বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০১৭

নাটঢিলের স্বর্গবাস
আমরা ভাবি এরা ঢিল। এদের গোলযোগ আছে। আসলে এরা অন্য জগতের মানুষ
, অন্যরকমের মানুষ। সদানন্দ তাদের দেখেছিল, বুঝেছিল। আমরা বুঝতে পারিনি।
সদাপুরাণ। আজ সপ্তম পর্ব।

অশোক দেব
সদাপুরাণ – ৭
পানির উপর পাত্থর ভাসে। পাত্থরের উপ্‌রে বইয়া রইছে বেডা। পুরুষ। বেডার নাম বদর। হজরত বদরশাহবুকে আল্লার নাম, নজরে আসমান। পাত্থর ভাইস্যা আইতে আইতে আইলো এক মাডির কাছে। মাডি হইলো জঙ্গল। টিলা। ডাকাইতের বাস। আটপাড় বাটপাড়।আর দৈত্য দানব, জানোয়ার। বদর বেডা আইয়া লামে। পানির উপ্‌রে পাষাণ ভাসাইয়া আইছে। মাডিত পা দিল এইদিগে আর হেইদিগে পাত্থর গেল ডুইব্যা। বেডা আইয়া দেখে ঘাড়তেরা মানুষ সবআহারের ঠিক নাই, বাহারের ঠিক নাই। তাইনেরে এই মারে তো হেই মারে। বদর সাহেব গা করে না। অন্ধকার। বাতাস থিকা বাত্তি জ্বালে। চেরাগ যে টিলাত হেই বাত্তি জ্বালছিলেন তার নাম অহনো চেরাগ টিলা। বেডা চাটি পাতে। নমাজ আদায় করে। হেই থিকা চাটিগেরাম। তোমরা কও চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের পত্তন করছে তাইনে। আমাগো পীর, বদর পীর। একবার তাইনে চট্টগ্রাম থিকা আইলেন এই রাঙ্গামাডি উদয়পুর। রাজ আমল। আমার দাদার দাদা গিয়া আনল তারে। রাজারে কইয়া টইয়া আস্তানা বানাইয়া দিল। রাজা হেমেন্দ্র মাণিক্য আছিল তহন। হের পরে ইহানেই থাইক্যা গেল পীরসাব। হিডাই বদরমোকাম। আমরা তাইনের খাস লোক। এল্লিগা খাস ভাবে যাই। দাদা পরদাদা ঘোড়াত চইরা যাইত, আমিও যাই। আমি বংশের ধারা ধইরা রাখলাম।পরের খবর জানি না।  
জালালী বলতে সবাই বোঝে পায়রা কবুতর। আমরা বুঝি জহিরুল। দূর সিলেট থেকে এই ছেলেটি আসে। গপিস্ট রহিম ডেকে আনান। পাসপোর্ট  টাসপোর্টের বালাই নেই। যখন খুশি আসে। যায়। সে নিজেকে শাহ জালালের মুরিদ মনে করে। বলে। তাই জালালী জহিরুল সে আবার বাঁশি বাজায়। আমাদের গপিস্ট বুড়া বদরসাহেবের একনিষ্ঠ ভক্ত। তার পূর্বপুরুষেরা বদরসাহেবকে ত্রিপুরায় আনেন বলে তাঁর বিশ্বাস আজ বদরমোকামে উরস। বাৎসরিক। সেই গাড়ি তৈরি হচ্ছে। ঘোড়ার গাড়ি। এখন ঘোড়া নেই। তাই জহিরুল। কোথা হতে সে একটি ঘোড়া নিয়ে আসে। এই ঘোড়া গাড়ি টেনে উরসে নিয়ে যাবে রহিম মিয়াঁ গপিস্টকে। লাল এই ঘোড়াটা আঁশটে গন্ধ মাখা। পুরনো। এটাকে নিয়ে সে আসে এই উরসের সময়ে। থাকে। কতদিন থাকবে কেউ জানে না। তবে যতদিন থাকবে, জ্বালাবে। গপিস্ট বুড়াকে জহিরুল পাগল নাচায় কেউ সেটা বাইরে থেকে দেখলে হাসি আটকাতে পারবে না,

   আমি তো হুনছি আমনে যে পীরের কতা কইলেন, এই পীর হেই পীর না। মুখ ফসকে বলে ফেলে জহিরুল।
   তোরে কেডা কইছে? কোন বান্দির পুতে?
