অশোক দেব
কন্যাতীরে
কন্যাতীরে
এক.
এক দেশে এক গ্রাম ছিল। দেশটা কি ছিল? ছিল কি
ছিল না, গ্রামের মানুষ জানতো না। কিন্তু গ্রামটা যে আছে তারা বোঝে। মানে, তখনও
বুঝতো, এখনও বোঝে। সেই গ্রামের ধারে একটা নদী ছিল। তার নাম কন্যা। তবে, সকলেই
তাকে নিজনিজ কন্যার নামে ডাকতো। কেউ ইচ্ছে করলে
কন্যাকে নিজের পুত্রের নামেও ডাকতে পারতো। কন্যা মানা করতো না। কিছু মনেও করতো না।
নদীর পরে ছিল মাঠ। অনেক দূরের মাঠ। এদের কারণেই কন্যাতীরের ওই গ্রামকে সকলে গ্রাম
বলতো। সেই গ্রামে সকলেই দরিদ্র। কেননা, তাই থাকতে হয়। তাছাড়া গ্রামের
মানুষগুলি মধ্যবিত্ত হতে চায় না। মধ্যবিত্ত না হলে কী করে ধনী হবে! ওরা তাই
ধনী হয়নি। মাঝারি হলে কী জ্বালা সেটা ওরা নকুল ডাক্তারকে দেখে বুঝেছিল। নকুল
ডাক্তার হোমিওপ্যাথি পারেন। অ্যালোপ্যাথিও জানেন কিছুটা। ছুরিকাঁচি
সেদ্ধ করে ফোঁড়াও কেটে ফেলতে পারেন। আবার অকালপোয়াতির পেটে কী একটা ঢুকিয়ে দিয়ে
কুঁড়ে কুঁড়ে বাচ্চাও কেটে আনতে জানেন। এসব কাজ গ্রামের জন্য নয়। শহরের জন্য। কোথা হতে যে এরা পেটের বাচ্চা খুবলে আনতে আসে!
গ্রামের
যেকোনও মানুষকে নকুলডাক্তার রোগী ভাবেন। হারামজাদা, শালারপুত বলে পুরুষদের
গালি দেন। মহিলাদের বলেন শালীর শালী। রাস্তায় কাউকে দেখলেই, ‘আরে হারামজাদা, তোর তো এমনই হবে। কালকে আসবি চেম্বারে। দেখে
দেব। মোরগ আছে?’ এমন বললেই হল। যে
চেম্বারে যায়নি, তার বিপদ। মোরগ হলে মোরগ, টাকা হলে টাকা। কারণ, পরের
দিন চেম্বারে না গিয়ে রসিক মরেছিল সত্য। তখন সে খেজুর গাছের সঙ্গে কথা বলছিল। আর গাছের গলা চাঁছছিলো। রসিকের নামটা সার্থক। তার রসের
কারবার। সে খেজুর গাছের গলা চেঁছে দেয়। মরা গাছের থেকেও রস বের করে আনে হেমন্তে, শীতে। তো, সেদিন গাছ চাঁছার সময় তার বুকে একটা কুত্তা ঢুকে পড়ে। বুকের
ভেতর কোথাও একটা ঘ্যাঁত করে কামড় দেয়। কোমরে দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে রসিক নিজেকে
বেঁধে রেখেছিল। গাছে আড়াআড়ি করে বাঁধা একটা বাঁশের পা-দান ছিল । তার ওপরেই দাঁড়ানো ছিল
রসিকের শরীর। রসের কারবারিদের
যেমন থাকে। কোমরে দুলছিল একটা তূণের মতন খাঁচা। তাতে নানারকম দা, ছেনি।
অন্যদিকে একটা কাঠের ছোট আঁকশি, তাতে ঝোলানো ছিল একটা মাটির কলসি। দা রইলো। ছেনি রইলো। দড়িতে বাঁধা রসিক রইলো। খেজুর গাছটাও রইলো। মৃদু
