অশোক
দেব
সদাপুরাণ- ৮
বুনো খরগোশের শুচিবায়ু আছে। স্পষ্ট, মসৃণ পথ ছাড়া তারা হাঁটে না। জলকাদায় যায় না। বানরের পালে থাকে একজন নেতা। গোদা। বানর বাংলা মদ ভালোবাসে। হনুমান তো জাতমদতি। বনরুই পিঁপড়ে শুষে খায়। পুরনো সিঁদল আর রাবগুড়ের মণ্ডে জমা পিঁপড়ে পেলে তো কথাই নেই। সারাদিন নিজেই নিজের মধ্যে একটা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে বনরুই। যেন এ পৃথিবী একটা কিছু না। গোধূলি হল বনমোরগের জন্য সবচেয়ে বিভ্রান্তির সময়। তখন এদিকে তাড়ালে ওরা ওদিকে যায়। খাটাশ যেদিক দিয়ে হাঁটে, সে জায়গার গন্ধ মৃত্যুর মত। বাইদ্যারা এসব জানে। এরা এলে বন সচকিত হয়ে যায়। জনপদ সাবধান থাকে। বাঞ্জারা বালক গাভীর বাঁটের নীচে বসে নিশ্চিন্তে দুধ টেনে খেয়ে নেয়। কিংবা একটা ছোট লাঠি ছোঁড়ে জলের হাঁসের দিকে। ঘুরতে ঘুরতে সে লাঠি গিয়ে হাঁসের ঠিক গলায়। হাঁস প্রথমে ডুবে যায়, পরে ভেসে ওঠে। মৃত। টুকে করে তাকে তুলে আনে বাইদ্যা বালক। নিয়ে যায়। তাই সকলে কানখাড়া রাখে।
সদাপুরাণ- ৮
বুনো খরগোশের শুচিবায়ু আছে। স্পষ্ট, মসৃণ পথ ছাড়া তারা হাঁটে না। জলকাদায় যায় না। বানরের পালে থাকে একজন নেতা। গোদা। বানর বাংলা মদ ভালোবাসে। হনুমান তো জাতমদতি। বনরুই পিঁপড়ে শুষে খায়। পুরনো সিঁদল আর রাবগুড়ের মণ্ডে জমা পিঁপড়ে পেলে তো কথাই নেই। সারাদিন নিজেই নিজের মধ্যে একটা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে বনরুই। যেন এ পৃথিবী একটা কিছু না। গোধূলি হল বনমোরগের জন্য সবচেয়ে বিভ্রান্তির সময়। তখন এদিকে তাড়ালে ওরা ওদিকে যায়। খাটাশ যেদিক দিয়ে হাঁটে, সে জায়গার গন্ধ মৃত্যুর মত। বাইদ্যারা এসব জানে। এরা এলে বন সচকিত হয়ে যায়। জনপদ সাবধান থাকে। বাঞ্জারা বালক গাভীর বাঁটের নীচে বসে নিশ্চিন্তে দুধ টেনে খেয়ে নেয়। কিংবা একটা ছোট লাঠি ছোঁড়ে জলের হাঁসের দিকে। ঘুরতে ঘুরতে সে লাঠি গিয়ে হাঁসের ঠিক গলায়। হাঁস প্রথমে ডুবে যায়, পরে ভেসে ওঠে। মৃত। টুকে করে তাকে তুলে আনে বাইদ্যা বালক। নিয়ে যায়। তাই সকলে কানখাড়া রাখে।
বাঞ্জারার দল আসে। এরা ঘরে সিঁদ কাটে না, হাজার
টাকা পড়ে থাকলে নেয় না। কিন্তু তুলতুলে কোনও পায়রা দেখলে তাকে জাদু করে। আকাশ হতে
পেড়ে কোঁচড়ে করে নিয়ে যায়। পৃথিবীর কোন্ গভীরে ডুমো ডুমো পিঁপড়েরা সাদা সাদা ডিম
পেরেছে তারা জানে। সুরেশ করের পুরনো বাগানের কোন গাছে বস্তার মত ঝুলে আছে মধুভরা
মৌচাক, তারা জানে। কার বাড়ির গাভী কখন দুধের তাড়নায় দূরে বেঁধে
রাখা বকনাকে ডাকে, জানে তারা। তারা
জানে কোথায় বসেছে শালিখের আলোচনা সভা। এরা যেন
বাতাস হতে সেসব সংবাদ পায়।