   আরে কইয়েন না, গপ মারনের মাইনসের অভাব আছেনি?কইছে একজনে। বান্দির পুত। জহিরুল ম্যানেজ করে।
   শালারা জানে না, হুনে না, গরুর ডেহা ঘোরাত লাগায়... কিতাবে স্পষ্ট কওয়া আছে একদিন পাষাণে চইরা এক আসমানি মানুষ চিটাগাং আইব।বলেই তিনি সেই উদ্ভট ভাষায় কোরআন হতে উদ্ধৃত করেন।
এই একটা ভাষা, যার আবিষ্কর্তা এবং ব্যবহারকারী তিনিই। আরবি উচ্চারণ, কিন্তু ভাষাটা মিথ্যা। যখন যা দরকার, বললেন তো বললেন। যেমন এখন। বলে, এমনকি সুরা আয়াত নম্বর উল্লেখ করে বলেন, ‘কী বুঝলি?’
   বুঝলাম আমনে একটা মাল
   মানে? কী কইতে চাস?
   না মানে, আমনে ক্যামনে এত মনে রাখেন? কিতা জানি সুরাডা কইলেন?
জহিরুল জানে, রহিম বুড়া গপিস্ট বুড়া। তিনি ফিরে আবার সেই বানানো সুরা বলতে পারবেন না। রহিম হাল ছাড়েন না। কী একটা বলতে উদ্যোগ নিতেই জহিরুল বলে, ‘হেমেন্দ্র মাণিক্য কি রাজা আছিল, না রাজার শ্বশুর? এই নামের রাজা...’
গপিস্ট বুড়া নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চান, ‘হেমেন্দ্র মাণিক্য অইলেন গিয়া...’
   জেডা ঘোড়াডার লাইগ্যা মলম কিনুম, ঘোড়ার কনস্টিপাইসন
   হিডা আবার কিতা?
   কনস্টিপাইসন,হাগতে কষ্ট। মলম লাগে। নাইলে পিডের সওয়ার ফালাইয়া পারাইয়া মারে...
জহিরুল টাকার ব্যবস্থা পাকা করে। এরকম নানা ফিকির করে সে রহিম মিয়াঁর টাকা হাতিয়ে নেয়। এখন ঘোড়ার কাল্পনিক ওষুধ বাবদ টাকাটা নিশ্চিত করে এদিকে উঠে আসে। উঠোনে এসে একটা খাটিয়ায় বসে।
এক অনুষ্ঠান হচ্ছে মনসাঘরের সামনে। অনেকটা জায়গা নিকনো হয়েছে।  চারটি বাঁশের খুঁটিতে টাঙানো হয়েছে ছোট একটা কাশ্মীরি চাঁদোয়া। তার নীচে সুন্দর একটা পাটি। সাদা কাপড়ে ঢাকা। আজ মজিদ মিয়াঁর জন্মদিন। রহিম মিয়াঁ সে সংবাদ প্রতি বছর জরিনাকে মনে করিয়ে দেন।‘যেদিন পীর বদর এই দুনিয়া ছাইরা আল্লার বেহেস্তে গেলেন, আমার লালু আইলো। তাইনে গেলেন, আমার লালুমজিদ আইলো। দেখ না, তার বুক ভরা আল্লার নাম, চোখে আসমান’?
