রবিবার, ৯ জুলাই, ২০১৭

সদাপুরাণ -২০

অশোক দেব
সদাপুরাণ-২০

‘কে বলে শারদ শশী সে মুখের তুলা
পদনখে পড়ি তার আছে কতগুলা
কি ছার মিছার কাম ধনুরাগে ফুলে
ভুরুর সমান কোথা ভুরুভঙ্গে ভুলে
কাড়ি নিলো মৃগমদ নয়নহিল্লোলে
কাঁদে রে কলঙ্কী চাঁদ মৃগ লয়ে কোলে’

     উঠানে দাঁড়িয়েই এই শুরু করে মানিক শীল। রবিবার সকালে চুল কাটার চেয়ার আপনি বসে যায় কামরাঙ্গা গাছের নীচে। মানিক শীল তার ছোট বাক্স নিয়ে হাজির হয়। এসেই জরিনার ঘরের সামনে টেনে টেনে সুর করে এইসব শোল্লক বলে। জরিনা বেরিয়ে এসে এই প্রৌঢ়ের দিকে তাকায়। হাসে। কিছু কিছু মানুষ দারিদ্র্যকে সাজাতে জানে। যা আছে, তাকেই। মানিক শীল তেমনি। পরিমিত নীল দিয়ে সাদা ধূতিকে উজ্জ্বল করা হয়েছে। একটা হাতাকাটা পাঞ্জাবি, ঘিয়ে রঙের। সেটাও বেশ স্পষ্ট করে পরা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে জরিনা। মানিক শীলের একটা দোলন আছে। হাল্কা। দুলে দুলে বলে ওইসব কবিতা। জরিনা এক সময় ঠাস করে একটা সাবানের কেস রাখে। তাতে সুগন্ধি সাবান। চুল কাটার আগে সে দিয়ে হাত ধুয়ে আসতে হবে। রহিম মিয়াঁর নির্দেশ। ‘মানিক্যার সব বালা, হাতের গন্ধ বালা না’। সাবানটা রেখে ঘরে ফিরে যায় জরিনা। তাতেই মানিক শীল যোগ করেঃ
‘মেদিনী হইল মাটি নিতম্ব দেখিয়া
অদ্যাপী কাঁপিয়া উঠে থাকিয়া থাকিয়া
করিকর রামরম্ভা দেখি তার উরু
সুবলনি শিখিবারে মানিলেন গুরু’

     রহিম মিয়াঁ চেয়ারে বসে তাকে ডাকেন। অন্যদিন চুল কাটার সময় ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। আজ ঘুম নেই। ওই রাস্তায় একটা লরি যায়। বারবার। সেটাতে মাটি টানা হচ্ছে। আজকাল দুমদাম পুকুর ভরিয়ে ফেলছে মানুষ। নিচু জমিও। টপাটপ বাড়ি উঠে যাচ্ছে। পাকা। কারা যেন কোথা হতে সব আসে। ‘এত সিমেন্ট পায় ক্যামনে?’
- সদা মিয়াঁ

     আমাকে ডাকেন গপিস্ট রহিম। আমিও চুল কাটানোর জন্য চলে আসি এবাড়ি। দোকানে যেতে হয় না। কু-কু শোনারও ঝামেলা নেই। হাতে করে একটা বই নিয়ে আসো। পড়তে থাকো। বাকিদের কাটা শেষ হলে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ি। মানিক শীলেরও লাভ তাতে। খুশিও হয়। আচমকা রহিম মিয়াঁর ডাক শুনে কাছে যাই।
- কন
- এত সিমেন্ট পায় কই?
- ক্যান বাজারে?
- বাজারে সিমেন্ট পাওয়া যায়? রডও?
- হ্যাঁ, গৌতইম্যাও তো রড সিমেন্টের দোকান দিল
- তাইলে আগের মতন ফুড অফিসে দরখাস্ত দেওন লাগে না?
- না না, হেইদিন গেছে গা, অহন ওপেন মার্কেট
- হিডা কিতা?