মৃদু বাতাসে খেজুরের লম্বা পাতা সবটা দুলছিলো। তেমনি
কাঁপছিলো একটা একটা আলদা পাতাও। এসব রইলো। সব রইলো। শুধু রসিকের প্রাণটা উড়ে
গেলো। রসিকের নানা রঙ্গ করার দোষ ছিলো। সে লোককে ডেকে বলতো, ‘রস নেবে, মাগনা? ঘটি নিয়ে এসো’। কেউ এলে সে কলসি উপুড় করে
দিতো। আসলে কলসিতে রসই নেই। তারপর খ্যা খ্যা করে হাসতো। ‘সাপে খেলো, সাপে খেলো’ বলে সে সুন্দরীর বাড়ির উঠানে গিয়ে আর্তনাদ করতো অন্ধকারে। ঘর
হতে আলো নিয়ে সুন্দরী ছুটে আসতো। যেকোনও সুন্দরী।
কাছে এলে রসিক ফু দিয়ে বাতি নিভিয়ে সুন্দরীর বুক টিপে দিতো। পরে বলতো, ‘আরাম হল?’। এই করে রসিক হাল্কা করেছে
নিজেকে। তবু, সে যতবার ‘সাপে খেলো’ বলেছে, সুন্দরী
এসেছে। তবু, সে যতবার ‘রস নেবে গো, মাগনা’ বলে ডেকেছে, লোকে ঘটি নিয়ে এসেছে। কারণ, রসিকের
গোপনে একটা রসিক বড়ই সত্য। একা একা সে পারে না। একটা কিছু রান্না হলে সে জনে জনে
ডেকে খাওয়ায়। বীজধানের যত্ন তার মত কে আর জেনেছে! যার বীজ থাকে না, তার
রসিক আছে। ফলে রসিকের ব্যাপার অনেকটা বিশ্বাস কিছুটা অবিশ্বাস। সেদিন, সেই
রসিক কোমরের দড়ির বাঁধনে আটকে ছিলো খেজুর গাছে। কোমর থেকে উল্টে তার বুক থেকে মাথা
পর্যন্ত ঝুলছিলো নীচের দিকে। পা হড়কে গেছে বাঁশের পা-দান থেকে। এখন গাছ মাঝখানে
রেখে পা দুটি দুদিকে। অনেকে দেখলো। কেউ কেউ বলল, ‘হেই রসিক, এটা আবার কোন্ সার্কাস, মাথায় রক্ত উঠে গেলে
টের পাবি’। কেউ বলল, ‘ কি রে, রসে কি
আজকাল মদের নেশা?’ রসিক ছিলো। তার
প্রাণ ছিল না। ফলে একরাত ঝুলে থেকেও সে কিছু বলতে পারলো না। পরের দিন বিকালে
রসিকের বউয়ের কান্নায় অনেকে এসে নামিয়ে আনে তাকে। তখনও কেউ যেন বলল, ‘লাথি মার, ঢং ছেড়ে
যাবে’। কেবল, নাড়ি টিপে দেখলেন নকুল ডাক্তার। বলে দিলেন, ‘বলেছিলাম চেম্বারে যাস, গেলো না। নাই রসিক’। যে রসিক ফু দিয়ে বাতি নেভাতো, তার জন্য সন্ধ্যাবাতি দিল
না কন্যাতীরের সুন্দরীরা। দুইদিন।
এইসব কারণে, হাসিখুশি মানুষকে চেম্বারে যেতে বলে বলে, কন্যাতীরে একমাত্র নকুলডাক্তার হয়ে গেলেন মধ্যবিত্ত। দূর দেশ হতে কুমারী মেয়েদের পেট খালাস করতে ধনীরা আসে। নকুল ডাক্তার সেইসব ধনীর সামনে আর্দালির মতন কিঁউ কিঁউ করেন। আর গ্রামের মানুষকে বলেন, হারামজাদা আর শালীর শালী। এইরকম আর কেউ হতে চায় না গ্রামে। ফলে, কেউ আর চায় না ধনী হতে। কারণ, পুরো ধনী হবার আগে একবার নকুল ডাক্তার হতে লাগে।
দুই.
