গদ্য অথবা গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
গদ্য অথবা গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০২০

ডোবারম্যান



অশোক দেব

ডোবারম্যান


এক

শুয়ে অন্ধকারে চোখ মেলে থাকাটাই ঘুম। সদানন্দের নিদ্রা। চোখের সাম্নে নানা রঙের বলয় তৈরি হতে থাকে। কখন ভোর হবে ভাবতে ভাবতে ভোর হয়। পাখি ডাকে, ঠিক তখন কিচ্ছু না জানিয়ে সদার ঘুম আসে।

সদানন্দ স্বপ্ন দ্যাখে। দ্যাখে, একটি ঘর, মেঝে একদম তকতকে, মন্দির যেমন। ছাদ থেকে ঘণ্টার মতো ঝুলছে অসংখ্য রাবারের তৈরি পুরুষাঙ্গ। দুলছে। কখনো, কোনো কোনো সময় এসবকে আসল বলে মনে হয়। গা বেয়ে রক্তও ঝরতে দেখা যায়। মেঝের মাঝখানে শুকনো রক্তের আলপনা। তাতে বসে আছে রানী মাসি পদ্মাসনে। নগ্ন, টান টান। চোখ আধবোজা। পুরো ঘরটার একটা উলটো ছবি মেঝের মধ্যে বিম্ব। সদানন্দ ঘুম ভেঙে তড়াক করে উঠে বসে।

ভয়ে ভয়ে নিজেকে একবার আঁতিপাঁতি খুঁজে দেখে স্বপ্নটাকে ভুলে যায়।
এসব আবার আরেকজন জানে কীভাবে? জানি, কারণ, সদা এমন একজন যে, অনেক সময় সে শুধু ঠোঁট নাড়ে, কথাগুলো বলে দিই আমি। সিনেমায় যেমন গান হয়।

সকাল হল। সবকিছু ওপাশে রেখে বেজে ওঠে নটার সাইরেন। ওয়াটার সাপ্লাইয়ের কল তিনবার হেঁচকি তুলে জল দেয়া বন্ধ করল প্রায়। খড়ধোয়া। অফিস টান দিল হ্যাঁচকা টানে পায়খানার লাইন। কোথাও জাগল হরতাল। কাশ্মীর জাগল। পাঞ্জাব জাগল। খবরের কাগজ জেগে ওঠে আর সদানন্দ বিড়ির কৌটোকে ডাকে। দেশলাই ডাকে। কাঁথায় পিঁচুটি মোছে, বিড়িজল খেয়ে বাইরে যায়। প্রথমে বাতকর্ম। পরে ইত্যাদি। সঙ্গে সঙ্গে চায়ের দোকান নাম ধরে ডাকবে ওকে।

সদানন্দ ভাড়া থাকে। অর্থাৎ বাপের সঙ্গে শেষব্দিও মেলানো গেল না। মনে হয় জন্ম থেকেই এরা খিঁচড়ে ছিল। সদানন্দের সুখের নাম কী? কী কৌতুক আর কী যে কান্না!

আমার গত এক হপ্তা ধরে নখ দাড়ি বাড়ছে না

হাঃ বলে কী, ডাক্তার দেখা

এটা রোগ নয়, স্থায়ী মানবজন্ম

গাছ নড়চড়ে উঠলো বাতাসের খেয়ালে। কখনো ইংরেজি, হিন্দি কিংবা কখনো বাংলায় সদানন্দ কথা বলে। এইখানে মাঠ। তাতে ঝাঁকড়া এই এক বটগাছ। তাঁর নীচে সদানন্দের বিকেল হয়।

আজকাল আর তেমন ডিম দেখা যায় না, যার কুসুম এই অস্তের সূর্য। বটগাছের কোনো ভাষা নেই। সদার সান্ধ্য ঠিকানা। তারপর ছেলে পড়াতে যাবে। পথে কোনো এক ফকিরের দরগা আছে। সদানন্দ মোম চুরি করে এবং ঘরে এসে বাল্ব নিভিয়ে মোম জ্বালে।

দৈনিক কাগজ, কম্পিটেটিভ পরীক্ষা দেবার বই। একটা টেবিল লাইট হাত দিলে শক্‌ করে, এই হল টেবিল। কিছুদিন পরেই চাকরির পরীক্ষায় বসা যাবে না। বয়স সীমা ছাড়িয়ে যাবে। তবু দিন হয় দিন আর রাত হয় রাত।

এক পেট জল স্বাভাবিক। কখনো ভাত লঙ্কা আলুসেদ্ধ হলে হলে ঢেঁকুর ওঠে। সদা হাঁটতে থাকে। দরোজায় লাগানোর তালা ছিল। তার চাবি নিরুদ্দেশ।
রাস্তার সব ইট উড়তে থাকে, সব সুরকি, জোনাকি।
সদানন্দ রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব কোন দেশের লোক?

 ইজিপ্ট, না... না... হ্যাঁ ইজিপ্ট।
Mr. Sadananda, do you know the story of genesis in the Bible? How man came on earth as per the Bible? Do you agree that man was created by God?

কী জানি! পা কাঁপে আমার। পেটের ভেতর কোঁৎ করে শব্দ হয়। খাইনি কিছু।

বরং একটি জন্মের কথা ধরা যাক। সদা একদা সমুদ্র দেখেছিল। তার বাঁ পাশে মা আর ডান দিকে বাবা। সামনে যতদূর চোখ যায় এ কী! কিসের সামনে দাঁড়ালাম! মা তারপর কী? সন্ধ্যা হচ্ছে, মা আর বাবাকে অনেক দূর হেঁটে যেতে দ্যাখে সদানন্দ।

সদা ঘরে ফিরে আসে। ঘড়ি বারো পেরিয়ে গিয়েছে। এই রাতে যাবার জায়গা বলে এক পায়খানা। বিড়ি দেশলাইও যায়। অযথা বিড়ি টানে। গর্তের মুখে সিমেন্টের স্ল্যাব। এই হল পায়খানা। নীচে জলের মধ্যে শব্দ হয়। কাতারে কাতারে মশা আর আরশোলা বেরিয়ে স্ল্যাবের মুখ দিয়ে। আজগের খবরের কাগজ মনে করে সদানন্দ। আজ একটি কিশোরকে পাওয়া গেছে একটি ডোবার জলে। তার নাকে রক্তের দাগ। পচে গন্ধ।
Q.11. Polyandry means
সদা পায়খানা থেকে বেরিয়ে আসে।

দুই.


ঘরের কোনে ফিতে ছিঁড়ে যাওয়া হাওয়াই, এক পাটি আরেক পাটির সঙ্গে হাসছে। আজও সকাল হয়েছিল। সন্ধ্যা হয়েছিল। আর রাস্তা থেকে চটি হাতে ফিরে আসে সদানন্দ। ছেলে পড়ানো হয় না। ঘরে এসে গভীর রাতের জন্য অপেক্ষা করা হল। বাইরে থেকে বেড়ার একটু তার ছিঁড়ে এনেছে সদা। কিছু কিছু মানুষ সব কাজ গভীর রাতের জন্য রেখে দেয়। তার দিয়ে ছেঁড়া ফিতে জোড়া লাগালে চটির হাসি বন্ধ হল। পা গলিয়ে ঘরেই একটু হেঁটে নেয়, তারপর বিছানায় যায় সে। বিছানা হল তার টাইম মেশিন। ওটাতে করে অতীতে যাওয়াটাই সদানন্দের পছন্দ।

সদানন্দ ভেবে দেখেছে যৌবন আসার আগে সকলে মৃতই থাকে। কারণ, একজন যুবকই ভাবতে পারে, বড়লোকের ডোবারম্যান যেমন, আমাদের ঘরের ছেলেরাও তা। ঘেউ। কাকে ঘেউ? কেন? তবু ঘেউ।

তথাপি একটি নদীর কাছে যাতায়াত। গোপনে আমি আছি তোমার হয়ে। তোমার জাতের নই, তাতে কী? ওই চোখের কী জাত? প্রতিদিন একটি করে চিঠি লেখা। স্বপ্নের রং কখনো নীল কখনো ঘোর স্কারলেট। বাড়িটার নাম হবে বৃষ্টি। সামনের দেয়ালে আমিই এঁকে দোব ছবি। সদর দরোজা থেকে দুধারের সার বাঁধানো দেবদারু। হাওয়ায় এরা দুলবে আরামে। ঘরের রং হবে  চাপা সবুজ। আমাদের শোবার ঘর হাল্কা নীল। আমাদের মনে থাকবে আমাদের বাস। মায়ের ঘরের সঙ্গে ঠাকুর বাবার ঘরে আস্ত লাইব্রেরি। তোমাকে নিয়ে যাব প্রতিদিন এক নদীর কাছে।

কিন্তু সব চুল ছেড়ে দিলে নারীকে কেমন মনে হয়? প্রশ্নের সাথে সাথেই সদানন্দের মনে হয় সমস্ত ঘরটা ঝুপ করে শব্দ করল। সদা টাইম মেশিনে উবু হয়ে শোয়।

টাইম মেশিন। অতীতকাল। সব চুল ছেড়ে দিলে নারীকে কেমন দেখায়? তার চুলে লাগানোর গার্ডার কোথায়? রানিমাসি দাঁড়িয়ে আছে সোজা। তার শাড়ি হল হাওয়ার প্রতীক। সদানন্দ দূর মাঠ ধরে ছুটে আসছে। তার কানে কোনও ডাক এসে পৌঁছায় না

তোর নাম টা বিচ্ছিরি। এ নামে আমি ডাকব না।

সদানন্দ নিজের নাম পাল্টে ফেলে মনে মনে। প্রকাশ্যে পারে না। সকলের তো সব হয় না। নিঝুম হয়ে সদা রানিমাসির পায়ের কাছে বসে। তার নখ থেকে খুটে খুটে রং তুলে নেয়।

ঘরের মেঝেতে খপ করে একটা টিকটিকি পড়ল। সদা পাশ ফিরে তাকে দেখে। সঙ্গে সঙ্গে পাশের বাড়িতে ক্যাবল টিভির শীৎকার কানে আসে। আবার টাইম মেশিন।

রানিমাসি সদাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসে। ঘর মানে সুযোগ। সন্ধ্যা মানে রানিমাসি পেছন ফিরে কাপড় তোলে। টেবিলে কনুই রেখে দাঁড়ায়। সদানন্দকে পেছন থেকে টেনে নেয় অদ্ভুত কায়দায়। এবার একটা ডোবারম্যান ঘোঁত ঘোঁত করে। সব শিথিল করে তারপর বাতাস আসে। অ্যাতোক্ষণ এইসব কোথায় ছিল? এই ঘর, এই হাওয়া? আলো জ্বলে। ঘেউ ঘেউ। পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে সদানন্দ দেয়, মাসি,

আমাকে বৌদি ডাকলি না কেন, প্রথম থেকে? কী রে?

প্রতি সন্ধ্যায়, নিয়মিত যে, প্রতিটি সন্ধ্যায় এইভাবে সদানন্দ একটি ডোবারম্যানকে ভালো করে বুঝে উঠতে পারে না। কার চিঠি কাকে দিয়ে ফেলে! অথচ সদার কাছে একটি নদীও ছিল।

সদা আপনমনে চলে আসে এক শহরে। একপ্রান্তে তার ঘর অন্যদিকে দুনিয়া। কাঁহাসে কাঁহা পহুঁচ গয়া! বাইরে এক জ্যোৎস্না। সদা আকাশের দিকে মুখ তুললে সারারাত ঊর্ধ্বদৃষ্টি কাটিয়ে দেবে। গাছের আনাচে কানাচে তাই জ্যোৎস্না দেখে, আকাশে তাকায় না। কে কাক, ডাকছ? কাকে? রাতকে তোমার দিন মনে হয়?

