মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০১৭



অশোক দেব
সদাপুরাণ – ১৫
বেজে চলেছে গায়ত্রী। নন্দদার ফোন। গায়ত্রীমন্ত্র পরানো আছে তাতে। ফোন করলেই বাজে।  একটানা, বারবার। কিরিং করে থামে, তারপর আবার শুরু। শুনতে থাকি। একসময় ধরলেন, ‘কন’। ‘নন্দদা, মাচ্ছা স্বপন...’ ফোন যতটা জোর দিতে পারে, তার থেকে জোরে নন্দদা হাসেন।‘জানি, মনে হইছে ঘটনা? বিকালে আইয়েন সদার ঘরে। এই রং রং না, আরও রং আছে।’
     বিকেল হল। একটা ঘুম দুপুর হতে সারা পাড়া ঘুরে বেড়িয়েছে। আমি তার পিছুপিছু হেঁটেছি
সুনীল মজুমদার। এখন কোথায় ছেলের কাছে চলে গিয়েছেন। বাড়ি বিক্রি করে দিলেন। তার এক বাড়ি এখন সাতটা বাড়ি হয়েছে। এই  নতুন মানুষগুলো কেমন! চিনি নাএই বাড়ির সেই গাছগুলো নেই, সেই গন্ধটাও নাসুনীলকাকা একটা আণ্ডারওয়্যার পরে থাকতেন সারাদিন। ধুতির নীচে পরার সুতির হাফ প্যান্ট। সেটা ঢাকতো বটে, প্রকাশ করত তার থেকে বেশি। অসভ্যসেটি পরে তিনি এদিক ওদিক ঘুরতেন। মেয়েদের স্নানের সময়ে পুকুরের ধারে ধারে হাঁটতেন অকারণ শাক তুলতেনশোনা যায় একদিন কে এক নারী বাগে পায় তাকে। মুচড়ে দেয়। সুনীলকাকা অসুস্থ হয়ে যান। সেই থেকে ধুতিকে লুঙ্গির মত পরতেন।
     সরকারদের বাড়ি। একটা ছেলে পাগল।এখন আর ছেলে নেই, প্রৌঢ়। খিদে পেলে টিনের ঘরে লাঠি দিয়ে মারতে থাকে আর পুরনো হিন্দি গান আবৃত্তি করে। খাবার দিলে সে গান সুরেলা হয়ে যায়। শোনা যায় সে প্রেমের পাগল। বিকেলে একা বসে চিৎকার করে, ‘আংরেজি মে কেহেতে হ্যায় কে আই লভ ইউ’। তার সামনে দিয়ে মেয়ে বৌ-রা হাঁটে নাদেখলেই সে ওদের প্রাক্তন, বর্তমান, কিংবা পরকীয়া প্রেমিকের নাম জোরে জোরে বলে।কবে কে কোথায় কার সাথে দেখা করে, মিলন করে, সেসবের ধারাবিবরণী দেয়। পাড়ায় পরকীয়ার অভাব নেই। নানা কিসিম। সবাই এই নিলু পাগলাকে ভয় পায়। জগৎ দেখলে দেখুক, নিলু যাতে না দেখেমেয়েরা নিলুকে ভয় পায় পুরুষ ভয় পায় ততোধিকসকলের সামনে তার বা তার স্ত্রীর বেচাল নিয়ে ঠাস করে বলবে। প্রায় প্রতিদিন নিলুর এখানে ফোলা, ওখানে কাটা। নীল হয়ে থাকে চোখ। কেউ না কেউ মেরেছে। নিলু গা করে না। এখন প্রায় প্রৌঢ়ত্বে এসেও সে আসলে সতেরো বছরের প্রেমিক। নিতান্ত একা হলে, কাছে গিয়ে বসলে ও বলে। একটা ট্রাঙ্কের থেকে এনে পুরাতন প্রেমপত্র পড়ে শোনায়। ছবি দেখায়। সত্যিই সুপুরুষ ছিল সে।