এই নকুল ডাক্তার সদানন্দের বাবা হন। তিনি সদাকে
সত্যকার ডাক্তার বানাতে শহরে রেখে পড়ান। সদানন্দও একটা গুল্লি। তার মতন একটা
মাথাওলা ছেলে নাই। কন্যাতীরের মানুষের বিশ্বাস, এমন ছেলে দেশেই নাই। নকুল ডাক্তার মনে করেন, পৃথিবীতে
নাই। সেই সদানন্দ একদিন ডাক্তার হয়ে ফিরে আসে। মহকুমার হাসপাতালে তার চাকরি আর
বাবার চেম্বারে ব্যবসা। বাবা টিপেটুপে ওষুধ দিতো। সদা প্রেসার মাপে। কানে লতি
লাগিয়ে বুকের খবর নেয়। মানুষকে সে হারামজাদা বলে না। কাকা-জেডা, ভাই-দাদা
বলে। মহিলাদেরও কাকি-মাসি, দিদি-বোন বলে। সে মোরগ নেয় না। টাকা নেয়। দিলেও
আচ্ছা, না দিলেও আচ্ছা। সে আবার গান গায়। একদিন নকুল ডাক্তার ধনী হয়ে গেলেন।
দক্ষিণে মুখ করে তাঁর ইয়া বড় দোতলা দাঁড়ালো। পুকুরের দিকে মুখ। আবার রাস্তার
দিকেও। সদাকে কেউ সদাডাক্তার বলে না। বলে ডাক্তার সদা। বাড়ি হয়ে গেলে সদার বিয়ে
হয়ে গেলো। বউভাতে গ্রামের মানুষকে নিমন্ত্রণ করা হল না। দূর দূর থেকে গাড়ি ভরে ভরে
মানুষ এলো। জগতে এত কিসিমের গাড়ি আছে? মানুষের এত সুন্দর সুন্দর বাচ্চা আছে? ওরা
কন্যাতীরে খেলল। হেসেছিলো তারা। যা দেখছিলো, তাতেই অবাক হচ্ছিলো। এমনকি গোরু
ছুঁয়ে দেখছিলো। সকল গাছের কাছে যাচ্ছিল।গ্রামের হাওয়াকে পেতে দিচ্ছিলো মুখমণ্ডল।
গ্রামের মানুষ তাদের দেখেছিল। কিন্তু কেউ নকুল ডাক্তারের বাড়ির দিকে যায়নি। বিস্ময়
হল পরের দিন। একটা কেমন গাড়িতে করে সদানন্দ বেরোল। তেমন তো রাস্তা নেই, কিন্তু
গাড়িটা চলে যাচ্ছিল সকলের বাড়িতে। মাঠ দিয়ে নাচতে নাচতে, রাস্তায় থমকে থমকে, হেলতে
দুলতে। প্রথমে ডাক্তার সদা গেলো শচীজেঠার বাড়িতে। পৃথিবীতে এই ঘটনা প্রথম।
সদানন্দ গিয়ে গ্রামের প্রতিটি মানুষকে প্রণাম করছিল। সকলকে আগামী বুধবার নিজের
বউভাতে নিমন্ত্রণ করছিল। নতুন বউ নিয়ে কেউ কি আসে ঘরের দাওয়ায়? এখন, কেউ
হাতের লোহাটাই খুলে বৌমাকে দেয়, কেউ চারটে বেগুন পেড়ে আনে, কেউ আসন হতে
লক্ষ্মীর ভাণ্ডার এনে হাতে তুলে দিতে যায়। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে সারা মাস এক মুষ্টি
করে চাল রাখা। বউটা হাসে। মুসলমান নাকি? সবকিছুকে বলে ‘ফানি ফানি’। আর তার সাথে ওই একটা ছোকড়া সাধু। গেরুয়া পরা। কী স্টাইল। বউটা তার
সঙ্গেই লেপটে থাকে বেশি। লাজ নাই।
সেই বুধবার গ্রামের সকলে গিয়ে উপচে পড়ে নকুল ডাক্তারের বাড়ির ইয়া বড়
উঠানে।আগের দিনের কিছু ভাঙা হয়নি। আগে যেমন টেবিলচেয়ারে খাওয়াদাওয়া, সেই
টেবিল চেয়ার রইলো। খাবার দিলো শহর থেকে আসা কিছু স্যার-স্যার চেহারার ছোকড়া। সেই
থেকে নকুল ডাক্তার আর কাউকে চেম্বারে যেতে বলে না। কাউকে হারামাজাদা, শালীর
শালী বলে না। নকুল ডাক্তার বাড়ি থেকে বেরোন না।
তিন.