কিছু পিঁপড়ে আছে পৃথিবীতে, কালো। ডুমো। এদের
চেহারা কংগ্রেসের নরসীমা রাওয়ের মত। কজন বাইদ্যা পুরুষ এদের সরু, প্রায়গুহ্য
গুহার মুখে সিঁদল আর রাবগুড়ের মণ্ড রাখে। তারপর একটা শিখাবিহীন, জ্বলন্ত
কাঠের চ্যালাকে পৃথিবীর গায়ে বোলায়। সে তাপ পিঁপড়ের বাড়িঘর গরম করে দিলে এরা
বেরিয়ে আসে। এসেই দেখে সুস্বাদু মণ্ড। লহমায় ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে
আসে পিঁপড়ে। ওই গোলক
তখন কালো হয়ে যায়। এরা
সকল ভুলে বাকিদেরও গর্ত হতে ডেকে আনে। পিঁপড়ে ক্ষুদ্রপ্রাণ, হয়তো
নির্বোধ। এরা বুঝতে পারে না একটা বাঁশের আঁকশি করে এদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে
শ্যামকান্তি শিকারী। সে এখন গোমতীর ওপারে জঙ্গলে চলে যাবে। এইসব পিঁপড়ের ব্যাঞ্জন
সে আবার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করবে। সারাদিন পিঁপড়ে সেই মণ্ডকেই জগৎসংসার ভাবে। তারই
গায়ে ঘোরাফেরা
করে।একটু এদিক ওদিক যায়, নিজেদের
বাসাটি খোঁজে। আবার ফিরে সে মণ্ডের গায়ে হুটোপুটি করে। হয়তো তারা গানও গেয়ে থাকে। এদিকে লতপত করতে করতে
বেরিয়ে আসবে বনরুই। পিঁপড়ের আনাগোনা তাকে শুয়ে থাকতে দেয় না। তার ওপর পুরনো
সিঁদলের গন্ধ। খাদ্য এমনই লোভাতুর করে। খাদ্যের টান এমনই টান। সে আসে। প্রথমে শুষে
শুষে পিঁপড়ে খায়। পরে সবটা মণ্ড খেয়ে ফেলে। খেয়ে কেমন নিস্তেজ হয়ে যায়। কারণ সে
মণ্ডের গভীরে ছিল কী জানি কী পাতা। বাঞ্জারা পুরুষ সে মূর্ছিত জন্তুকে নিয়ে ফিরে
আসে। এসব আঁশে ঢাকা কিম্ভূত প্রাণী দিয়ে কী করে কে জানে।
বনে এইসব ষড়যন্ত্র চালাতে হলে বানর আর হনুমানকে শান্ত
করতে হয়। নইলে নীচে শিকারী দেখে এরা গাছে গাছে এমন চেঁচামেচি করে, সকল
প্রাণী সাবধান হয়ে যায়। শিকারী বাঞ্জারা সেটি
জানে। ওরা সকলেই হরবোলা। সেই বিদ্যা দিয়ে বানরকে ডাকে। হনুমানকে ডাকে। ওরাও ঠিক
আসে। প্রথমে দূরে দূরে থাকে। একসময় কী এক জাদুতে পালের গোদার সঙ্গে ভাব করে নেয়
বাইদ্যা পুরুষ। মাটির বড় একটা গামলায় সে বাংলা মদ বেড়ে দেয়। একে একে জমে যায় সেই
পানের আসর। স্ত্রী, পুরুষ, একেবারে আবালবৃদ্ধবণিতা, সকলেই
কিছুক্ষণের মধ্যে নেশায় চুর। পুরো বন খালি করে চলে আসে সব। তারপর এদিক ওদিক ঘুম।
মাতাল বানরের নিদ্রা যে দেখেনি, সে জানে না নিদ্রিত বন্যতা কী নিষ্পাপ। শান্ত হয়ে যায় বন। এই শান্তির মধ্যে স্পষ্ট সরল পথের ওপর
মিহি ঘাস ছড়িয়ে দেয় বাইদ্যা। ছড়িয়ে দেয় কী
গাছ থেকে তুলে আনা চাপা চাপা কিশলয়। খরগোশ আসে। খেতে খেতে চলে যায় একটা তারের
কুণ্ডলীর মধ্যে। বেড়া বাঁধার লোহার সরু গুণা দিয়ে সেটা বানানো। খরগোশের পেছনের পা