শহরের বড় বড় বাড়িতে এখন কিছু লোক জাগছে। সদানন্দ আদের চেনে। খবরের কাগজ চেনে। এ সপ্তাহে সদা মোট ১০ জন মানুষের মৃত্যু জেনেছে। এখন রাস্তায় বলে বলে বিক্রি করে কিছু ছেলে। গৃহবধূ ধর্ষিতা, শ্বশুর গ্রেপ্তার। তছলামারায় সাত ব্যক্তি খুন। ওই লোকগুলোর কাছে রাত্রি এক রকম। কাউয়া কা। আমার কাছে এক। কাউয়া কা। সদা এদিক ওদিক হাঁটে। এদিকে ঘাস আছে ওদিকে উঠোন। সদানন্দের পায়ে হাওয়াই চটি। সদ্য লাগানো লোহার সরু তার ব্যথা দিচ্ছে খুব। ঘরে চলে এসো। আসার আগে সদা আকাশে তাকায়। চাঁদ, তুমি নীল আর্মস্ট্রংকে চেন?

বিছানা।

   মাসি, স্কুলে তুমি কী পড়াও?
মাসি স্নানঘর থেকে এসেছে। একটু গায়ে থাক তুই, মাসি অমন করে

   ভালোওওবাসা

   চুল খুলে দাও। আমি গন্ধ নেব। দেবও। আসলে সদা জমিয়ে রাখা থুতু মাখায় চুলে।

বিড়ি দেশলাই। সদা রাত কাটাতে যায়। পায়খানার দরোজায় একটা ব্যাঙ। ওকে দেখে লাফাতে লাফাতে নিরাপদ অন্ধকারে চলে যায়। আজকের কাগজে যে বউটির কথা, তার শ্বশুরের সাথে স্বামীও জড়িত ছিল।

তিন.

Q.5. where are days and nights equal throughout the year and why?

জানি না তো, আহা, সমান?

এই তার শেষ বছর। আর কোনও পরীক্ষা দেওয়া যাবে না। চাকরির আশা হত হল। সদা চারদিকে তাকায়। মেয়েটির চশমাটা টেবিলে উলটো হয়ে মেয়েটিকে দেখছে। তার কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। ওই ছেলেটি বাচ্চা। জানালাগুলো এদিকেরটা ওদিকেরটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাতাস খাচ্ছে। ওই মেয়েটির চুল ছেলেদের মত ছাঁটা। একটি ছেলে রোগা, আর এটি হয় ধামসা। ধুর।সদা বেরিয়ে যায়। দরোজা কানে কানে বলে, এসো এসো, দুগগা দুগগা। মহিলাদের কলেজে ছিল পরীক্ষা। সদা সেটি ছেড়ে এসে এখন রাস্তায়।

বাহ, আহা, আর সংবাদপত্র দরকার নেই। কম্পিটিশন সাকসেস পড়ার প্রয়োজন নেই। পরীক্ষা নেই। এখন আমি যেমন খুশি। রাস্তায় এখানে ওখানে গর্তে জল জমে আছে। সদা পেরিয়ে পেরিয়ে হাঁটছে সেদিক দিয়ে। এমন একটা সময় ছিল আমরা ওকে ছবি আঁকতে দেখেছি। এমনও দিন গেছে সে ম্যান্ডোলিন বাজাত। সদা এমন ভাবে দাঁড়াতে জানত, দেখলে মনে হত দেবে যাচ্ছে মাটি। এখন, এখন হাঁটতে হাঁটতে শিস বাজাচ্ছে, সুর নেই তাতে।

শহরে এক যে ছিল রাজা। তার প্রাসাদ এখনও আছে। পতাকা পাল্টে গেছে। প্রাসাদের সামনে রাজপুকুর। মাঝে রাস্তা দুপাশে দুটি।  এক পাশে টুপ করে বসে পড়ে সদা। পকেটে কটি টাকা আছে। সেগুলোকে  ঘাসের ওপর কলমচাপা দিয়ে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে নিল। পাড়ে উঠে পোক্ত করে বসেছে, যতক্ষণ না জামা কাপড় শুকিয়ে যায়।

কোথাও কিছুক্ষণ বসে থাকার যো নেই। ভিজে কাপড়ে খুব জোর সি পেয়েছে। পেছনে রাস্তা, সামনে পুকুর। কোথায় যাব, আড়াল নেই। খুব জোর। সদা দাঁড়াতে দেরী কর্মটি হয়ে যেতে দেরী হয় না। আমাদের স্থায়ী মানবজন্ম নিজগাত্রে প্রস্রাব করে এবার নাইতে নেমেছে। একবার সাঁতার শিখলে কেউ তা আর ভোলে না।

আমাদের বাড়ির সামনে একটি পুকুর ছিল। সদানন্দ ডুব দিয়ে পুকুরকে একটা গল্প বলে। আমাদের বাড়ির সামনে একটি পুকুর ছিল। তোমার মতন বড় কিন্তু নয়। তবে অনেকে সাঁতার কাটতে আসত। যেমন ধরো, বিনু, রাধে, বিলাস। আমারও কপাল থেকে চাঁদের টিপ মুছে গিয়েছিল। তারপর একদিন পুকুরে চাঁদের বিম্ব হল। আমি দেখলাম। আমার শরীরে বিদ্যুৎ এসে খেলা করে যায়। কেমন মায়া লাগে। রানিমাসি যে, মাসি এ কথা বুঝতে পেরেছিল। আমাকে ডাকত। কেমন মন্ত্রের মতন কাজ। আমি যাই। মাসি তার দুধ খুলে খেতে দেয়। অনেক চুষতাম । দুধ নেই। অন্য বুকে মাসির ছোট ছেলেটা দুধ খেত। কী জানি দুধ আসত কি না। রানিমাসির বাড়িতে একটা রাক্ষসও ছিল। সেলফিশ জায়েন্ট। তার হয়ে মাসি রক্ত শুকিয়ে তারপর গুঁড়ো করে কপালে লাগিয়ে রাখত। নইলে রাক্ষস রাতেরবেলা তাকে পিষে ফেলতে চায়। মাসির অনেক কষ্ট। তাই রাক্ষসকে দেখিয়ে দেখিয়ে সে আমাকে আহ্লাদ করত। সন্ধ্যায় নিজে পুকুর হয়ে আমাকে বলত, সাঁতার কাট। এত কথা একসাথে বলে সদানন্দের জলের নীচে শ্বাস আটকে আসে। ওপরে উঠে এলে ভেসে ওঠে রাস্তা, মানুষ, রাজপ্রাসাদ। হিহি, ধ্যুত, আমি না খুব মিথ্যে বলি। রাজপুকুরকে বলে। আমি একটা ল্যাজকাটা ডোবারম্যান। হি। ঘেউ ঘেউ। পুকুরের খুব মায়া হয়। বলে, সন্ধ্যা হল, বাড়ি যাও।

শহরের সব রাস্তাকে ঘুরেফিরে সদানন্দের বাড়ির পথের কাছে আসতে হয়। ওদিকে হাসপাতাল আছে। হাসপাতালে রাত হয় অন্ধকার। ওই হাসপাতাল ছাড়া এ শহরে আর কোনও গণিকাপল্লী নেই। সদানন্দ যেকোনও একটি পথে হাঁটে। একটি চকচকে ভ্যানিটি ব্যাগ হঠাৎ পথের কোন্‌ থেকে ডাক দেয়। ও কাছে যায়, কলম আর টাকা রয়ে গেছে পুকুরের পাড়ে। পেছন ফেরে না, বরং আরও কাছে যায়। যেতেই মুচকি মুচকি হাসে ব্যাগটি। সদাও হাসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে নজর করে দেখে ব্যাগটিকে। দেখে কী, ও এখন মুখ কালো করে তাকিয়ে আছে। পড়ে থাকা ব্যাগ দেখলে পুলিশে খবর দিন। ওই, ওই। মাথায় আতস। পালা, পালা। দৌড়। শ্বাস। আহা আহা। হা হা। কানে কোনও শব্দ বেজে ওঠে না। তবু সে ছুটছে। তার ঘরটিও ছুটছিল তার দিকে। নাহয়, এ পথ সদা এল কী করে ইশারায়?

আজ রোববার। বাড়িঅলা অন্য জায়গা থেকে ফিরে আসে। এই যা। আজ সদারও ছুটি। এই তো স্টোভের সামনে  ঘরের ভেতর। ইনিয়ে বিনিয়ে বলে, আজ জ্বল ভাই, কাল থেকে অত জ্বলতে হবে না। স্টোভও না পারতে জ্বলছে। তার কী দোষ। সদা ভাবে, এসবের মানে কী? আমি কেমন করে হাঁটতে পারি। ঠান্ডা ঘরে ঢুকে অবলীলায় বলতে পারি, গুড মর্নিং স্যার। ফিরে আসার সময়, এনি মোর কোশ্চেন,প্লিজ? না, কোনও প্রশ্ন তো থাকে না। হিহি করে হেসে ওঠে একটা বাটি। সদা সেটাকে তুলে নিয়ে তাল বাজায়। দূরে টেবিলে সকল কাগজপত্র নাচতে থাকে। সংবাদপত্র, খুন, ধর্ষণ নাচে, নাচে উগ্রপন্থী নাচে। সম্পাদক নাচে। নাচে প্রতিদিন নাচে, নাচে কারেন্ট অ্যাফেয়ারস নাচে। সদার পায়ের ঠিক নেই। চুপ। চিড়চিড় স্টোভ জ্বলছে। একটা অদ্ভুত আলো ঘরের ভেতর। বিদ্যুতের আলো কখন চলে গেছে। একটি একটি করে সব কাগজ সদা স্টোভের ওপর ছুঁড়ে মারে। সব, খবরের কাগজ, লেখার কাগজ, কম্পিটিশন সাকসেস। সারটিফিকেটস। অনেক কাগজের নীচে পড়ে বোধহয় সদার স্টোভ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল। নাহলে দাউ দাউ আগুন জ্বলল না কেন?

চার.