- লাইসেন্স মাইসেন্স নাই... বাজারে সব খোলা...
- এই যে পুস্কনি সব ভইরা যাইতাছে... জমি... অত টেকা কই থিকা...
- কিতা কমু কন...
- হুম

     এইবার মনে হয় ঘুমিয়ে পড়লেন। নীরব হয়ে গেলে সরে এলাম। ওইদিকে লালুমজিদ সেই বাঁশি বাজানোর চেষ্টা করছিল। হয় না। লরিটা ঠিকই বিচ্ছিরি শব্দ করে আসে। যাবার সময় শব্দ কম। আসার সময় মাটির ভারে গোঙায় বেশি। তখন মজিদ চুপ থাকে। লরির শব্দ না থাকলে বাজায়, কেন যে সেটা হয় না।
- মজিদ ভাই
- কন
- ইডা মনেলয় অইতো না...  এই বাঁশি বাজানডা...
- মালুম হ্যায়
- তাইলে... ক্যান?
- সদাভাই... সবচে কঠিন কিতা কন তো?
- কী?
মা
- মানে?
- ও মা স্বরটা লাগে না আমার... লাগেই না... আইচ্ছা, মা হইতে কেমন লাগবো কন তো
- বুঝলাম না
- এই যে পোলাপানে মা কইয়া ডাক দেয়, তখন মাইয়ালোকের কী হয়? বুকের মিধ্যে কিতা হয়? হিডা ঠাহর করতাম পারি না। কত রকমের মা-ডাক আছে...
- কেমন?
-ক্ষুধা লাগলে একরকম, দুঃখ পাইলে একরকম, পইড়া গিয়া ছইরা গেলে একরকম, মা-র উপরে রাইগ্যা গেলেও মা-ডাক একরকম...
- স্ট্রেঞ্জ
- এইসব মা-ডাক যে বাজাইতে জানে না, হে কী বাজাইবো
মজিদ ভাইয়ের কাছে এলে মনখারাপ হয়ে যায়। কী কী যে ভাবে বসে বসে। টুক করে জরিনা আসে বারান্দায়, হাতছানি দিয়ে ডাকে। আবার ঘরে ঢুকে যায়।যাই।
- আমার ছানের পুস্কনি লাগতো না
- কী কন?
- না, আমি আর জলে নাইম্যা ছান করি না। এই জীবনে আর করতাম না। ঠাহুররে কন হিডা ভইরা লাইতো... গাড়ির মাডি দিয়া...
- আমি?
- আমনেই কন, ওই গপিস্ট ঠাহুর আমনের কতা হুনবো... আজগাই কইবেন... এক্ষণ কইবেন, যান...
   বিপদে ফেলে দেয় ভাবি। পুকুর ভরিয়ে ফেলার কথা বললে গপিস্ট আমাকে এ বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিতে পারে। আবার না বললে, জরিনা বন্ধ করে দেবে। যা হবার হবে, আমি যাই গপিস্টের কাছে। তখনও কাঁচির ওই শব্দটা হয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে চিরুনিতে বাড়ি দিয়েও একটা শব্দ করে মানিক শীল। ভেবেছি রহিম ঘুমিয়ে পড়েছেন কাছে যেতে বুঝলাম কথা বলছেন ধীরে ধীরে।
- মানিক
- কন
- তুই যে শোল্লক কস, ইডি কার লেখা জানস?
- আরে না না... আমি হুইন্যা হুইন্যা শিখছি... কার থিকা হুনছি হিডাই ভুইলা গেছি
- ইডার নাম বিদ্যাসুন্দর। লেখছেন ভারতকবি।
- ও
- রাজারা এই জিনিস পড়ন বন্ধ কইরা দিছিলো। এদিকে  অবইশ্য বেশি একটা পড়া অইতো না। আগত্তলার মাইনসে পড়তো। সইন্দাবেলা হারিকেন জ্বালাইয়া... রাজার মানুষ ঘুরত লাডি লইয়া...
- কন কী?