লম্বা। গোটানো। জড়িয়ে যায়
সেই হিজিবিজি তারের গোলাকার জালে। নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে আরও জড়িয়ে যায় খরগোশ। শেষে লাল
লাল ডালিমের বীজের মত চোখ তুলে তাকায় চারদিকে। সে যেন বিশ্বাস করে এখুনি কেউ তাকে
মুক্ত করে দেবে। ফিরে যাবে সে। কিন্তু ফিরে যেতে পারে না। মৃত্যুর দিকে যায়।
বাঞ্জারা পুরুষের হাতে ঝুলতে ঝুলতে, নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে যেতে যেতে খরগোশের
চোখেমুখে এমন ভাব, যেন বাবার সঙ্গে মেলায় যাচ্ছে। কিছু প্রাণী আছে মৃত্যু
বলে যে কিছু আছে, জানেই না।
এইসব করে তারা। বাঞ্জারা বাইদ্যার দল। আর তাদের রমণীরা
যায় শহরের পথে পথে। গলিতে গলিতে এরা হাঁক দেয়, ‘দাঁতের পোক খোয়াই, মাজার
ব্যাদনা সারাই, শিঙা লাগাই’। কোনও কোনও বৃদ্ধ, কোনও কোনও পুরুষ এই
ডাক শুনলে কামার্ত হয়ে ওঠে। বাঞ্জারা রমণীর মত নদীতুল্যা নারী পৃথিবীতে নেই আর। শ্যামা।
গোমতীর মাটির সঙ্গে রূপার গুঁড়ো মিশিয়ে যেন এদের রূপটি সাজানো। পৃথিবীকে
ছন্দ শেখাতে এরা হাঁটে। এদের গায়ের ঘ্রাণ এমন এক পুষ্পের মত, যে
পুষ্প বৃক্ষাতীত। তারা নিজেরা সেটা জানে। তাই হাঁক দেয়। তাদের কণ্ঠ হতে বন্য
উস্কানি ছড়িয়ে পড়ে। আর তখনই দুনিয়া কাঁপিয়ে কোনও পুরুষের মাজা চিড়বিড় করে ওঠে, দাঁতে
শিনশিন করে। ডেকে আনে বাইদ্যানিকে।
রহিম বুড়ার এসব নেই। তিনি পুরুষ। তিনি ডাক শুনে ডাকবেন
কেন? তিনি নিজে লোক পাঠিয়ে ডেকে আনেন কোনও বেদেনীকে। এবার মিট্টিকেই
তাঁর মনে ধরেছে। সে আসে। কর্পূর মেশানো কী তেল যেন মালিশ করে। সারা গায়ে। সবটা তেল শরীরের অন্দরে ঢুকিয়ে দিতে হবে।
পারিশ্রমিক কুড়ি টাকা, প্রতি মালিশ। আর কানে সুড়সুড়ি আলাদা। কয়েকটা
সরু সরু ধাতব শলাকার মাথায় রুই লাগিয়ে কানের খোলও পরিষ্কার করে মিট্টি। সেটার
জন্য আলাদা টাকা। তথাপি একিদন রহিম মিয়াঁর কাছে এসব ক্লান্তিকর লাগবে। তার আগে
মিট্টির মালিশ, তার স্বেচ্ছাকৃত শারীরিক টুকটাক তিনি সবটা নেবেন। ততদিন
নেবেন যতদিন মিট্টিকে তাঁর অত্যন্ত কুৎসিত মনে না হয়। ততদিন, যতদিন
মিট্টির গায়ের গন্ধ তাঁর কাছে খাটাশের মত না লাগে। যেদিন ক্লান্তি লাগবে, যেদিন তার আর এসব
ভালো লাগবে না, তিনি খবর পাঠাবেন দূরে। ময়ালে। সেখান থেকে আসবে
গহীনকুমার জমাতিয়া, আসবে শুক্লসাধন, আসবে রবিচধ্রি।
খাওয়াদাওয়া হবে। মিথ্যা সোনার চশমা পরবেন গপিস্ট বুড়া, তাঁর মিথ্যা হুঁকোতে
বৃথা আগুন জ্বলবে। তিনি বলবেন
—
কবে তোমরার হুঁশ হইব কও দেখি? বন তো বিধবা কইরা
দিতাছে... নিপেনদা জানলে ব্যাপারটা ক্যামন অইব, বুঝনি
কিছু... না?