হাসপাতালের কিছু গন্ধ পোষ্টবক্সটির ভেতরেও ঢুকে আছে। তবু এ নিয়েও লাল ডাকবাক্স ঠায় সেঁটে থাকে দেয়ালে। যে লোকটি এগিয়ে আসে, তাকে দেখলেই বোঝা যায় তার একটি বাড়ি আছে, ভাড়া খাটে। চিঠিখানি বাক্সে পড়ে শব্দ করল। লোকটা খানিক তাকাল বাক্সের দিকে। তারপর চলে যায়।

সদার দিনের বেলা পিঁপড়ে আর রাতের বেলা আরশোলা। সারা দিনরাত ঘরে থাকে সে। টিকটিকিদের তার বিশ্বাস নেই। শহরের টিকটিকি মিছেকথায় তিন ডাক ডাকে।

মাঝে মাঝে কাঁদে সদানন্দ। মাঝে মাঝে চেয়ে থাকে। হাসি পেলে থামে না। প্রথমে চেয়ে থাকে, যেমন এখন,  স্থির, যেন সত্যিই দেখতে পাচ্ছে উড়ে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে কাক, চড়ুই, শালিক। ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে কান।

আবার নীরবতায় হাহা করে চারদিক। বনপায়রা এসেছে মরতে। মাথা গুঁজে মরে আছে অনেক পাখি। গম খেতে এসেছিল তারা। সিরাজ মিয়াঁ  ক্ষেতে ওষুধ দিয়েছিল। সদানন্দ এর পেছনে ছুটে যায়, ওর পেছনে যায়। সন্ধ্যা হল এভাবে। সদা অনেক পাখির শব কুড়িয়ে এনেছে। গর্ত খুঁড়েছে। অনেক বড়। সবাইকে সেটাতে মাটি দিল। রাত হয়ে গেছে। গম ক্ষেত অন্ধকার। একটা কড়া গন্ধ হচ্ছে বাতাসে। সদার মাথায় রক্ত উঠে যায়। বাড়ি হতে নিয়ে আসে একটা দেশলাই, কেরোসিন। গম ক্ষেত জ্বলে ওঠে দাউদাউ।

ধরতে পারে ওরা, ধরতে পারে। বাবা গো মেরো না। সদা যেন স্পষ্ট ব্যথা পায় এখনও। অশরীরী হয়ে বাবা তাকে এখনো মারছেন। এইসব দেখে কেঁদে ওঠে সদানন্দ। সে জানে না একটা ডাকবাক্সও আজ তার জন্য কেঁদেছে। নীল একটা ইনল্যান্ড লেটার পড়ে নিয়েছিল সেই ডাকবাক্স।

আপনাদের পুত্র শ্রীমান্‌ সদানন্দের আচরণে একপ্রকার সন্দেহ হইতেছে ।তাহার চুলে জটা ধরিয়াছে এবং চোখেও অদ্ভুত দৃষ্টি আসিয়াছে ।কাহারো সহিত কথা বলে না।নিজে নিজেই হাসিয়া এবং কাঁদিয়া উঠে ।মাসখানেক ধরিয়া স্নান খাওয়া প্রায় বন্ধ করিয়া দিয়াছে ।আপনারা আসিয়া একবার দেখিয়া যাইবেন ।অন্যথায় আপনাদের পুত্রের এই দায়িত্ব গ্রহণ করিতে পারিবনা ক্ষমা করিবেন ।

ডাকবাক্সের কষ্ট হয়েছিলো ।সদারও কত খাম সে দেখেছিলো ।বায়োডাটা, ব্যাঙ্কড্রাফট,বয়েসের মানপত্র, সার্টিফিকেটসের জেরক্স, কয়েকখানা সদ্য তোলা ছবি।সদা তো আর অপরিচিত কেউ নয় ।

 

পাঁচ

মার সঙ্গে বাবাও এসেছিল ।মাথায় হাত রাখে বাবা, মনে হয় মাথা ফুঁড়ে সমস্ত অভিমান আজ বেরিয়ে যাবে ।এমন হয়না ।শুধু কৌতুক, না-কি সদা এমন হাসা হাসলো, এত লজ্জা এ্যাতো কাঁদলো ।

এদিকে আমাদের শহরে মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে একদিন ।অনেকের বিয়ে হয়ে গেলো।রাতের বেলা আকাশ দিয়ে এরোপ্লেন যায় ।শীত পড়লো খুব ।আমরা তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসতাম ।

অনেকদিন সদাকে আমরা মনে রাখলাম না ।আমাদের অনেক বাইরে যে সদা অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিয়ে আসে, তারও কেবল তিনজনকে মনে আছে ।আজ ফিরে আসার পর তাদেরকে মনে করে না সে। তবু তার মনে আছে ।সদা এখন ভাবে তিনজন বলতে একজন মহিলা, জান্‌লায় দাঁড়িয়ে থাকে সারাদিন ।বিকেল হলে কাঁদে আর কাকে যেন টাটা দ্যায় ।তার বয়েসী একটি ছেলে সারাদিন ধ্যানে বসে থাকে ।ধ্যানেই তাকে জোড় করে খাওয়াতে হয় ।ধ্যানেই তার সবকিছু ।আর ওই ডাক্তার ।টাক হলে মানুষের চেহারা যেমন গম্ভীর হ্য়, তারও তেমন ।এমন একটি লোকই সদাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো,

Do you know who Jocasta was?

   রানি মাসি ।

এ প্রথম ফিরে আসার পর সদা বেশি করে হেসে ওঠে ।

 

তার ঘর ।সব ঠিকই পায় সে ।সারাদিন আড্ডা মারতে ইচ্ছে করে এত ঝরঝরে হয়েছে সদা ।তবে কারো কথা জিজ্ঞেস করলোনা ।সন্ধ্যায় আমরা দুজন নদীর পাড়ে অনেক পাখির ডাক শুনলাম ।ওর প্রিয় ব্র্যাণ্ডের সিগারেট খেলাম ।আরো ধীরে সন্ধ্যা কালো হয় ।সদাকে বাড়ি দিয়ে আসা ঠিক হবে ।

 

আজও ও আলো নিভিয়ে দ্যায় ।মোম নিয়ে পুরোনো ছবিগুলিকে দেখলো ।একটু একটু হাসলো ।ড্রয়ার থেকে অনেকগুলি পুরোনো চিঠি বের করে আনে ।টেবিলের সাম্নে বসে ।

 

চেয়ারটাকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে আগের আরাম পর্যন্ত যায় ।একটি বই নিয়ে শব্দ করে পড়েহুঁ হুঁ সমস্ত বেগই আপেক্ষিক বেগ ।কারণ পৃথিবীতে প্রকৃত স্থির বলিয়া কোন বস্তু

হেসে ওঠে ।পড়ার সুরটাও বেশ মনে আছে ।মোম জ্বেলে দেয়ার পরই ওকে ভালো করে চোখে পড়ে ।তবু এতক্ষণ না দেখার ভান করেছে ।এবার হাত দিলে তার শব্দও আগের মতো খসখসে ।আজকের কাগজ-ই তো ! সদা প্রথমে হেডলাইন দেখে ।দুলাইন সম্পাদকীয় পড়ে ।এ পাতা ও পাতা ।বিজ্ঞাপন ।রোববারের আলাদা পাতা ।না, নাই-তো ।আগের মতো নাই-তো ।ওসব এম্নিতেই চোখে পড়ে অত দেখতে হয়না ।তবু দেখে সদা ।বাইরে আকাশে আজও  জ্যোৎস্না ।ওঘরে একটু টিভি দেখে আসা হলো ।আবার, খস খস ।না-নাই ।ধর্ষণ, খুন, হত্যা ।নাই ।অন্য, অন্য রকম সবকিছু ।মোমের কাছে অনেক পোকা আসে ।সদা তাদেরকেও ভালো মতো দ্যাখে ।তাদের ডানার রঙ জলের মতো ।বারবার আগুনে লেগে যাচ্ছে কই পুড়ছে না তো ।এবার স্যুইচ টেপে সদা ।আঙুল দিয়ে কলামের ওপর থেকে নীচ অব্দি আসে।না।স্যুইচ অফ্।আবার মোম জ্বালে ।কাগজটি বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে ফিক্‌ ফিক্‌ হাসে ।

 

রাত্রি নীরব হয়ে ওঠে ।খেয়ে আসার পর ।বিছানার দিকে যেতে ভয় করে সদার।কাগজটা আছে। তবু হাতে নিয়ে চোখের সাম্নে ধরে রাখে ।দ্যাখে না ছাই-ও।

রানিমাসি এখানে নেই ।রক্তও না ।মাসিকে অপারেশন করে নারীর কম করা হয়েছিলো মনে আছে ।মাসিও মুটিয়ে গ্যাছিলো ।তার যেন যন্ত্রণাই কমে গ্যাছিলো অনেক ।সব যন্ত্রণা কি ঐ অপারেশনে কেটে গিয়েছে? কাগজটিকে ফেলে রাখে সদা।বাবাও এখন আর ততো রাগী নয় ।

 

মোম নিভে গেলে ঘরের মধ্যে সব অন্ধকার ।বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে ।

 

মা চা না দিলে সদা ঘুম থেকে ওঠেনা ।বাইরে থেকে ডাকলে উঠে গিয়ে চা নেয় ।কুঁজো থেকে জল নিয়ে মুখ ধোয় ।আজও কুঁজো ঘরের কোনে, মায়ের বাঁ পায়ের শব্দ ডান পায়ের চেয়ে বেশি হয় ।কুঁজো তা শোনে আর ভয় পায় ।আস্তে দু তিনবার মা ডাকে ।দরোজা খোলে না ।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঠেলা দ্যায় ।ভেজানোই ছিলো ।খুলে গেলে একরাশ আলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে মেঝের মাঝখানে উল্টে রাখা চেয়ারে ।হাত থেকে কাপ প্লেট প্রথম শব্দগুলি করে, তারপর মা ।দরোজার এক পাটে হেলান দিয়ে মা স্থির হয়ে যায় ।বুকের কাছে এসে যায় চিবুক ।চোখ বন্ধ ।নীরব ।ঘরের কোন্‌ থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে জলের কুঁজো ।মায়ের পায়ের কাছে এসে কাত হয়ে জল দিতে থাকে ।তার ভেতর সমুদ্র ছিলো, ভেসে যাচ্ছে গতকালের কাগজ ।The king is dead, long live the king. সমুদ্রের সকল ঢেউ মেঝের সামান্য ওপরে সদানন্দের পা-ও স্পর্শ করে ।   

[প্রকাশিত : পদক্ষেপ, ১৪০১]


পাঠের জন্য ধন্যবাদ। এই অতিমারির কালে গাছের সঙ্গে সময় দারুণ কাটে 

               

 


সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

একাকিত্ব — আত্মবিচ্যুত মানুষের রক্তগীতিকা






সেই বৃক্ষের কথা ভাবি। সুখসাগর জলার মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে থাকত। ছোটো একটা ডাঙা, সে ছাড়া আর কেউ নেই। বর্ষায় নাচন-নাচন জল তার পদতলে ঢেউ সমর্পণ করে।হেমন্তে কেটে নেওয়া ধানের মস্ত একাকিত্বের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে থাকত। দূর হতে দেখতাম। হয়তো পিতার সঙ্গে অভিমান করে অস্থায়ী গৃহত্যাগ করেছি। তখন জাতীয় সড়কের ওপর দিয়ে কেবল নীরবতা যাতায়াত করত। অতসব গাড়িঘোড়া ছিল না। ঘামের গন্ধ ফেলতে ফেলতে চলে যেত সাইকেল চালক কিংবা রিকশাওয়ালা। টুংটাং বেজে চলত ঘণ্টি। ঘণ্টি মাত্রই নিজে বাজে। রিকশায় লাগানো কেরোসিনের বাতিটি আলো কম বিষাদ ছড়াত বেশি। আমি ওই দূরের বটবৃক্ষের কাছে কত কী নালিশ করতাম। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার কারণে সে নিকট হয়ে উঠত। যেন তার পাতার নাচন দেখতে পেতাম। অনেকক্ষণ বসে থাকতাম। অনেকক্ষণ। ধীরে মন শান্ত হয়ে যেত। আকাশের অস্তানুষ্ঠান শুরু হলে দেখতাম রঙের চড়কমেলা। এক রং অন্যকে অভিবাদন করে, আলিঙ্গন করে। নিজেদের একেবারে মিশিয়ে ফেলে অন্ধকার হিসেবে পুনর্জন্ম নেয়। তখন ফিরে আসি। মনের মধ্যে কে যেন গান করে। অপূর্বরচিত, অপূর্বগীত সেই গান আমি নিজেকে শোনাই। অভিমান উবে যায়, আমি আর গান মিলে দুইজন হই, আমি আর একাকী থাকি না।
এই যে প্রাচীন বৃক্ষটি। এই যে আলোকযজ্ঞের আকাশ। এই যে পথিকবিরল পথ। এরা একা? তাহলে আমি কেন এমন একাকী? তবু আমি এমন একাকী। এ দুটি পঙ্‌ক্তি সেই কবির নির্জনতার কবি বলে যার অভিধা জুটেছিল। বাংলা কবিতায় একাকিত্বকে অত করুণ সুরে আর কেউ বাজাননি।
কিন্তু কী এই একাকিত্ব? কী তার পরিচয়? এই একাকিত্ব শব্দটির জন্মই-বা কবে। ইংরেজিতে দেখলাম, loneliness শব্দটির ব্যবহার ১৮০০ সালের আগে বিরল। প্রায় নেই। ১৬০০ সালের আশেপাশে lonely শব্দটিকে দেখা যায়। কিন্তু সেটা আজকের একাকিত্ব নয়। আজকের একাকিত্বকে বলা হচ্ছে একুশ শতকের কুষ্ঠ। অর্থাৎ একটা কঠিন ছোঁয়াচে রোগ। একটা মহামারি, নিজেই। এই করোনাকালে যে একাকিত্বে আমরা বাস করছি, সেই করোনার থেকে বয়সে প্রাচীন এক মহামারি নিয়ে কথা বলতে বসেছি একাকিত্ব। আবার যদি সেই নির্জনতার কবির কাছে যাই? মাথার ভেতরে এক বোধ জন্ম লয়মড়ার খুলির মতন আছাড় মারিতে চাইআমি তারে পারি না এড়াতে। কী সে? এর জবাব কি অনেক পরে আমেরিকা থেকে পাব আমরা? সে আরেক একাকীর কাছ থেকে? সিলভিয়া প্লাথ। করুণ এক কবি। একাকিত্বের মার জীবনভর সইতে সইতে শেষে আত্মহত্যা করলেন। ২০১৭ আর ২০১৮ সালে দুই খণ্ডে তাঁর চিঠিগুলো প্রকাশিত হয়। মায়ের কাছে লেখা, পত্রমিত্রের কাছে লেখা, ধাত্রীর কাছে লেখা এবং মনোচিকিৎসকের কাছে লেখা। সেইসব চিঠির একটিতে বলছেন ‘I am so lonely, this single room is so lonely’. একাকিত্বের বোধ সিলভিয়ার ভাষায়, উঠে আসে ‘from the vague core of the self – like a disease of the blood’. তাহলে এ এক অজানা রোগ? দুজন একাকী মানুষ, একজন ১৯২৯ সালের আশেপাশে যাকে বোধ বলতে চাইছেন, তাঁর থেকে বহু পরে এসে এক আমেরিকান কবি তাকে রোগ বলছেন? তাহলে একাকিত্ব আসলে কী?
১৬০০ সালে রচিত একটি অভিধানে lone শব্দটি আমরা পাই। কিন্তু বাংলা একাকিত্ব শব্দটি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত বঙ্গীয় শব্দকোষে এখনও নেই। নেই। নেই জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধানেও। কারণ সে ছিল না। যে গাছ দেশে জন্মায় না, তার নাম কী করে রাখবে মানুষ? সংস্কৃতে কৈবল্য আছে কিন্তু সেই শব্দের কেন্দ্র ও পরিধি ভিন্ন। নিঃসঙ্গ শব্দটি কি ছিল না? ছিল না নির্জন? ইংরেজিতেও অনুরূপ অর্থবাহী শব্দ ছিল, বাংলাতেও আছে। সেসবের অর্থ ঠিক একাকিত্ব নয়। নিঃসঙ্গ, নির্জন প্রধানত শারীরিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক। কিন্তু একাকিত্ব মনোশারীরিক, তারপর বাকি সব।
এখন রাত্রিকাল। একটা সবুজ রঙের আলো আছে বাইরে। আগামীকাল পূর্ণিমা। মেঘের রঙের সঙ্গে চাঁদের জোছনা মিশে শ্যামল হয়েছে। বারান্দায় বসে বাইরে তাকিয়ে আছি। আমাদের বাগান নেই। যে যেমন জন্ম নিয়েছে তেমনি কিছু গাছ আছে।বেশ অনেক। তারাও আলোকের মধ্যে নিজেদের সবুজ মেশাচ্ছে।আমি নিঃসঙ্গ, নির্জন। যার যার ঘরে শুয়ে আছেন মা, পুত্র, স্ত্রী, বাকি পরিজন। একটু আগে কথা হল তমাল ও মেঘ অদিতির সঙ্গে। আরো কিছু ফোন এসেছিল, ধরিনি। এখন কি গান শুনব? কিন্তু এই লেখাটা তো লিখে শেষ করতে হবে।
গানের কথা ভাবতেই মনে এল এলানর রিগবিকে। সেই বিখ্যাত গান, বিটলস। সেখানেই হয়তো প্রথম জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল,
All the lonely people
Where do they all come from?
All the lonely people
Where do they all belong?’
এই গানটা কবে লেখা হয়েছিল। একটু ঘাঁটতেই দেখলাম, ঠিক ১৯৬৬ সালে লেখা হয়েছিল এ গান। আমার জন্মের তিন বছর আগে। এর আগে এই জিজ্ঞাসা জাগেনি কোনও শিল্পীর? কোথা হতে আসে এইসব একাকী মানুষ? তারা কাদের? বাংলা কোনও গান আছে এমন? ঠিক, মান্না দে। আমি আজ আকাশের মত একেলা। কত সাল? জানি না, অনুমান সে-ও গত শতকের ছয়ের বা সাত দশকের কোনো সময়ে হবে। এই সময়টা থেকেই একাকিত্ব মহামারির রূপ নিতে শুরু করে সমাজে।
একেলা, বললেই মনে আসে তিনজন মানুষকে। জীবনানন্দ, সিলভিয়া প্লাথ আরও দূর ভিনসেন্ট ভ্যান ঘঘ। এঁদের জীবনে কী মিল! নিদারুণ একাকিত্বের শিকার সকলে। সকলের সারাজীবনের কাজে অসাধারণ মৌলিকতা। সঙ্গলোভে চিঠি বা ডায়েরি লেখা আর শেষে অস্বাভাবিক মৃত্যু। তাঁরা কোথা হতে এলেন, কোথায় তাঁরা বিলং করেন?
ঘঘের জন্ম ১৮৫৩ মৃত্যু ১৮৯০। জীবনানন্দ ১৮৯৯ সালে জন্মান, মৃত্যু হয় ১৯৫৪ সালে। প্লাথের জন্ম ১৯৩২ সালে। মারা যান, ১৯৬৩ সালে। তাহলে এটা কি ঠিক অষ্টাদশ শতাব্দীতেই একাকিত্বের জন্ম, যা একুশ শতকে এসে মহামারির রূপ নিয়েছে আজ? ঠিক। সত্য। সমাজতাত্ত্বিক, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির ইতিহাসবিদ সকলে এই সময়টাকে একাকিত্বের জন্মকাল বলে চিহ্নিত করেছেন।
নিঃসীম একাকিত্বের কথা এর আগে সাহিত্যেও তেমন পাইনি আমরা। হ্যামলেটের দীর্ঘ সলিলকিতে বেদনার এমন ব্যক্তিগত রূপ আমরা পাই না। আত্মহত্যার কথা ভাবছে বটে সে, কিন্তু সেটা ঈশ্বরের দ্বারা অনুমোদিত নয় বলে বাদ দিচ্ছে সেই ভাবনা। আর যে একাকিত্বের, নিজের সঙ্গে নিরন্তর কথা বলার আধুনিক রূপ, সেটা হ্যামলেটের সলিলকিতে নেই। তাহলে? আচ্ছা যক্ষের একাকিত্ব তবে কী? বিরহকাতর যক্ষও তো একপ্রকার চিঠিই লিখছে। যেমন লিখেছেন ভ্যান ঘঘ, জীবনানন্দের ডায়েরি কিংবা সিলভিয়া লিখছেন মনোবিদের কাছে। কিন্তু মেঘদূতে যক্ষ একাকী হলেও একাকিত্ব তার সমস্যা নয়। রামগিরি পর্বতে একাকী যক্ষের অনেক পরে আমরা আরেকজন একাকী মানুষকে পাব। ইংরেজি সাহিত্যে। রবিনসন ক্রুশো। ফ্রাইডেকে পাবার আগে পর্যন্ত মানুষ হিসেবে ক্রুশো বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপে একেবারে একা। কিন্তু যে একাকিত্বের হাতে খুন হয়ে যান সিলভিয়া, তা তো ক্রুশোকে আক্রমণ করল না। অত ভিড়ে থেকেও সিলভিয়া একাকিত্বের শিকার আর সত্যকার একা থেকেও ক্রুশো তা নয়? সত্য যে, ক্রুশো ডিফোর কল্পনাপ্রসূত চরিত্র, প্লাথ বাস্তব। হলেও, ডিফোর মাথায় একাকিত্বের অপশনটি আরোপ করবার চিন্তা তো এল না।
মজার কথা হল, এই সেদিন সম্ভবত, ২০০০ সালে একটি ছবি হয় আমেরিকায়। ‘Castaway’। এর উৎস ডিফোর রবিনসন ক্রুশো। কিন্তু কাস্টএওয়ে তে দেখা গেল একাকী নায়ক একটা ভলিবলে  রক্তাক্ত একটি মুখচ্ছবি এঁকে তার নাম রাখল উইলসন। আর এই উইলসন আসলে একটা ক্রীড়াসামগ্রীপ্রস্তুতকারী কোম্পানি। ছবিটি জনপ্রিয় হলে তারা উইলসন নামে একটা বলও বিক্রি করতে শুরু করে। তাতে সেই মুখটা আঁকা। এইখান থেকে একাকিত্ব নিয়ে আমাদের আড্ডাটা পাল্টে যাবে।
যদিও এই কথাটি বলতে অতকিছু বলবার দরকার ছিল না একাকিত্ব নামক মহামারিটি আসলে আধুনিকতার পার্শ্বফল তবু বললাম কারণ, প্রতি তিনজন বন্ধুর মধ্যে দুজন এতে ভোগেন দেখতে পাই। আমি নিজে ভুগেছি। মনোবিদের কাছে গিয়েছি। এই আধুনিক সমাজ আমাদের কী দিয়েছে? যন্ত্র, শিল্পোদ্যোগ আর বাজার। আমাদের অসুখবিসুখও এই হাঁ-মুখ বাজারের কাছে পণ্য। এই সমাজ আসলে সিলভিয়ার বেলজারে ঢাকা পৃথিবী
তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী।
এই প্রশ্ন এবং স্বীকারোক্তিতে আসার আগে কবি কী বলছেন? বলছেন
সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর
পরে?
সহজ নেই আর মানুষ। এই যন্ত্রসভ্যতা আমাদের প্রথমেই জটিল করে দিয়েছে। শরীর থেকে মাটির গন্ধ কেড়ে নিয়েছে। যৌনতা, বিবাহ, প্রেম পরকীয়া সব জটিল হয়ে গিয়েছে।  আর ডিজিটাল বিপ্লব আমাদের একেবারেই ঘরে বন্দি করে দিয়েছে আজ। আমরা নিসর্গচ্যুত।
জীবনানন্দ তাঁর রূপসীবাংলা থেকে বিচ্যুত। প্লাথ তাঁর আধাশহর থেকে বিচ্যুত। ঘঘও বারবার বিচ্যুত। আজকের মানুষ জন্ম ও কৈশোরকালীন নিসর্গ থেকে বারবার বিচ্যুত হয়। কেবল নগরের দিকে ছোটে। কিংবা নগর ছুটে আসে তাদের কাছে। যে নৈসর্গিক সঙ্গ একাকিত্বকে আন্দময় করে তোলে, সে নেই আর।  তাই, যে আকাশকে আমার এই ২০২০ সালে একেলা মনে হয় না। আলো আর রঙের উৎসব বলে মনেহয়, তাকে আধুনিক গানের গীতিকার একেলার উপমা করে কেন বলেন, আমি আজ আকাশের মত একেলা? কারণ আমার আকাশ বিশাল, বিস্তৃত এখনও। এখনও আমার আকাশ বহুতলের ফাঁক দিয়ে আমার দিকে উঁকিঝুঁকি দেয় না।আমি নিসর্গচ্যুত নই। তবে যে আমিও মনোবিদের কাছে গেলাম? কারণ একাকিত্ব ছোঁয়াচে। এমন যে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে গ্রেট ব্রিটেন ‘Mninister of Loniless’ তৈরি করে। জো কক্স ছিলেন এই দফতরের  প্রথম মন্ত্রী। একাকিত্বকে মহামারির মতন করে বিচার করেছে তারা। তাই আধাশহরবাসী আমাকেও নাগরিক রোগে আক্রমণ করে কিংবা আমিও সংক্রমিত হই। কারণ,আমরা  আজকাল  সহজে আত্মবিচ্যুত হই। আশা করি। বিবাহের কাছে, সমাজের কাছে, বন্ধুর কাছে আমাদের আশার অন্ত নেই। আশাহত হই। পিতার কাছে আশাহত হয়ে গিয়ে সুখসাগর জলার কাছে বসি। কিংবা, আমরা অতীতচারী হয়ে পড়ি। আর নস্টালজিক হয়ে পড়াকে একাকিত্ব সংক্রমণের প্রথম উপসর্গ বলে চিহ্নিত করেন অনেক মনোবিদ। আত্মবিচ্যুত মানুষের অন্তর একেবারেই শুকিয়ে যেতে থাকে।ভারি হয়ে যায়। শেষে এই দেহ, যেটার ভেতরে শুকনো একটা অন্তর তাকে শেষ করে দিয়ে ভাবি, যাক বাঁচা গেল। কিন্তু মৃতেরা কি ভাবতে শিখেছে?
তাহলে? আরেকরকম একাকিত্ব আছে। ভাবনা করবার একাকিত্ব। Solitude. এই শব্দের সঠিক বাংলা আমি জানি না। একান্ত?  আমাতে শেষ। আমি একজনেই অন্ত। সেই একান্তে বসেই ভগবান বুদ্ধ আবিষ্কার করেন অন্তহীন জরার থেকে মুক্তির উপায়। তারও আগে উপনিষদ ভাবিত ও রচিত হয়। ভগবান মুহম্মদের কাছে আসেন ঐশী কোরআন। ভগবান যিশু পান প্রেমের বারতা। রবীন্দ্রনাথ পান মানসী লেখার ছন্দরূপ। তাঁরা আত্মসম্পৃক্ত হতে পেরেছিলেন। আধুনিকতা আমাদের দিয়েছে আত্মবিচ্যুতির নানাহ উপায়। আমরা তাদের দ্বারাই একাকিত্বে সংক্রমিত হই।