     নন্দদা ফোন করেন,‘কই, আইয়েন। বইয়া রইলাম। আজকে আমনে বেকুব অইয়া যাইবেন’
     আসি। সদানন্দের পড়ার ঘর।খাতা নয়, নন্দদা  একটা ফাইল খুলে কয়েক তাড়া কাগজ বের করে দেন। পড়ি।
     জরিনার স্নানের ঘাট এখানে পুকুর নিজেই ঢেউ তুলতে সাহস করে না। এ ঘাটে কেউ নামে না। এত দুঃসাহস অন্তত এ পাড়ার কারও নেই। এই সন্ধ্যায় সেই ঘাটের জল সাদা হয়ে যাচ্ছেসজু কলসি কলসি দুধ নিয়ে এসেছে। কোমর অব্দি জলে দাঁড়িয়ে মাথায় দুধ ঢেলে চলেছে। পুকুরের জল প্রথমে ঘন সাদা, পরে নীলচে সাদা হচ্ছে। আবার সে আরেক কলসি দুধ নিয়ে মাথায় ঢালে, ‘ইডা আবার কিতা?’ বলেই ফেললাম কথাটা।
  শালারপুত, কালকে রাত্রের কথা ভুইল্যা গেছো? তোমারেও দেখুম আমি। তোমার দিন ঘি দিয়া স্নান করুম।
 
     আর ভালো লাগে না। চলে আসি।কিছুতেই কাঁপটা কমছে না। ভেতর হতে কাঁপে শরীর। থেকে থেকে দামের গভীর হতে উঠে আসা স্বপনের হাতটা মনে পড়েআপ্রাণ হাতছানি দিচ্ছিলো। ঘোরাচ্ছিলো। দামের গভীরে ওকে ঘিরে ধরছিল মৃত্যুআর সে হাত নেড়ে ডাকছিলো ওপরে যারা বেঁচে আছে, তাদের। মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে ওই তার হাত নাড়া। একটু জীবন খরচ করে ওকে টেনে তুলতে বলছিল সে পৃথিবীর মানুষকে? নাকি, কী বলছিল? আমাকে বেঁধে রেখেছে সজু আর ওর মদখোর চ্যালাগুলো। একটা কী গাছ, বয়স কম। তার সঙ্গে এনে আমাকে বেঁধেছে। গাছটা কী যেন করছিল। তাতে সারা শরীর চুলকায়। চিৎকার করছিসজু এসে দমাদম চড় কশাচ্ছেকী জোর ওর হাতে! আমি চিৎকার করছিশিখিনি চিৎকার করতে, তাই সেটা চিৎকার হচ্ছিলো না। গোঙানি হয়ে যাচ্ছিলো। কেউ শুনতেই পেলো না।
     সন্ধ্যায় মাচ্ছা স্বপনকে নিয়ে সজু এলো আমার ঘরে। একটা হান্ড্রেড পাইপারস এনেছেব্রিটিশের দোকান হতে চপ এনেছে শূয়রের মাংস এনেছেঅনেক কাজুবাদাম এনেছে। আর এনেছে একটা ঘোলা রঙের বাংলা মদের বোতল। সে এসে নাগাড়ে গেটের সামনে কু-কু করছিলগেট খুলতেই ঢুকে পড়ে। ‘পার্টি করুম’।
  আমার ঘরে?
  কেরে? ইডা কি সৎসঙ্গ আশ্রম?
  না... মানে...
  হুনো, কুউউউ, তোমার এই ভ্যাবলামার্কা বদনডা পাল্টাও। ইডার ভিতরে তুমি যে কী মাল, আমি জানি। ইডা দেখছ?