- হুম, পোলাপানের মাতা খারাপ করতো ইডা। মাইয়ালোকের করতো বেশি। যত ঘেঁষাঘেঁষি আর ডলাডলির কতা... ইতান পইড়া উচ্ছন্নে যাওনের যোগাড়...
- তই
- তই আর কি... রাজার মাইনসে বই পাইলে পুইরা লাইতো আগুন দিয়া...
- আমনে পড়ছেন?
- ‘কিবা রূপ কিবা গুণ কহিলেন ভাট
খুলিল মনের দ্বার না লাগে কপাট
প্রাণধন বিদ্যালাভ ব্যাপারের তরে
খেয়াব তনুর তরী প্রবাস সাগরে.
যদি কালী কূল দেন কূলে আগমন
মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’
- আরে? আমনে তো বাক্কা

     আজ আর ওসব বলে লাভ নেই। কোথা হতে সরাইল্যা লালু এলো। লালুমজিদ যেনো কোথায়। কুকুরটা তার নিজের জায়গায় বসে। দূরে কাদের বাড়িতে বেজে ওঠে কাঁসর, উলুধ্বনি... সরাইল্যা তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে শব্দ করে। ওপরের দিকে মুখ করে সে ডাকে। দূর হতে জরিনা আমাকে দেখছিল।রহিমকে আসল কথা না বলে ফিরে আসছি দেখে আবার হাতছানি দেয়। একটু হাসেও। দ্রুত নাড়ায় হাত। বুঝলাম তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ঘরে ঢুকতেই দেখি সেই আরামচেয়ারটা। এটা জানালার কাছে। এখানে বসে জরিনা আলো খায়। সেই চেয়ারে বসে আছে মিট্টি। অবাক কাণ্ড! কেমন একটা ভাব, যেনো তাকে কেউ বেঁধে রেখেছে। ঘরে একটা গন্ধ। নতুন। মিট্টির পায়ের সামনে বসে আছে মজিদভাই। জরিনার ভাব দেখে বুঝলাম বসানো হয়েছে। ঘটনা বোঝা যাচ্ছে না কিছু। বিকৃত শব্দ করে মাটির লরি যাচ্ছে পাশের রাস্তায়। পথের সে ধুলা যেনো সর্বত্র ছড়ানো।
- ‘বাজান’, জরিনা আদেশ করে...
মজিদভাই একটা মোটা বাঁশিকে ঠিকঠাক করে ঠোঁটের কাছে ধরে। বাজায় না।
-   বাজান
এবার বাজে বাঁশি। সত্যিই যেনো কেউ করুণ করে মা ডাকছে...
-   আরেকটা বাজান
এবার ঢেউ তুলে তুলে মজিদ এসে সেই মা-তে স্থির হয়...
-   ইয়ে সব কা হো রাহা হায়?
মিট্টি প্রশ্ন করতেই জরিনা তার বুক আর পেটের মাঝখানে পা রাখে
- বাইদ্যানি... তুই ফিরা ফিরা আইয়স কেরে? কেরে?
- হাজারবার আয়ুঙ্গি
বলেই ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়ায়। টাল রাখতে পারে না জরিনাভাবি। ছিটকে বিছানায় পড়ে যায়। মিট্টি দুমদাম করে বেরিয়ে যেতে গিয়ে কেড়ে নিতে চায় মজিদের বাঁশি। লালুমজিদ বাঁশি ছাড়ে না। একটু চেষ্টা করে সেটা ছাড়াই বেরিয়ে যায় মিট্টি।
- কী বিষয়?আমি জানতে চাই।
- তাই খালি ঘুরঘুর করে... অহন মাডির গাড়ির লেবার হইছে... কাম তো ছাতাও করে না... তাইনের বাঁশির সামনে আইয়া বইয়া থাহে... কানতো চায়...
- তো আমনের কী?
এই কথা বলে উঠে বেরিয়ে যেতে চায় মজিদভাই।‘আমনের কিতা যায়?’