ব্যাস,বাঞ্জারাদের
দিন শেষ। গপিস্ট বুড়া নৃপেন চক্রবর্তীকে নিপেনদা ডাকেন।তিপ্রা মানুষের কাছে নৃপেন
চক্রবর্তী মানুষ নন। মন্ত্র। গপিস্ট বুড়া সেটা জানেন। তাই নামটা বলেন। সঙ্গে
মিশিয়ে দেন একটা নৈকট্যের মিথ্যা। ফল হাতে হাতে। একদিন গোমতীর চরা হঠাৎ খালি। বাঞ্জারা যে এসেছিল, তার
কোনওমাত্র চিহ্ন থাকবে না।
লালুমজিদ তার বাপের এইসব জারিজুরি জানে।
কিন্তু মিট্টিকে তারও তো বড় প্রয়োজন। মেয়েটার কাছে গান আছে। আজ সে দূর হতে
মিট্টিকে দেখে। সে তার পিতার ব্যাদনার উপশম সাজাচ্ছে। কিন্তু
সেই গান তো তার
শেখা হল না। সেদিন রাতে এক গান মিট্টি গেয়েছিল। এক কন্যা তার বুকের পাতা দিয়ে
মুকুট বানাবে। সে মুকুট মাথায় পরবে এক পেশল প্রেমিক। তারপর তারা দূর দেশে গিয়ে
হীরামন পাখি শিকার করবে। হরিণের মাংস রেঁধে খাবে। এইসব কথা ছিল সেই গানে। সে গানের
সুর সোঁদা সোঁদা। মজিদের সে সুর চাই। চাই যে সেটা মিট্টিও জেনেছে। তাই কাছে আসে
না। গপিস্ট বুড়ার
গায়ে তেল মাখতে মাখতে
ইতিউতি স্তনের চাপ দেয়। মজিদকে দেখিয়ে দেখিয়ে। আর মিটি
মিটি হাসে। এদের সমাজে সব কেমন খোলামেলা। কেমন নির্লজ্জ। এদিকে, মজিদের তো শরীরের চাপ চাই
না। গান চাই। মিট্টি যে রাগে রাগাতে চায়, সে রাগে রাগে না
মজিদ। বেসুরে বাঁশি বাজায়। একসময় অসহ্য ঠেকে তার। সে এগিয়ে
যায়। বলে
—
ইধার আইয়ে
মায়ের
ওপর রাগ করা কিশোরের মত সে মিট্টিকে ডাকে। যেন তার
কত অধিকার! মিট্টি ছাপিয়ে হাসে। হাসে। হাসতেই থাকে। তার শরীরে যতটা পুরুষ, সবটা
এক জায়গায় এনে লালুমজিদ চড় মারে মিট্টিকে। ব্যাস। যেন ঘুমন্ত সিংহীকে কে আঘাত করেছে। মিট্টি এখন
যে ভাষায় চিৎকার করছে সেটা হিন্দি নয়। সে মজিদের প্রায়লাল গায়ে আঁচড়ে আঁচড়ে
রক্তাক্ত করে দিচ্ছে তাকে। চড় মারছে,
বারবার। চড়ের পর চড়, ঘুঁসিও। হিন্দিতে বলে, ‘শালা না-মরদ
কঁহিকা ...’ লালুকুত্তা এসব দেখে হিংস্র হয়েছে। সে প্রাণপণ ছুটে
আসছিল। তার প্রভু আক্রান্ত। দূর হতেই সেটা বুঝেছে মিট্টি।‘খাড়ে রে উধারি’ সে
সরাইল্যাকে আদেশ করে। লালুকুত্তা কী বোঝে, চুপচাপ
দাঁড়িয়ে পড়ে। কুঁইকুঁই করে।
—
ক্যা চাহিয়ে বোল, বোল কেয়া চাহিয়ে? বোল
শালে...
—
গানা... গানা চাহিয়ে... বো বালা গানা, হীরামন
বালা ... গাওগে?
যেন কিছু হয়নি। যেন কেউ তাকে হিংস্রভাবে
মারছে না। লালুমজিদ এমন ভাবে বলে। সরে আসে। সেই গান একবার শুনে
সে যতটা শিখেছিল, সেটাই গেয়ে ওঠে। গান
ধরে মজিদ। আপসে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে চলে আসে প্রিয় চালতা তলায়।
গান গায় আর তার দুচোখ কাঁদে। অবিরল ধারা।
জরিনা এসব দেখছিল।
তার নাটঢিল স্বামী পরনারীর মার খেয়ে এসে বসেছে। গান গাইছে। কী ভাষার গান এটা? এমন
দরদ কোথা হতে আসে? মানুষের কান্নার মত সুন্দর কী কিছু নেই? কী
ভাষায় কোন এক বুনো গান গাইছে মজিদ, মানে বোঝা যায় না। অথচ কেমন নেশা ধরে
যাচ্ছে। তার পুরুষটি কেমন! কী এত দুঃখ তার? জরিনা বোঝে না। এসে
তার মজিদের সামনে বসে। মোহিত হয়ে যায়। যেন পুরুষের আসল কাজ নারীকে মোহিত করা।
বৃথাই এরা যুদ্ধে গিয়েছে, বৃথাই এরা পেশী ফোলায়।
মজিদের গান ভুল
হচ্ছিল। একবার মাত্র শুনেছিল খালি। এক মানুষের গান অন্য
মানুষের অন্তরে শুয়ে থাকা গানকে ডাকে। সেই টানে টানেই হয়তোবা গেয়ে ওঠে মিট্টি। কী উদ্ভাস
আজ গপিস্ট বুড়ার উঠানে ফুটে ওঠে এই বিষণ্ণ দুপুরে! মজিদের সামনে এসে
বসে মিট্টি। অবাক করে দিয়ে জরিনাকে তুলে দাঁড় করায়। গান গায়।
কী একটা নাচ — পৃথিবীর মানুষ কখনও নাচেনি — সে নাচ করে। আর
কাঁদে। সেই গানে কী ছিল... লালুসরাইল্যা সব বোঝে। সে-ও লেজ
নাড়ে আর ঘুরে ঘুরে নাচে।
—
ইতনা রো তা কিঁউ হ্যায় আপ?