সে একটা মাছমার্কা ড্যাগার বের করে। কানকো চাপে, তড়াক করে বেরিয়ে আসে উদ্যত শাণ। আবার গুছিয়ে রাখে।
  ডরান কেরে সদাভাই? ফুর্তি করবো। আমনে বিলাতি আমরা বাংলা... মাচ্ছা স্বপন বলে
  আচ্ছা তোমরা বও, গেটটা লাগাইয়া আই
     গেট বাইরে থেকে কে যেন লাগিয়ে দিয়েছে। কী করি এখন আমি? আজ আমার গান শোনার দিন। রামপ্রসাদ শুনবো। আজ অমাবস্যা। ঘরে এসে আমার আর কিছু করার থাকলো না। কোথা হতে কাটাবাপ্পা, টিংকু,  আর একটা ছেলে এসেছে।  ওর কী যেনো নাম, সবাই লারেলাপ্পা বলে ডাকে। সে-ও এসে বসে গিয়েছে মেঝেতে। এরা কেউ তেমন খাচ্ছে না। মাচ্ছা স্বপন মৃদু হাসছে আর গেলাসের পর গেলাস খেয়ে চলেছে। এক গেলাস খেয়ে নিলেই সজু ওকে দশ টাকা দিচ্ছে। স্বপন সেটা পকেটে পুরেই আরেক গেলাস চোঁ করে গিলে নেয়। হাত পাতে, টাকা নেয়।
     ফোনের কাছে যাই, কাউকে একটা ফোন তো করি। তুলে দেখি নিরেট হয়ে আছে। এরা কী প্ল্যান করেছে? ফিরে আসবো, আমাকে চ্যাংদোলা করে এরা ভ্যানটাতে তোলে। একটা ছেলে হাত দুটো এক করে ধরে রেখেছে। এত পাথর হতে পারে কারও হাত? চিৎকার করি, হয় না। সজু সামনের সিটে, কে যেন গাড়িটা চালাচ্ছিলো। দুদিকে মুখ করা দুটো সিট। লম্বা। আমার সামনে মাচ্ছা স্বপন, প্রায় শোয়া। শুয়ে শুয়েই সে ডান হাতের তর্জনী তুলে তালে তালে নাচাচ্ছে। মনে মনে কী গান গাইছে, এটা তার তালরক্ষাকী হতে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। লহমায় ছনবন দামের কাছে চলে এলো গাড়ি। মেয়েদের স্কুলের পেছন দিয়ে কাদাভরা রাস্তা পেরিয়ে একেবারে উত্তরে। কে যেন ঠেলে দিল।মাটিতে পড়তেই এই দেখি এই তরুণ গাছ। তাতেই বেঁধে ফেলল আমায়। যেন কোনও সিনেমা, যেন একটা ঘটছে না এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। স্বপনকে নামানো হল। ও দাঁড়াতে পারছে না। সজু নাগাড়ে মেরে চলেছে স্বপনকে। কেড়ে নিয়েছে সবগুলো টাকা। স্বপন কেমন একটা করছে, মার থামলেই ও আবার কেমন মার খেতে চাইছে যেন। লালামাখা মুখ তুলে, মৃতপ্রায় দৃষ্টি মেলে সে বলে, ‘আমি জানি কেরে মারতাছো, আমারে পরী-এ মারছে। তুমি কি বাল মারবা?’
     ওকে ওরা চ্যাংদোলা করে নেয়যেন অতিশয় যত্ন। তখনও মাচ্ছা মনেমনে সে গান গাইছিলোডান হাতের তর্জনী নাচিয়ে তাল রেখে যাচ্ছিলো। যেন কোনও দামি তরলএক পাত্র হতে আরেক পাত্রে ঢালা হচ্ছে তাকে। এমনি করে ওরা দামের ওইটুকু ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিল স্বপনের দেহ। আমি চিৎকার করেছি প্রাণপণ। হয় না। সকলে চিৎকার করতে জানে না
  পরীভাবি মারাইবা নাআমি ছুঁইলে ফিট অইয়া যায়? তোমরা অইলে রসকষ সিঙ্গারা বুলুবুল? লালুমজিদ্যার বাড়িত যাইবা, তোমারও এই অইবো... আমাকে স্থির ভাবে এই কথা বলে সজু।
     সকলে সমস্বরে কু কু কু... আমাকে ঘিরে ওরা নাচে। অন্ধকারের যে নিহিত আলো তাতে আমি দেখিদেখি, দামের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে স্বপনের হাতখানি। সে প্রাণপণ হাতছানি দিচ্ছিল। দামের ঘাস ধরে টানছিল। ওসব ঘাস ওকে তিলমাত্র সাহায্য করেনি। একসময় থেমে যায় হাতনাড়া। সজু এসে লাথি মারে আমাকে। একটা লাথি মারে একবার কু করে চিৎকার করে। জীবনে মার খাইনি। মার খাওয়া এমন? একসময় হয়তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছি। কতক্ষণ চলে গেলো? দেখি আমার বাঁধন খোলা। মাটিতে পড়ে আছি। স্বপনের হাতটা দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার এসে লেপে দিয়েছে সব। পেচ্ছাপ পেলো। ছুটে বাড়ি চলে আসি। কেউ কি আমায় দেখেছে?