এক দেশে এক গ্রাম ছিল। গ্রামে বাস করত এক ডাক্তার।
ডাক্তার সদানন্দ দাশগুপ্ত। সদানন্দের বিবাহ হয়েছে চার বছর। সদানন্দ নিজেকে ডাক্তার
কম, কবি বেশি মনে করে। সদানন্দ গান গায়। গ্রামের মানুষের মতই সে আদাড়বাদাড়
ঘোরে। ডাক্তারি করে দূরে মহকুমা শহরে। সেটা সেরে সে আর ডাক্তার থাকে না। চলে যায়
শীতলাতলায়। তাস খেলে। আর সন্ধ্যাবেলা দাঁড়িয়ে গান গায়। ডাক্তার সদানন্দ বিজলি বাতি
এনেছে। কৃষিকাজ যে এগ্রিকালচার, সেটা তার আগে কে জেনেছে? কৃষিকাজ
দেখভালের জন্যেও সরকারি বাবু আছে, কে আগে জেনেছে? সদানন্দ মাঠে গিয়ে
নামে। নকুল ডাক্তার জমি তো কম করেনি। সে জমিতে পুকুর করেছে সদানন্দ। হাজারটা হাঁস, মোরগ।
মৌমাছি যে এমন বাক্সে করে পোষ মানানো যায়, সেটাও কি কেউ জানে? সদানন্দ
পারটিলা এনেছে। পাওয়ার টিলার। গ্রামের ছেলেরা সেসব বেশ চালাতে জানে। গ্রামে সবার
বাড়িতে একটা করে পায়খানা হল। পাকা। সদানন্দ কী করেছে, সরকারই দিল খরচাপাতি।
এখন ডাক্তার সদানন্দ যা বলে তাই নিয়ম। আর কী তার গানের গলা! কেমন দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে সে গান বাঁধে। লহমায়। শীতল সরকার যে এত বড় কবি, সে-ও এসে একবার লড়ে
গেলো তার সাথে। হেরে গেলো। লবকুশ সহ সীতামাকে বনে দিয়ে আসাটা রামের সত্যি ঠিক
হয়নি। সদানন্দ স্পষ্ট করে গেয়ে দিল সেই কথা। শীতল সরকার হার মানলো।
কিন্তু
ডাক্তার সদানন্দ তো ওই কন্যাতীরে গিয়ে বসে থাকে একা। দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
বিকালে কে না দেখেছে সদানন্দ মাঠ পেরিয়ে কোথায় চলে যায়! ওই বনে বাঘভাল্লুক
নেই, কিন্তু সাপের তো অভাব নেই, না? সদা যায় কোথায়? সদানন্দ
আসলে কেমন! তার বউ থাকে কই জানি। শনিবার আসে, রবিবার থাকে সোমবার যায়।
কই যায়?
