মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০১৭


অশোক দেব

সদাপুরাণ-১১

রাজা আছে নেপালদেশে আর আছে আরবে। দুইখানেই আমার যোগাযোগ। পাখি পাডাই। চৈতমণি পাখি

    সদানন্দের বাড়ি। ছাত। জায়গাটা সদা মদ্যপানের জন্য গড়েছিলো। নামমাত্র কাচের ঘের। বাকিটা খোলা। খেলাচ্ছলে ঢুকে যায় বাতাস। বেরিয়ে যায়। গোল টেবিল। আরামচেয়ার। ছোট একটা বার। নানা রকম মদ। হুইস্কি বেশি। বড় বড় জানালা। নন্দ দারোগা সদার সব যেমন ছিল, তেমনি রেখেছেন। এখান থেকে দূর দূর দেখা যায়। খাঁ-খাঁ, নাই-নাই একটা ভাব অনেক দূর অব্দি ছড়িয়ে আছে। তারপর গোমতীর বিস্ময়কর বাঁক। এখান থেকেও তার দেমাক দেখা যায়। আমার হাতে সদানন্দের সেই খাতা, ‘গপিস্ট বুড়ার কল্পজগৎ:
    
তই, আমি তখন পাইখ্যলি করি। কামকাজ নাই। কাম করনের কাম কী? বাপেরটি খাইবো কেডা? হের থিকা চৈতমণি ধরতে পারলে নেপাল পাডামু, সৌদি পাডামু, রাজাগো লগে ভাব অইব। আমরার রাজা কী আর রাজা, হেরা ইতান বুঝে না। যারা বুঝে বুঝে। লাইগ্যা পড়লাম। ছয়কাডি বানান শিখলাম। ছয়কাডি কিতা বুজোনি?
   না, হিডা কিতা কন
মাইজখানে একটা ছুডু কাডি। শক্ত। মিত্তিংগা বাঁশের। তারে ঘেইরা আরও পাঁচটা। মনে হয় আকাশের একটা তারার চেহারা বুঝি। এইডা হইল ফান্দ। কাডলের আডা, বেলের আডা, চিনি-চুনের আডা লাগাইন্যা থাকে সব কাডির মইধ্যেমাঝখানে একটা তুরুলা বাইন্দা গাছে নিয়া দিয়া আইওচৈতমণি আসলে আইলসা পক্ষী। পরিশ্রম করে না। সামনে পড়লে খায়। যেই না ওই তেলতেইল্যা তুরুলা দেইখ্যা খাইতে যায়, আর কী, পাখনা টাখনা আটকাইয়া বেরাতেরা। হেরপরে ছয়কাডি লইয়া ধুপ্পুর কইরা মাডিত।
    আমনে পাইখ্যল আছিলেন? পক্ষী ধরতেন?
   হেইডাই কই হুনো
      লোভ হল এখন বুড়াকে ডিস্টার্ব করা যাবে না। শুনতে হবে সবটা। দিনকতক পরে চৈত্রের মেলা হবে। গকুলপুর বাজারে, বাজারের পাশে মাঠে, মাঠের পরে মজুমদারের ক্ষেতে মেলা জমে। জালালী জহিরুল কোথা হতে মুরগাবাজ এনেছে কয়েকটা। এবার নাকি মোরগের ফাইট করাবে। যারা মোরগ লড়ায়, শেখায় পড়ায়, তাদের বলে মুরগাবাজ। সেসব মুরগাবাজি হচ্ছে উঠানে। এই মোরগের সঙ্গে সে মোরগকে লাগিয়ে দেবার খেলা।রাতা মোরগ। এখন অবশ্য পায়ে চাকু বাঁধা হচ্ছে নামেলার সময় হবেোকে তামাশা দেখবে আর বাজি রাখবে। আর এসেছে খাঁচা-ভরা কত কত পাখি সেসবও বিক্রি হবে। জহিরুল গলায় রুমাল নিয়ে, ঠোঁটে পানের লাল নিয়ে আর কানে আতর গুঁজে ঘোরে। আজকাল আবার সুরমাও পরে চোখে। এখন এইসব পাখিটাখি দেখে গপিস্টের গপ জাগলো। আমি শুনি।
   কন কন, কত না-জানা কথা আপনের থিকা জানি...কন
   তখন রাজ আমল। আমি তো পাইখ্যল। নতুন পাইখ্যল। চৈতমণি পাখি ধরন কি সোজা কতা? কই কই দূরে দূরে ঘোর জঙ্গলে থাকে হেই পক্কিআমি অইন্য পাইখ্যলরার লগে ভাবসাব করলাম। ঘাঁতঘোঁত শিখলাম।
   নেপাল পাডাইতেন? সৌদি পাডাইতেন? রাজারা হেই পাখি দিয়া করে কী?