     গেট খোলা হাট করে। ঘরের অবস্থা সঙ্গিন।জল খাই, বসি। কাউকে বলব? কাকে? কিছুই মাথায় আসে না আমার। মজিদভাইকেই বলবো কাল।

     স্বপনের দাহ হল। এখন বিকেল। আর সজু ওই জরিনার ঘাটে দাঁড়িয়ে দুধ ঢেলে চলেছে মাথায়মজিদভাইয়ের চালতা তলায় যাবো, তার আগেই ডাকেন রহিম মিয়াঁ। যাই তাঁর ঘরে
  আমরা পুরান লাইঠ্যল। জানি, বুঝি। চুপ থাকেন, ভুইলা যান
  কী কন?
  যা কই হুনেন
     চলে আসি। এইখানে একটা তেঁতুল গাছ। ওই দূরে চাষ হচ্ছেপাওয়ার টিলারধাতব দাঁত দিয়ে মাটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে একটা প্রায়শুষ্ক মানুষ। একঘেয়ে একটা শব্দ হচ্ছে ওই যন্ত্রলাঙল হতে। দূরে আরও দূরে একটা তারা উঠে এসেছে। পৃথিবীকে সন্ধ্যাকাল শেখানো তার কাজছোট একটা নৌকা গোমতী পেরিয়ে যাচ্ছে। বসি। কী যেন ঘাস এগুলো। ছুঁচলো। লাগে। তবু বসি।
     সামনে একটা লঙ্কাক্ষেত করেছে কে যেনো। বেড়া দিয়েছে। তাতে একটা পাখি। একটা কেমন তালে সে লেজ নাড়ায়। সকলের ভেতরেই গান থাকে। জীবনে বাজে। মৃত্যু নিকটে এলেও বাজে হয়তো। স্বপন কাল রাতে তার তালে তাল রেখেছিলো?
  নন্দদা...
  বলেন, কন
  এইসব সত্য? সদা সাহিত্য কইরা লেখছে না তো?
  তাইলে কি আর আলগা কইরা ফাইলে লুকাইয়া রাখতো?
  ঠিক ঠিক
  মাল খাইবেন?
  না, আমি যাই
চলে আসি। বাড়ি যেতে মন চাইছে না।পশ্চিমে সেই তেঁতুল গাছ। দূরে সন্ধ্যাতারা।

   


অশোক দেব
সদাপুরাণ - ১৪

দিঘির বয়স হয়ে গেলে সে তার জল লুকিয়ে ফেলে। দামের আড়ালে জলের টলটল ঢেকে দেয়। আজকাল কিছু লিখতে পারি না। সদার মতন হয়ে যায় লেখা। সদানন্দ একটা নেশা হয়ে পড়েছে। আজ ছুটি। সদার বাড়িতে যাবার উদ্যোগ নিলেই বউ টের পায়। ‘এই কু-ডার বাড়িত কী পাও তোমরা? সারাডাদিন পইড়া থাকো। সুইসাইড কেইস... ডর লাগে। মদ খাওনের অইন্য জাগা নাই?’ কিছু বলি না।চুপচাপ বেরিয়ে যাই। গোমতীর গায়ে গায়ে কয়েকটা বাড়ি। পেরিয়ে গেলেই সদানন্দের আস্তানা
গেলাম। বন্ধ। ভেতর থেকে গেট লাগানো। বুঝি, ভেতরে নন্দদা। এখন তার সদার ঘর গোছানোর কাজযত্নে সবকিছু ঝকঝক তকতকছিলেন তদন্তকারী পুলিশ অফিসারসদানন্দের মৃত্যুর কারণ খুঁজে বার করবার কথা ছিল তারএখন সেটি নয়, তার ফেলে যাওয়া জীবনের রূপ খুঁজে চলেছেন। আমাকেও নিয়ে জোটালেন এতে এখন আমারও ওই এক নেশা। সদানন্দ।আজ আর  সদাকে পড়া হবে না। শত ডাকলেও নন্দদা গেট খুলবেন না এখনচলে আসি।
     এমন বিকেলে উদয়পুরে ঘুরবে? চলে যাও গোমতীর কাছে। কিংবা শুকসাগরের পাড়ে
