রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৭

সদাপুরাণ-২১



অশোক দেব
সদাপুরাণ-২১


পরচুলা শুকোতে দিয়েছে জহিরুল। ঘোড়া মরে গেলে সে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। এখন আসে। টুপি পরে। টুপির ফাঁকে কাওয়ালদের মতন চুল বেরিয়ে থাকে কানের পাশে। এখন টুপি নেই, সেই চুলও নেই। টাক দেখা যায়। ও এখন সকল ছেড়ে আতরের ব্যবসা ধরেছে। একটা ছোট বাক্স। তাতে নানা রকম খাঁজ। সে খাঁজে খাঁজে কত আকারের যে শিশি। লাল শালুতে পেঁচিয়ে সে বাক্স কাঁধে ঝুলিয়ে সারাদিন ফেরি করে জহিরুলমেলায় মেলায় যায়। নানারকম আতরের গন্ধ মিশে গিয়ে একটা কেমন নেশা নেশা সুগন্ধ হয়। সেটা তার পিছু পিছু ফেরে। একটু অশক্ত হয়েছে। চোখও আর তত উজ্জ্বল নেই কেমন উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে। এখন স্নান করে এলো। চকচক করছে টাক। যদি ডাক পায় খাবে। আজকাল আর তত রান্না হয় না এ বাড়িতে।
     আজ অমাবস্যা। ভাদ্রমাস। এ কারণেই এসেছে জহিরুল। গপিস্ট বুড়ার সারা বছরের রুটিন তার জানা। আজ বিশেষ পূজা হয় ত্রিপুরাসুন্দরী মায়ের
রাজার লেঠেল গপিস্ট বুড়ার বংশ। আজকের দিনে মায়ের দারোয়ান হতেন তিনিদাতারামে একটা জোলাইবাড়ি আছে। এখানে জোলাইরা থাকতো। রাজ আমলে মায়ের পূজায় মশাল ধরা তাদের কাজসুবল দাস। গপিস্টের থেকে বয়সে বড়। সেই বুড়াও একটা ছোট মশাল নিয়ে আসতো। এই দিনে এসে মা-কে দেখিয়ে যেতো। গপিস্ট গিয়ে প্রধান ফটকে একটা লাঠি নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। নিয়মরক্ষা করে চলে আসেন। জহিরুল এটার সুযোগ নিতে আসে। অযথা ঘোড়াটোড়া আনে। হইহই লাগায়। গপিস্টকে সে সাজায় যাত্রার পোশাকে। কোথা হতে একটা বেতের শক্ত লাঠিও আনে লম্বা। এই করে বেশ টাকা নিয়ে নেয়। এবার তার ঘোড়া নেই। তবু আসে। কিন্তু ওই জোলাই সুবল মারা যাবার পরে গপিস্টও যান না নিয়মরক্ষা করতে। জহিরুল আসে।  এখন চান সেরে এসেছে। গপিস্টের ঘরে যায় সে।
-   জেডা
-   কন
-   যাইবেন?
-   মার বাড়ি?
-   হুম
-   না
-   আর পারি না
-   বুজি
-   আমনে থাকেন কই?
-   ঘুরি, আতর বেচি
-   কেমন ব্যবসা, চলেনি?
-   জেডা আমনে একটা কাম কইরা দেন না আমারে, দিবেন?
-   কন
-   একটা ফতোয়া দেন
-   কেমন?
-   আতর তো চলে না। আইজকাইল বোতলের সেন্টও চলে না। কিতা বইলে ডিওরেন্ট বাইর অইছে। টিপ দিলে বাইর হয়। ছুত কইরা গ্যাসের মতন ইতান কি মোছলমানের গায়ে দেওন হালাল? মোছলমান দিবো আতর
-   আমনে ভাত খান। বিশ্রাম করেন। যান গা। আর আইবেন না।
জহিরুল বেরিয়ে যায়। আতরের বাক্সটা নেবার সময় অযথা শব্দ করে। জরিনা একটু সাধলে খেয়ে যাবে। কেউ কোথাও নেই।