   হিডা আর কী কমু কও। তোমরা কি বেডা, না বেডার জাত?
   আমরা কিয়ের বেডা? বেডা অইলেন গিয়া আপনে
   আরে ধুর, আমার থিকা কোটি গুণ বেডা অইলো ওইসব রাজা। নিজের চক্ষে দেখছি হেল্লিগা জানি। চৈতমণি হইল এমন পক্ষী, আগুনপক্ষী। হেই পাখির ভিতরে আল্লামিয়াঁ যে কিতা ঢুকাইয়া রাখছে হেই বেডাই জানে। চৈতমণির মাংস খাইলে জীবন ছাইড়া জৈবন যায় না। রাজারা চৈতমণি খায়, ডেইলি খায়। পক্ষীরে আগে পারদ খাওয়াইয়া লয়। পারদ চিননি?
   সদানন্দ হবার এই এক সুবিধা। সবাই মনে করে এ কিছু জানে না, কিছু দেখেনি, বোঝে না। বুন্দা।
   জানি... মানে... ওই থার্মোমিটারের ভিতরে থাকে...
   রাখো তোমার বালের থার্মোমিটার। পারদ অইলো ধাতু। ধাতু খাইলে ধাতু অয়। রাজারা খায়। আমি নিজে দেখছি। চৈতমণি পাখিরে খাওয়াইয়া হিডারে সিদ্দ কইরা মাংস খায়। হেরপরে রানিটানি, হারেমটারেম... বানকুরালি ছুডায়, বানকুরালি বুজো?
   ছুডুখাডু তুফান
   ছুডু না বড়, তুমি কেমনে বুঝবা... টের পাইত তো রানিরাযাক, হুন যা কই।
     তই, তখন কোন সাল? বেয়াল্লিশ না তেতাল্লিশ মনে নাই। হুনলাম খোয়াই লাঠাবাড়ি জঙ্গলে চৈতমণি পাখি উড়ে। গোমতীর উজান বাইয়া প্রথমে অমরপুর, হেরপর খোয়াই। গেলামগা। তহন জ্যৈষ্ঠমাস। তহন গাছে গাছে আমকাডাল, ভুতিজাম, চামলপক্ষীও টের পায় কোন সময় বাচ্চা আনন লাগে। কোন সময় আনলে খাওনের অভাব থাকত না। এই কারণে পাখির হইচই সারা জঙ্গলে। জোনাপর রাইত আছিল, ছরার পথই পথ। কী এক ছরা বাইয়া গেলাম জঙ্গলে। জোসনার আলো চিকিরমিকির করে। যত দেহায় তার থিকা বেশি লুকাইয়া রাখে। হের ভিতরেই আমি ছয়কাডি লইয়া উডি গাছে। বিরাট গাছ, আসমানের লগে তার আলাপসালাপ হেই ঝাপটা বনচাম্পা গাছের মইন আগাত উইট্যা দেখি এক কাণ্ড। বিরাট বিরাট বস্তা। গাছের ডাইলে ডাইলে বান্ধা। কিয়ের? কিয়ের বস্তা... কওসেন, কিয়ের বস্তা?
   আমনে কন
   তীর ধনুক, বল্লম রাইফেলও আছে দুইডা আর আছে গুল্লিআমি তো ভাবলাম মহাভারত। ভাবলাম কই জানি লুকাইয়া রইছে পাণ্ডব, হিজড়া অর্জুন...
   বিয়াল্লিশ সালে?
   এই তো বুজো না, আমার মনডায় কইল আরকি। মন কি এমে পাশ? মনের কততান মনে অয়। আমার মনে অইলো ইডা মহাভারত ডর পাইলাম। চান্দের আলোর পিছে পিছে আমি আইয়া পড়লাম হেইদিন
     পরদিন বাজারে কয়েকজনেরে কইলাম কথাডা। কথা তো পক্ষীর মতন। এ গাছে হে গাছে কইরা ছড়াইয়া গেল। দলে দলে মাইনসের লাইন। মহাভারতের তীরধনুক বান্দা আছে লাঠাবাড়ি জঙ্গলের বনচাম্পা গাছেমানুষ বেকুব। গিয়া পূজাপালি লাগাইয়া দিল গাছের গোড়াতরাজার পুলিশ আইল। গাছের কাছে গেল। লোক উডাইলো গাছেবস্তা নাই।
   গেল কই বস্তা?