এই মহামারিকালে আমাদের জোর করে একাকী করা হয়েছে। এখন সুযোগ ছিল, আত্মস্মপৃক্ত হবার। আমরা কেন সেই সুযোগ না নিয়ে, ডিজিটাল সমাজ বানিয়ে সেই সশব্দ হাহাকার দিয়ে একাকিত্বকে প্রচার করছি? একান্তে বসে এই আমার জিজ্ঞাসা।

(যখন ভুগছিলাম, তখন একাকিত্ব নিয়ে খুব ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। পড়েছি। নিজেকে সামলেছি। সেইসব পাঠ এ লেখাটায় কাজে এসেছে) 

......................................................................................................................................................


কিছুদিন আগে এক বন্ধুর সূত্রে এই বইটির সন্ধান পাই। পড়ে মান্য করলে জীবন পাল্টে যাবে। (অ্যামাজন এফিলিয়েটেড)

রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৯

নয়নতারার ঘ্রাণ




নয়নতারার ঘ্রাণ

অশোক দেব 

অন্ধকার। কিন্তু ওই যে শোনা যাচ্ছে সে কি ধ্বনি নাকি আলোর ধ্বনিরূপ? রাইচাঁদ বাজাচ্ছে। অন্ধকারে দেখতে পান? আমি পাই। রাই যখন বাজায় তখন আলো বিচ্ছুরিত হয়। সেই অদ্ভুত আলোতে কী দেখা যায়? দেখা যায় আমাদের রাইচাঁদ কাঁদছে। অবিরল ধারায় ঝরছে অশ্রু। রাইয়ের বাদ্যের আলোকে স্পষ্ট হয় সামনের আসন। উদ্বাহু শ্রীচৈতন্য, নিতাইচাঁদ আর একটু ওপরে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি। এখন যে তাল বাজাচ্ছে রাই, তা আসলে কোনও তাল নয়। কথা বলছে সে। শ্রীখোলই বলে দেয় তার কথাগুলো। মাঝে মাঝে যখন অশ্রুর তোড় আসে, তখন বামের থেকে গুমগুম করে ওঠে। তারপর এই মাটির তৈরি বাদ্যযন্ত্র বিলাপ করতে শুরু করে। আনন্দময় শ্রীখোলের কান্না যে শোনেনি, সে কী শুনেছে?
একটা বটগাছ আছে। তার বয়স কত? তার নীচে একটা দালান আছে। চারদিক খোলা। আর আছে ঠাকুর। সেই শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগল। সন্ধ্যায় সেখানে লোকে কাঁদতে আসে। কারণ, কীর্তন হয়। সবার থেকে বেশি কাঁদে বাবুলের মা। বাবুলের মায়ের ষাট হবে বয়স। কিন্তু, বাবুলকে কে দেখেছে? কবে কোন অতীতে সে জলে ডুবে মরে যায়। বাবুলের বাবা সেই থেকে কথা বলে না। নিজের কাজটুকু করে যায়। কথা বলে না। কেউ তাকে কথা বলতে শোনেনি। কী এমন ছিল বাবুল যে, সে চলে গেলে একজন মানুষের কাছে পৃথিবীকে বলবার মত আর কিছু থাকে না? বাবুলের মায়ের কান্না কেমন? ওই রাইচাঁদ দাসের বাজনার মতন? না। তিনি তাকিয়ে থাকেন শ্রীবিগ্রহের দিকে। শ্রীরাধিকাকে একদৃষ্টে দেখেন। পায়ের দিকে নয়। মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন। আর তার অশ্রুর খনি খুলে যায়। অবিরল। এদিকে কীর্তন গেয়ে চলে যায় হারুর বাবা, নিতাই গোস্বামীর পাঠও শেষ হয়, শেষ হয় মালতির নৃত্য এবং প্রণাম। সবাই চলে গেলে আমাদের রাইচাঁদ বাবুলের মায়ের সামনে যায়। বসে।
      এত কিরে কান্দো?
      জানি না রে বাপ, আমার উথাপাথাল অয়
      বাবুলরে মনে পড়ে বুঝি?
      পোলাডারে দুধ খাওয়াইতে পারলাম না আমিমাত্র হামা দেওন শিখছিল। ক্যামনে যে গিয়া কুয়াত পইরা গেল...
      ইস
      তে যাওনের পরে কী যন্ত্রণা, কী টনটন, বুকে দুধের চাপ...
হাহাকার করে ওঠে বাবুলের মা। প্রায় চিৎকার করে জড়িয়ে ধরে রাইচাঁদকে। রাইও তখন কাঁদে। হা প্রভু, হা প্রভু। ঠিক কী রকম হতে পারে এই টনটন? স্তন্যপান কেমন? জন্মকালে মাতৃহারা রাই জানেও না স্তন্যপান ঠিক কী রকম হয়।
          দয়াল সংঘ। রাইচাঁদের দল। তারা ঘুরে ঘুরে নামকীর্তন করে। দূর দূর থেকে ডাক আসে। বছরে একদিনও বাদ পড়ে না প্রায়। শীতকালে তো একদমই না। তখন রাইচাঁদের শরীর লতানে হয়ে যায়। শ্রীখোলের তালে তালে সে তার নরম পা মাটিতে বোলায়। আর পৃথিবীকে তালবাদ্য শেখায়। যারা গায়েন, মাঝে মাঝে তারা রাইকে আসর ছেড়ে দেয়। ওপর থেকে ঝুলে থাকা মাইকের নীচে প্রায় ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় রাই। বাজায়। সারা মাঠ জুড়ে উলুধ্বনি গুঞ্জরিত হয়। এমন যে এমন, সামান্য বয়সের বউরাও তাতে যোগ দেয়। রাই তার শ্রীখোলকে নিয়ে খেলা জুড়ে দেয়। এদিকে কাত হয়, গমক গমক। সোজা হয়ে একটু নরম নরম কথা বলিয়ে নেয়। তারপর একটু হাহাকার যোগ করে দিয়ে ফিরে আবার মূল তালে আসে। আবার গায়েনের দিকে তাকিয়ে নেয় একটু। তারপর ঝলমল করে এসে সম-এ পড়ে। হরিবোল, হরিবোল। রাইয়ের বাবরি চুলে তুফান থামিয়ে একটু দাঁড়ায়। সে ঠেকায় ঠেকায় গায়েনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়এ বাদ্য দূর হতে শুনেছে যে, সে বাড়িতে থাকতে পারে না। রাত দশটার পরে মাইক বাজানো নিষিদ্ধ। কিন্তু রাইকে বাজনায় পেলে আয়োজকেরা ধার ধারে না এসব। বড়োবাবু আসে, তবুও না। এরপর আসেন খোদ এসপি সাহেবা। লম্বা। পুলিশের পোশাক পরা জাঁদরেল মহিলা। উত্তরপ্রদেশ না কোথাকার। হিন্দি বলে। তিনি যখন আসেন, তখন আমাদের রাই তার শ্রীখোলের সঙ্গে নিজের আত্মীয়তা বাজিয়ে দেখাচ্ছিল। গাড়ি থেকে নেমে সেই যে দাঁড়ালেন এসপি, নড়নচড়ন নেই। একজন পুলিশ আসে। রাইয়ের কাছে যায়। একটা হাজার টাকার নোট তার পাঞ্জাবিতে গেঁথে দিয়ে এসপি সাহেবাকে দেখায়মানে, উনি পাঠালেন। রাই শ্রীখোল তুলে নমস্কার জানায়। কিন্তু তার বাদন বন্ধ হয় না।  ফিরে যায় পুলিশ। আবার মাঠজুড়ে উলুধ্বনি।
          কিন্তু, এই যে একা বসে অন্ধকারে বাজাচ্ছে রাই, কী বাজায়? তার বাজনার থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। খালি গা। রোমহীন পেলবকান্তি। ভক্তিলাবণ্য? গোহালে কয়েকটি গাভী, তাদের বাছুর। জল নেই সামনের পাত্রেতারা ডাকে। রাইচাঁদের খেয়াল নেই। বাজায়। বছরে যে-কদিন বায়না থাকে না, রাইচাঁদ মাখন বিক্রি করে। ধলী, কালী, ললিতা, বিশখা তার আদরের গাই। রাইয়েরা আসলে ঘোষ। বাবার মিষ্টির দোকান ছিল। বেশ নামডাক। দাদারা মিলে সব ভাগাভাগির তাল তুললে রাই সেসব থেকে সরে আসে। স্বেচ্ছায়। একটুকু ভিটে, দুতিন কানি ধানের জমি আর গাইগুলো তার ভাগে আসে। না চাইতেই দিয়ে যায় দাদারারান্নাবান্না স্বপাক। একেবারে সামান্য। কিন্তু সকাল সন্ধ্যা মিছরি দিয়ে দুধ খেতে হয়, এক ঘটি। কাঁসার একটি ঘটি আছে। সোনার মতন চকচক করে। ঠাকুরের তৈজস সহ রাইয়ের সকল কিছু কাঁসার। নিজেই মেজে মেজে সোনার মতন করে রাখে। রাইচাঁদের ঘরদোর দেখলে তত বড় গিন্নিও লজ্জা পাবে, এমন পরিপাটি।  মাটির ঘরে থাকে সে। ঠাকুর থাকেন ইটের দালানে। বাহারি করে বানানো ঠাকুরঘরের সামনে ছোট্ট একটা নাটও রয়েছেরয়েছে প্রদক্ষিণ করবার মতন চারবারান্দাওরাই ঠাকুরঘরের দরোজা বন্ধ করে দিয়ে অন্ধকারে শ্রীখোল দিয়ে আত্মকথা রচনা করে। সে কথা সে রাধাকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য, নিতাইচাঁদকে শোনায়। শোনায় গোপালজীকে। সামনের ছোট পেতলের আসনে শ্রীগোপাল হাসি-হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছেন রাইচাঁদের দিকে। রাইচাঁদ ঘোষ, দীক্ষা নিয়ে দাস হয়েছে।