জরিনা লালুমজিদকে আসনে বসায়। গড় করে প্রণাম করে। তার সামনে থরে থরে সাজানো নানা রকম খাবার। কত যে! ওদিকে জহিরুল জরিনাকে গিলছে। জহিরুল সুন্দর। কোঁকড়া চুল। শ্যামলা। টানা চোখ বুদ্ধি আর কৌতুক দিয়ে সে চোখ সাজানো। সে সুন্দর। সে সূত্রে সকল নারীকে বিজিতা ভাবে জহিরুলচোখেমুখে এমন ভাব ফোটায় যেন, কাম হল একটা হাওয়ার তৈরি খেলনা। সে সেটা নারীর দিকে ছুঁড়ে দেবে, নারী লুফে নেবে। এখন সে একের পর এক সেসব খেলনা ছুঁড়ছে জরিনার দিকে। স্বামীসেবায় জরিনা সেটা লক্ষ করে না। লালুমজিদ করেছে। খুব লক্ষ করেছে। আর, সে একা হতে থাকে ঝিম মেরে যায়। তার চোখ নীরব হয়মুখমণ্ডলে আষাঢ় মাস ঘনিয়ে এলে জরিনা বোঝে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। জরিনা তার স্বামীটিকে চেনে। মজিদ কেবল পেটে পেটে কান্না পোষে। বুক কিলায়, মনে মনে। কিছু বলে না কখনও। কিন্তু কথা সে আটকাতে পারে না আসলেতার অস্তিত্বই কথা বলে ওঠে। অভিমানের ভাষায় কথা বলে। জরিনা সে ভাষা বোঝে। সে এদিকে তাকায়, ওদিকে তাকায়। তারপর দেখে জহিরুলকে। দেখেই বুঝে ফেলে কী ঘটেছে। জহিরুল একটা লাল রুমালকে এমন ভাবে দলা পাকাচ্ছে, নাড়ছে যেন সেটা একটা নারী শরীর।কিংবা জরিনার সাদা স্তন তার হাতে রুমাল হয়ে লাল হয়েছে। জেগে ওঠে জরিনার ভেতরের দারোগা। সে ছুটে গিয়ে জহিরুলের সামনে দাঁড়ায়। তার গলায় গামছা পেঁচানো। তার দুপ্রান্ত এক করে শেষে টেনে ধরে জরিনা, ‘কিতা দেখস, কী দেখতাসস, শালারপুত’?
   দেখি
   কিতা দেখস?
   দেখি নাটঢিলের স্বর্গবাস
শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জরিনা। ‘কেডা নাটঢিল?’ হিড়হিড় করে টেনে আনে জহিরুলকে। এনে ফেলে লালুমজিদের সামনে।‘মাফ চা, মাফ চা’। ছুটে আসে সরাইল্যা। যেন কামড়ে দেবে জহিরুলকে, ছিঁড়ে ফেলবে। লালুমজিদ, ধীরে, প্রায় তদগত ভাবে বলে, ‘লালুমিয়া আমনে যান, চুপ করেন, শান্ত হন’। পৃথিবীতে একমাত্র লালুই এক কুকুর যার নাম তার প্রভুর নামে। পৃথিবীতে এই লালুই একমাত্র কুকুর যাকে তার প্রভু, আপনি বলে সম্বোধন করে। লালুকুত্তা চুপ মেরে যায় শান্ত। জহিরুল লালুসরাইল্যাকে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এখনও জরিনা তার গলার গামছা ধরে আছে। যেন ওটা দিয়েই ফাঁস করে মেরে ফেলবে। উথলে উঠছে তার দুধে আলতাজহিরুল মহা ধুরন্ধর, সে বলে যায়
   নাটঢিলেরে নাটঢিল কইছি। ঠিক করিনাই মজিদভাই? আমনের নাট ঢিল আছে না? আমনে কি আর আমরার মতন? জরিনা ভাবি ক্ষেপল ক্যান?