   আমি তো জানি না। আমি আছিলাম ঘুমাইয়া। এক বাড়িত ঘর নিছিলাম। হেই রাত্রেই আমারে তুইল্যা নিল তারা।
   কেডা?
   প্রথমে ভাবলাম টিপরা। পরে দেখি টিপরা অইলেও অইন্য।
     চোখ বাইন্দা আমারে নিল। কই নিল জানি না। এক বাড়িত গেলাম। ফকফকা বাড়ি। ছুডু ছুডু ঘর। চাইরদিকে শক্ত শক্ত পোলাপান, রাইফেল লইয়া দাঁড়াইয়া রইছে। এই চিপাত একটা, হেই চিপাত একটা। এই গাছের তলে, হেই ঘরের বগলে।তই আমি বুঝলাম, অর্জুন বেডা রাইফেল পাইব কই। আমার ভুল হইছে। এক ঘরের ভিতরে লইয়া গেল আমারেএক বেডা, সাদা। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা চেহারা। ভালা কইরা চাইয়া দেখি,গুরুদেব। নবকুমার ঘুঙুর। সব আছে, পায়ের ঘুঙুর নাই। আমি তো গুরুদেব কইয়া পাও পরনের যোগাড়। দিল না। বেডা কয় হেরা সব ঘুঙুরসেনা। দেশ একদিন ঘুঙুর অইব। বস্তার কতা ভুইল্যা যাও। আমিও পট কইরা ভুইল্যা গেলাম।
     তখন একটা বিকেল কোথা হতে এসে বসন্তকাল হয়ে গেল। ছোট ছোট আনন্দ এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সে, বালিকার মতকী একটা গান গাইছিলো মজিদ মিয়াঁ। তাতেও সেই এক পাখির কথা। গপিস্ট বুড়া চোখ বন্ধ করে পুত্রের গানের দিকে কান পেতে আছে। আমি, সদানন্দ দাশগুপ্ত, ভাবি, এইসব গপ কি গপ? মিথ্যা? সবটা?রহিম মিয়াঁ গপিস্টের মুখের দিকে তাকালাম। মিথ্যা সোনার চশমার আড়ালে তার মুদে রাখা চোখপ্রশান্ত। এত এত মিথ্যা দিয়েই কি তিনি এই প্রশান্তি আয় করেন?
     লহমায় কেটে গেল প্রশান্তি। একটা সমবেত রে-রে শোনা গেল। আজ প্রায় পুরো গ্রামের পোলাপান এই বাড়িতে। পাখি দেখতে এসেছে, এসেছে মুরগাবাজি দেখতে। ওইপাশে জহিরুলের কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা ঘোড়াও বাঁধা রয়েছে। সেটাও একটা আকর্ষণ। এর মধ্যে লালুমজিদ কখন সব পাখি ছেড়ে দিয়েছে। তাতেই রে-রে রব। পাখিগুলো আসলে মুক্তি ভুলেছে। বদ্ধ থাকতেই যেন জন্ম তাদের। ছাড়া পেয়েও যায় না। লালুমজিদের সরাইল্যা কুত্তা লালু। সে যেন দায়িত্ব পেয়েছে পাখিদের উড়িয়ে দেবার। এর পেছনে ছোটে, তার পেছনে ছোটে। অবশেষে সব পাখি ইতিউতি এ গাছে সে গাছে চড়ে বসেছে। কিন্তু মজিদ ভেবেছিল অন্য। ভেবেছিল মুক্তি পেয়ে পাখিরা সব উড়ে যাবে। উড়ে উড়ে  গায়ে আকাশ মাখবে। মুক্তি মাখবে। পাখি ছেড়ে দিয়ে সে জরিনাকে আদেশ করে, ‘পাখি বাবদ জালালী কত চায়, দিয়া দ্যানজরিনা দেয় না।কারণ, ওই বেইট্যা রাজু। বেইট্যা রাজুকে রাজু নামে কেউ চেনে না। গুলবদন ডাকে। সে কি পুরুষ?