          রেলগাড়ি এসেছে এখন। নতুন। সকালে আগরতলা হতে আসে একটা গাড়ি। আবার সাড়ে আটটার দিকে ফিরে যায়। এখানে দূর দূর মাঠ। সেটা পেরিয়ে গেলে টিলা, রাবারের বাগান। তার কোনো আড়াল দিয়ে রেলগাড়িটা আসে যায়, রাইচাঁদ জানে না। সে তো রাতে ঘুমায় না। ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে গোহালে গিয়ে গরুগুলো দেখে আসে। হাফ ওয়াল করে পাকা করা গরু ঘর। উপরে টিন। সিলিঙ্গে ফ্যান আছে। বাছুরের জন্য আলাদা ভাগ করা আছে ঘরে। ভোরের দিকে গিয়ে ফ্যান অফ করে দিতে হয়। গরুর ঠান্ডা লেগে যায়। এসব করে এসে রাই যখন বিছানায় আসে, ভোরকীর্তনের সময় হয়ে যায়। তার আগে আধ ঘণ্টাটাক তন্দ্রা-তন্দ্রা, ঘুম ঘুম। আজকাল আর ভোরকীর্তনে কেউ বেরোয় না। আগে অর্চনা বৈষ্ণবী আসত। তার বাড়িতে এলে সঙ্গে রাইও বেরিয়ে পড়ত তার সঙ্গে। একটা টিমটিমে ধোঁয়া-ওঠা হ্যারিকেন হাতে নিয়ে অর্চনা এবাড়ি ওবাড়ি যেত। তার বুঝি দেনা শোধের বিষয় আছে, যেন এই ঘুমন্ত মানুষগুলো তাকে তাড়া দেয়। অর্চনা বৈষ্ণবী গেয়ে গেয়ে বেড়াত। তত মধু ছিল না তার কণ্ঠে। কিন্তু আদর ছিল। গ্রামটা পুরো মুখস্থ তার। কার বাড়ির ছেলেটার জ্বর, কোন বাড়ির বউ বাপের বাড়ি গিয়ে আর ফিরছে না, কার বাড়ির মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে... ভোর হলে অর্চনাকে মনে পড়ে রাইয়ের। কোথাকার কে যেন তাকে নিয়ে গিয়েছে। কেউ তো নেই, শেষকালে কী হবে খুব ভাবত সে। এখন বোম্বাই না কোথায়, কাদের ঘরে ছেলে রাখে সে। কী করে যে তার ভোরকীর্তন ফেলে রেখে চলে গেল। ঘুম আসে না। পাশের অত বড় করই গাছটাকে একটা মাধবীলতা পুরো দখল করে নিয়েছে। আসল গাছ আর দেখাই যায় না। মনে হয় মাধবীলতাই আসল। তার আড়াল থেকেই প্রথম পাখি ডাকে। রাই আরেক দফা বাজিয়ে নেয়। যেন সে বাজনা ছাড়া অর্থহীন, যেন বাজনাটাই আসল রাইচাঁদ। রেলগাড়ির শব্দ শোনা গেলে থামে। স্নান করে। ঠাকুর জাগায়। গাই দোহাতে যায়।
          কে বলে নয়নতারার গন্ধ নেই? রাইচাঁদের সারা বাড়িতে নয়নতারার গাছ শিশুর মতন খেলে, বাড়ে। সারা বাড়িতে ফুটে থাকে। হাসে, দোলে। গাই দোহাতে গেলে রাই এর সুগন্ধ পায়। সুঘ্রাণে ভরে যায় এমনকি তার ভেতরটাও। গাইগুলোর নানা জাত। পালা করে দুটিতে দুধ দেয়, দুটি গর্ভবতী থাকে। ধলী আর কালী দেশি। ললিতা নেপালি আর বিশখা জার্সি। এখন ওরা গর্ভবতী। রাই ধলীর কাছে যায়। তার বকনাটার নাম বংশী। তাকে ছেড়ে আসে। ছুটে এসে মায়ের স্তনের বোঁটায় জুটে যায় বংশী। পৃথিবীতে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য কি আছে? রাইচাঁদের সাদা রঙের গাভী সারা পৃথিবীর পুলককে তার চোখে ধারণ করেছে। আর অবশ হয়ে যেতে থাকে রাই। এত বাৎসল্য এই অবলা প্রাণে কোথা হতে আসে? একটু একটু করে সে চেটে দেয় সন্তানের শরীর। আর ওই বাছুর অযথা ঠুসে দেয়, আঘাত করে মায়ের দুধের ভাণ্ডে। কোথাও একটা গিয়ে লাগে রাইয়েরও। কেমন একটা ঝিম ধরানো পুলক লাগে তার। আর সেটা সে দেখে ধলীর মধ্যেও। দুগ্ধের ধারাস্রোত আরও বেড়ে যায় তখন। আনন্দে ঘন ঘন লেজ নাড়ে বাছুরটি। হুহু করে ওঠে রাইচাঁদের বুক। কোথাও একটা আনন্দ হয়, আবার কী যেন হারিয়েও যায়। হাফওয়ালের ফাঁক দিয়ে দূরের গাছপালার দিকে তাকায় রাই। সারা বাড়িতে ছড়িয়ে থাকা নয়নতারা দেখে। দুলছে, হাসছে। তারাও তো সন্তান, বসুন্ধরার দুধ খেয়ে বেঁচে আছে। রোদের দুধ খেয়ে। কী যেন মনে পড়ে রাইয়ের। ছুটে চলে আসে ঠাকুরঘরে। গোপালজী কি অপরাধী? রাইচাঁদ গিয়ে তাঁকে ধরে।
      আমি কী দোষ করলাম ঠাকুর? সবাইরে দও আমারে দও না। আমি কী আর এমন কঠিন জিনিস চাইলাম?
গোপালজী তাকিয়ে থাকেন। চোখে হাসি, ঠোঁটেও। রাইচাঁদের কথা শুনে যেন আরো বেশি করে হাসেন। 
        আমাদের রাইচাঁদ নারী হতে চায়। আসলে স্তন্যদানের পুলক পেতে চায়। নিজের বুকের দুধ সে খাওয়াতে চায় স্বয়ং গোপালজীকে। এ কথা কেউ জানে না। রাই জানে আর জানেন গোপালজী। নিজে তো পারে না। তাই সে বাজনায় বাজনায় স্তন্যদান করে। সেই সুমধুর বাদ্যধারায় সে গোপালজীকে তৃপ্ত করতে চায়। আর সেই একই গোপন আর্জি পেশ করে চলে তার গোপালজীর কাছে। আজও, সেই ভুলেই গেল দুধ দোহাতে। চলে এল ঠাকুরঘরে। বাৎসল্য আর আনন্দ তাকে ঠেলে গোহাল থেকে বের করে দিয়েছে। কিন্তু এই যে একই প্রার্থনা সে জানিয়ে যাচ্ছে, সে কবে থেকে? যেদিন সে জেনেছে, মায়ের দুধ পায়নি সে ধাত্রীও জোটেনি। যেদিন এ কথা জেনেছে, সেদিন থেকে? জানে না। বরং বুড়ো হয়ে যাচ্ছে রাইচাঁদ। যা কখনো হয়নি সে হচ্ছে আজকাল। অনেক্ষণ বাজালে তার কাঁধে ব্যথা হচ্ছে। কিন্তু আসল কাজ তো হল না। কবে হবে? কবে?
          আজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে রাই। বৃথা এই চেষ্টা। আমাকে তুমি দেবে না, আমিও তোমাকে দেব না আর। আজ থেকে ঠাকুরকে আর বাজিয়ে শোনাবে না। বাদ। ঠাকুরঘরে যাবে না। সেই কবে কোন বালক বয়স থেকে সে বাজায়। নিজেই শিখেছে। নদীয়া থেকে এসেছিল গোপাল গোস্বামী। তার বাজনা শুনেই পাগল হয়েছিল রাই। তার পিছু পিছু ঘুরে সে শিখেছে। তখন বাবা ছিলেন। কী করে নদীয়া থেকেই আনিয়ে দেন শ্রীখোল। দুটো। একটা বালক রাইয়ের জন্য। আরেকটা রাই যখন বড় হয়ে যাবে, তার জন্য। বাবা কী করে জেনেছিলেন, রাইয়ের ভাগ্য বাঁধা হয়ে গেল এই শ্রীখোলের সঙ্গে! তখন, যখন তখন বাবা বলতেন, ‘বাবা এট্টু বাজাইয়া শোনা’কোনো গান নেই, কিছু না। কেবল শ্রীখোল। সেই বাজনা শুনেই বাবার চোখে অবিরল নেমে আসত অশ্রু। কৈশোরে দীক্ষা হল। কণ্ঠীধারণ কল রাই। বাবরি চুল হল। আর পৃথিবী থেকে উবে গেল রাইচাঁদ। এ আরেকজন রাই। সে কেবল নারী হতে চায়। একবার মাত্র গোপালজীকে দুধ খাইয়ে মরে গেলেও কিছু যায় আসে না। কিন্তু একথা জানেন গোপালজী আর জানে রাই। পৃথিবী জানে না।  কোনো নারীর কোলে শিশু দেখলে হা-হা করে কোলে তুলে নেয়লুকিয়ে তার মুখটি চেপে ধরে নিজের অস্পষ্ট স্তনের ওপর। একপ্রকার পুলক ঘিরে ধরে তখন। একটু পরেই সে মিথ্যা হয়ে যায়। মিথ্যা মনে হয়। ঠাকুর ঘরে যায় সে, আর একই প্রশ্ন, ‘কবে ঠাকুর, কবে’, কবে আর?’