     আজও অমাবস্যা। ভাদ্রমাস। কেমন একটা রাক্ষুসে রোদ উঠেছে। সদার কাচের ঘর। দূরে মেঘের ছায়া এসে কাচের গায়ে ছায়া পড়েছে। আকাশে সে মেঘ হাঁটে, এই কাচেও। আজ এখানে আসতেই হবে। নন্দ দারোগা বারবার করে বলে দিলেন। আজকে নাকি কী এক অদ্ভুত জিনিস দেখাবেন। আমাকে এইটুকু লেখা দিয়ে চলে গেলেন কোথায়। এটুকু পড়লাম। ঠিকই জহিরুল আতর বেচতে আসতো তখন। তার নাম যে জহিরুল আমরা জানতাম না। ওকে জালালি বলেই ডাকতো সবাই। ঘোড়া আনতো ঠিকই। সেটা একটা এক্কার সঙ্গে জুড়ে জয়রাইডও করাতো মায়ের বাড়িতে। কিন্তু গপিস্ট তাকে একদিন বাড়ি থেকে বের করে দিলেন, সে আমরা কী করে জানবো? হঠাৎ করেই তাকে দেখা যেতো না, এটাও ঠিক। কিন্তু এটুকু লেখা পড়ে আমি কী করব? নন্দদার একটা কাশি আছে। কাশি নয়, মুদ্রাদোষ। সেটা শুনতে পেলাম সিঁড়িতে।
-   পড়ছেন?
-   হ, ইডা তো এট্টুখানি লেখা
-   আছে আছে বাকিডাও আছেইডা তো স্টার্টার
-   মেইন কোর্স দেন, পড়ি
-   শুনেন, সজুরে মনে আছে?
-   হুম, মদ আর ফেন্সিডিল, তির খেলা, রড সিমেন্ট... প্রচুর টাকা করছিল। আৎকা মইরা গেল।
-   একজাক্টলি, ক্যামনে মরল?
-   সিরোসিস হইছলো, না? ঘরের মিধ্যে মইরা পইড়া আছিল
-   ইয়েস, ইয়েস... নেন পড়েন
     এইটাও লাল কাপড়ে বাঁধানো খাতা নয়। ডায়েরিও না। ফাইল। এগুলো থাকে ওই আলমারিতে, যেখানে ওই গয়নাগুলি ছিল। দলিল লেখার কাগজ এগুলো। শেমি। সেই সুন্দর শীতল হাতের লেখা সদানন্দেরঃ
সজু একটা মারুতি ভ্যান কিনেছে। সেটা নিয়েই সে এলো। আজ অমাবস্যা। ভাদ্রমাস। গপিস্টকে সে জোর করে। বারবার বলে ভ্যানে করে মাতাবাড়ি যেতে। দারোয়ানগিরি করতে। কী করে যে রাজিও করে ফেলে। জরিনাও রাজি হয়। জগতে আমার কোনও কাজ নেই। গপিস্টের কাঁচামিঠে গাছের নীচে বসে পড়ছিলাম। সজু আসে।
-   চলেন
-   কই যামু?
-   মার বাড়িত যামু। জেডা একটু নিয়ম করবো। আমরা আইয়া জেডারে নামাইয়া দিয়া ঘুরুম। ভাবিও যাইব।