মজিদকে
এই কথা বলে চলে যেতে উদ্যোগ করে মিট্টি। পড়ে থাকে তার বেদেনীর ঝোলা, তার
সর্বস্ব। পড়ে থাকে সেই কাঁচামিঠে আমগাছের নীচে। যাবার
আগে একবার কাছে চলে আসে।
তার কোমরে রূপার বিছে। শরীরের ঢেউ যেন কী কারণে এইমাত্র পরাজিত। মজিদের কানের কাছে
মুখ নেয় মিট্টি। জরিনাকে শুনিয়েই বলে, ‘ফির
আউঙ্গি, রো নে আউঙ্গি। ফির কব রুলাওগে, জান? রোতে
হুয়ে আচ্ছা লাগতা হ্যায়... মালুম নেহি থা... আবার কবে কান্দাইবে... হামি
আবার আসবে ’।
জরিনা কী বোঝে, হাউহাউ করে গিয়ে
মজিদকে জড়িয়ে ধরে। যেন কে এসে কেড়ে নিচ্ছে বালিকার খেলনা। কে যেন তার আকাশ হতে
সাধের পায়রা জাদু করে নিয়ে যায়। কে যেন তার হংসের দিকে
ছুঁড়ে মেরেছে অস্ত্র। যেন এই বেদেনী কী এক ফাঁদের লোভে কুণ্ডলী হতে জাগিয়ে তুলছে
মজিদকে। সে তার ফ্যাঁৎকাঁদুনে পুরুষটিকে নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে চায়। সান্ত্বনা
তো দেওয়া যাবে না। কারণ, মজিদের কষ্টটি তো জানে না কেউ। এদিকে নাটঢিল
মজিদও বোঝে না কিছু। সে তার দারোগাবেডির ভাবসাব বোঝে না। তাই গান ছাড়ে না। গান
গায়।
স,
এইমাত্র ফিরে এলাম গোমতীর চরা থেকে। এই মানুষগুলি
অদ্ভুত। এদের যা নেই, তা হল দুঃখ। কারণ, এরা প্রতিযোগিতা
করতে জানে না। বসে ছিলাম। ওপাড়ে শ্মশান। সেখান থেকে চিতা ধোয়া আধপোড়া কাঠ নদীতে
এসে পড়ছিল। কারা যেন দাহ শেষে চিতা ধোয়াচ্ছে। এদিকে একটু একটা চরায় কিছু মানুষ।
এদের নির্দিষ্ট জীবন নেই, তাই বাঁধা শ্মশানও নেই। কিংবা এদেরই আছে
প্রকৃত জীবন, তাই এরা মৃত্যুকে হিসাবে রাখে না। শ্মশান হতে মরাকান্না
ভেসে আসছে তখনও। যে গেল সে এই শেষ কাঁদাচ্ছে তার স্বজনকে। আর সে কাঁদাতে পারবে না
কাউকে। হয়তো তার স্মৃতি কাঁদাবে কিছু কিছু। কিন্তু মৃত মানুষটি আর কাঁদবে না। এটাই
তার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল। মৃত্যুর ওপাড়ের মানুষই সবচেয়ে ভালো। কিংবা এমন নির্মল
জীবনে যারা ভাসে, এইসব বাঞ্জারার দল, তারাও। কিছু পেতে
চায় না, তাই প্রতিযোগিতা নেই। যেমন আমিও পেতে চাই না তোমাকে, তাই
প্রতিযোগিতা নেই কারও সাথে। যে নেই, তাকে কী করে পাব? এই কথা আজ নিজেকে
বলেছি। ইতি ২২ মার্চ ১৯৮৪
তোমার একান্ত
সদানন্দ
সদানন্দ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন