অশোক দেব
সদাপুরাণ-১১
‘রাজা আছে নেপালদেশে আর আছে আরবে। দুইখানেই আমার যোগাযোগ। পাখি পাডাই। চৈতমণি পাখি’।
সদানন্দের বাড়ি।
ছাত। জায়গাটা সদা মদ্যপানের জন্য গড়েছিলো। নামমাত্র কাচের ঘের। বাকিটা খোলা।
খেলাচ্ছলে ঢুকে যায় বাতাস। বেরিয়ে যায়। গোল টেবিল। আরামচেয়ার। ছোট একটা বার। নানা
রকম মদ। হুইস্কি বেশি। বড় বড় জানালা। নন্দ দারোগা সদার সব যেমন ছিল, তেমনি
রেখেছেন। এখান থেকে দূর দূর দেখা যায়। খাঁ-খাঁ, নাই-নাই
একটা ভাব অনেক দূর অব্দি ছড়িয়ে আছে। তারপর গোমতীর বিস্ময়কর বাঁক। এখান থেকেও তার
দেমাক দেখা যায়। আমার হাতে সদানন্দের সেই খাতা, ‘গপিস্ট বুড়ার কল্পজগৎ’ :
তই, আমি তখন পাইখ্যলি করি। কামকাজ নাই। কাম করনের কাম কী? বাপেরটি খাইবো কেডা? হের থিকা চৈতমণি ধরতে পারলে নেপাল পাডামু, সৌদি পাডামু, রাজাগো লগে ভাব অইব। আমরার রাজা কী আর রাজা, হেরা ইতান বুঝে না। যারা বুঝে বুঝে। লাইগ্যা পড়লাম। ছয়কাডি বানান শিখলাম। ছয়কাডি কিতা বুজোনি?
তই, আমি তখন পাইখ্যলি করি। কামকাজ নাই। কাম করনের কাম কী? বাপেরটি খাইবো কেডা? হের থিকা চৈতমণি ধরতে পারলে নেপাল পাডামু, সৌদি পাডামু, রাজাগো লগে ভাব অইব। আমরার রাজা কী আর রাজা, হেরা ইতান বুঝে না। যারা বুঝে বুঝে। লাইগ্যা পড়লাম। ছয়কাডি বানান শিখলাম। ছয়কাডি কিতা বুজোনি?
—
না, হিডা কিতা কন
— মাইজখানে একটা ছুডু কাডি। শক্ত। মিত্তিংগা বাঁশের। তারে ঘেইরা আরও পাঁচটা। মনে হয় আকাশের একটা তারার চেহারা বুঝি। এইডা হইল ফান্দ। কাডলের আডা, বেলের আডা, চিনি-চুনের আডা লাগাইন্যা থাকে সব কাডির মইধ্যে। মাঝখানে একটা তুরুলা বাইন্দা গাছে নিয়া দিয়া আইও। চৈতমণি আসলে আইলসা পক্ষী। পরিশ্রম করে না। সামনে পড়লে খায়। যেই না ওই তেলতেইল্যা তুরুলা দেইখ্যা খাইতে যায়, আর কী, পাখনা টাখনা আটকাইয়া বেরাতেরা। হেরপরে ছয়কাডি লইয়া ধুপ্পুর কইরা মাডিত।
— মাইজখানে একটা ছুডু কাডি। শক্ত। মিত্তিংগা বাঁশের। তারে ঘেইরা আরও পাঁচটা। মনে হয় আকাশের একটা তারার চেহারা বুঝি। এইডা হইল ফান্দ। কাডলের আডা, বেলের আডা, চিনি-চুনের আডা লাগাইন্যা থাকে সব কাডির মইধ্যে। মাঝখানে একটা তুরুলা বাইন্দা গাছে নিয়া দিয়া আইও। চৈতমণি আসলে আইলসা পক্ষী। পরিশ্রম করে না। সামনে পড়লে খায়। যেই না ওই তেলতেইল্যা তুরুলা দেইখ্যা খাইতে যায়, আর কী, পাখনা টাখনা আটকাইয়া বেরাতেরা। হেরপরে ছয়কাডি লইয়া ধুপ্পুর কইরা মাডিত।
—
আমনে পাইখ্যল
আছিলেন? পক্ষী ধরতেন?
—
হেইডাই কই হুনো
লোভ হল। এখন বুড়াকে ডিস্টার্ব করা যাবে না। শুনতে হবে সবটা।
দিনকতক পরে চৈত্রের মেলা হবে। গকুলপুর বাজারে, বাজারের পাশে মাঠে, মাঠের
পরে মজুমদারের ক্ষেতে মেলা জমে। জালালী জহিরুল কোথা হতে মুরগাবাজ এনেছে কয়েকটা।
এবার নাকি মোরগের ফাইট করাবে। যারা মোরগ লড়ায়, শেখায় পড়ায়, তাদের
বলে মুরগাবাজ। সেসব মুরগাবাজি হচ্ছে উঠানে। এই মোরগের সঙ্গে সে মোরগকে লাগিয়ে
দেবার খেলা।রাতা মোরগ। এখন অবশ্য পায়ে চাকু বাঁধা হচ্ছে না। মেলার সময় হবে। লোকে তামাশা দেখবে আর
বাজি রাখবে। আর এসেছে খাঁচা-ভরা কত কত পাখি। সেসবও বিক্রি হবে। জহিরুল গলায় রুমাল নিয়ে, ঠোঁটে
পানের লাল নিয়ে আর কানে আতর গুঁজে ঘোরে। আজকাল আবার সুরমাও পরে চোখে। এখন এইসব
পাখিটাখি দেখে গপিস্টের গপ জাগলো। আমি শুনি।
—
কন কন, কত না-জানা কথা আপনের থিকা
জানি...কন
—
তখন রাজ আমল। আমি তো পাইখ্যল। নতুন পাইখ্যল। চৈতমণি পাখি
ধরন কি সোজা কতা? কই কই দূরে দূরে ঘোর জঙ্গলে থাকে হেই পক্কি। আমি
অইন্য পাইখ্যলরার লগে ভাবসাব করলাম। ঘাঁতঘোঁত শিখলাম।
—
নেপাল পাডাইতেন? সৌদি পাডাইতেন? রাজারা
হেই পাখি দিয়া করে কী?
—
হিডা আর কী কমু কও। তোমরা কি বেডা, না
বেডার জাত?
—
আমরা কিয়ের বেডা? বেডা অইলেন গিয়া
আপনে
—
আরে ধুর, আমার থিকা কোটি গুণ বেডা অইলো ওইসব রাজা।
নিজের চক্ষে দেখছি হেল্লিগা জানি। চৈতমণি হইল এমন পক্ষী, আগুনপক্ষী। হেই
পাখির ভিতরে আল্লামিয়াঁ যে কিতা ঢুকাইয়া রাখছে হেই বেডাই জানে। চৈতমণির মাংস খাইলে
জীবন ছাইড়া জৈবন যায় না। রাজারা চৈতমণি খায়, ডেইলি খায়। পক্ষীরে আগে
পারদ খাওয়াইয়া লয়। পারদ চিননি?
সদানন্দ হবার এই এক
সুবিধা। সবাই মনে করে এ কিছু জানে না, কিছু দেখেনি, বোঝে
না। বুন্দা।
—
জানি... মানে... ওই থার্মোমিটারের
ভিতরে থাকে...
—
রাখো তোমার বালের থার্মোমিটার। পারদ অইলো ধাতু। ধাতু
খাইলে ধাতু অয়। রাজারা খায়। আমি নিজে দেখছি। চৈতমণি পাখিরে খাওয়াইয়া হিডারে সিদ্দ
কইরা মাংস খায়। হেরপরে রানিটানি, হারেমটারেম... বানকুরালি ছুডায়, বানকুরালি
বুজো?
—
ছুডুখাডু তুফান
—
ছুডু না বড়, তুমি কেমনে বুঝবা... টের
পাইত তো রানিরা। যাক, হুনো যা কই।
তই, তখন
কোন সাল? বেয়াল্লিশ না তেতাল্লিশ মনে নাই। হুনলাম খোয়াই লাঠাবাড়ি
জঙ্গলে চৈতমণি পাখি উড়ে। গোমতীর উজান বাইয়া প্রথমে অমরপুর, হেরপর খোয়াই।
গেলামগা। তহন জ্যৈষ্ঠমাস। তহন গাছে গাছে আমকাডাল, ভুতিজাম, চামল। পক্ষীও
টের পায় কোন সময় বাচ্চা আনন লাগে। কোন সময় আনলে খাওনের অভাব থাকত না। এই কারণে পাখির হইচই সারা জঙ্গলে। জোসনাপর
রাইত আছিল, ছরার পথই পথ। কী এক ছরা বাইয়া গেলাম জঙ্গলে। জোসনার আলো
চিকিরমিকির করে। যত দেহায় তার থিকা বেশি লুকাইয়া রাখে। হের ভিতরেই আমি ছয়কাডি লইয়া
উডি গাছে। বিরাট গাছ, আসমানের লগে তার আলাপসালাপ। হেই ঝাপটা বনচাম্পা গাছের মইন আগাত উইট্যা দেখি এক
কাণ্ড। বিরাট বিরাট বস্তা। গাছের ডাইলে ডাইলে বান্ধা। কিয়ের? কিয়ের
বস্তা... কওসেন, কিয়ের বস্তা?
—
আমনে কন
—
তীর ধনুক, বল্লম। রাইফেলও আছে দুইডা। আর আছে গুল্লি । আমি তো ভাবলাম মহাভারত। ভাবলাম কই জানি লুকাইয়া রইছে
পাণ্ডব, হিজড়া অর্জুন...
—
বিয়াল্লিশ সালে?
—
এই তো বুজো না, আমার মনডায় কইল
আরকি। মন কি এমে পাশ? মনের কততান মনে অয়। আমার মনে অইলো ইডা মহাভারত। ডর পাইলাম। চান্দের আলোর পিছে পিছে আমি
আইয়া পড়লাম হেইদিন।
পরদিন বাজারে কয়েকজনেরে কইলাম কথাডা। কথা তো পক্ষীর মতন।
এ গাছে হে গাছে কইরা ছড়াইয়া গেল। দলে দলে মাইনসের লাইন। মহাভারতের তীরধনুক বান্দা
আছে লাঠাবাড়ি জঙ্গলের বনচাম্পা গাছে। মানুষ বেকুব। গিয়া পূজাপালি
লাগাইয়া দিল গাছের গোড়াত। রাজার পুলিশ আইল। গাছের কাছে গেল। লোক উডাইলো
গাছে। বস্তা নাই।
—
গেল কই বস্তা?
—
আমি তো জানি না। আমি আছিলাম ঘুমাইয়া। এক বাড়িত ঘর
নিছিলাম। হেই রাত্রেই আমারে তুইল্যা নিল তারা।
—
কেডা?
—
প্রথমে ভাবলাম টিপরা। পরে দেখি টিপরা অইলেও অইন্য।
চোখ বাইন্দা আমারে
নিল। কই নিল জানি না। এক বাড়িত গেলাম। ফকফকা বাড়ি। ছুডু ছুডু ঘর। চাইরদিকে শক্ত
শক্ত পোলাপান, রাইফেল লইয়া দাঁড়াইয়া রইছে। এই চিপাত একটা, হেই
চিপাত একটা। এই গাছের তলে, হেই ঘরের বগলে।তই আমি বুঝলাম, অর্জুন
বেডা রাইফেল পাইব কই। আমার ভুল হইছে। এক ঘরের ভিতরে লইয়া গেল আমারে। এক বেডা, সাদা।
ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা চেহারা। ভালা কইরা চাইয়া দেখি,গুরুদেব। নবকুমার
ঘুঙুর। সব আছে, পায়ের ঘুঙুর নাই। আমি তো গুরুদেব কইয়া পাও পরনের যোগাড়।
দিল না। বেডা কয় হেরা সব ঘুঙুরসেনা। দেশ একদিন ঘুঙুর অইব। বস্তার কতা ভুইল্যা যাও।
আমিও পট কইরা ভুইল্যা গেলাম।
তখন একটা বিকেল কোথা
হতে এসে বসন্তকাল হয়ে গেল। ছোট ছোট আনন্দ এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সে, বালিকার
মত। কী একটা গান গাইছিলো মজিদ মিয়াঁ। তাতেও সেই এক পাখির কথা।
গপিস্ট বুড়া চোখ বন্ধ করে পুত্রের গানের দিকে কান পেতে আছে। আমি, সদানন্দ
দাশগুপ্ত, ভাবি, এইসব গপ কি গপ? মিথ্যা? সবটা?রহিম
মিয়াঁ গপিস্টের মুখের দিকে তাকালাম। মিথ্যা সোনার চশমার আড়ালে তার মুদে রাখা চোখ। প্রশান্ত। এত এত মিথ্যা দিয়েই
কি তিনি এই প্রশান্তি আয় করেন?
লহমায় কেটে গেল
প্রশান্তি। একটা সমবেত রে-রে শোনা গেল। আজ প্রায় পুরো গ্রামের
পোলাপান এই বাড়িতে। পাখি দেখতে এসেছে, এসেছে মুরগাবাজি
দেখতে। ওইপাশে জহিরুলের কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা ঘোড়াও বাঁধা রয়েছে। সেটাও একটা আকর্ষণ।
এর মধ্যে লালুমজিদ কখন সব পাখি ছেড়ে দিয়েছে। তাতেই রে-রে রব। পাখিগুলো
আসলে মুক্তি ভুলেছে। বদ্ধ থাকতেই যেন জন্ম তাদের। ছাড়া পেয়েও যায় না। লালুমজিদের
সরাইল্যা কুত্তা লালু। সে যেন দায়িত্ব পেয়েছে পাখিদের উড়িয়ে দেবার। এর পেছনে ছোটে, তার
পেছনে ছোটে। অবশেষে সব পাখি ইতিউতি এ গাছে সে গাছে চড়ে বসেছে। কিন্তু মজিদ ভেবেছিল
অন্য। ভেবেছিল মুক্তি পেয়ে পাখিরা সব উড়ে যাবে। উড়ে উড়ে গায়ে আকাশ মাখবে। মুক্তি মাখবে। পাখি
ছেড়ে দিয়ে সে জরিনাকে আদেশ করে, ‘পাখি বাবদ জালালী কত চায়, দিয়া
দ্যান’। জরিনা
দেয় না।কারণ, ওই বেইট্যা রাজু। বেইট্যা রাজুকে রাজু নামে কেউ চেনে না।
গুলবদন ডাকে। সে কি পুরুষ?
গুলবদন এখন যা করছে, সেটা
একটা অবিশ্বাস্য খেলা। সে আরও বিরাট পাইখ্যল। এই সুর করছে, শরীর বেঁকিয়ে চোখ
নাচিয়ে কী সব ভাব করছে। মুক্তি পাওয়া পাখিগুলো একে একে নেমে আসে। যেন তারা এই
কুতকুতে লোকটার দাস। গুলবদন ধরে ধরে খাঁচায় পোরে মুক্তি ফেলে ফিরে আসা পাখিদের। এই দেখে নরম মজিদ আরও
মিইয়ে যায়। সে জানে না, সে যা জানে তা জানা নয়। লোকে আরও অনেক
জানে। নানা কসরত আছে জগতে, নানা বিদ্যা আছে। গুলবদনেরা জানে। ওরা যে
এসব জানে, সে কথা মজিদ জানে না।
মায়া হল। মজিদভাইকে
একটু সান্ত্বনা দেব ভেবে উঠছি, ‘সদামিয়াঁ, হুনেন’। গপিস্ট বুড়া আমাকে
সদামিয়াঁ ডাকেন। নীরবে বসলাম তাঁর পায়ের কাছে, ‘কন, কী
কইবেন’
—
আমনে একবার নিজের মনের কাছে খোঁজ নিয়েন তো
—
কী খবর নেমু?
—
মনেরে জিগান, তাইনে বুজ্জেনি
ছয়কাডি কারে কয়?
—
কারে কয়?
—
জিগান জিগান, মনেরে জিগান, ছয়খান
কাডি... শক্ত আডা... একবার লাগলে ছুডন
যায় না...
একটা হাসি আছে গপিস্টের। নিজের ভেতরে শ্লেষ বেটে
বেটে সে হাসি তৈরি হয়। সে হাসি পেছনে ফেলে আমি উঠে চলে আসি। এই বাড়ির সবেতেই রহস্য, সকলেই
রহস্যময়।
আজ দুহাজার সতেরো সাল। আমি সদানন্দের মদ্যপানের কাচের ঘরে বসে আছি। বিকাল। খেলাচ্ছলে বাতাস আসে ঘরে, খেলাচ্ছলে বেরিয়ে যায়। এইখানে এই লেখাটা শেষ। তারকা চিহ্ন দিয়ে সদা লিখে রেখেছেঃ *৭ এপ্রিল ১৯৮৫ **গপিস্ট... হ্যান্ডেল উইথ কেয়ার...
আজ দুহাজার সতেরো সাল। আমি সদানন্দের মদ্যপানের কাচের ঘরে বসে আছি। বিকাল। খেলাচ্ছলে বাতাস আসে ঘরে, খেলাচ্ছলে বেরিয়ে যায়। এইখানে এই লেখাটা শেষ। তারকা চিহ্ন দিয়ে সদা লিখে রেখেছেঃ *৭ এপ্রিল ১৯৮৫ **গপিস্ট... হ্যান্ডেল উইথ কেয়ার...