   আছে, আমার নাট ঢিল আছে। আমনেরটি টাইট, একটু বেশি টাইট, তেল দেন। মজিদ মাটির দিকে তাকিয়ে কথাগুলি বলে। কিন্তু স্পষ্ট, দৃঢ় সে উচ্চারণ।
হা হা হা করে হেসে ওঠে জহিরুল।
ওদিকে বাঞ্জারাদের দল বসে ছিল। তাদেরও নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। খাওয়াদাওয়ার পরে গান হবে। কে একজন বলে ওঠে, ‘মার শালে কো’। বলতেই ছুটে আসে কয়েকজন। চকিতে উঠে দাঁড়ায় লালুমজিদ।‘বিবি হামারি হ্যায়,খুবসুরত হ্যায় লোগ দেখেঙ্গে, তাকেঙ্গে। কয়ি বাত নেহি আপ কুছ নেহি করেঙ্গেশান্তি শান্তি
ধপাস করে বসে পড়ে জরিনা। সে এই লোকটাকে বুঝতে পারে না। স্পষ্ট দেখেছে সে মনে মনে কাঁদছিল। এবং কাঁদছিল জহিরুলের ওই অসভ্যতা দেখে। এখন এই কথা? জরিনা একটা ঊর্ধ্বফণা সাপের মত ঘরে চলে যায়।
ধীরে ঘরে আসে লালুমজিদ। খাটের ওপর বসে। পাশে বসা জরিনাকে জোর করে বুকে টেনে আনে। জোরাজুরি করতে গিয়ে সবটা জরিনা আসে না। তার মুখখানি মজিদের বুকে আসে।
   এত শোর করেন ক্যান বিবি? এত শব্দ তোলেন ক্যান? নীরব থাকেন, চুপ থাকেন। নীরব থাকনের মত আওয়াজ নাই
   কিতা নীরব থাকুম? আর, ইডি বুঝি শব্দ না?
   কোনডি?
   এই যে আমনের বুকের ভিতরে শুনি, আমি তো দেখি ধড়ফড় শব্দ অইতাছেভাইঙ্গা যাইতাছে।না?আমনের পরান নীরব আছেনি?
  আমনে লুকান কেরে?
   ও, বলেই লালুমজিদ সোজা হয়ে যায়। ‘কান পাইত্যা থাকেন, হুনেন’।
 বলেই লালুমজিদ কী একটা করে। ধীরে ধীরে তার বুক শান্ত হয়ে যেতে থাকে। হৃদয়ের গতি কমে। কমে কমে একসময় আর কোনও শব্দ নাই। লালুমজিদ প্রায় নাই হয়ে যায়। স্থির, নিস্তরঙ্গ হয়ে যায় শরীর। তার চোখ বন্ধ, তার শ্বাসের গরমও আর নেইএমনকি শরীরও ঠান্ডা হয়ে যায়। চোখ বোজা কিন্তু আধেক উন্মুক্ত পাতার নীচে চোখের মণি ঊর্ধ্বমুখী।
   কিতা করেন, কিতা করেনও মিয়াঁ
জরিনা ভয় পেয়ে যায়। আপ্রাণ ঠেলতে থাকে মজিদকে। জাগিয়ে তুলতে চায়। একসময়ে সব স্বাভাবিক হয়। লালু চোখ খোলে।‘যে পারে, সে বাইরে পারে, ভিতরেও পারে। কেবল নিজেরে নিজের শাসনে রাখন লাগে’।
   কাম নাই শাসনের। আমনে একটা মানুষ হইয়া ওডেন। একটা পুরুষ মানুষ হন... আমার আর কিছু লাগে না... আমি আর পারিনাও...