ইংরেজি ঝগড়াগুলো বাংলার থেকে নিষ্ঠুর
সদাবউ ইংরাজিতে সদাকে গালি দেয়
সদানন্দ নীরব থাকে
সদাবউ কেবল বলে, হেল হেল... হেল...
পারুলের মা বোঝে হেল হল একটা অভিশাপ। হয় এই অভিশাপটা সদাবাবা বউকে দিয়েছে, নাহয় বউ সদানন্দকে দেয়, প্রতিদিন। আর ওই ছোকড়া গুরুটা মিটি মিটি হাসে। তার যে কী গুরুগিরি কেউ জানে না। কী যে তার ধর্ম! গিটার বাজিয়ে কীর্তন করে সে। তাতে না আসে ভক্তি, না আসে ভাব। ওইটুকুন গুরু, সদাকে বলে, ‘বাবা’। যেনো সদানন্দ তার ছেলে। সদা চোখমুখ দিয়ে তাকে অস্বীকার করে।
ইংরেজি ঝগড়াগুলো বাংলার থেকে নিষ্ঠুর
সদাবউ ইংরাজিতে সদাকে গালি দেয়
সদানন্দ নীরব থাকে
সদাবউ কেবল বলে, হেল হেল... হেল...
পারুলের মা বোঝে হেল হল একটা অভিশাপ। হয় এই অভিশাপটা সদাবাবা বউকে দিয়েছে, নাহয় বউ সদানন্দকে দেয়, প্রতিদিন। আর ওই ছোকড়া গুরুটা মিটি মিটি হাসে। তার যে কী গুরুগিরি কেউ জানে না। কী যে তার ধর্ম! গিটার বাজিয়ে কীর্তন করে সে। তাতে না আসে ভক্তি, না আসে ভাব। ওইটুকুন গুরু, সদাকে বলে, ‘বাবা’। যেনো সদানন্দ তার ছেলে। সদা চোখমুখ দিয়ে তাকে অস্বীকার করে।
পারুলের
সময় পারুলের মায়ের সূতিকা হল। নকুল ডাক্তার বাঁচালেন। সেই থেকে এই বাড়িতে সারাদিন
থাকে পারুলের মা। খেটে দেয়। খেতে পায়। রাতে কেবল নিজের ঘরে যায়। স্বামী মরে গেলে আর যায়ই না।
পারুল একদিন পালিয়ে গিয়েছিল নারুর সাথে। এখন
থাকে অনেক দূরে। এখন এ বাড়িই পারুলের মা-র বাড়ি। সে জানে, ডাক্তার সদানন্দ
আসলে হেরেছে। একদিন সাহস হল তার। শত হলেও সদানন্দ তার সন্তান। সদা এলো আর তার মা
মরলো। পারুলের মা-ই তো সব করলো। সেই টানে সাহস হল তার। গুরুর ঘরে ঢুকে গেলো পারুলের মা। গুরুকে গিয়ে সোজা বলে,
— বাবু তোমার বয়স কত?
— তোমার কী চাই মা?
— চাই টাই না, বয়স কত বল?
— সে দিয়ে তোমার কী হবে, বল তো...
— তুমি আমার সদাবাবারে মুক্তি দাও, ওইটুকুন ছেলে...
— মুক্তি? মুক্তির জন্যই তো এতকিছু
বউটা
তখনও তার কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল। গুরুটার লম্বা দাড়ি। তার একটাকে আঙুলে পাকাচ্ছিল
সদাবউ। মাঝে মাঝে টান মেরে ব্যথা দিচ্ছিল গুরুকে। ব্যথা পেলেই ওই গুরুটা খানকির মত চোখ করে হাসছিল। আর কোথাও, কী করে যেনো, গোপনে, বউকে
চিমটি কাটছিল। বউটাও ঝিনকি তুলছিল। পানের পিক, পানের ছাবা, খয়েরের কালো
আর পুরাতন বৈধব্য এক করে পারুলের মা ঘরের মাঝখানে ছিটিয়ে দিলো। সব ভেঙে গেলো
তারপর।
চার.
