রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৭

সদাপুরাণ-২২


অশোক দেব
সদাপুরাণ-২২

রক্ত ভারি অয়। সব শিরা ঢিলা অইয়া যায়। চক্ষের আর দেখবার ইচ্ছা থাকে না। দুনিয়াত হুননের মতন কুনু কথা থাকে না আর
মন নতুন কিছু নেয় না।  মনের মিধ্যে জাগা থাকে না আরমন ঘামাইয়া যায়। দেখবেন বাইচ্চা অইলে নতুন নতুন কেবল ঘুমায়। ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া কার লগে জানি হাসে। কেবল হাসে। ঘুমের বাইচ্চা খিলখিল কইরা উডে। আবার ঘুমাইয়া যায়। তারে আল্লামিয়াঁ কতকিছু খেইল দেখায়। কয়, এমন এক জাগা আছে কেবল জল। যত দূরে দেখবা কেবল জল। হিডারে কয় সাগর। ঘুমের বাইচ্চা বিশ্বাস করে না। হাসে। আল্লামিয়াঁ কয়, এমন একটা জাগা বানাইছি কেবল বালুযতদূর দেখবা কেবল বালু। শিশু মানে না, হাসে। তবু তার ঘুম ভালা লাগে। যা দেখেনাই, যা হুনেনাই, তা দেখনের লিগ্যা, তা হুননের লিগ্যা ঘুমায়। সারাদিন ঘুমায়। আমারও ঘুম আইয়ে। অহন আমি আর বাইচ্চা নাই। সাগর দেখসি না, তবে সাগর আছে। মরু দেখসি না, তবে আছে। জানি। যারা দেখসে তারা কয়। আমিও যা যা পারলাম দেখলাম, হুনলাম। অহন পুরান অইছি। ঘুমের নিশা অয়। ঘুমের মিধ্যে দেখি ওই দেশ। হেই দেশে  হাতে পরাণ লইয়া মানুষ মানুষের দিকে দৌড়াইয়া যায়। বাইচ্চা ঘুমের পিডে চইরা জগতে আইয়ে। আমি বুড়া ঘুমের উপরে চইরা দুনিয়ার থিকা যাইগা।
- আমনে না ঘুমাইতে ঘিন্না করেন?
- করতাম
- অহন?
- ওই যে কইলাম, কতা বোজেন না?
- বুজি
- সদামিয়াঁ
- কন
- যামুগা
- কই যাইবেন?
- ওই যে পক্ষীডা ডাকে হুনেন? ওই যে, টুবুর টুবুর... টুবুর টুবুর... হুনেন? ওইখানে যামু
- ইডা তো ওই তো, কামরাঙা গাছে বইয়া ডাকতাছে
- এই তো বুঝলেন না। আমনে হুনতাসলেন? আমি কওনের আগে পক্ষীডার ডাক আমনে হুনতাসলেন? হুনেননাই। কিন্তু ওইডা তো আছিলো। আছিলো না? আমনে জানতেন না কই আছিলো।হারাদিন তো খাইলো দাইলো, যদ্দুর উড়নের উড়লো। অহন ওই গাছে বইছে। আছে কিন্তুক নাই। ডাকে কেবল ডাকে, বিশ্রাম নাই... কেবল ডাকে... জিকির দেয়, আমনেরা য্যান কন জপ... পক্ষী জপ করে। একটাই কতা বারবার কয়... আমিও একটা কতা অহন কেবল কই... যামুগা, যামুগা, যামুগা... একটা কতা বারবার নিজেরে কইলে কতাডাই আমনেরে চালাইবো। হারাদিন উড়বেন, খাইবেন দাইবেন, একটা সময় বইয়া ওই পক্ষীর মতন একটা বালা কতা বারবার কইবেন...