লালু এসব শোনে না। একা বাইরে চলে আসে। সার করে বাঞ্জারাদের বসায়। সকলের সামনে কলা পাতা দিতে থাকে। ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে জরিনা তার নাটঢিল স্বামীকে দেখে। গৌরকান্তি, উন্নত, যেন তার চারধারের বাতাস তার দেহের আলোতে বেঁকে যাচ্ছে। ওই মিট্টি না কী নামের বাঞ্জারা মেয়েটা মজিদকে সাহায্য করছে। বারেবারেই ছুঁয়ে দিচ্ছে, একটু শরীর ঠেকিয়ে দিচ্ছে মজিদের শরীরে। জরিনা টের পায় তার ভেতরে শব্দ হচ্ছে, সোরগোল হচ্ছে, ধড়ফড় হচ্ছে। কিন্তু নীরব থাকতে হবে, নীরব। নীরবতার মতন আওয়াজ নাই।
স,
একটা কোনও দুরূহ সুরের মতন জীবন, না? সবাই গাইতে পারে না। কেউ কেউ শিখে ফেলে। শিখে নিয়ে আর গায় না। নীরব হয়ে যায়। মনে মনে ভাঁজতে থাকে জীবন। তুমিও কি সেই সুর? আমি দূর হতে তোমাকে সাধি। এদের দেখি।আর মনে হয় সব ফেলে ছুটে যাই তোমার কাছে। কিন্তু কোথায়, কোন দিক দিয়ে যেতে হবে? আমিও চাই, বুকে ধড়ফড় হোক। তোমার দিকে কেউ তাকালে তার চোখের সামনে অন্ধকার লেপে দিতে ইচ্ছে হোক আমার। সে তো হবার নয়। তবু আমার কেমন লাগে, তীব্র অভিমান হয়। যে তুমি নেই, যাকে দেখিনি, জীবনে যাকে জয় করিনি, তাকে হারানোর ভয়ে আমি একা হয়ে যাই। পৃথিবী ছেড়ে আমি এই ঘরে চলে আসি। তোমার জন্য পৃথিবীর সব পুরুষকে অভিশাপ দিইযে তুমি নেই, তার জন্য যুদ্ধ করব বলে নিজেকে সশস্ত্র করি। ইতি ১২ মার্চ ১৯৮৪

তোমার একান্ত
সদানন্দ





শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০১৭

কাল কাটালি কালের বশে
সদানন্দ নিজের পিছু পিছু ফিরত। কী পেত সে? কেনই বা? কোনোদিন কি ঠিক সে দাঁড়াতে পেরেছে নিজের সামনে?
আজ ষষ্ঠ পর্ব।অশোক দেব
সদাপুরাণ – ৬
মাটির গভীর হতে গুম করে একটা শব্দ হয়। গম্ভীর। চাপা। সেটা মাটির শরীর বেয়েই দূরে দূরে বয়ে যায়। ঠিক কানে শোনা যায় না। কিন্তু শব্দটা হচ্ছে,বোঝা যায়। একটু কেঁপে ওঠে মাটিওছোট ছোট ভূমিকম্প। কিছুক্ষণ পরপর এটা হয়ে চলেছে। মানুষের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে।কিন্তু লালুমজিদের সরাইল্যা কুত্তা সইতে পারে নাশব্দ হয়, মাটি কাঁপেআর সে কেবল শিউরে ওঠে। এদিকে ছোটে, ওদিকে ছোটে। কুঁইকুঁই করে কাঁদে। অজানার উদ্দেশে ছুঁড়ে দেয় তার উন্মত্ত ঘেউ। কিন্তু সেই ভূমিগত শব্দের বিরাম নেই।
গোমতীর তীরে তীরে খনিজ তেলের খোঁজ করে ওএনজিসি। কী একটা পাইপের মত মাটির অনেক গভীরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঢুকিয়ে দেয়তার মুখে বাঁধা বোমা সেটা মাটির গভীরে নিয়ে গিয়ে ফাটায়। তাতেই গুমরে ওঠে পৃথিবী আর তাতেই ভূমিকম্প। লালুকুত্তা আশঙ্কা করে। কেউ বাড়ি থেকে বেরোতে পারে না, সে পায়ে পড়ে। যেতে দিতে চায় না।  