আমি ওর পিছু পিছু যাই। ও নিজেই চালাবে? কবে শিখলো গাড়ি চালানো? ওর পাশে আমি বসি। জরিনা রহিম মিয়াঁকে নিয়ে আসে। গাড়িতে বসে। রহিম মিয়াঁর যেন ইচ্ছে নেই তেমন। সজু নেমে গিয়ে সাঁত সাঁত করে দরোজা লাগায়। ছোটে। সবাই নীরব। মাতাবাড়ি। আমি নামলাম না। সজুও না। জরিনা গপিস্টকে নিয়ে নামে। ওই তো মূল ফটক। রাস্তা থেকে দূরে, উঁচুতে। দেখা যায়। গপিস্ট শিরদাঁড়া সোজা করে মিনিটখানেক দাঁড়ালেন। আবার বসলেন এসে গাড়িতে। আবার সজু সাঁত করে দরোজা লাগায়। ছোটে। বাড়ি এসেই রহিমকে নিজে গিয়ে নামিয়ে দিতে যায়জরিনা নামে না। আমিও না। চুপ। কোথায় ঘোরাতে নিয়ে যাবে সজু আমাদের? ভাবিকে জিগ্যেস করি,
-   কই যাইবো?
-   জানিনা
-   তই?
-   তই কিছু না, নাটক, বইয়া থাকেন, দেখেন
সজু আসে। বসে। গাড়ি স্টার্ট করে। ছোটেঅমরপুরের রাস্তা ধরে। কী স্পিড! যেনো কে পালিয়ে যাচ্ছে।
-   সদাভাই
-   কও
-   আমনে হুনছেন সুইজ্য যহন অস্ত যায় তখন ক্যামনে পাখি ছাড়া বাকিরা চুপ করে?
-   পাখির ডাক শুনি
-   হেইডা তো হগলে শুনে
-   তো?
-   যিডা চুপ অইয়া যায়, হিডা হুনছেন? আই মিন সায়লেন্স?
-   সজু
-   কন
-   তুমি তো একসময় প্রচুর পড়তা। কিতা কিতা লেখতা, ঠিক না?
-   পড়তাম। লেখতাম, কবিতা... ছদ্মনামে... সজল সমুদ্র
-   অহন?
-   অহন মাডি টানি, রড সিমেন্ট ঘাডি
-   তিরখেলা?
-   আছে... ইতান বাদ দেন, এই দেখেন
এর মধ্যেই সে চলে আসে এইখানে। দূরে কালাঝারি পাহাড়। এদিকে তার কোল ছড়ানো। সূর্যাস্ত হয়ে গিয়েছে। উলটো দিকে। সত্যই কেমন একটা নীরবতা ছড়িয়ে আছে, শব্দের মতন।
-   লামেন
জরিনা নেমে আসে। আমরা তিনজন। ওই দূরে একটা অজানা নীলে চোবানো পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছি। একটুক্ষণ। যেনো বহুদূর থেকে কেউ মন্ত্র পড়ছে, এমন ভাবে কথা বলে সজু, ‘আমি খারাপ। মা সুইসাইড। বাবা পাগল পাগল। ভাই কই জানি। বইনডা সার্কাসের পোলার লগে গেলো গা। অহন শিলচরে বেশ্যা। এইসবের লিগ্যা না। আমি এমনেই খারাপ। আমনেরে বালাপাইছি। কাছে যাইতাম চাই। আমনে ফিট অইয়া যান। আমনের লিগ্যা মাচ্ছারে মারছি। মাইরা লাইছি। আমারে মাপ করেন।
-   কি কও সজু, চুপ করো
-   আমনের লগে কেডা কতা কয়? আমনে চুপ থাকেন সদাভাই