- তাইলে কী অইব?
- আমনে বালের নি শিক্ষিত? কিতা বোজেন?
- না, মানে একটা কতা বারবার...
- এই নাটঢিল, আমনেরে কু-কু কইলে কান্দেন কিলিগ্যা?
- কান্দি না। কষ্ট লাগে...
- একটা আওয়াজ আমনেরে কষ্ট দিতো পারে, আরেকটা আওয়াজ আনন্দ দিতো পারতো না? আমনে দুনিয়াত
 বাইর অন না, কেডা কুন সময় কুউ করবো... ডরান...
- না, মানে...
- না, আমনে ডরান। একটা শব্দ আমনেরে ডর লাগাইয়া দিতো পারে
মনে অশান্তি আনতো পারে। একটা এমন শব্দ কি নাই, যিডা আনন্দ দিবো, শান্তি দিবো? যান টোকান, আমি ঘুমামু...
     উঠি না। এই হল কাঁচামিঠে আমের গাছ। এইখানে তার আসন পাতা। গপিস্ট বুড়া সত্যই ঘুমিয়ে পড়েছেন। এবং সত্যই মুচকি মুচকি হাসছেনমাঝে মাঝে ভ্রূ কুঁচকে কী যেনো অস্বীকার করছেন। পাখিটা ডাকছে। একটা কলাপাতা ওই। সে বাতাসে নড়ে। ডানে আর বামে। যেনো নিজের গাছকে সে হাওয়া করে দিচ্ছে। আজ রবিবার। এখন দুপুর। নিদাঘ। কী একটা রান্না হবে বলে ডাক পেলাম। কই কোথাও কোনও সাড়া নেই। খিদে পেয়েছে। বাড়িটা সত্যই শুনশান। কী করব? পাশে একটু দূরে একটা ঝোপ। তারপরেই কামরাঙা গাছটা। টুবুর টুবুর। দেখি তো কী পাখি। কাছে যেতেই ঝোপে অলস কিছু পোকা ওড়াউড়ি করে। যেনো অনিচ্ছায়। ভালো করে দেখি জোনাকি। কেমন বেমানান। এখন এই এত আলো। দিনের বেলা। এখন জোনাকি তার আলো কী করেছে? আছে, নাকি নিভিয়ে রেখেছে? দিনের পৃথিবীতে জোনাকি থাকে?
     আজকের দুপুরে আর খাওয়াদাওয়া হবে না। বুঝলাম দুপুরটা নিরেট। হাওয়া আছে। ওপরে কারণ ওই দূরে তেঁতুল গাছের ওপরের পাতা সব নাচছে। নীচে কিছু নেই। কেবল একটা কেমন ডাক ভাসছে। অনেক দূরে কে একটা মা তার ছেলেকে ডাকছে, ‘বাবানু রে...’ হয়তো গোমতীর জলে গিয়ে হুটোপুটি করছে বাবানু। বাবানু। কী নাম... বাবানু রে...