    গুলবদন এখন যা করছে, সেটা একটা অবিশ্বাস্য খেলা। সে আরও বিরাট পাইখ্যল। এই সুর করছে, শরীর বেঁকিয়ে চোখ নাচিয়ে কী সব ভাব করছে। মুক্তি পাওয়া পাখিগুলো একে একে নেমে আসে। যেন তারা এই কুতকুতে লোকটার দাস। গুলবদন ধরে ধরে খাঁচায় পোরে মুক্তি ফেলে ফিরে আসা পাখিদেরএই দেখে নরম মজিদ আরও মিইয়ে যায়। সে জানে না, সে যা জানে তা জানা নয়। লোকে আরও অনেক জানে। নানা কসরত আছে জগতে, নানা বিদ্যা আছে। গুলবদনেরা জানে। ওরা যে এসব জানে, সে কথা মজিদ জানে না।
     মায়া হল। মজিদভাইকে একটু সান্ত্বনা দেব ভেবে উঠছি, ‘সদামিয়াঁ, হুনেন গপিস্ট বুড়া আমাকে সদামিয়াঁ ডাকেন। নীরবে বসলাম তাঁর পায়ের কাছে, ‘কন, কী কইবেন
   আমনে একবার নিজের মনের কাছে খোঁজ নিয়েন তো
   কী খবর নেমু?
   মনেরে জিগান, তাইনে বুজ্জেনি ছয়কাডি কারে কয়?
   কারে কয়?
   জিগান জিগান, মনেরে জিগান, ছয়খান কাডি... শক্ত আডা... একবার লাগলে ছুডন যায় না...
 একটা হাসি আছে গপিস্টের। নিজের ভেতরে শ্লেষ বেটে বেটে সে হাসি তৈরি হয়। সে হাসি পেছনে ফেলে আমি উঠে চলে আসি। এই বাড়ির সবেতেই রহস্য, সকলেই রহস্যময়
     
আজ দুহাজার সতেরো সাল। আমি সদানন্দের মদ্যপানের কাচের ঘরে বসে আছি। বিকাল। খেলাচ্ছলে বাতাস আসে ঘরে, খেলাচ্ছলে বেরিয়ে যায়। এইখানে এই লেখাটা শেষ। তারকা চিহ্ন দিয়ে সদা লিখে রেখেছেঃ  *৭ এপ্রিল ১৯৮৫ **গপিস্ট... হ্যান্ডেল উইথ কেয়ার...   






অশোক দেব
সদাপুরাণ -১০
‘বেডা অইলে আর আইবি না। যা ইহান থিকা। শালারপুত’
ঘটনা কিছু না। ফাইট হচ্ছিল। মিঠুন চক্রবর্তী।
পেয়ার ঝুকতা নেহিলোকে মিঠুনকে মারতে আসছে। উড়ে উড়ে মারতে আসে তারা। মিঠুনের মিঠুনকাট চুল সরু সরু পা। লম্বা লম্বা হাত। কালো। হঠাৎ বুকটা চওড়া। চেহারায় সৌন্দর্যের সঙ্গে কেমন একটা খেটে খাওয়া ভাব। সিনেমায় মিঠুন একজন ফটোগ্রাফার। দরিদ্র। এদের সঙ্গেই ধনী মেয়েদের প্রেম হয় দরিদ্রের প্রেম লাখ টাকা। যত গোল সেখানেই। সে কারণেই হয়তো অত মারামারি। এখন বদ লোকেরা মিঠুনকে মারতে এসেছে মিঠুনও ভুলভাল ক্যারাটে জানে। সেসব দিয়ে এতক্ষণ চালাচ্ছিল। এখন মাস্তানেরা উড়ে উড়ে আসে। মিঠুনের গায়ে সশরীর পড়তে চায়।বদলে মিঠুন ওদের দিকে তাক করে ক্যামেরা চালায়। ফ্ল্যাশ লাইটের আৎকা ঝলকে দিশামিশা না পেয়ে এদিকে পড়তে ওদিকে পড়ে উড়ন্ত মাস্তান এতে ধীরে ধীরে মিঠুনের জয় নিশ্চিত হচ্ছিল। কিন্তু, জরিনা এই দৃশ্য দেখে হেসে ফেলে,
   ইতান বালের মস্তান, ক্যামেরার উদ্দুর লাইটে চিত্তইয়া যায়। যতসব গপ।