     ধীরে গাড়িতে গিয়ে উঠে পড়ে জরিনা। পিছু পিছু আমিও যাই। বসি সজুর সঙ্গের সিটে। সামনে। ও আসে না। দাঁড়িয়ে আছে এখনও। একটা আঁধার তার পায়ের থেকে ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠছে। যেন এই সময়টা শেষ হবে না। আমি নেমে গিয়ে ওকে নিয়ে আসবো? দরোজা খুলতেই ও ফিরে আসে।
     অবিশ্বাস্য স্পিডে সজু আমাদের উদয়পুর নিয়ে আসে। এই পাড়াটা আমার তেমন চেনা নেইঅনেক গলি। কোথা কোথা দিয়ে সে একটা বাড়িতে এনে সোজা উঠানে চলে আসে। বাড়িটা পুরনো। সজু নামে। কেন কে জানে, নিজেই দরোজা খুলে নেমে পড়ে জরিনা। বাড়িটার দিকে তাকায়, ইতিউতি দেখে।
-   আমার। পুরান বাড়ি কিনলাম
-   সব বাড়িই পুরান
-   চলেন
বলেই ঘরে যায় সজু। জরিনাও। পিছু পিছু গিয়ে ঘরে ঢুকে আমি অবাক। এত বড় ঘর? একটা বিশাল টেবিল। তার ওপর একটা সত্যকার ঝাড়বাতি। জ্বলছে। টেবিলটাকে ঘিরে সিনেমার চেয়ারের মতন চেয়ার পাতাসজু একটাকে একটু সরিয়ে জরিনাকে বসতে দেয়। জরিনা বসে। সজু আমাকে হাতে ইঙ্গিত করে বসতে। বসি। একটা বড় গেলাস আর দামি হুইস্কি নিয়ে আসে। সঙ্গে একটা সাদা কৌটো। একটাই জিনিস কেমন লাগছে, সারা মেঝেতে কী জানি বড়ির খালি র‍্যপার ছড়িয়ে  আছে। সদা মদ ঢালে। জরিনা কেমন বিবশ।
-   আমি যামু
-   যাইবেন
-   শইল খারাপ লাগে। আমনে ইতান কইরেন না
‘থাক না সজু’। বলে সারিনি, ‘এই কু-র বাচ্চা। চুপ মাইরা ব, দেখ কিতা করি’ জরিনা কেমন ফুঁপিয়ে ওঠে, ‘না, আমার কিছু করনের নাই সজু, তুমি বালা মানুষ, আমার মানুষের লগে অয় না... বন্ধ করো, সদাভাই আমনে কন না’
-   সজু, জানোই তো ভাবি পারে না মদ সইজ্য করতে...
-   চুপ
     সজু মদ ঢালে। অনেকটা। সাদা কৌটা থেকে অনেকগুলো বড়ি ঢেলে দেয় তাতে, ‘আমি জানি, আমি খারাপ। আমার আর ভাল্লাগে না কিছু। সদাভাই, আমি ওই জমিবাড়ি চাইছিলাম, ভাবিরে চাইছিলাম। দুইডা মিশ খায় না। আমিই মিশ খাই না। ইডি ঘুমের ট্যাবলেট। দেড়শোডা... আমারে মাপ কইরেন... টুক করে গিলে ফেলে সে এই বড়ি মেশানো মদ। নিট। চোখমুখ কেমন করে ওটাকে সহ্য করে নেয় একটু। কাঁদছে?  কেমন একটা মদ যেনো, পুরনো আতরের মত গন্ধ। ও গিলতেই বেরিয়ে যায় জরিনাভাবি। বিদ্যুৎ। আমি চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই দেখি ছুটছে...