     নন্দদার প্ল্যান বেশি কাজ কম। আসলে কেমন যেনো দিশেহারা। সদানন্দের খাতা, ডায়েরি, ওই ফাইলের লেখা, সব সাজিয়ে একটা বই করতে হবে। এই কাজে তিনি আমায় ডাকেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু গুছিয়ে করতে দেন না। এই খাতাটা দেন, সেটা কেড়ে নেন। সেই ফাইল দেন তো সবটা দেন না। আজকাল আর ভালো লাগে না। কিছুই ভাবতে পারি না। নিজের পাড়াটাকেই কেমন রহস্যময় লাগে।
- বুজ্জি
- না, নন্দদা, সময় নষ্ট। আমনে কী চান কন
- আমি জানলে তো আমনেরে কইতাম... আমনে একবার একবার পড়েন
আমি তো কতবার পড়লাম।
- কী করতাম, কন। আমার মনখারাপ অইয়া যায়...
- আমারও অয়। তবুও দেখেন
বলে একটা খাতা এগিয়ে দেন। পড়ে মনে হল আগের লেখাটার অংশইঃ
এই বাজারটার নাম আৎকা বাজার। আজকাল যেখানে খুশি, যখন খুশি একটা বাজার বসে যায়। সব আছে। মাছও। সব্জি। সবাই ছোট ছোট বাল্ব লাগিয়ে নিয়েছে। কেমন করে সারা উদয়পুরে রটে গেলো এখানে সব তাজা, সব সস্তা। সবাই আসে। অনেকের গাড়ি হয়েছে। গাড়ি নিয়ে আসে। এই একটা ছোট বটগাছও কে যেন লাগালো। হঠাৎ করে রীতিমত বাজার। তাই আৎকা বাজার। মাঝে মাঝে জরিনার ঘোরার বাতিক চাপে। দুপুরে কোথায় একটা জায়গায় গেলোওএনজিসি গ্যাসের জন্য কূপ খুঁড়েছে। তাতে কী করে আগুন লেগে গেছে। মাটির অনেক গভীর হতে দগদগে আগুন ওপরের দিকে উঠে আসে। রাশিয়া না জাপান থেকেও লোক এসেছে। নেভাতে পারছে না। দুপুরে সেইটাই দেখতে গেছে জরিনা। দুপুরে খাওয়া হল নাখাবার নিয়ে এলো খেতে হল। এখন ওই বাজারে যাবে। আৎকা বাজারে। সব্জি নিয়ে বসে একটা ছেলে আছে। মামুনওকে গিয়ে বলে, ‘কও মামুন, কিতা আছে আমার লিগ্যা’। মামুন তার সর্বস্ব দিয়ে ফেলতে চায়। কাস্টমার গুল্লি মারাক।
- কেমন দেখলেন আগুন?
- আমনে দেখছেন? যাইবেন?
- না
- রাগ?
- না
- খাইছে, আমনে দেখি মাইপ্যা কতা কওন শিখছেন। আজগা লাল লাল বেডা দেখলাম। সোজা সোজা। পরিষ্কার। কেমন জানি পানসা।
- ও
- ও কিতা?
- আমনেরে দেইখ্যা মরছেনি এক দুইডা?