    এ বাড়িতে ‘গপ’ শব্দটা বলা একপ্রকার নিষিদ্ধগপ’-টা শুনলেই গপিস্ট বুড়া বাতাসে গালাগাল ওড়ানমেজাজ নড়ে।মিথ্যা একটা লোককে তাঁর জমির আল দাবিয়ে মিথ্যা জল চুরির জন্য গালাগাল করেন।  সজু সেটা জানে। সজুসা আজকাল কই কই থাকে। খুব বেশি আসে না। তীর খেলার বিজনেসের সঙ্গে নতুন এই ভিডিও-র ব্যসা খুলেছে। ভিসিআর কিনেছে কোম্পানি ফুনাইভাড়া দেয়। সঙ্গে দুটো কালার টিভি। অনিডা মাঝে মাঝে সে এখানে শো চালায়। ফ্রি। এটা রহিম মিয়াঁ গপিস্ট আর সজুর কারসাজি। সঙ্গে এসে আজকাল জুটেছে জালালী জহিরুল। বাংলায় ফেরেনি সে। কত বিদ্যা যে জানে! মাতাবাড়িতে ঘোড়ার গাড়ি চালায়। সেটা একরকম জয় রাইড। সে দিয়েই সে কানে আতরমাখা তুলো গুঁজে এধার ওধার ঘোরে। আজকে অবশ্য ওটি নেই। যাক, সিনেমা হল জরিনাকে হাত করার খেলা। জরিনা সিনেমা দেখে কাঁদতে ভালোবাসে। যে বই দেখে কান্না আসে না, সেটা কী ছাতার সিনেমা? সিনেমা দেখে একবার তৃপ্তি করে কাঁদতে পারলে কয়েকদিন মেজাজ ঠাণ্ডা। দারোগা জরিনা তখন নরম নরম। গান গান। ভালো ভালো খাবারদাবার রান্না হবে। আজকে এসেছে তিনটে সিনেমা, ‘পারাবাত প্রিয়া’, ‘পেয়ার ঝুকতা নেহি’ আর ‘রাম তেরি গঙ্গা ময়লি’ ইচ্ছে করলে সারারাত চলবে। পাড়ার কিছু বাছা বাছা পোলাপানও দেখতে এসেছে। এরা জরিনার ন্যাওটা। তিনটের মধ্যে এই পেয়ার ঝুকতা নেহি-তে কান্নার মশলা বেশি থাকায় সেটা আগে চালানো হল। তো, ওই ফাইটের ছিরি দেখে জরিনা হেসে ফেলল।বলে ওঠে সে কথাটা। বলে, ‘ইতান বালের মস্তান, ক্যামেরার উদ্দুর লাইটে চিত্তইয়া যায়। যতসব গপ’। রহিম মিয়াঁ ‘গপ’ শুনে ক্ষেপে গেলে সজুর লস। ‘আমেনের কইসে আৎকা চোখে লাইট পড়লে লালিয়ান্দা লাগতো না? আমনে সব বুইজ্জা লাইসেন’? সজু জরিনাকে বিলক্ষণ চেনে। জানে এটা আগুন নিয়ে খেলা। দারোগা বেডির বিরুদ্ধে বলা? তবু বলে ফেলল কথাটা। ব্যাস লেগে গেল আগুন। জ্বলে ওঠে জরিনা। সজু তার একপ্রকার প্রেমিক। সজুর ভোমাগুড্ডির শব্দ জরিনাকে টেনে নিয়ে যায় অভিসারে। মাথায় আগুন লেগে গেলে সেসব কি আর মনে থাকে জরিনার? উঠেই প্রথমে  সুইচ অফ করে দিলআলো চুপসে গেল টিভির। প্রথমে ঝিরিঝিরি পরে নীল হয়ে গেলসজুর আজকে বাড় বেড়েছে। আজ মনে হয় ফেন্সিডিল নয়, মদই খেয়ে এসেছে। সে প্রায় আদেশ করে বসে, ‘স্যুইচটা দেন। দেন কইলাম’। এইবারে আর কিছু দেখতে হল না।  কিসে যেন একটা লাথি মারে জরিনা। কোণ থেকে ঝাড়ুটা নেয়, ফেলে দেয়। পরে দরোজার বড় ঠেসানটা নেয়। এই দিয়ে এদিক ওদিক হয়ে গেলে সজু পটল।  সে তড়াক করে উঠে বাইরে ছুটতে গিয়ে চৌকাঠে ফেঁসে বারান্দায়। সেখানেও টাল সামলাতে না পেরে উঠোনে। চিৎপাত। ‘ বেডা হইলে আর আইবি না। শালারপুত। ভাগ, যা ইহান থিকা, আদেশ করে জরিনা
