করে দূর দূর কৃষিক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেটি একটা উচ্চতার পর খোলা, তাকে ছাড়াবাঁধার বিষয় নেই।
ডম্বুর প্রকল্পের মূল জলাধার থেকে বাঁধের পাশ দিয়ে ক্যানাল দিয়ে নিয়ত জল মূল গোমতীতে এসে পড়ে। আর টারবাইন ঘোরাতে বহু ওপর থেকে বিশাল পাইপ দিয়ে জল আনা হয়। সে জল টারবাইন দিয়ে আপনি বেরিয়ে যায়। বাঁধটি কম খরচে করবার জন্য দুই পাহাড়ের মাঝখানে করা হয়েছে। ৯৪ মিটার হাইট। তার বেশি হলে জল উপচে বেরিয়ে যায়। ত্রিপুরাতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২০০০ মিমি। এবার চারদিনে হয়েছে গড়ে ৮০০মিমি। গোমতী জেলার মুখ্যপ্রশাসক অতি উৎসাহী হয়ে বারবার সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। সেটিই যাবতীয় বিতর্কের কারণ হয়েছে বলে মনে হয়।কারণ, অনেকেই তাঁর পোস্ট শেয়ার করে গিয়েছে। গোমতী নদী প্রশাসনিক ভাবে বন দফতরের অধীন আর ড্যাম বিদ্যুৎ দফতরের অধীন। বাঁধা ছাড়াখোলা নিয়ে তাদের তরফে এমন কিছুই বলা হয়নি। পরে বিদ্যুৎমন্ত্রী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু ইতোমধ্যে যা হবার হয়ে গিয়েছে।
এবার অন্য কিছু কথা। দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার দুটি নদী। মুহুরি এবং ফেনী। এদের সঙ্গে গোমতীর কোনও সম্পর্ক নেই। এরা ত্রিপুরায় উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশ ঘুরে আবার ত্রিপুরায় এসে শেষে বাংলাদেশের দিকে গিয়েছে। সাব্রুম এবং বিলোনীয়া শহরে তীব্র জলাভাব। এই দুই নদী থেকে জল তুলে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করে দুই শহরের মানুষের পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে চায় ভারত। বাংলাদেশ তাতে রাজি নয়। ফলে তীব্র জলসংকটে ভুগতে হয় এই দুই শহর ও আশেপাশের প্রায় লক্ষ মানুষকে। মানুষকে পানীয় জলে বঞ্চিত করা সকল ধর্মে পাপ। বিলোনীয়া শহরে যদি যান, দেখবেন, প্রতিটি বাড়িতে গুলির ক্ষত। এক সময়ে সারারাত গুলি চলত ওদিক থেকে। আর এর মাঝে দেদার চুরি ডাকাতি আর চোরাকারবার চলত। এই সীমান্তে গোলাগুলি চলবে না, এ মর্মে দু’দেশের চুক্তি ছিল। ফলে এদিক থেকে পালটা গুলি চলত না। ওপারের বিলোনীয়ার মানুষ সঠিক বলতে পারবেন।
ত্রিপুরার অধিকাংশ বড়ো অপরাধ ভিনদেশি অপরাধীদের দ্বারা হয়। আপনি বাইক রেখে এদিক থেকে ওদিকে গেলেন, বাইক চলে গেল কুমিল্লা বা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কাঁটাতারের বেড়ার ওপর দিয়ে বাঁশের ঢেঁকির মতন একটি ব্যবস্থাপনা করে সেসব পারাপার করা হয়।এভাবে জীবিত গরুও যায়।
বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপুরার বার্ষিক বৈধ বাণিজ্য ৭৫৮.০৯ কোটি টাকার। তার মধ্যে ত্রিপুরা থেকে রফতানি মাত্র ১২১.৩৭ কোটি টাকা। বাকিটা বাংলাদেশ থেকে আমদানি। ভাবুন কত হাজার মানুষ নানাভাবে এই বাণিজ্যের জন্য ভাত পাচ্ছে। অন্ধতা ভালো, তবে তা যদি কল্যাণান্ধ করে দেয় তাহলে আর কী! ভারত থেকে বাংলাদেশ মোট ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নেয়, ত্রিপুরা থেকে নেয় ১৯২ মেগাওয়াট। ভাবুন। আমাদের দেশে বিভিন্ন আঞ্চলিক গ্রিড আছে, সকালবেলা প্রতিটি রাজ্যকে এক রকমের বিডিং করে ইলেকট্রিক কিনতে হয়। নিজের দেশেই। প্রতিদিন বিদ্যুতের দাম ওঠানামা করে। বাংলাদেশ একই দামে বছরের পর বছর বিদ্যুৎ নিচ্ছে অন্তত ত্রিপুরা থেকে।
রেল ও সড়কে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ত্রিপুরার যে যোগাযোগ, তা নিয়ে অনেকের আপত্তি। এসব যোগাযোগ করবার জন্য বাংলাদেশের ভেতরে সড়ক ও রেলের উন্নয়ন, গজের বদল সব ভারত করছে, ভারতের খরচে। বাংলাদেশ উত্তাল হলে ৭৫০জন ভারতীয় শ্রমিককে আটকে ফেলা হয়। পরে কূটনৈতিক উপায়ে তাদের রাজ্যে আনা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী এসব কাজে উপঠিকাদার, স্বল্প দক্ষ শ্রমিক এবং সাপ্লায়ার সব সে দেশের, ভাবুন কত লোক কাজ পাচ্ছে, লাভবান হচ্ছে।
মোটকথা, আমরা পরস্পরের প্রতিবেশী। উসকানিদাতা পশ্চিম, উত্তরপূর্ব চিন কিংবা পশ্চিমপাকিস্তান থাকবে না হে বিপদে। আমাদেরই থাকতে হবে কাছাকাছি। বাংলাদেশের লোকসংখ্যা মোটামুটি ১৮ কোটি। ভারতের একা উত্তরপ্রদেশের লোকসংখ্যা কুড়ি কোটি। বাজারের ব্যাপার নয়। আমরাই আপনাদের বাজার। সুতরাং মঙ্গলান্ধ হয়ে কারও লাভ হবে না।
[২৪ আগস্ট, ২০২৪ সকালের ফেসবুক পোস্ট]