     কেমন চুপ মেরে গেলো পরিভাবি। জানালার দিকে যায়
ওইদিকে ছাত। গ্রিলে হাত রাখে। ধরে না কিছু রাখে। এমনি রাখে। উলটো দিক থেকে আলো আসছে। হাতের পাতায় পড়ে ভেদ করে বেরিয়ে চলে আসছে আলো। আসতে গিয়ে গোলাপি হয়ে যাচ্ছে। আঙ্গুলগুলিতে একটা পাখির ডাক। টুবুর টুবুর... টুবুর... টুবুর... অনামিকা। কেমন বেঁকে আছে মধ্যমার দিকে। কনিষ্ঠা ওইদিকে গ্রিলের একটা রডকে আলতো করে ছুঁয়ে আছে। মধ্যমা গ্রিলের একটা রডের আড়ালে পড়ে গেলো। তাই আলো ওকে ছুঁতে পারছে না। আঁকুপাঁকু করছে। বৃদ্ধা আর তর্জনী নিজেদেরকে কী বলাবলি করছিল।  যতটা বাহু আলোতে পড়েছে সেখান থেকে আলো বেরুচ্ছে উলটো। তার তোড়ে বাকি আলো নাই আর। বাইরের আলোটা, যেটা কোথায় কোন সূর্য হতে আসছিল, কেমন দিনের জোনাকি হয়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখলাম লোহা গলে যাচ্ছে। আমার পায়ের কাছে কেমন একটা শিরশির হচ্ছে। দেখি পা গলে যাচ্ছে। যেনো মাটি দিয়ে বানানো হয়েছিলো আমাকে। গলে যাচ্ছি, জল পড়েছে গায়েদূরে একটা পাখি ডাকছে, কোথায়? টুবুর টুবুর। আমি নেই। আমি এখন একটা গলে যাওয়া মানুষ। মেঝেতে পড়ে আছি। একটা পাখির ডাক সেই মাটির স্তূপ হতে বেরিয়ে যাচ্ছে। টুবুর টুবুর, টুবুর টুবুর...
-হুনেন
 ডাক শুনতেই দেখি সব আগের মতন। আমি আসলে দাঁড়িয়ে আছি। এদিকে ফিরে আমার চোখের দিকে তাকায় ভাবি। এবার আলো তার পেছনে এসে দাঁড়ালো

-
এই উপরের থিকা পড়লে কেমন ব্যথা?
বুঝতে পারি। চুপ করে থাকি। সজু ওইটা ভালো কাজ করেনি। ওভাবে মরে যায় কেউ?
-আমি মানুষটা কিতা কইতে পারেন? আমি কেডা?
-আমনে কন
-আমনে কন। আমনে কইবেন
আমি কেডা? কেডা আমি? কিতা? কিতা আমি? একজন একজনরে মাইরা লায়। একজন মইরা যায়... আমি কেডা? আমি য্যান চাইয়া থাহি একটা মাইনসের দিকে হ্যায় আমারে মানুষ মানে না। আমার পায়ের সামনে বয়। আমারে সাজায়। গান দিয়া সাজায়, কতা দিয়া সাজায়। সাধনা করে। সাধে না...
- ছাড়েন। ছাড়েন এইসব কথা

- কেরে ছাড়ুম? অদ্দেক জীবন দেখলাম একটা বাঁশির মিধ্যে শ্বাস ফালাইয়া আর কাইন্দা কাডাই দিলো। যত তাইনের তে দূরে যাই, তত তাইনে হাসে... কাছে আইলে কান্দে...
- মজিদভাই তো এমনই?
- তই আমি কেমুন?
হঠাতই বুক হতে কাপড় সরিয়ে দেয় পরিভাবি। কেমন একটা সুডৌল অনচ্ছতা। একটা খাম। বেশ বড়। ব্লাউজের ভেতর বুকের ওপর থেকে নীচে। এক টানে ওটাকে খোলে। ভেতরের সব কাগজ ছুঁড়ে মারে আমার দিকে। এই ছাতা আমনেরে দেখাইতে আনছিলাম হেইদিন। আমনেও হেই পাও লইয়া পড়লেন... আমিও দেখাইতে পারলাম না... দেখেন। হেইদিন দেখলে আজগা আর এই লাজে পড়ি না আমি।


     উইল। সজু করে গিয়েছেসব।সবকিছু। স্থাবর অস্থাবর। মালিক জরিনাবিবিস্বামীঃ মজিদ মিয়াঁ।

রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৭

সদাপুরাণ-২১



অশোক দেব
সদাপুরাণ-২১


পরচুলা শুকোতে দিয়েছে জহিরুল। ঘোড়া মরে গেলে সে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। এখন আসে। টুপি পরে। টুপির ফাঁকে কাওয়ালদের মতন চুল বেরিয়ে থাকে কানের পাশে। এখন টুপি নেই, সেই চুলও নেই। টাক দেখা যায়। ও এখন সকল ছেড়ে আতরের ব্যবসা ধরেছে। একটা ছোট বাক্স। তাতে নানা রকম খাঁজ। সে খাঁজে খাঁজে কত আকারের যে শিশি। লাল শালুতে পেঁচিয়ে সে বাক্স কাঁধে ঝুলিয়ে সারাদিন ফেরি করে জহিরুলমেলায় মেলায় যায়। নানারকম আতরের গন্ধ মিশে গিয়ে একটা কেমন নেশা নেশা সুগন্ধ হয়। সেটা তার পিছু পিছু ফেরে। একটু অশক্ত হয়েছে। চোখও আর তত উজ্জ্বল নেই কেমন উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে। এখন স্নান করে এলো। চকচক করছে টাক। যদি ডাক পায় খাবে। আজকাল আর তত রান্না হয় না এ বাড়িতে।
     আজ অমাবস্যা। ভাদ্রমাস। এ কারণেই এসেছে জহিরুল। গপিস্ট বুড়ার সারা বছরের রুটিন তার জানা। আজ বিশেষ পূজা হয় ত্রিপুরাসুন্দরী মায়ের
রাজার লেঠেল গপিস্ট বুড়ার বংশ। আজকের দিনে মায়ের দারোয়ান হতেন তিনিদাতারামে একটা জোলাইবাড়ি আছে। এখানে জোলাইরা থাকতো। রাজ আমলে মায়ের পূজায় মশাল ধরা তাদের কাজসুবল দাস। গপিস্টের থেকে বয়সে বড়। সেই বুড়াও একটা ছোট মশাল নিয়ে আসতো। এই দিনে এসে মা-কে দেখিয়ে যেতো। গপিস্ট গিয়ে প্রধান ফটকে একটা লাঠি নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। নিয়মরক্ষা করে চলে আসেন। জহিরুল এটার সুযোগ নিতে আসে। অযথা ঘোড়াটোড়া আনে। হইহই লাগায়। গপিস্টকে সে সাজায় যাত্রার পোশাকে। কোথা হতে একটা বেতের শক্ত লাঠিও আনে লম্বা। এই করে বেশ টাকা নিয়ে নেয়। এবার তার ঘোড়া নেই। তবু আসে। কিন্তু ওই জোলাই সুবল মারা যাবার পরে গপিস্টও যান না নিয়মরক্ষা করতে। জহিরুল আসে।  এখন চান সেরে এসেছে। গপিস্টের ঘরে যায় সে।
-   জেডা
-   কন
-   যাইবেন?
-   মার বাড়ি?
-   হুম
-   না
-   আর পারি না
-   বুজি
-   আমনে থাকেন কই?
-   ঘুরি, আতর বেচি
-   কেমন ব্যবসা, চলেনি?
-   জেডা আমনে একটা কাম কইরা দেন না আমারে, দিবেন?
-   কন
-   একটা ফতোয়া দেন
-   কেমন?
-   আতর তো চলে না। আইজকাইল বোতলের সেন্টও চলে না। কিতা বইলে ডিওরেন্ট বাইর অইছে। টিপ দিলে বাইর হয়। ছুত কইরা গ্যাসের মতন ইতান কি মোছলমানের গায়ে দেওন হালাল? মোছলমান দিবো আতর
-   আমনে ভাত খান। বিশ্রাম করেন। যান গা। আর আইবেন না।
জহিরুল বেরিয়ে যায়। আতরের বাক্সটা নেবার সময় অযথা শব্দ করে। জরিনা একটু সাধলে খেয়ে যাবে। কেউ কোথাও নেই।