    জরিনা মা-র সবকিছুতেই রহিম মিয়াঁ গপিস্টের আদর লাগে। খালি হাসি পায়। গপিস্টের সব মিছে কিন্তু ছোট পুত্রবধূটির প্রতি তাঁর প্রশ্রয়টি সত্য।এমনভাবে হাসছেন, যেন নতুন কোনও শিশু জলকে দল, গাড়িকে দাড়ি বলছে। যেন গপিস্টের বালিকা কন্যা নাচ করে দেখাচ্ছে। এই হাসি দেখে ক্ষেপে যায় সজু। ও মার খাচ্ছে আর গপিস্ট হাসে? ‘কইতাম নি, লাস্টের সিনামাডা কিতা’? সে আসলে গপিস্ট বুড়াকে ধমক দেয়। ভয় দেখায় সম্মান নষ্ট করবার হুমকি দেয়।ওই তিনটে ছাড়াও আরেকটা ভিডিও ক্যাসেট তো আছে। গুপ্ত। ‘তুই কি কইবি, বদমাইশ? আমি জানি। সব’, জরিনা চিৎকার করে ওঠে। গপিস্ট ধীরে ধীরে উঠে ভেতর থেকে দরোজা বন্ধ করে দেন। আলো নিভিয়ে দেন।একটুর জন্য থমকে গেল জরিনা।‘মোমিন, নমাজি মানুষ, তোরা আইন্যা ইতান দেহাস? না-পাক জিনিস?’ চুপসে যাওয়া শ্বশুরকে শুনিয়ে সে বলে। ঘরের ভেতর থেকে সেটি শোনেন রহিম মিয়াঁ গপিস্ট। যেন কী বীরপুরুষ, দরোজা খুলে বাইরে আসেন, ‘বাচতে চাইলে ভাগ, আর কোনদিন আমার সামনে পড়বি না’। জরিনা একটু একটা হাসি যেন লুকিয়ে ফেলল শাড়ির খুঁটে। সে জানে, গপিস্টের ধমকও গপ।
    এইসব হট্টগোল দেখে লালুমজিদের সরাইল্যা বলে, ঘেউ। আর তার প্রভু লালুমজিদ উঠে আসে।‘ভাই আজগা যানগা’, সজুকে তুলে প্রায় নীরবে সে এই কথা বলতেই আবার রেগে যায় জরিনা। ‘কিতা যাইবো গা? ভাতটি কেডা খাইবো? তার বাপে’? সজু বোঝে নীরবতাই নিরাপত্তা। মজিদও তাই জানে। জরিনাকে বুঝবার চেষ্টা করার মত বোকামি তো নাই। আজ গরুর গোস্ত হয়েছে। হিন্দুর পোলা সজু। সাহা। গরু খাবে জেনেই পেট পুরে মদ খেয়ে এসেছে। কেউ না জানুক, মজিদ জানে, মদটাই আসল কারণ। জরিনা মদ সইতে পারে না। মদ খেয়ে কেউ তাকে ছুঁয়ে দিলেই  সে ফিট হয়ে যায়। মজিদ সেটা বোঝে। সে ধীরে ধীরে ওদিকে চলে যায়। সেখানে একটা ছোট মতন জোছনা ক্রমে পূবের দিকে হেলছে। মজিদ বসে। আমিও বসি তার পাশে।
‘বুঝলেন সদাভাই, মানুষের মতন মেশিন নাই’
   ঠিক
   আপনের মেশিন আমার মেশিন কিন্তু একই। তবু মিলে না।
   মিলে না ঠিকই
   কেরে মিলে না কন, কইতে পারেন?
   আপনে কন
   আইচ্ছা হুনেন,আমি কমু না যে কথা কইতে পারে না, হে কইব।
লালুমজিদ তার কুকুরকে ডাকে। সে নিজের নামে কুত্তা পোষে। ‘লালুমিয়াঁ, একটু হুইন্যা যান তোযেন কুকুরও একটা মানুষ।  তেষ্টার জল চেয়ে কন্যাকে যেমন ডাকে পিতা, লালুমজিদ তার কুকুরকে তেমনি ডাকে। লালুকুত্তা এগিয়ে আসে। মজিদের সামনে বসে যেন বলছে, ‘কন কী কইবেন’
   আমনে তো একলা, না?
    আমার আকাশপাতাল এক হয়ে গেল। আমার সকল অভিজ্ঞতা মিথ্যা হয়ে গেল।লালুকুত্তা কুঁই কুঁই করে এমন শব্দ করল, যেন জগতের সকল হাহাকার সে কুকুরের ভাষায় অনুবাদ করে শোনাচ্ছে।
   আপনের একলা লাগে না? এদেশি কোনও কুত্তা তো আপনেরে নিল না।
    আবার সেই হাহাকার। আবার সেই শ্বাপদ কান্না। লালুকুত্তা তার সারা শরীর দিয়ে বলতে চায়, ‘কষ্ট পাই গো, ইতান কইয়েন না, আমি কষ্ট পাই’। কিন্তু মজিদকে কিসে পেয়েছে যেন।
   কত রাইজ্যের কুত্তা ঘুরে, আপনের তো কেউ নাই
এই প্রথম দেখলাম লালুকুত্তার চোখের কোন চিকচিক করে পরে সরু একটা ধারায় জল গড়াতে থাকে। যেন নিজের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে কেঁদে চলেছে, এমন করে কুঁই কুঁই করে। আকাশের দিকে মুখ তুলে একটা ফরিয়াদি ঘেউউউ তোলে...
   সদা ভাই
প্রথমে বুঝতে পারিনি। যেন একটা জাদুখেলা দেছিলাম। সম্বিত পেয়েই বলি, ‘কন মজিদভাই,কন’আমার কথায় আর কান দিল না মজিদ। সে তার কুকুরকেই বলে, ‘লালুমিয়াঁ,বাঁচতে কেমন লাগে একটু সদাভাইরে দেখান তো’। ওই কুকুর কী বোঝে, শিশুর মত এসে মজিদের সঙ্গে প্রায় গলাগলি করে। যেন মজিদ তার সন্তান, এমন করে চেটে দেয় তার গাল। মজিদ চুপ করে বসে থাকে। হয়তো তারও চোখে জল ছিল, সেসবও চেটে দিল লালুকুত্তা। এখানে আর কী দেখব, আমি উঠে আসি। উঠতেই ওই প্রায় নীরবে মজিদ বলে, ‘বইয়েন আরেকটু’। বসলাম। আমাকে নয়, কুকুরকে নয়, যেন নিজেকেই মজিদ বলে।‘আমনেরেও নিল না কেউ সদাভাই, আমারেও না। আমার লালুমিয়াঁরেও না। কেরে জানেন? কারণ, মিল নাই। আমার লালুমিয়াঁ সরাইল্যা কুত্তা। ইহানের কুত্তার লগে মিলে না। আমিও জানি কই থিকা আইছি, কারও লগে মিলে না। আমনেও’।
    চুপ করে থাকি। লালুমজিদ আবার  নীরবতাকে কথার মধ্যে
গাঁথে। বলে, ‘আমাগো আসল জগৎ দেহ। দেহের ভিতরেই আছে আসল আত্মীয়। আমরা তো হের কাছে যাই না। বাইরে খুঁজি। আমি বুজ্জি, আমার কুত্তা বুজ্জে’।
    কেমন একটা গোঙানিতে আমাদের ঝিম কেটে গেল। ওইদিকে, রান্নাঘরের ওপাশ থেকেই আসছে শব্দটা। জরিনা গোমাংস দিয়ে ভাত খাওয়াচ্ছিল বেহায়া সজুকে। একবার কাউকে খাওয়াবে মনস্থ করলে জরিনা ছাড়ে না। তাছাড়া এই সজুটার প্রতি তার কী এক মায়া। কিন্তু কে গোঙায় অমন করে? মজিদ যেন জানত কী হতে চলেছে। ছুটে যায়। আমি পিছু পিছু। রান্নাঘরের পাশেই একটা ছোট কদম গাছ। তার নীচে তখনও পড়ে আছে একটা জোছনা, ছায়া ছায়া। জরিনা সেখানে পড়ে কাতরাচ্ছে। শরীর শক্ত হয়ে যাচ্ছে তার। যেন তারই ভেতর হতে কিছু একটা বাইরের জরিনাকে টেনে নিচ্ছে। পাশে সজু, হতভম্ব।