যেন গেলে আর আসবে না ফিরে। যেন কী একটা বিপদ। দিনের বেলা এই কাণ্ড, রাতেও মুক্তি নেই। গোমতীর ওপাড়ে আশু কর্মকারের বাড়ির লাগোয়া চরায় এসেছে বাঞ্জারর দল। তারাও বোমা ফাটায়। তাদেরটা রাতে। বিস্তীর্ণ আখের ক্ষেতে ফাঁদ পাতে। কাঁচা মাংসের আড়ালে ছোট ছোট বোমা লুকিয়ে পেতে রাখে। শেয়ালেরা আখ ভালোবাসে। আখ খেতে এসে দেখে মাংস পড়ে আছে। লাল। রক্ত মেশানো, ইতিউতি পাখির পাখনা। খেতে যায়। একটা বিস্ফোরণের শব্দ, মানে একটা শেয়াল শেষ। মুখ সহ অনেকটা উড়ে যাওয়া শেয়ালের দেহ বাঞ্জারা লোকেরা সকালে সংগ্রহ করে। শেয়ালের মাংস খায়, নাকি কী করে, কেউ জানে না। তবে শেয়ালের মাংস খেলে বাত সেরে যায়, এমন প্রচার আছে। বাইদ্যারা নাকি বেতো মানুষের কাছে সে মাংস বিক্রি করে।  কিন্তু এইসব বোমার আতঙ্কে লালুকুত্তা ব্যতিব্যস্ত। সে একা। কুকুর সমাজে তার কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। এ এলাকায় তার জাতের সে একলা। সরাইল্যা। খোদ সরাইল থেকে আনা। সে তার অভিজাত চেহারা আর দারুণ শিকারি চালচলন নিয়ে একা। সন্ধ্যায় শেয়ালের দূরাগত ডাক শুনে সে এদিকে থেকে জবাব ভাঁজে। চিৎকার করে। সারাদিন তার প্রভু মজিদের পায়ে পায়ে ফেরে।সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকে। আজকাল এই দুইরকম বিস্ফোরণের চাপে পড়ে আরও একা হয়ে গেছে লালুদেশি নেড়িগুলো এ বাড়িতে আসতে পারে না তার জন্য।সে তার ব্যক্তিত্বের কারণেই ওদের বাধা বিনিময়ে লালুকুত্তাকেও বাইরে যেতে দেয় না নেড়িগুলো তারা দল বেঁধে ওকে তাড়া করে। ফলতঃ লালুকুত্তা একা কুত্তা। তার প্রভুর ডাকনামও লালু। ভালো নাম মজিদ মিয়াঁ। এদের মধ্যে একাকীত্বে মিল।মজিদেরও কারও সাথে সখ্য নেই। কারও সাথে শত্রুতাও নেই। ভাব নেই, তাই অভাবও নেই তার।
লালুমজিদ গোমতীর চরার দিকে চলেছে। গানের সন্ধানে। ওপাড়ে চরা। সেখানে তাঁবু খাটিয়েছে বাঞ্জারার দল। লোকে বলে বাইদ্যা। ওরা নিজেদের বলে বাঞ্জারা। অনেক বাধা দিয়েও মজিদকে আটকাতে পারে না লালুকুত্তা। শেষ অব্দি মজিদ পোষাটাকে বেঁধে রাখে চালতা গাছের সঙ্গে। পেতলের তৈরি খুব বাহারি  শেকল। রাতে বাঞ্জারাদের গানবাজনার শব্দ ভেসে আসে। আর আসে বিবাদের শব্দ। কলহ আর সংগীতকে যারা এভাবে মেলাতে পারে, তারা কেমন জাত? তাছাড়া লালুমজিদ হিন্দি বলতে ভালোবাসে। সেটা বলবার মত লোক কই? লালুমজিদ যায়।
এখন দূর পাহাড়ে জঙ্গলে জঙ্গলে আগুন দেওয়া হয়। বাতাসে ভেসে আসে পোড়া পাতা। কত দূর থেকে এরা ওদের নশ্বরতা বয়ে নিয়ে উড়ে আসে! জুমের জন্য টিলা জ্বালানো হচ্ছে। রাতে ওদিক থেকে বাঁশ ফাটার শব্দও শোনা যায় সেটা মৃদু। ওই দুরকমের বিস্ফোরণের তলায় হারিয়ে যায় অনেক শব্দ। বাঁশ ফাটার করুণ শব্দটিও হারিয়ে যেতে পারত। কিন্তু লালুমজিদ শব্দপাগল। সে শুনে ফেলে। তার কুকুরের সঙ্গে এই তার আরেক মিল। এরা অনাগত শব্দও শুনতে পায়। এখন একটা পোড়া পাতা বাতাসে ভেসে এসে লালুর মুখে লাগে। লেগেই যায়। লালু সেটাকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে গিয়ে কালো করে ফেলে মুখ। এমন সময় জরিনাবিবি তার বৈকালিক স্নান সেরে ফিরছিল।
  কীও, মুখ কালা কইরা কই যান?