-   কী বুঝলেন?
-   নন্দদা
-   কন
-   আমনে চুপ কইরা থাকেন তো অনেকক্ষণ। চুপ করেন।


রবিবার, ৯ জুলাই, ২০১৭

সদাপুরাণ -২০

অশোক দেব
সদাপুরাণ-২০

‘কে বলে শারদ শশী সে মুখের তুলা
পদনখে পড়ি তার আছে কতগুলা
কি ছার মিছার কাম ধনুরাগে ফুলে
ভুরুর সমান কোথা ভুরুভঙ্গে ভুলে
কাড়ি নিলো মৃগমদ নয়নহিল্লোলে
কাঁদে রে কলঙ্কী চাঁদ মৃগ লয়ে কোলে’

     উঠানে দাঁড়িয়েই এই শুরু করে মানিক শীল। রবিবার সকালে চুল কাটার চেয়ার আপনি বসে যায় কামরাঙ্গা গাছের নীচে। মানিক শীল তার ছোট বাক্স নিয়ে হাজির হয়। এসেই জরিনার ঘরের সামনে টেনে টেনে সুর করে এইসব শোল্লক বলে। জরিনা বেরিয়ে এসে এই প্রৌঢ়ের দিকে তাকায়। হাসে। কিছু কিছু মানুষ দারিদ্র্যকে সাজাতে জানে। যা আছে, তাকেই। মানিক শীল তেমনি। পরিমিত নীল দিয়ে সাদা ধূতিকে উজ্জ্বল করা হয়েছে। একটা হাতাকাটা পাঞ্জাবি, ঘিয়ে রঙের। সেটাও বেশ স্পষ্ট করে পরা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে জরিনা। মানিক শীলের একটা দোলন আছে। হাল্কা। দুলে দুলে বলে ওইসব কবিতা। জরিনা এক সময় ঠাস করে একটা সাবানের কেস রাখে। তাতে সুগন্ধি সাবান। চুল কাটার আগে সে দিয়ে হাত ধুয়ে আসতে হবে। রহিম মিয়াঁর নির্দেশ। ‘মানিক্যার সব বালা, হাতের গন্ধ বালা না’। সাবানটা রেখে ঘরে ফিরে যায় জরিনা। তাতেই মানিক শীল যোগ করেঃ
‘মেদিনী হইল মাটি নিতম্ব দেখিয়া
অদ্যাপী কাঁপিয়া উঠে থাকিয়া থাকিয়া
করিকর রামরম্ভা দেখি তার উরু
সুবলনি শিখিবারে মানিলেন গুরু’

     রহিম মিয়াঁ চেয়ারে বসে তাকে ডাকেন। অন্যদিন চুল কাটার সময় ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। আজ ঘুম নেই। ওই রাস্তায় একটা লরি যায়। বারবার। সেটাতে মাটি টানা হচ্ছে। আজকাল দুমদাম পুকুর ভরিয়ে ফেলছে মানুষ। নিচু জমিও। টপাটপ বাড়ি উঠে যাচ্ছে। পাকা। কারা যেন কোথা হতে সব আসে। ‘এত সিমেন্ট পায় ক্যামনে?’
- সদা মিয়াঁ

     আমাকে ডাকেন গপিস্ট রহিম। আমিও চুল কাটানোর জন্য চলে আসি এবাড়ি। দোকানে যেতে হয় না। কু-কু শোনারও ঝামেলা নেই। হাতে করে একটা বই নিয়ে আসো। পড়তে থাকো। বাকিদের কাটা শেষ হলে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ি। মানিক শীলেরও লাভ তাতে। খুশিও হয়। আচমকা রহিম মিয়াঁর ডাক শুনে কাছে যাই।
- কন
- এত সিমেন্ট পায় কই?
- ক্যান বাজারে?
- বাজারে সিমেন্ট পাওয়া যায়? রডও?
- হ্যাঁ, গৌতইম্যাও তো রড সিমেন্টের দোকান দিল
- তাইলে আগের মতন ফুড অফিসে দরখাস্ত দেওন লাগে না?
- না না, হেইদিন গেছে গা, অহন ওপেন মার্কেট
- হিডা কিতা?
- লাইসেন্স মাইসেন্স নাই... বাজারে সব খোলা...
- এই যে পুস্কনি সব ভইরা যাইতাছে... জমি... অত টেকা কই থিকা...
- কিতা কমু কন...
- হুম