          আজ পূর্ণিমার কাজ ছিল। লম্বা  আসর হল কীর্তনের। বটতলায়। গ্রামের সকলে এল। বাইরে থেকেও অনেকে এসেছে। কিন্তু কিছুতেই বাজাতে রাজি হল না রাইচাঁদ। শেষে বাবুলের মা এসে বলে, ‘তুমি না বাজাইলে তো আমার কান্দন আইতো না বাপ। আমি আমার বাবুলরে তোমার বাজনার তালে তালে হামা দিতে দেখি। বাবুল তো বাজনা অইয়া গেছে।‘ মন ভিজে গেল রাইয়ের। তুলে নেয় শ্রীখোল। ‘মাথুর হোক’ আদেশ করে সে। দূর বনকর থেকে এসেছে একটা অতিথি কীর্তনিয়ার দল। আসলে রাইচাঁদের বাজনার ভক্ত দূর দূর জায়গার দলগুলি। তারা একবার অন্তত রাইকে শুনিয়ে নিতে চায় তাদের কীর্তনঅথবা, তারা ভাবে রাইয়ের সঙ্গে না গাইতে পারলে গেয়ে কী লাভ।
          বটতলার নাটমন্দিরে এখন মাথুর চলছে। এই দলের মালিক শম্ভু শর্মা। আসলে ব্রাহ্মণখোদ নবদ্বীপ থেকে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে এনেছেন। বউটির কী মধুর কণ্ঠ! কী শিক্ষিত। কী উচ্চারণ! প্রথমে গোবিন্দবন্দনা করে শ্লোক বলল ওই মধুক্ষরা কণ্ঠে। কী ভক্তি! এবার...শ্রীরাধিকা অমঙ্গল ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন। তাঁর দক্ষিণ নয়ন নাচে। কুলক্ষণ। পাখিরা কাঁদছে। ওদিকে যাত্রামন্ত্র গাওয়া হচ্ছে। শ্রীহরি ছেড়ে যাচ্ছেন। নিশ্চিত। এত সম্ভ্রান্ত গায়কী পেয়ে রাইচাঁদ ভরে ভরে যাচ্ছে। অক্রূরকে রাধিকা বলছেন,  ‘নিয়ো না, নিয়ো না পরাণবল্লভকে...’ ‘কোথা যাও, কোথা যাও, কোথা যাও হে পরাণ রাখাল, মুখ তুলে চাহ চাহ চাহ একবার... আবার দেখা হয় না না হয়... পরাণখানি যায় না ছেড়ে... তুমি না বলেছিলে ব্রজ ছেড়ে যাবে না’‘আমি আজ যাব কাল আসব ফিরে, মথুরা নয় বহু দূরে, দাও গো আমার পথ ছেড়ে’ বলে শ্রীগোবিন্দ আশ্বস্ত করছেন...
          আজ রাইচাঁদ এ কী বাজাচ্ছে! এদিকে মাঝে মাঝে সংস্কৃত শ্লোক বলছে শম্ভু শর্মার পুত্রবধূ এই হল আসল জিনিস। মানুষ কান্না ভুলে গেল, নাকি কান্না এখন আরো গভীরে চলে গিয়েছে? পালার পর্বে পর্বে পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে রাগ। পাল্টে যাচ্ছে সুর। ভাব। আমাদের রাইচাঁদও কোথা হতে সোনা এনে জুড়ে দিচ্ছে বাজনায়। আবার কখনো মনে হচ্ছে বাজনায় সে মেখে দিচ্ছে মহার্ঘ চন্দন। সকলকে অবাক করে দিয়ে বউটি গান থামিয়ে এসে রাইচাঁদের গলায় নিজের পুষ্পমালাটি পরিয়ে দিল। বিনিময়ে রাই তাকে আলিঙ্গন করে, নমস্কার জানায়না, মাথা নুইয়ে নয়। বাজিয়ে। তাতে বউটির ভাব আরও গভীর হল। শ্রীগোবিন্দের রথ চলে গিয়েছে দৃষ্টির বাইরে। এখন আর ধূলাও দেখা যাচ্ছে না। এখন শ্রীরাধিকা বান্ধবশূন্য হলেন। সখীকে ডেকে বলছেন, ‘এতদিনে বান্ধবশূন্য হলাম। এখন যাইতে যমুনার জলে তমালের নীচে সে আর জ্বালাবে না। সেই সুমধুর জ্বালাতন আর কে করবে’?
          একমসয় শেষ হল পালাএবার কাঁদছে সকলে। মনেহয় বৃক্ষটিও কেঁদে নিয়েছে। তার অযুত পাতায় পাতায় জোছনা। এ আবার আরেক আনন্দ ছড়িয়ে আছে গাছের পাতায়, পাতায়। একটা অন্যরকম বটবৃক্ষের মতন নাটমন্দিরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে রাইচাঁদ। কাঁপছে। আজকে প্রথমবারের মতন শ্রীবিগ্রহের সামনে অন্যসকল মানুষকে প্রণাম করল বাবুলের মা। বয়সের ব্যবধান রাখল না। আর ওই সুমধুর সংগীতের জননী, শম্ভু শর্মার পুত্রবধূ গলবস্ত্র হয়ে পাশে রাখা শ্রীখোলকে প্রণাম করল। কণ্ঠ হতে বহুমূল্য সোনার হারখানি খুলে শ্রীখোলের উপর রাখল। কৃষ্ণ কৃষ্ণ হে, কৃষ্ণ কেশব হে... আজকের আসর শেষ হল। সকলে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। আবার, আবার প্রণাম করে। সাষ্টাঙ্গ হয় যুগল বিগ্রহের সামনে। আর স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে রাই। আজ যেন সে নেই এইখানে। ভেতর থেকে কে যেন শুষে নিচ্ছে তাকে, কিংবা কী একটা যেন প্রবেশ করছে শরীরে। আনন্দ? নাকি কী একটা পুলক? একে একে বাড়ির দিকে রওনা হয় সবাই। শম্ভু শর্মার দল একটু দূরে থাকবে শহরে। তাদের গাড়িও চলে যায়।
          একটু এগিয়ে গেলে একটা তমাল গাছ। প্রাচীন গ্রাম। এখানে কেউ উদ্‌বাস্তু নয়। মহারাজের আমল থেকে এ গ্রাম বৈষ্ণব। মণিপুর থেকে  মহারাজের কোন এক আত্মীয় এসে এই গ্রাম প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। কবে কোন সনে কেউ জানে না। এই তমাল তরু সেই লোকের লাগানো। রাইচাঁদ একা বাড়ি ফেরার সময় তমালকে শাসায়, হয় আজগা, নইলে নাই।
          আজ আর ঠাকুরঘরে যায় না রাই। একবার নিয়মরক্ষার নিদ্রা দিয়ে আসে। কয়েকটা করবী গোটা এনে হামানদিস্তায় ছেঁচে নেয়। পেতলের সেই ঘটিতে দুধের সঙ্গে মেশায়। আজ হয় হবে, নাহলে বিদায়। শুধু তখন, যখন এ প্রাণ ছেড়ে যাবে, একবার এসে শিয়রে দাঁড়িও ঠাকুর। ঘটিতে দুধ ধীরে নীলবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। রাইচাঁদ ধূপ জ্বালিয়ে দেয় ঘরে। জানালা খুলে দিলে দূর আকাশের আলো এসে তার মেঝেতে খেলা করে। একটা কী পাতা বাতাসে নাচছে। তার দোলনের ছায়া এসে ঘরের মেঝেকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলছে। একটু জিরিয়ে নেবে ভাবে রাই। তারপর ওই দুধ খেয়ে শুয়ে পড়বে যা হোক হবে...
          পূর্ণিমার চাঁদ কখন সরে গিয়েছে। কেমন আধো অন্ধকার হয়েছে ঘর। কোন ফাঁকে ঘুম এসে গেল রাইয়ের। তার মুখের পেলবতা আরেকটা জোছনা তৈরি করেছে। কেমন একটা হাসি শুয়ে আছে রাইয়ের মুখে। বুকে একটা চাপ চাপ আরাম। একটু কি ব্যথা? যন্ত্রণা? মাঝে মাঝে কেমন পুলকবেদনার চিহ্ন ফুটে উঠেছে তার চোখেমুখে।  কখনো মুচকি হাসছে। কখনো ভ্রূ কুঁচকে যাচ্ছে তার। ত্বরিতে উঠে দাঁড়ায়। তার বুক দুটো ভরভরন্ত স্তন। টনটন করছে। রাই বুঝতে পারে স্তনে দুধ এসেছে। এসে চাপ দিচ্ছে তাকে। তার আবাল্যসাধনা আজ পূর্ণ হল। ছুটে ঠাকুরঘরে যায়। আজ কপাট লাগাতেও ভুলে গিয়েছিল। অসময়ে নিদ্রা থেকে তোলে গোপালজীকে। চেপে ধরে তাঁর ঠোঁট ওই সদ্য জাগা স্তনের বোঁটায়। অজ্ঞান হয়ে যায়। আবার জ্ঞান ফিরে আসে। আবার অজ্ঞান হয়। বারবার সে গোপালজীকে খোঁজে। রুপার তৈরি গোপালঠাকুর তো দুধ খেতে জানেন না মনে হয়।  ওই তো, কে ও? বাবুল, হামা দিয়ে আসছে? সে এসে স্তনের বোঁটায় মুখ লাগায়? অসহ্য চাপ কমে যাচ্ছে এবার। কী সুখ, কী সুখ! কুট করে কামড়ে দেয় বাবুল। জ্ঞান ফিরে আসে রাইয়ের। শিয়রের কাছে পেতলের ঘটি। তাতে বিষ হয়ে যাওয়া দুধ। রাই নেশাগ্রস্তের মতন হাঁটে। উঠোনের এককোণে একটু জোছনা। রাইচাঁদ উপুড় করে দেয় সেই  ঘটি।