     আজও অমাবস্যা। ভাদ্রমাস। কেমন একটা রাক্ষুসে রোদ উঠেছে। সদার কাচের ঘর। দূরে মেঘের ছায়া এসে কাচের গায়ে ছায়া পড়েছে। আকাশে সে মেঘ হাঁটে, এই কাচেও। আজ এখানে আসতেই হবে। নন্দ দারোগা বারবার করে বলে দিলেন। আজকে নাকি কী এক অদ্ভুত জিনিস দেখাবেন। আমাকে এইটুকু লেখা দিয়ে চলে গেলেন কোথায়। এটুকু পড়লাম। ঠিকই জহিরুল আতর বেচতে আসতো তখন। তার নাম যে জহিরুল আমরা জানতাম না। ওকে জালালি বলেই ডাকতো সবাই। ঘোড়া আনতো ঠিকই। সেটা একটা এক্কার সঙ্গে জুড়ে জয়রাইডও করাতো মায়ের বাড়িতে। কিন্তু গপিস্ট তাকে একদিন বাড়ি থেকে বের করে দিলেন, সে আমরা কী করে জানবো? হঠাৎ করেই তাকে দেখা যেতো না, এটাও ঠিক। কিন্তু এটুকু লেখা পড়ে আমি কী করব? নন্দদার একটা কাশি আছে। কাশি নয়, মুদ্রাদোষ। সেটা শুনতে পেলাম সিঁড়িতে।
-   পড়ছেন?
-   হ, ইডা তো এট্টুখানি লেখা
-   আছে আছে বাকিডাও আছেইডা তো স্টার্টার
-   মেইন কোর্স দেন, পড়ি
-   শুনেন, সজুরে মনে আছে?
-   হুম, মদ আর ফেন্সিডিল, তির খেলা, রড সিমেন্ট... প্রচুর টাকা করছিল। আৎকা মইরা গেল।
-   একজাক্টলি, ক্যামনে মরল?
-   সিরোসিস হইছলো, না? ঘরের মিধ্যে মইরা পইড়া আছিল
-   ইয়েস, ইয়েস... নেন পড়েন
     এইটাও লাল কাপড়ে বাঁধানো খাতা নয়। ডায়েরিও না। ফাইল। এগুলো থাকে ওই আলমারিতে, যেখানে ওই গয়নাগুলি ছিল। দলিল লেখার কাগজ এগুলো। শেমি। সেই সুন্দর শীতল হাতের লেখা সদানন্দেরঃ
সজু একটা মারুতি ভ্যান কিনেছে। সেটা নিয়েই সে এলো। আজ অমাবস্যা। ভাদ্রমাস। গপিস্টকে সে জোর করে। বারবার বলে ভ্যানে করে মাতাবাড়ি যেতে। দারোয়ানগিরি করতে। কী করে যে রাজিও করে ফেলে। জরিনাও রাজি হয়। জগতে আমার কোনও কাজ নেই। গপিস্টের কাঁচামিঠে গাছের নীচে বসে পড়ছিলাম। সজু আসে।
-   চলেন
-   কই যামু?
-   মার বাড়িত যামু। জেডা একটু নিয়ম করবো। আমরা আইয়া জেডারে নামাইয়া দিয়া ঘুরুম। ভাবিও যাইব।
আমি ওর পিছু পিছু যাই। ও নিজেই চালাবে? কবে শিখলো গাড়ি চালানো? ওর পাশে আমি বসি। জরিনা রহিম মিয়াঁকে নিয়ে আসে। গাড়িতে বসে। রহিম মিয়াঁর যেন ইচ্ছে নেই তেমন। সজু নেমে গিয়ে সাঁত সাঁত করে দরোজা লাগায়। ছোটে। সবাই নীরব। মাতাবাড়ি। আমি নামলাম না। সজুও না। জরিনা গপিস্টকে নিয়ে নামে। ওই তো মূল ফটক। রাস্তা থেকে দূরে, উঁচুতে। দেখা যায়। গপিস্ট শিরদাঁড়া সোজা করে মিনিটখানেক দাঁড়ালেন। আবার বসলেন এসে গাড়িতে। আবার সজু সাঁত করে দরোজা লাগায়। ছোটে। বাড়ি এসেই রহিমকে নিজে গিয়ে নামিয়ে দিতে যায়জরিনা নামে না। আমিও না। চুপ। কোথায় ঘোরাতে নিয়ে যাবে সজু আমাদের? ভাবিকে জিগ্যেস করি,
-   কই যাইবো?
-   জানিনা
-   তই?
-   তই কিছু না, নাটক, বইয়া থাকেন, দেখেন
সজু আসে। বসে। গাড়ি স্টার্ট করে। ছোটেঅমরপুরের রাস্তা ধরে। কী স্পিড! যেনো কে পালিয়ে যাচ্ছে।
-   সদাভাই
-   কও
-   আমনে হুনছেন সুইজ্য যহন অস্ত যায় তখন ক্যামনে পাখি ছাড়া বাকিরা চুপ করে?
-   পাখির ডাক শুনি
-   হেইডা তো হগলে শুনে
-   তো?
-   যিডা চুপ অইয়া যায়, হিডা হুনছেন? আই মিন সায়লেন্স?
-   সজু
-   কন
-   তুমি তো একসময় প্রচুর পড়তা। কিতা কিতা লেখতা, ঠিক না?
-   পড়তাম। লেখতাম, কবিতা... ছদ্মনামে... সজল সমুদ্র
-   অহন?
-   অহন মাডি টানি, রড সিমেন্ট ঘাডি
-   তিরখেলা?
-   আছে... ইতান বাদ দেন, এই দেখেন
এর মধ্যেই সে চলে আসে এইখানে। দূরে কালাঝারি পাহাড়। এদিকে তার কোল ছড়ানো। সূর্যাস্ত হয়ে গিয়েছে। উলটো দিকে। সত্যই কেমন একটা নীরবতা ছড়িয়ে আছে, শব্দের মতন।
-   লামেন
জরিনা নেমে আসে। আমরা তিনজন। ওই দূরে একটা অজানা নীলে চোবানো পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছি। একটুক্ষণ। যেনো বহুদূর থেকে কেউ মন্ত্র পড়ছে, এমন ভাবে কথা বলে সজু, ‘আমি খারাপ। মা সুইসাইড। বাবা পাগল পাগল। ভাই কই জানি। বইনডা সার্কাসের পোলার লগে গেলো গা। অহন শিলচরে বেশ্যা। এইসবের লিগ্যা না। আমি এমনেই খারাপ। আমনেরে বালাপাইছি। কাছে যাইতাম চাই। আমনে ফিট অইয়া যান। আমনের লিগ্যা মাচ্ছারে মারছি। মাইরা লাইছি। আমারে মাপ করেন।
-   কি কও সজু, চুপ করো
-   আমনের লগে কেডা কতা কয়? আমনে চুপ থাকেন সদাভাই
     ধীরে গাড়িতে গিয়ে উঠে পড়ে জরিনা। পিছু পিছু আমিও যাই। বসি সজুর সঙ্গের সিটে। সামনে। ও আসে না। দাঁড়িয়ে আছে এখনও। একটা আঁধার তার পায়ের থেকে ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠছে। যেন এই সময়টা শেষ হবে না। আমি নেমে গিয়ে ওকে নিয়ে আসবো? দরোজা খুলতেই ও ফিরে আসে।
     অবিশ্বাস্য স্পিডে সজু আমাদের উদয়পুর নিয়ে আসে। এই পাড়াটা আমার তেমন চেনা নেইঅনেক গলি। কোথা কোথা দিয়ে সে একটা বাড়িতে এনে সোজা উঠানে চলে আসে। বাড়িটা পুরনো। সজু নামে। কেন কে জানে, নিজেই দরোজা খুলে নেমে পড়ে জরিনা। বাড়িটার দিকে তাকায়, ইতিউতি দেখে।
-   আমার। পুরান বাড়ি কিনলাম
-   সব বাড়িই পুরান
-   চলেন
বলেই ঘরে যায় সজু। জরিনাও। পিছু পিছু গিয়ে ঘরে ঢুকে আমি অবাক। এত বড় ঘর? একটা বিশাল টেবিল। তার ওপর একটা সত্যকার ঝাড়বাতি। জ্বলছে। টেবিলটাকে ঘিরে সিনেমার চেয়ারের মতন চেয়ার পাতাসজু একটাকে একটু সরিয়ে জরিনাকে বসতে দেয়। জরিনা বসে। সজু আমাকে হাতে ইঙ্গিত করে বসতে। বসি। একটা বড় গেলাস আর দামি হুইস্কি নিয়ে আসে। সঙ্গে একটা সাদা কৌটো। একটাই জিনিস কেমন লাগছে, সারা মেঝেতে কী জানি বড়ির খালি র‍্যপার ছড়িয়ে  আছে। সদা মদ ঢালে। জরিনা কেমন বিবশ।
-   আমি যামু
-   যাইবেন
-   শইল খারাপ লাগে। আমনে ইতান কইরেন না
‘থাক না সজু’। বলে সারিনি, ‘এই কু-র বাচ্চা। চুপ মাইরা ব, দেখ কিতা করি’ জরিনা কেমন ফুঁপিয়ে ওঠে, ‘না, আমার কিছু করনের নাই সজু, তুমি বালা মানুষ, আমার মানুষের লগে অয় না... বন্ধ করো, সদাভাই আমনে কন না’
-   সজু, জানোই তো ভাবি পারে না মদ সইজ্য করতে...
-   চুপ
     সজু মদ ঢালে। অনেকটা। সাদা কৌটা থেকে অনেকগুলো বড়ি ঢেলে দেয় তাতে, ‘আমি জানি, আমি খারাপ। আমার আর ভাল্লাগে না কিছু। সদাভাই, আমি ওই জমিবাড়ি চাইছিলাম, ভাবিরে চাইছিলাম। দুইডা মিশ খায় না। আমিই মিশ খাই না। ইডি ঘুমের ট্যাবলেট। দেড়শোডা... আমারে মাপ কইরেন... টুক করে গিলে ফেলে সে এই বড়ি মেশানো মদ। নিট। চোখমুখ কেমন করে ওটাকে সহ্য করে নেয় একটু। কাঁদছে?  কেমন একটা মদ যেনো, পুরনো আতরের মত গন্ধ। ও গিলতেই বেরিয়ে যায় জরিনাভাবি। বিদ্যুৎ। আমি চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই দেখি ছুটছে...

-   কী বুঝলেন?
-   নন্দদা
-   কন
-   আমনে চুপ কইরা থাকেন তো অনেকক্ষণ। চুপ করেন।