-   সব যায়, শালারপুত... সব যায়... সব যায়...
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। কী করবো? মিট্টি চলে গিয়েছিল। আবার ফিরে এসেছে। সোজা চলে আসে ঘরের সামনে। চিৎকার করে...
-   তু মরেগি... পাগল হো যায়েগি... পেটকে আন্দার বাল উগে গা...
     এই প্রথম কেমন যেনো উদাস হয়ে গেলো জরিনার দৃষ্টি। একটু তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই সেই পুরনো জরিনা। মজিদভাইয়ের বাঁশিটা সে মাটিতে ফেলে। পা দিয়ে আঘাত করে জোরে। বাঁশিটা প্রথমে ফাটে, পরে ভেঙে চেপ্টা চেপ্টা হয়। জরিনা পাগলের মত পা চালাতে থাকে। সে শোনে না, কিছু শোনে না। প্রতিটি আঘাতে বাঁশিটার থেকে একটা শব্দ বেরোচ্ছিল। আমি স্পষ্ট শুনলাম, মা মা মা  



রবিবার, ২ জুলাই, ২০১৭

সদাপুরাণ-১৯




অশোক দেব
সদাপুরাণ-১৯

একটা কাউকে টেলিফোন করতে চায় জরিনা। যে কাউকে। ‘টেলিফোনে হাসন যায়নি? হাসি উডেনি? কেউ য্যান হাসির কতা কইল, হিডা মুখ না দেইখ্যা ক্যামনে বোজেন?’ আজ কদিন ধরে এসব চলছে। পরিভাবি টেলিফোনে কথা বলতে চান।
   কার লগে কইবেন?
   যার লগে খুশি, মাইয়ালোক না
   বেডা?
   মাইয়ালোক না অইলেই অইবো
   আইচ্ছা
   আমনে খালি আইচ্ছা আইচ্ছা কন। কই কওয়ান না তো?
   আজগা বিকালে
      আজ সেই বিকাল। মাধুকে বলেছি, ঘরদোর সব গুছিয়ে দিয়ে গেল। সব ফুলদানিতে নতুন ফুল সাজালাম। আচ্ছা, মজিদভাই কি আসবে ভাবির সঙ্গে? জরিনার এসব খেয়ালে মজিদভাই থাকে না। এখন ওই পাখিটা এসেছে। ছোট। দোয়েল হবে। এইখানে ছাতে কিছু চাল, গম, আধভাঙা ডালিম আমি রেখে দিই। পাখিরা খায় এসে।  আজকাল পাখি কমে গেল। কেবল এইটা আসে। জানালা দিয়ে ভেতরে তাকায়। দেখে নেয় আমাকে। তারপর একবার খায় অনেকক্ষণ ডাকে। তারপর আবার খায়। যেন ডাকাটাই আসল। খাওয়াটা কিছু নয়। সবচেয়ে মজার কাণ্ড করে শালিখগুলো। এরা ডাকে, আর ডেকে ডেকে বুকের ভেতরে ঠোঁট ঢুকিয়ে কাকে যেন কী দেখায়। যেন বলে, ‘এইখানে, এইখানে’। এখন শালিখ আসে না। এরা এলে বেশ সরগরম হয়ে যায় ছাত। সকলে মিলে কী যেন একটা আলোচনাসভা বসায়। কত কী বলে। আর ওই, ‘কই কই’ বলে ডাকে। তারপর বুকে ঠোঁট ঢুকিয়ে দেখায়, ‘এইখানে এইখানে’। দোয়েলটা একা। সে কেবল একটা শিস বাজাতে শিখেছে। কেমন বিরহী। কেমন একাকীত্বের পাচারকারী এই পাখিটা।
      এমনভাবে বসেছি, যেন জরিনা এলে দেখতে পাই। মদের গেলাসটেলাস, বোতল, যা-কিছু সব গোছানো হয়েছে। আবার ফিট হয়ে গেলে বিপদ। কী কাণ্ড করে জরিনা। কিন্তু ফোনে কাকে ধরিয়ে দেবো? আজ দুপুরে র‍্যান্ডম কয়েকটা নম্বর লাগালাম। একটাকেও যুতের মনে হল না। আমার তো ওই কয়েকটা মাত্র নম্বর। সবই কেজো। আর জামাইবাবুদের নম্বরে দিলে তো মহা ঝঞ্ঝাট। জরিনা জানে না মোবাইল ফোন এসে গিয়েছে এখন। পাড়ায় আমার একটাই আছে। রাঙ্গাদি দিল। সেদিন সজু বিলটিলের খবর নিলো। বোঝা গেলো সেও একটা কিনতে চলেছে। ল্যান্ড ফোন থেকে আমার নম্বরটাই ধরে দেবো? আমিই কথা বলব? এসব ভাবছি, এর মধ্যেই চলে আসে জরিনা। কেমন একটা শাড়ি পরেছে। এর শাড়ি পরার ধরনটা যেন কেমন। শাড়িটা চুপ করে থাকে, শরীরই বাঙময়। আমি দরোজা খুলে দিই।
   কন
   কী কমু?
   মাইয়ালোকের লিগ্যা বইয়া থাকতে কেমুন লাগে?
   আমি তো পক্ষী দেখছিলাম
   তাইলে দেখেন, আমি যাই
     যা বলা, সেই কাজ। ফিরেই যাচ্ছে জরিনা। বেরিয়ে ঠাস করে গেট লাগিয়ে দিল। পথে গিয়ে ওকে দাঁড় করানো, সাধা, কেমন লাগবে। আমি ছাতে চলে যাই। দাঁড়িয়ে দেখি। জরিনা যে পথে এলো, সে পথেই ফিরে যাচ্ছে। এর মাথায় কী খেলা করে কে জানে! কী বলা উচিৎ ছিলো আমার? তাকিয়ে থাকি। অবাক, হঠাৎ করেই, যেন কিছু মনে পড়লো, হনহন করে ফিরে আসছে ও। রেগেছে? আমি ছুটে গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়াই। আমাকে পাত্তা না দিয়ে একপ্রকার ঠেলে ঘরে চলে আসে। একটা কেমন চটি। ও দুটোতে কেমন ওর পায়ের আকার চলে এসেছে। এমন ভাবে চটিগুলো রাখা, যেন কেউ এদের কোনোদিন পরেনি।
   জুতাত কিতা?
   না
   কতা কমু, না-দেখা মাইনসের লগে, দেন
   আইচ্ছা
আমি ওই র‍্যান্ডম একটা নম্বর টিপি। একটা লোক।
   হ্যালো
   নেন কতা কন
চোখের ইশারায় জরিনাকে ডাকি। ফোন ধরে সে। চুপ। ওদিক থেকে হ্যালো, হ্যালো করছে, শুনতে পাচ্ছি।
   আমি, আমি কইতাছি, জরিনা
ওদিক থেকে কী বলছে এবার আর শোনা যাচ্ছে না।
   আমি হাসলে আমনে দেখবেন?
লোকটার মুখ ভাবছি। কে যেনো আজ এই জরিনার খপ্পড়ে পড়েছে, কষ্ট হচ্ছে তার জন্য।
   কেরে? হাসি বুঝি ভালা লাগে না?
   এই বেদমার বাচ্চা, আমি একটা মাইয়ালোক অইয়া তোরে কই হাসতি, হাস। হাসতে টেকা লাগে না।
কী যেনো বলেছে লোকটা। জরিনা খুলে যায়। সেই হাসিটা খুলে দেয়। সেই একটু উল্টে আসা, সেই পাকিয়ে পাকিয়ে হাসিটা... সেই বুনো ঝরনা... শেষে দুম করে ছেড়ে দেয় রিসিভার। সেটা ঠক করে গিয়ে টেবিলে পড়ে। জরিনা হাসতে হাসতেই আমার কাঁধে হাত রাখে, যেনো ইয়ারদোস্ত।
   সদামিয়াঁ
   কন
   এই টেলিফুন দিয়া আমনে কিতা করেন?
   কতা কই
   কার লগে?
   দিদিরা, মা, জামাইবাবু, বন্ধুবান্ধব... কাজে...
   কী কাজ?
   কতই তো...
   একটা কন
   এই যেমুন খবরাখবর করা...
   আমনের খবর কী সদামিয়াঁ?
   কী খবর?
   টেলিফুনে য্যান কন, এমুন একটা খবর কন আমারে
   ভাবি...
   কন, কন, আমনের খবর কন... কেমুন আছেন... আজগার খবর কন, কালকার খবর কন। আইচ্ছা আইয়ে কালকার খবর কন।
   হিডা আমি ক্যামনে জানুম?
   বিষ্টি আইবো
   মানে?
   এট্টু পরে বিষ্টি আইবো
আমি জানালার দিকে তাকাই। পাখিটা নেই। আমার কাচের ঘরের ভেতরে এসে বাতাস পড়ছে হুমড়ি খেয়ে। কালকের খবরের কাগজ লতপত করছে। ঠিকই একটু মেঘলা করেছে আকাশ। সত্যিই একটু ঠাণ্ডা বাতাস বইছে সঙ্গে। জরিনা কাচের ঘরে আসে। একটু হাঁটে। ছাতে গিয়ে দোলনাটায় বসে। নিজেকে দোলায়। আমাকে হাতের ইশারায় ডাকে। গিয়ে দাঁড়াই।
   বন
আমি কোথায় বসবো, ভাবছি। জরিনা পা দিয়ে দেখায়, ওর পায়ের সামনে, ছাতের মেঝেতে বসতে। বসি। আমার কোলে সে তার পায়ের পাতা দুটি রাখে।
   দেখেন
   কিতা দেখুম
   দেখেন, আমনে জানেন কিতা দেখবেন...
   পা চিনেন?
   মানে কিতা?
   দেখেন, পর্বত দেখেন? ইডাত দেখেন উপরের দিকে... দেখছেন? আইচ্ছা এইডাত দেখেন পদ্মপুষ্প দেখছেন? শঙ্খ? রথ দেখেননি? মীন দেখছেন? অঙ্কুশ দেখছেননি একটা?
   কিতা কও পরি? আমি তো বুঝিনা
ছোট করে একটা ঠেলা দিতেই আমি পড়ে যাই। তখুনি দূর হতে ছুটে বৃষ্টিটা এলো। স্পষ্ট দেখতে পেলাম ছুটে এলো বৃষ্টির ফোঁটাগুলি। আমিও ছুটে কাচের ঘরে চলে যাই। জরিনা ওখানেই বসে থাকে। আর জোরে জোরে বলে, ‘হ্যালো, হ্যালো...’ কী করবো আমি?
     দুলে দুলে বৃষ্টি হচ্ছে। এদিক থেকে প্রথম আসছে, পরেই ওদিক থেকে হচ্ছে। একটা কেমন বাতাস এসব করছে। কামরাঙা গাছটা আনন্দে কুটিকুটি। দূরে গোমতীর বুকে কেমন সাদা ফুটফুট এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। ঢেউও। আকাশ বলতে কিছু নেই এখন। যেন কখনও ছিলো না। বৃষ্টিই আসল। ‘হ্যালো, হ্যালো... হ্যালোর বাইচ্চা...’ চিৎকার করছে জরিনা... দুলে দুলে ভিজছে... কখন চুল খুলে দিয়েছে যেন। এইসব বাতাস, এইসব বৃষ্টি যেন ওর ভেজাকেই সঙ্গত করছে। আমি কি যাবো? আমি যে আছি, সেটা পরিভাবিকে দেখে বুঝবার উপায় নেই। কেউ কি আছে পৃথিবীতে? আর কেউ? সব কাচ ঝাপসা হয়ে গেলে সিঁড়ি বেয়ে কে যেন ওপরে উঠে এলো। সোজা আমার সামনে। মারতেই কিছুক্ষণ অন্ধকার দেখলাম। ওই একটুকু সময়েই আমি প্রথম শুনলাম বৃষ্টির শব্দটা। আবার কী করতেই আমি চোখ মেলে সোজা হয়ে দাঁড়াই। সজু। ও পরপর আমাকে মেরে চলেছে। মেরেই চলেছে। আমি এদিকে ওদিকে মার খেতে খেতে দেখি, জরিনার কিছু যায় আসে না। দুলছে আর ভিজছে। একসময়, সে আবার বলে, ‘হ্যালো...।’ সজু থামে। ওইদিকে যায়। একেবারে কোনার দিকে দাঁড়ায় গিয়ে জরিনা। সজু প্রায় ছুটে যায়। আজ যেনো ওকেই মেরে ফেলবে। কাছে যেতেই ঘুরে দাঁড়ায় জরিনা, ‘হাস’
   কিতা?
   হাসতি কইসি তোরে, হাস...
জরিনা সজুকে কাতুকুতু দেয়। ‘আমার সজুসা, আমার আল্লাদিডা মস্তান অইয়া গেছে’ কাতুকুতু দেয়।‘আমার আদরটা, আমার ভোমাগুড্ডি’ সারা ছাতে ওরা খেলছে। হাসছে এবার সজু। ও খালি চাইছে, কোনওমতে জরিনাকে জাপটে ধরতে। মাথা টনটন করছে আমার। এতক্ষণ লড়াই করে ভাসটা আর পারলো না। ফুল সহ মাটিতে পড়ে যায়। ভাঙে না। দোলে, দুলে দুলে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। একবার লাল ফুলটা ওপরে আসছে, আবার নীচে চলে যাচ্ছে। কী একটা শব্দ হতেই দেখি সজু নেই। ছাতের থেকে টপ করে পড়ে গিয়েছে সে। ওইদিকে পাশের বাড়ির পুরনো একটা একচালা। টিনের। তারই শব্দ হল। হতেই ‘কু, কু’ করে ওঠে জরিনাভাবি। ওর এই শব্দটা অন্যরকম। এতে ইয়ার্কি নেই। কাছে যাই।
   হ্যালো...
   কন
   নিজের খবর লন। নিজের... কিতা চান, কিতা কইতেন চান, কইতে শিখেন... কেডায় একটা কুই দিলো, আর আমনে বোরখা পইরা লান
   না, মানে...
   কিছু মানে নাই...
   ভাবি
   ফরমাইয়ে
   পায়ের মইদ্যে কী দেখাইলা?
   পইড়া লইয়েন। ঘর ভর্তি বই আর ওই কতা কওনের টেলিফুন... এই বালছাল দিয়া কী করবেন? নিজেরে পড়েন, নিজের সংবাদ লন। চলেন আমি যামু, নীচে লামেন
     নেমে আসি। কী করব? এমন ভেজা শরীরে ভাবিকে যেতে দেওয়া ঠিক হবে? জরিনাও নেমে আসে। রিসিভারটা এমনি এমনি তুলে বলে, হ্যালো... তারপর মায়ের আলমারি খুলে একটা শাড়ি টেনে নেয়। আরও কয়েকটা পড়ে যায়। সাদা। ওঘরে গিয়ে পাল্টে আসে। সোফায় বসে। দূরে গিয়ে বসি। চুল সব মুছছে। ঝোলানো একটা টাওয়াল থাকে এখানে। মা এলে লাগে। সেটা দিয়েই চুল মোছে। ফাঁক করে করে একটা একটা গোছা করে মুছে চলেছে। ব্লাউজ নেই। বারবার বুকের কাছে কী যেনো ঢাকছিলো জরিনা। বারবার চুলের জন্য মুখ তুলে দিচ্ছিলো ওপরের দিকে। যেন সেই শালিখ পাখি, বারবার বলছে, ‘কই কই?’ বারবার বুক দেখিয়ে নিজেই বলছে, ‘এইখানে এইখানে’।