ভেঙে গেলে মানুষ বনে চলে যায়। কন্যা পেরিয়ে এসে
সদানন্দ এই বনে চলে আসে। এর আগে অনেক মানুষ এসেছে। মানুষকে দু পায়ে দাঁড় করানোর
আগে পৃথিবী পথ কাকে বলে জানতো না। এখন যত ঘন বনই হোক পৃথিবী নিজে পথের সম্ভাবনা
সাজিয়ে রাখে। সদানন্দ সেইরকম একটি পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে। সে যত এগোয়, তার ভাঙা
ভাঙা জিনিসগুলো তত তাকে ছেড়ে ফিরে চলে যায়। যেতে যেতে যেতে, হেঁটে হেঁটে, সদানন্দের
তৃষ্ণা পেল। অনেক দূর হাঁটলে পরে মানুষের তৃষ্ণা পায়। বাতাসের শীতলতায় সদানন্দ
বোঝে কাছেই কোথাও জল আছে। ঝোপ সরিয়ে সদানন্দ দেখে এইসব ভেঙে যাওয়া সত্য নয়। ওই
ঝিলটা সত্য। এটাই হয়তো এই বনের নাভি। জলনাভি। সদা কাছে যায়। জল খিলখিল করে ওঠে।
ঝিলের পাড়ে একটা গাছ। বৃক্ষ। সব পাতা যেনো কারও আধবোজা চোখ। সদা আঁজলা ভরে জল খায়।
— কিছু কি ভেঙেছে তোমার?
সদা গা করে না। এ ঘোর জঙ্গলে কে আর কথা বলবে এমন
সুরেলা কণ্ঠে? সদার বিভ্রম হচ্ছে। সে আরেকবার জল নেয় আঁজলা ভরে।
— কে তোমায় বিদ্রূপ করে?
— কে কে?
এবার সদানন্দ সচকিত হয়। বউ তাকে গাইঁয়া বলে।
মধ্যবিত্ত বলে। বিয়ের মানে বোঝে না বলে। বলে সদানন্দ চাষাড়ে। বলে ভূত, পাগলছাগল।
সদানন্দ সত্যিই চমকে যায়, ‘কে তুমি?’
হস্তিনী আসবে টের পেলে যেমন ছোট প্রাণীরা সরে যায়, তেমনি সরে গেল সন্ধ্যা। দূরে ওই গাছের নীচে গিয়ে গুটিসুটি বসলো। স্পষ্ট দেখতে পেয়ে সদানন্দ ভয় পায়। আবার ভয় পাচ্ছে জেনে তার নিজেকে হাস্যকর মনে হল। এমনি এক সন্ধ্যায় সে এক মায়াবী মেয়েমানুষকে কবিতা পড়ে শুনিয়েছিল শহরের সবচেয়ে নির্জন নদীপাড়ে। এমন সন্ধ্যাগুলিতেই পৃথিবীতে মেয়েরা কবিদের প্রেরণা আর বিষ পাঠায়। বলেছিল সে। সেইসব মনে হয়।মনে হতেই ঝিলের মাঝখানের জল কেমন একটা ঘূর্ণির মতন ওপরে উঠে গেলো। সেটা স্থির হলে উঠে এলো এক নারী। না, সোনার মুকুট নেই, তেমন কিছু সাজ নেই। কেবল ওই একটি হাসি আছে। শান্ত জলে ঢিল পড়লে যেমন জল সরে যায়, তেমনি সন্ধ্যাকাল সরে যাচ্ছিলো আরও দূরে। আর ওই নারীর শরীর হতে একটা সুগন্ধি আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিলো।
— তোমার কী ভেঙেছে?
— কেন?
— বল
— তুমি কে?