     এইবার মনে হয় ঘুমিয়ে পড়লেন। নীরব হয়ে গেলে সরে এলাম। ওইদিকে লালুমজিদ সেই বাঁশি বাজানোর চেষ্টা করছিল। হয় না। লরিটা ঠিকই বিচ্ছিরি শব্দ করে আসে। যাবার সময় শব্দ কম। আসার সময় মাটির ভারে গোঙায় বেশি। তখন মজিদ চুপ থাকে। লরির শব্দ না থাকলে বাজায়, কেন যে সেটা হয় না।
- মজিদ ভাই
- কন
- ইডা মনেলয় অইতো না...  এই বাঁশি বাজানডা...
- মালুম হ্যায়
- তাইলে... ক্যান?
- সদাভাই... সবচে কঠিন কিতা কন তো?
- কী?
মা
- মানে?
- ও মা স্বরটা লাগে না আমার... লাগেই না... আইচ্ছা, মা হইতে কেমন লাগবো কন তো
- বুঝলাম না
- এই যে পোলাপানে মা কইয়া ডাক দেয়, তখন মাইয়ালোকের কী হয়? বুকের মিধ্যে কিতা হয়? হিডা ঠাহর করতাম পারি না। কত রকমের মা-ডাক আছে...
- কেমন?
-ক্ষুধা লাগলে একরকম, দুঃখ পাইলে একরকম, পইড়া গিয়া ছইরা গেলে একরকম, মা-র উপরে রাইগ্যা গেলেও মা-ডাক একরকম...
- স্ট্রেঞ্জ
- এইসব মা-ডাক যে বাজাইতে জানে না, হে কী বাজাইবো
মজিদ ভাইয়ের কাছে এলে মনখারাপ হয়ে যায়। কী কী যে ভাবে বসে বসে। টুক করে জরিনা আসে বারান্দায়, হাতছানি দিয়ে ডাকে। আবার ঘরে ঢুকে যায়।যাই।
- আমার ছানের পুস্কনি লাগতো না
- কী কন?
- না, আমি আর জলে নাইম্যা ছান করি না। এই জীবনে আর করতাম না। ঠাহুররে কন হিডা ভইরা লাইতো... গাড়ির মাডি দিয়া...
- আমি?
- আমনেই কন, ওই গপিস্ট ঠাহুর আমনের কতা হুনবো... আজগাই কইবেন... এক্ষণ কইবেন, যান...
   বিপদে ফেলে দেয় ভাবি। পুকুর ভরিয়ে ফেলার কথা বললে গপিস্ট আমাকে এ বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিতে পারে। আবার না বললে, জরিনা বন্ধ করে দেবে। যা হবার হবে, আমি যাই গপিস্টের কাছে। তখনও কাঁচির ওই শব্দটা হয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে চিরুনিতে বাড়ি দিয়েও একটা শব্দ করে মানিক শীল। ভেবেছি রহিম ঘুমিয়ে পড়েছেন কাছে যেতে বুঝলাম কথা বলছেন ধীরে ধীরে।
- মানিক
- কন
- তুই যে শোল্লক কস, ইডি কার লেখা জানস?
- আরে না না... আমি হুইন্যা হুইন্যা শিখছি... কার থিকা হুনছি হিডাই ভুইলা গেছি
- ইডার নাম বিদ্যাসুন্দর। লেখছেন ভারতকবি।
- ও
- রাজারা এই জিনিস পড়ন বন্ধ কইরা দিছিলো। এদিকে  অবইশ্য বেশি একটা পড়া অইতো না। আগত্তলার মাইনসে পড়তো। সইন্দাবেলা হারিকেন জ্বালাইয়া... রাজার মানুষ ঘুরত লাডি লইয়া...
- কন কী?
- হুম, পোলাপানের মাতা খারাপ করতো ইডা। মাইয়ালোকের করতো বেশি। যত ঘেঁষাঘেঁষি আর ডলাডলির কতা... ইতান পইড়া উচ্ছন্নে যাওনের যোগাড়...
- তই
- তই আর কি... রাজার মাইনসে বই পাইলে পুইরা লাইতো আগুন দিয়া...
- আমনে পড়ছেন?
- ‘কিবা রূপ কিবা গুণ কহিলেন ভাট
খুলিল মনের দ্বার না লাগে কপাট
প্রাণধন বিদ্যালাভ ব্যাপারের তরে
খেয়াব তনুর তরী প্রবাস সাগরে.
যদি কালী কূল দেন কূলে আগমন
মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’
- আরে? আমনে তো বাক্কা