দাঁড়িয়ে আছে। সামান্য টলছে।‘ গামছাডা আনেন’, মজিদ বলতেই লালুকুত্তা ছুটে গিয়ে বারান্দায় ঝুলতে থাকা গামছাটা কামড়ে নিয়ে আসে। এ ফাঁকে রান্নাঘর থেকে জল আনে মজিদ। সে ভেজা গামছা দিয়ে মুছে দেয় জরিনার মুখ, ঘাড়, বুকের কিছুটা। হাত পায়ে ছোট ছোট চাপ দেয়। লালুমজিদ যেই ভাব নিয়ে এখন এইসব করে চলেছে, এই জিনিসকে আবহমান মানুষ মমতা বলেছে। এই জিনিসকেই হয়তো মানুষ ভালোবাসা বলেছে। হয়তো একেই প্রেম বলা হয়েছে যুগ যুগ ধরে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে জরিনা। সে যেন কত দূরে চলে গিয়েছে। সেই দূরত্ব থেকেই, নালিশের সুরে বলে, ‘ছুঁইয়া দিল, মদ্যাডা ছুঁইয়া দিল’। জরিনাকে তুলে বসিয়ে দেয় মজিদ। দাঁড়ায়। মজিদের কথা হল নীরবতার কথ্যরূপ। বলে, ‘সজুভাই বাড়িত যান, আমনে থাকলে বিবির ক্ষতি ইব’।
    আমিও চলে আসি। মাংসের লোভ আমারও ছিল। হল না। ওই দূরে গোমতী।পশ্চিমে। এখনও ঘুমায়নি। শুয়ে আছে। পুবের দিকে দূরে শহর। ওই শহরের সকল জাঁকজমক আকাশের দিকে হলুদ একটা আলো পাঠায়। ঠিকরে আছে একটুখানি আকাশ।নদীর দিক থেকে একটা মৃদু ভট ভট ভট শব্দ শোনা যাচ্ছেএকটানা। সরকারি সেচের নৌকায় দমকল চালানো হয়েছে কেমন খরা পড়েছে। জোছনার রাতে সেচের কাজ সেরে নেয় অনেকে। এতে অন্য কাজের জন্য দিনটা বাঁচানো যায় শব্দ হচ্ছে, ভটভট ভটভটমেশিন। সে-ও একটা মেশিন। মানুষের বুদ্ধিবলে সে কেমন একটা বিদ্যা শিখেছে। গোমতীর জল নিজের পেটে ঘুরিয়ে নিয়ে পাইপ দিয়ে উগলে দেয় সেই জল সরু ঝোরা দিয়ে ক্ষেতে ক্ষেতে যায়। মানুষের ফসলের তৃষ্ণা মেটায়। ভাবলাম, ওইদিকে যাই। এখন ওখানে মেশিন ম্যান আর তার কয়েকজন সাগরেদ মিলে মদ্যপানের আসর বসাবে। সেচের নৌকাটা বড়। বাঁশের চাম্পাকাম্পা বেড়ার একটা ঘর নৌকায়। সবুজ রং করা। ওপরে দোচালা ঢেউটিন। মেশিনের পাশে ছোট একটা খুপরিঘর আছে। ভাবি, আমিও গিয়ে বসি পাড়ে সবুজ, নরম ঘাসের ওপর পশ্চিম আকাশের দিকে একটা অলস চাঁদ। তার নীচে বসে ওই একঘেয়ে যান্ত্রিক শব্দটা শুন কিন্তু সেইদকে যাবার উদ্যোগ করতেই থেমে গেল শব্দটা। থেমে গেল মেশিন। হয়তো কোনও মদ্যপ মানুষ ছুঁয়ে দিল তাকে।
    দ্রষ্টব্যঃ এইসব টুকরো টুকরো এন্ট্রিগুলো সদানন্দের খাতায় লেখা। এইসব দিয়েই সে একটা পূর্ণরূপ দিয়েছে শেষে। একদম শেষ করতে পারেনি। নিজেকেই শেষ করে ফেলল। এই লেখাটার সঙ্গে ‘স’-কে লেখা সেই চিঠি নেই।সদানন্দ লিখেছিল ঠিক। কিন্তু সে অংশটা ছেঁড়া। শুধু এটুকু আছেঃ

ইতি ৪ এপ্রিল ১৯৮৫
তোমার একান্ত সদানন্দ