— আমি তোমার নুনুদিদি
— না।ও তো বিচ্ছিরি ছিল
— থাক তবে, আমি শিবু পাটোয়ারি
— সে তো পুরুষমানুষ ছিল
— ও, আমি রসিক, আমি দিলীপ নাগ, আমি শ্যামলতনু
— এই এই, বেছে বেছে এদের নাম নিচ্ছ কেন? কে তুমি?
— আমি হাঁটি। পথে পথে। ঘরে ঘরে যাই। যাদের সকল ভাঙে, যারা সকলের
কাছে হেয় হয় তাদের ঘরে যাই। হেয় হতে হতে গাছের কাছে গিয়ে নালিশ করে যে, আমি
সেই রসিকের কাছে যাই। শ্যামলতনুর কাছে যাই। সে রাতের পর রাত চেষ্টা করে একটা গান
বাঁধতে পারে না।আমি দিলীপ নাগের কাছে যাই। সে আর আগের মতন পট আঁকতে পারে না।
লক্ষ্মী এঁকে নিজেই নিজের আঁকা পটকে বেশ্যা বলে গালি দেয়। আমি তার কাছে যাই। এরা
অকারণ ভেঙে যায়। বছরের পর বছর রোগে ভুগে ভুগে যখন নুনু আর পারে না, তার কাছে
আমি যাই। সে-ও ভেঙে যায়। ভাঙা মানুষ জোড়া লাগাতে সময় নেই কারও। এমনকি, নিজেকে
সবটা দিতে চেয়ে নেবার লোক পায় না বলে অনেকে ভেঙে যায়। তাদের কাছে যাই আমি। তুমি তো
নিজে চলে এলে...
— আমি তো তোমার কাছে আসিনি
— আমার কাছেই এসেছো। এতকাল চেষ্টা করেছো, আসতে পারোনি আজ এসে গেলে... চলো
— কোথায়?
গাছের
নীচে জমাটবাঁধা সন্ধ্যা ছুটে এসে সদাকে কী দিয়ে মুছিয়ে দিলো। শীতল শীতল। সারা গায়ে
কেমন আনন্দ। সামনে ওই রহস্যময়ী নারী, সদানন্দ তার পিছু পিছু যায়। যেতে বাধ্য
হয়। একটা বিদেশি গমক্ষেত। সোনালি হলুদ। তার আকাশে কয়েকটা উড়ন্ত কালো কাক স্থির হয়ে
আছে। এ গমক্ষেত সত্য নয়। কে যেন এঁকেছে। একটা এঁকে রাখা হাওয়াকলের নীচে
দাঁড়িয়ে হাত নাড়লো একটা লোক। তার এক কান কাটা। তাতে ব্যান্ডেজ।সদানন্দ হাত নাড়াতে যায়, চেয়ে দেখে লোকটা নেই।
গমক্ষেত, কাক সেসব কিছু নেই। উল্টে কারা যেন একটা ট্রামলাইন পেতে দিল। আকাশ
হতে ঝুলতে লাগল বাসি সব ডিমের বড়া। ট্রামলাইন দিয়ে পেছনে ঘা নিয়ে ছুটে আসছে একটা
ষাঁড়, নাকি ট্রামই? একটা লোক গোঁয়ারের মত মাথা নিচু করে তার দিকে হেঁটে
যাচ্ছে। আর এদের সকলকেই ঠেলে দিচ্ছে গিটার হাতে একদল তরুণ গুরু। তাদের দাড়ির থেকে
ঝুলছে ছোট ছোট বিদ্রূপাত্মক গান। দূরে কারা
যেন লালনীল শাড়ি শুকোতে দিয়েছিল... সেসব এখান সাদাকালো দেখাচ্ছে... কে
একটা লোক সিনেমার ক্যামেরার পেছনে বসে সিগারেট খাচ্ছিলো...
(প্রকাশিতঃ যাপন কথা)
(প্রকাশিতঃ যাপন কথা)
দারুণ।
উত্তরমুছুন