  গানে
  কই গান?
  চরাত, হেই পারে
  আমিও যামু
বাঁধা পড়ে যায় লালুমজিদ। বাহারি বউ তাকে বেঁধে ফেলেছে। শেকল, শেকল। স্থাণু হয়ে যায় লালুমজিদভুল হয়ে গিয়েছে। বউ ভেবেছে কোথাও নিমাই সন্ন্যাস কিংবা রূপবান হচ্ছে। সেসবকেই এদিকে গান বলেজরিনা তো ভেবেছে সেই গানকিন্তু লালু যাচ্ছে বাঞ্জারাদের তাঁবুর দিকে। অন্য কোনও নতুন গানের খোঁজে।
এরা ভোরে উঠে যায়। সারাদিন ধনুক নিয়ে বনে বনে ফেরে।কারও কাছে থাকে গুলতি। কেউ সরু বাঁশের ছোট বোঝা নেয়। এসব বাঁশ আসলে অস্ত্র।  একটার সঙ্গে একটা জুড়ে দেওয়া যায়। লম্বা হতে হতে গাছের মগডালে চলে যায়। বসে থাকা পাখির নীচে দাঁড়িয়ে একটা বাঁশের মাথায় আরেকটাকে গাঁথে বাঞ্জারা পুরুষএকদম ওপরেরটাতে থাকে একটা ফলা। সেটাকে বসে থাকা, বিশ্রামরত পাখির অজান্তে তার দিকে তুলে নিয়ে যায়। সন্তর্পণ। নীরব। নিষ্কম্প। স্থিরদৃষ্টি। একসময় গাছের ডাল থেকে পাখি পেড়ে আনে। আহত, ঝটপট করতে থাকা বিমুঢ় পাখি। দিনে এসব পাখি, কাঠবিড়ালি মারে এরাআর বিকেলে, সন্ধ্যার দিকে বোমা পাততে যায়। ফিরে এসে সন্ধ্যা গাঢ় হলে নেশা করেউদ্দাম বিবাদ করে। গান গায়।নানারকম পশুর ছাল, বাঘের নখ, সাপের চামড়া, শক্ত, আঠালো কস্তূরী, গণ্ডারের শিং, ভালুকের লোম আরও কত কী নিয়ে আসে এরা বাতবিষ টেনে আনার মাটির শিঙ্গা,নানারকম তেলের শিশি আনেআর আনে ওই একটা নালের মত বাদ্যযন্ত্র, একটা ডাফলি, ঝুনঝুনি। কী অদ্ভুত!কীসের সঙ্গে কী! তারা গান করে। কেমন উতলা সুর সে গানের। গাইতে গাইতে হেসে লুটিয়ে পড়ে। আবার একটু এদিক ওদিক হলেই থেকে থেকে কলহ করে। লালু সেই গানের লোভে যাচ্ছিল। তার মুখ পাহাড় থেকে উড়ে আসা অর্ধদগ্ধ পাতার কালোতে কালো হয়ে আছে। এখন অপ্রস্তুত হয়ে আরও নিভে গিয়েছে।
জরিনার স্নানের জন্য পুকুরের শরীরে বেড়া দিয়ে আড়াল তৈরি করা। সেখানে যে ও স্নান করছিল, লালু জানত না। সামনে পড়ে গিয়েছে। এখন বলছে যামু। যামু মানে তো যামু। কিন্তু তাহলে তো লালু একা হয়ে যাবে। মানুষের সঙ্গ লালুমজিদকে একা করে দেয়। সে নিজের সঙ্গ করতে পারে না। কেউ থাকলে তার সাথেই কথা বলতে হয়। নিজে একলা পড়ে যেতে হয়মানুষের সঙ্গে তাই মজিদের নিজেকে একলা লাগে। সে ছুট লাগায়। যেন কেউ তাকে তাড়া করেছে, কেউ তাকে মারতে আসছে। লালু এক ছুটে অনেকটা চলে আসে। কখন পেরিয়ে গিয়েছে ধোয়াইছড়ি ব্রিজ, আশু কর্মকারের বিশাল উঠোন... ভেজা ভেজা বালুর চড়ায় সে চলে আসে। হঠাৎ নরম বালুতে ছুটতে গিয়ে টাল সামলাতে পারে না। হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সে যার গায়ে এসে পড়ল, তার নাম মিঠি, নাকি মিট্টি?