     আজ আর ওসব বলে লাভ নেই। কোথা হতে সরাইল্যা লালু এলো। লালুমজিদ যেনো কোথায়। কুকুরটা তার নিজের জায়গায় বসে। দূরে কাদের বাড়িতে বেজে ওঠে কাঁসর, উলুধ্বনি... সরাইল্যা তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে শব্দ করে। ওপরের দিকে মুখ করে সে ডাকে। দূর হতে জরিনা আমাকে দেখছিল।রহিমকে আসল কথা না বলে ফিরে আসছি দেখে আবার হাতছানি দেয়। একটু হাসেও। দ্রুত নাড়ায় হাত। বুঝলাম তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ঘরে ঢুকতেই দেখি সেই আরামচেয়ারটা। এটা জানালার কাছে। এখানে বসে জরিনা আলো খায়। সেই চেয়ারে বসে আছে মিট্টি। অবাক কাণ্ড! কেমন একটা ভাব, যেনো তাকে কেউ বেঁধে রেখেছে। ঘরে একটা গন্ধ। নতুন। মিট্টির পায়ের সামনে বসে আছে মজিদভাই। জরিনার ভাব দেখে বুঝলাম বসানো হয়েছে। ঘটনা বোঝা যাচ্ছে না কিছু। বিকৃত শব্দ করে মাটির লরি যাচ্ছে পাশের রাস্তায়। পথের সে ধুলা যেনো সর্বত্র ছড়ানো।
- ‘বাজান’, জরিনা আদেশ করে...
মজিদভাই একটা মোটা বাঁশিকে ঠিকঠাক করে ঠোঁটের কাছে ধরে। বাজায় না।
-   বাজান
এবার বাজে বাঁশি। সত্যিই যেনো কেউ করুণ করে মা ডাকছে...
-   আরেকটা বাজান
এবার ঢেউ তুলে তুলে মজিদ এসে সেই মা-তে স্থির হয়...
-   ইয়ে সব কা হো রাহা হায়?
মিট্টি প্রশ্ন করতেই জরিনা তার বুক আর পেটের মাঝখানে পা রাখে
- বাইদ্যানি... তুই ফিরা ফিরা আইয়স কেরে? কেরে?
- হাজারবার আয়ুঙ্গি
বলেই ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়ায়। টাল রাখতে পারে না জরিনাভাবি। ছিটকে বিছানায় পড়ে যায়। মিট্টি দুমদাম করে বেরিয়ে যেতে গিয়ে কেড়ে নিতে চায় মজিদের বাঁশি। লালুমজিদ বাঁশি ছাড়ে না। একটু চেষ্টা করে সেটা ছাড়াই বেরিয়ে যায় মিট্টি।
- কী বিষয়?আমি জানতে চাই।
- তাই খালি ঘুরঘুর করে... অহন মাডির গাড়ির লেবার হইছে... কাম তো ছাতাও করে না... তাইনের বাঁশির সামনে আইয়া বইয়া থাহে... কানতো চায়...
- তো আমনের কী?
এই কথা বলে উঠে বেরিয়ে যেতে চায় মজিদভাই।‘আমনের কিতা যায়?’
-   সব যায়, শালারপুত... সব যায়... সব যায়...
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। কী করবো? মিট্টি চলে গিয়েছিল। আবার ফিরে এসেছে। সোজা চলে আসে ঘরের সামনে। চিৎকার করে...
-   তু মরেগি... পাগল হো যায়েগি... পেটকে আন্দার বাল উগে গা...
     এই প্রথম কেমন যেনো উদাস হয়ে গেলো জরিনার দৃষ্টি। একটু তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই সেই পুরনো জরিনা। মজিদভাইয়ের বাঁশিটা সে মাটিতে ফেলে। পা দিয়ে আঘাত করে জোরে। বাঁশিটা প্রথমে ফাটে, পরে ভেঙে চেপ্টা চেপ্টা হয়। জরিনা পাগলের মত পা চালাতে থাকে। সে শোনে না, কিছু শোনে না। প্রতিটি আঘাতে বাঁশিটার থেকে একটা শব্দ বেরোচ্ছিল। আমি স্পষ্ট শুনলাম, মা মা মা