নাহয় এইসব দিঘির পায়ে পায়ে ফেরো। আনন্দ আর অতীত এদের ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় চকচক করে। এইসব দিঘি রাজাদের। নদীর ওই পারে আসল রাজধানী। এখন প্রাচীন প্রাসাদের একটুখানি ভূমি ছাড়া আর কিছু নেই। লোকে দখল করে নিয়ে নিয়েছে। সেসবের আবার কাগজপত্রও আছে। বৈধই নাকি সব। মানুষের কাছে প্রাচীন রাজা হোক কি দেবতা, সবাই হেরে যায়। আজকের উদয়পুরের অর্ধেক ভূসম্পত্তির মালিক দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী। রাজা দেবীকে লিখে দিয়েছেন। এখন দেবীর জমিতেও মানুষের একতলা, দোতলা।বাকি উদয়পুরের বেশিটা আসলে জল। দিঘি। রাজারা দেবতার জন্য দিঘি খনন করেছেন কখনও। কখনও রানির বায়না রাখতে। রাজা যায়। রাজা আসে। কিন্তু কখনও এমন যায় যে, আর আসে না। হাজার বছরের পুরনো এই মাদা রঙের শহর আসলে পরিত্যক্ত রাজা পরিত্যাগ করে গিয়েছিলো। সেই পরিত্যাগের মাদা রং আর যায় না। কিছুতেই একে উজ্জ্বল করা যায় নাযত আলোই দাও, উদয়পুর নিজেকে কেমন আলো-আঁধার করে রাখবে।
     এইটা দিঘি নয়। দাম। এটাও হয়তো কোনও রাজার কাটা দিঘি ছিল। ছনবন, মেয়েদের ইশ্‌কুলের পেছনে বিশাল এই দিঘি
কালের অযত্নে নিজেকে দামের আড়ালে ঢেকেছে।  হেঁটে চলে যাও, পারবে। ঘাস লতাপাতা আছে, ছোট ছোট ঝোপও আছে। ভাসন্ত। হাঁটলেই টের পাওয়া যায় টলটল করে। দেবে দেবে যায় ঘাসের জমি। নীচে জল। গভীর। মাঝে মাঝে একটু একটু গর্ত, কালো রঙের জল। সেখানে তাকালে মুখচ্ছবি টলটল করে উঠবে।এইসব ঘাসলতা খাবার জন্য গরু বেঁধে দিয়ে যায় লোকে। কখনও,তার পেছনের সরু একটা পা দামের নরম ভেদ করে নীচে চলে যায়। গরু সেটাকে তুলতে সামনের পায়ে ভর দিয়ে চেষ্টা করে। এবার সামনের পা ডুবে যায়, পেছনের পা উঠে আসে।এ এক খেলা। যে দেখে তার জন্য খেলাগরুটির জন্য প্রাণান্তকর। এখনও ওই একটা গরু কতক্ষণ ধরে সেই চেষ্টা করে চলেছে।আজ কেন যে মৃত এই দিঘির কাছেই এলাম! তার ঢেউ নেই, জল নেই কিন্তু সে আছে।
     রাজাদের সব দিঘিই এমন দাম হয়ে গিয়েছিল।জলের ওপর এমনই টলটলে স্থলজঙ্গল
তার ভিত্তি আসলে গুপ্ত, গভীর জল একদা সরকার দামে ঢাকা দিঘিগুলির লুকনো জল বার করে আনতে উদ্যোগ নিলকোদালি লাগানো হল, মাটি কাটার লোকজন এলো। দেখা গেল, কোদাল চালাতে চালাতে টুক করে ডুবে যায় কোদালি। ডুবে গিয়ে নেই। নেই মানে নেই এই শহরে কিছু নতুন উদ্যোগ করলে রক্ত দিতে হয়। গোমতী বাঁধবে মহারানিতে? একজন মরল।কী জানি কী গোলাগুলি হয়েছিলতার আগে, ধোপাইছড়িতে নেতাজি সুভাষ সেতু বানাবে? তিনজন শ্রমিক একদিনে নাই। এই সেদিন নতুন রেল স্টেশন হল শুকসাগর জলার শুকিয়ে যাওয়া জমির মাঝখানে একজন শ্রমিকের ওপর দিয়ে চলে গেল ট্রেন। সে কি আছে, না মরে গিয়েছে? এ শহরের জন্ম রক্ত ঝরিয়ে। গোপীপ্রসাদ রাজার শ্বশুর। সেনাপ্রধান। জামাতাকে হত্যা করে হলেন রাজা। নিজের নাম রাখলেন উদয়মাণিক্য। এই হল রাজধানী।  তার নাম হয়ে গেল উদয়পুর। সে রক্ত যেন উদয়পুরকে ছাড়ে না আরদামের আড়াল হতে প্রাচীন দিঘিগুলির লুকোনো জল প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা হচ্ছিলোতখনও হচ্ছিলো লোকক্ষয়  তখনও রক্ত। দিঘি টপাটপ গিলে নিচ্ছিল মানুষ। শেষে কোদাল বাদ গেল আনা হল করাত। লম্বা শক্ত বরাক বাঁশ শোয়ানো হল। বাঁশের ওপর কাঠের শক্ত তক্তা পেতে করাত দিয়ে কাটা হল নরম স্থল। বের করে আনা হল দিঘি। অমরসাগর, জগন্নাথ দিঘি।প্রায় সব দিঘিই এমন নতুন জাগানো! কিন্তু এটিকে আর জাগিয়ে তোলা হল নাসে এখনো টলটলে স্থল নিয়ে দাম হয়ে আছে। সে এখনও ভয়ঙ্কর
     উদয়পুরটা আসলে কয়েকটি পরিবারের শহর হয়ে পড়েছিল। ছিল তো মগের মুলুক।  তাদের হাত থেকে নিল ফা-রাজারা। তারাই আবার মাণিক্য হল। রাঙামাটি থেকে উদয়পুর। যুদ্ধ, যুদ্ধ, যুদ্ধ। কিন্তু পরাধীন হয়নি কখনও এ শহর
শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা। দখল করেছিল। ধরে রাখতে পারেনি। উদয়পুর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে। উদয়পুর।শখ করে এক রাজা পুত্রের নামে এর নাম রেখেছিলো রাধাকিশোরপুর। থানা আর পোস্ট অফিস ছাড়া সে নাম কেউ মনে রাখেনি। যেমন এই জায়গাটার নাম  রাজেন্দ্রপল্লী, সেটাও কেউ মনে রাখেনি। রাজেন্দ্র ভট্টাইজ। এদিকটা তাদের। পুকুরের পর পুকুর। ভূমির পর ভূমি। আরও পূর্বদিকের উদয়পুর শ্যাম সাহাদের। পুকুরের পুকুর, ভূমির পর ভূমি। শ্যাম সাহা এমনকি গোমতীর পরিত্যক্ত খাতকেও নিজের নামে করেছে। মাস্তানদেশভাগের সময় মুসলমানদের মেরেপিটে, ভয় দেখিয়ে তাড়িয়েছে। এক ছিল ম্যাজিস্ট্রেট তারক গাঙ্গুলি। তার সাথে শ্যাম সাহার কী সব যোগাযোগ। মুসলমানদের বিরাট পরিবারকে টুকরো করে শ্যামসাহা পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকিয়ে দিতো। একই পরিবারের চার ভাইকে চারদিকে কাউকে ঢাকায় ছেড়ে দিলো, কাউকে হবিগঞ্জে, কাউকে চিটাগাং তো কাউকে নোয়াখালি। এরা একও হতে পারে না। ফিরে এসে