  ধীরে... ধীরে বাবুজি, হম কাঁহা ভাগে যা রেহে হ্যায় ... আপকাই ইন্তিজার থা... ইতনি জলদি কিস বাত কি, ধীরে... ধীরে...
বলেই জোরে তার স্তনের মধ্যে গুঁজে ধরে লালু মজিদের মুখ। ঠেসে দেয়। লালু সেই সোঁদা গন্ধ, পোড়া ভুট্টার গন্ধ মাখা বুকজোড়ায় নিজেকে পায় নাকি হারায় কে জানে, ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। আপ্রাণ জড়িয়ে ধরে মিট্টিকে। মিট্টি হেসে হেসে জগৎকে খবর পাঠায়, ‘দেখো দেখো, মিট্টি নে কেয়া পাকড়ি... ঘড়িয়াল... ঘড়িয়াল পাকড়লি...’ ছুঁড়ে ফেলে লালুমজিদকে। বিকেলকে শিউরে দিয়ে হেসে ওঠে। হেঁটে চলে যায় তাঁবুর দিকে। অকারণ অশ্রুভরা চোখে লালুমজিদ দেখে একটা নদীর চরার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আরেকটা নদী। কোমরে রূপার বিছা, সেটা দুলে দুলে তখনও বাতাসের সঙ্গে খুনসুটি করছিল। লালু নিজেকে তোলে না। তাকে একটা গান এসে বেঁধে ফেলেছে আপাতত। তার শরীরটাই গেয়ে ওঠে,
‘এ যে যৌবনকাল কামে চিত্তকাল
কোন কালে তোর হবে দিশে...
কাল কাটালি কালের বশে...’
গোমতীর নীচের থেকে একটা গুমরে ওঠা শব্দ এসে লালুমজিদের শরীরে মিশে যায়। কেঁপে ওঠে ভূমি। তার গান সহ কেঁপে ওঠে লালুমজিদ।
স,
গভীরে সন্ধান করতে হলে মনের মাথায় বোমা বাঁধতে হয়, না? মনের গভীরেই প্রবেশ করাতে হয় বোমা বাঁধা মন?  নিজেকে কাঁপিয়ে দিয়ে নিজেকে ছারখার করতে হয়? জানি না, মজিদ জানে। এই যে তুমি আসলে নেই, তাতে এক ভালো, ওই শেয়ালগুলির মত মরি না। তবে মরছি তো ঠিক। শব্দ হচ্ছে, শোনা যায় না। তুমি নেই বলে তোমাকে পাওয়ার তাড়া নেই। আমি নিজের পিছু পিছু ফিরি, দেখি তুমি কেমন আগে আগে আছ। এই থাকাটুকু রেখো।
একদিন হয়তো দেখা হয়ে যাবে তোমার সাথে, যে তুমি নেই। তখন কী নামে ডাকব তোমাকে? কী দিয়ে সম্ভাষণ করব? জানি না। ইতি ১০ মার্চ ১৯৮৪
তোমার একান্ত
সদানন্দ