জমিজমার দাবিও করতে পারে না। শ্যাম সাহার ছিল দোনলা বন্দুক আর লোক ঠকানোর নেশা। এই করে তার দখলে অনেকটা উদয়পুর গেলো এমনকি আগরতলায়, এমনি সোনামুড়ায়, এমনকি অমরপুরে তার ঠকিয়ে দখল করা বিশাল ভূসম্পদ কিন্তু ভোগ করবে কে? শ্যাম সাহার ছেলেরা কেন কে জানে টপাটপ গলায় দড়ি দেয়। যেটা বেঁচে থাকে পাগল-পাগল হয়। ঝিম ধরানো। তার যদি সন্তান হল, টেঁকে না। হয় জলে ডুবে, নয় গলায় দড়ি।শ্যাম সাহার জগৎ পেরিয়ে এসে ভট্টাইজদের উদয়পুরতারপরে সেনেদেরতার পরে ওই রহিম মিয়াঁ ‘গপিস্টে’র সাম্রাজ্য। শ্যাম সাহার প্রতিপক্ষ ছিল এই ‘গপিস্টে’রা। রাজার লেঠেল। এদের তাড়ানো যায়নি। সদানন্দ এর বাড়িতে অত পড়ে থাকতো কেন?‘মজিদ্যার বৌডার লগে লাইন আছিল’, একদিন স্ত্রী আমাকে এই কথা বলে। কিছু বলি না। কেবল মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘লাইন’
     সেদিন আঁতিপাঁতি করে খুঁজলাম। সদানন্দের কাপড়ে বাঁধানো খাতাগুলি,ছোট ছোট পকেট ডায়েরিগুলি, অন্য সব ডায়েরি। মাচ্ছা স্বপনের কথা আর কোথাও লেখা নেই। মনটা খুঁত খুঁত করছিলো। মাচ্ছা স্বপনকে আমি চিনতাম। তার কী হল? ‘মাচ্ছা স্বপনের কী হইলো নন্দদা?’
   খোজেন খোজেন, পাইবেন
   কই খুজুম?
   ক্যান? আমনে এ পাড়ার না? মনে করেন, মনে করতে চেষ্টা করেন
     আজ সকালেই দুম করে মনে এলো। মনে এলো? নাকি সদানন্দ মনে এসে বসেছে আমার? নাহলে এত জায়গা থাকতে আমাকে এই বিশাল দিঘির মৃতদেহের সামনে কে নিয়ে এলো?
     তখন জরিনার স্নানের পুকুরে বিকেল এলে একটা সার্কাস শুরু হয়ে যায়।প্রায় প্রতিদিন মাছ ধরবার আয়োজন। যে যা ধরতে পারবে সেটি তার। ফ্রি। ‘গপিস্ট বুড়া’ বলেন, ‘মাছ বেইচ্যা টেকা কামানের দিন অহনও আইছে না’। তার ওপর, যেদিন মাছ ধরা নেই, সেদিন সাঁতার শেখা। মাচ্ছা স্বপন শেখাবে কী, নিজে জলের মধ্যে কত কায়দা করতে পারে, সেসব দেখাতেই তার যত আনন্দ
ডুব দিলো তো দিলো, আর ওঠে না। দেখা গেলো দুটো মাছ নিয়ে ওই দূরে ভেসে উঠলো। জরিনাকে তার হাতের তালুতে রেখে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মাঝখানে। সে যে এতক্ষণ জলের নীচে কী করে থাকে! জরিনা ভাসতে ভাসতে হাসে। সে হাসির আঘাতে জলের ঢেউ আর ঢেউ থাকে না। খিলখিল হয়ে যায়জরিনাকে ভাসিয়ে নিয়ে মাঝপুকুরে ছেড়ে দেয় স্বপনএকটু হাবুডুবুর মাঝখানেই আবার তুলে ধরে। ‘এমনেই শিখন লাগে সাতার’, বলেমার খায়। কিন্তু খেলা বন্ধ নেই। দর্শকেরও অভাব নেই। কাঁচামিঠে আমগাছের নীচে ‘গপিস্টে’র পাশে বসে থাকে সজু। দেখেছি তাকে। স্পষ্ট মনে আছে। সদার খাতায় এসব না পড়লে অনেক রহস্য জানা হত না।
     সেদিন বিকেল। ছনবনের এই দাম। দামের ওপর যে স্থল, সে ছদ্ম। তাতে একটি সরু ফাঁক। নীচে গভীর জল। সেই ফাঁক দিয়ে একটি মানুষের বাম হাত। সাদা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। নখে লেগে আছে ঘাস। সেসব আঁকড়ে নীচের লোকটা হয়তো প্রাণপণ উঠে আসতে চাইছিল। পারেনি। পুলিশ এলো, ক্লাবের ছেলেরা এলো। কাঠের তক্তা, বড় বড় বরাক বাঁশ এলো
সেসব বাঁশ আড়াআড়ি রাখা হল দামের তুলতুলে ভূমিতেতার ওপর পাতা হল তক্তা। তাতে দাঁড়িয়ে বহু কায়দা করে তুলে আনা হল স্বপনকে। মাচ্ছা স্বপন।

     স্বপন রাতের আঁধারে কোথায় কোথায় না ঘোরে? কোন্‌ সে জলাভূমি যেখান থেকে সে টুক করে মাছ তুলে আনতে পারে না? আর এই দামের গোপন জলে যে বিশাল বিশাল সব শোল মাছের সাম্রাজ্য, কে না জানে? কে না স্বপনকে বলেছে, ‘দামের সইলমাছ পাইলে দিস’? কে না জানে স্বপনের কেউ নেই কোথা হতে সে এসেছে, রাইয়াবাড়ি না কোন সে গ্রাম থেকে কে জানে একটা বাড়ি তার ছিল বটে। টিনের একচালা একটা ঘর, তাতে বেড়া আছে তারা যে আছে, তাদেরই হাসি পায়। এখন, এই মরে যাওয়া স্বপনকে কে কী করবে? তার দাহ কে করবে? কে দেবে খরচ? রহিম মিয়াঁই সেসব ভার নিলেন। স্বপনকে পুলিশ নিল না, মর্গে নিলো না, তাকে কাটাচেরা করা হল না।
     রহিম মিয়াঁর বাড়ি। বাইরের উঠোনে একটা পুরাতন পাটির ওপর শুয়ে আছে স্বপন। খালি গা। একটা গামছা টাইট করে পরা। তখনও। চোখেমুখে কেমন একটা বিস্ময় তার। যেন ভাবছে, মরেই গেলাম, সত্যি! বাম হাতটা যে ওপরে তোলা সেটাকে নীচে শরীরের সমান্তরালে আনা যাচ্ছে না
একটা কে যেন, হাতটা এনে রেখেছিল শরীরের পাশে।  সেটা আবার বেঁকে যায়। লোক জমে গেছে। নানা তত্ত্ব ছড়াচ্ছে। মাছ মাছ কইরা পোলাডা গেল। ওইদিকে সদানন্দ ছিল? ছিল। মজিদ মিয়াঁ লালুর সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল সে। এখন মনে করতে পারছি। জরিনা? একটা কেমন শ্যাওলা রঙের শাড়িতে এক সময় সে আসে। স্বপনের পাটির যে অংশে স্বপন ছিল না, সেখানে অনেকগুলো টাকা রাখে।দাঁড়ায়। একটু কি ফোঁপাচ্ছিল? স্বপনের বেঁকে যাওয়া হাত বারবার সোজা করছিল যে, সে আসলে সজু। জরিনাকে দেখে কেন কে জানে, ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। লাথি মারে স্বপনের শবে, ‘সব জলে সাতার মারাইতে যাইও না, শালারপুত’।