প্রকাশিত : উৎসারণ পূজা সংখ্যা, ২০১১
(একটি বই পড়লাম। অ্যামাজনের এফিলিয়েটেড) 






বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৭

কন্যাতীরে

অশোক দেব
কন্যাতীরে

এক.
এক দেশে এক গ্রাম ছিল। দেশটা কি ছিল? ছিল কি ছিল না, গ্রামের মানুষ জানতো না। কিন্তু গ্রামটা যে আছে তারা বোঝে। মানে, তখনও বুঝতো, এখনও বোঝে। সেই গ্রামের ধারে একটা নদী ছিল। তার নাম কন্যা। তবে, সকলেই তাকে নিজনিজ কন্যার নামে ডাকতো কেউ ইচ্ছে করলে কন্যাকে নিজের পুত্রের নামেও ডাকতে পারতো। কন্যা মানা করতো না। কিছু মনেও করতো না। নদীর পরে ছিল মাঠ। অনেক দূরের মাঠ। এদের কারণেই কন্যাতীরের ওই গ্রামকে সকলে গ্রাম বলতো। সেই গ্রামে সকলেই দরিদ্র। কেননা, তাই থাকতে হয়। তাছাড়া গ্রামের মানুষগুলি মধ্যবিত্ত হতে চায় না। মধ্যবিত্ত না হলে কী করে ধনী হবে! ওরা তাই ধনী হয়নি। মাঝারি হলে কী জ্বালা সেটা ওরা নকুল ডাক্তারকে দেখে বুঝেছিল। নকুল ডাক্তার হোমিওপ্যাথি পারেন।  অ্যালোপ্যাথিও জানেন কিছুটা। ছুরিকাঁচি সেদ্ধ করে ফোঁড়াও কেটে ফেলতে পারেন। আবার অকালপোয়াতির পেটে কী একটা ঢুকিয়ে দিয়ে কুঁড়ে কুঁড়ে বাচ্চাও কেটে আনতে জানেন। এসব কাজ গ্রামের জন্য নয়। শহরের জন্য। কোথা হতে যে এরা পেটের বাচ্চা খুবলে আনতে আসে!
          গ্রামের যেকোনও মানুষকে নকুলডাক্তার রোগী ভাবেন। হারামজাদা, শালারপুত বলে পুরুষদের গালি দেন। মহিলাদের বলেন শালীর শালী। রাস্তায় কাউকে দেখলেই, আরে হারামজাদা, তোর তো এমনই হবে। কালকে আসবি চেম্বারে। দেখে দেব। মোরগ আছে? এমন বললেই হল। যে চেম্বারে যায়নি, তার বিপদ। মোরগ হলে মোরগ, টাকা হলে টাকা। কারণ, পরের দিন চেম্বারে না গিয়ে রসিক মরেছিল সত্য। তখন সে খেজুর গাছের সঙ্গে কথা বলছিল। আর গাছের গলা চাঁছছিলো। রসিকের নামটা সার্থক। তার রসের কারবার। সে খেজুর গাছের গলা চেঁছে দেয়। মরা গাছের থেকেও রস বের করে আনে হেমন্তে, শীতে। তো, সেদিন গাছ চাঁছার সময় তার বুকে একটা কুত্তা ঢুকে পড়ে। বুকের ভেতর কোথাও একটা ঘ্যাঁত করে কামড় দেয়। কোমরে দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে রসিক নিজেকে বেঁধে রেখেছিল। গাছে আড়াআড়ি করে বাঁধা একটা বাঁশের পা-দান ছিল । তার ওপরেই দাঁড়ানো ছিল রসিকের শরীর। রসের কারবারিদের যেমন থাকে। কোমরে দুলছিল একটা তূণের মতন খাঁচা। তাতে নানারকম দা, ছেনি। অন্যদিকে একটা কাঠের ছোট আঁকশি, তাতে ঝোলানো ছিল একটা মাটির কলসি। দা রইলো। ছেনি রইলো। দড়িতে বাঁধা রসিক রইলো। খেজুর গাছটাও রইলো। মৃদু মৃদু বাতাসে খেজুরের লম্বা পাতা সবটা দুলছিলো তেমনি কাঁপছিলো একটা একটা  আলদা পাতাও। এসব রইলো। সব রইলো। শুধু রসিকের প্রাণটা উড়ে গেলো। রসিকের নানা রঙ্গ করার দোষ ছিলো। সে লোককে ডেকে বলতো, রস নেবে, মাগনা? ঘটি নিয়ে এসো। কেউ এলে সে কলসি উপুড় করে দিতো। আসলে কলসিতে রসই নেই। তারপর খ্যা খ্যা করে হাসতো। সাপে খেলো, সাপে খেলো বলে সে সুন্দরীর বাড়ির উঠানে গিয়ে আর্তনাদ করতো অন্ধকারে। ঘর হতে আলো নিয়ে সুন্দরী ছুটে আসতো যেকোনও সুন্দরী। কাছে এলে রসিক ফু দিয়ে বাতি নিভিয়ে সুন্দরীর বুক টিপে দিতো। পরে বলতো, আরাম হল?। এই করে রসিক হাল্কা করেছে নিজেকে। তবু, সে যতবার সাপে খেলো বলেছে, সুন্দরী এসেছে। তবু, সে যতবার রস নেবে গো, মাগনা বলে ডেকেছে, লোকে ঘটি নিয়ে এসেছে। কারণ, রসিকের গোপনে একটা রসিক বড়ই সত্য। একা একা সে পারে না। একটা কিছু রান্না হলে সে জনে জনে ডেকে খাওয়ায়। বীজধানের যত্ন তার মত কে আর জেনেছে! যার বীজ থাকে না, তার রসিক আছে। ফলে রসিকের ব্যাপার অনেকটা বিশ্বাস কিছুটা অবিশ্বাস। সেদিন, সেই রসিক কোমরের দড়ির বাঁধনে আটকে ছিলো খেজুর গাছে। কোমর থেকে উল্টে তার বুক থেকে মাথা পর্যন্ত ঝুলছিলো নীচের দিকে। পা হড়কে গেছে বাঁশের পা-দান থেকে। এখন গাছ মাঝখানে রেখে পা দুটি দুদিকে। অনেকে দেখলো। কেউ কেউ বলল, হেই রসিক, এটা আবার কোন্‌ সার্কাস, মাথায় রক্ত উঠে গেলে টের পাবি। কেউ বলল,  কি রে, রসে কি আজকাল মদের নেশা? রসিক ছিলো। তার প্রাণ ছিল না। ফলে একরাত ঝুলে থেকেও সে কিছু বলতে পারলো না। পরের দিন বিকালে রসিকের বউয়ের কান্নায় অনেকে এসে নামিয়ে আনে তাকে। তখনও কেউ যেন বলল, লাথি মার, ঢং ছেড়ে যাবে। কেবল, নাড়ি টিপে দেখলেন নকুল ডাক্তার। বলে দিলেন, বলেছিলাম চেম্বারে যাস, গেলো না। নাই রসিক যে রসিক ফু দিয়ে বাতি নেভাতো, তার জন্য সন্ধ্যাবাতি দিল না কন্যাতীরের সুন্দরীরা। দুইদিন।

          এইসব কারণে, হাসিখুশি মানুষকে চেম্বারে যেতে বলে বলে, কন্যাতীরে একমাত্র নকুলডাক্তার হয়ে গেলেন মধ্যবিত্ত। দূর দেশ হতে কুমারী মেয়েদের পেট খালাস করতে ধনীরা আসে। নকুল ডাক্তার সেইসব ধনীর সামনে আর্দালির মতন কিঁউ কিঁউ করেন। আর গ্রামের মানুষকে বলেন, হারামজাদা আর শালীর শালী। এইরকম আর কেউ হতে চায় না গ্রামে। ফলে, কেউ আর চায় না ধনী হতে। কারণ, পুরো ধনী হবার আগে একবার নকুল ডাক্তার হতে লাগে।
দুই.
এই নকুল ডাক্তার সদানন্দের বাবা হন। তিনি সদাকে সত্যকার ডাক্তার বানাতে শহরে রেখে পড়ান। সদানন্দও একটা গুল্লি। তার মতন একটা মাথাওলা ছেলে নাই। কন্যাতীরের মানুষের বিশ্বাস, এমন ছেলে দেশেই নাই। নকুল ডাক্তার মনে করেন, পৃথিবীতে নাই। সেই সদানন্দ একদিন ডাক্তার হয়ে ফিরে আসে। মহকুমার হাসপাতালে তার চাকরি আর বাবার চেম্বারে ব্যবসা। বাবা টিপেটুপে ওষুধ দিতো। সদা প্রেসার মাপে। কানে লতি লাগিয়ে বুকের খবর নেয়। মানুষকে সে হারামজাদা বলে না। কাকা-জেডা, ভাই-দাদা বলে। মহিলাদেরও কাকি-মাসি, দিদি-বোন বলে। সে মোরগ নেয় না। টাকা নেয়। দিলেও আচ্ছা, না দিলেও আচ্ছা। সে আবার গান গায়। একদিন নকুল ডাক্তার ধনী হয়ে গেলেন। দক্ষিণে মুখ করে তাঁর ইয়া বড় দোতলা দাঁড়ালো। পুকুরের দিকে মুখ। আবার রাস্তার দিকেও। সদাকে কেউ সদাডাক্তার বলে না। বলে ডাক্তার সদা। বাড়ি হয়ে গেলে সদার বিয়ে হয়ে গেলো। বউভাতে গ্রামের মানুষকে নিমন্ত্রণ করা হল না। দূর দূর থেকে গাড়ি ভরে ভরে মানুষ এলো। জগতে এত কিসিমের গাড়ি আছে? মানুষের এত সুন্দর সুন্দর বাচ্চা আছে? ওরা কন্যাতীরে খেলল। হেসেছিলো তারা। যা দেখছিলো, তাতেই অবাক হচ্ছিলো। এমনকি গোরু ছুঁয়ে দেখছিলো। সকল গাছের কাছে যাচ্ছিল।গ্রামের হাওয়াকে পেতে দিচ্ছিলো মুখমণ্ডল। গ্রামের মানুষ তাদের দেখেছিল। কিন্তু কেউ নকুল ডাক্তারের বাড়ির দিকে যায়নি। বিস্ময় হল পরের দিন। একটা কেমন গাড়িতে করে সদানন্দ বেরোল। তেমন তো রাস্তা নেই, কিন্তু গাড়িটা চলে যাচ্ছিল সকলের বাড়িতে। মাঠ দিয়ে নাচতে নাচতে, রাস্তায় থমকে থমকে, হেলতে দুলতে। প্রথমে ডাক্তার সদা গেলো শচীজেঠার বাড়িতে। পৃথিবীতে এই ঘটনা প্রথম। সদানন্দ গিয়ে গ্রামের প্রতিটি মানুষকে প্রণাম করছিল। সকলকে আগামী বুধবার নিজের বউভাতে নিমন্ত্রণ করছিল। নতুন বউ নিয়ে কেউ কি আসে ঘরের দাওয়ায়? এখন, কেউ হাতের লোহাটাই খুলে বৌমাকে দেয়, কেউ চারটে বেগুন পেড়ে আনে, কেউ আসন হতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার এনে হাতে তুলে দিতে যায়। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে সারা মাস এক মুষ্টি করে চাল রাখা। বউটা হাসে। মুসলমান নাকি? সবকিছুকে বলে ফানি ফানি। আর তার সাথে ওই একটা ছোকড়া সাধু। গেরুয়া পরা। কী স্টাইল। বউটা তার সঙ্গেই লেপটে থাকে বেশি। লাজ নাই।


     সেই বুধবার গ্রামের সকলে গিয়ে উপচে পড়ে নকুল ডাক্তারের বাড়ির ইয়া বড় উঠানে।আগের দিনের কিছু ভাঙা হয়নি। আগে যেমন টেবিলচেয়ারে খাওয়াদাওয়া, সেই টেবিল চেয়ার রইলো। খাবার দিলো শহর থেকে আসা কিছু স্যার-স্যার চেহারার ছোকড়া। সেই থেকে নকুল ডাক্তার আর কাউকে চেম্বারে যেতে বলে না। কাউকে হারামাজাদা, শালীর শালী বলে না। নকুল ডাক্তার বাড়ি থেকে বেরোন না।
তিন.
এক দেশে এক গ্রাম ছিল। গ্রামে বাস করত এক ডাক্তার। ডাক্তার সদানন্দ দাশগুপ্ত। সদানন্দের বিবাহ হয়েছে চার বছর। সদানন্দ নিজেকে ডাক্তার কম, কবি বেশি মনে করে। সদানন্দ গান গায়। গ্রামের মানুষের মতই সে আদাড়বাদাড় ঘোরে। ডাক্তারি করে দূরে মহকুমা শহরে। সেটা সেরে সে আর ডাক্তার থাকে না। চলে যায় শীতলাতলায়। তাস খেলে। আর সন্ধ্যাবেলা দাঁড়িয়ে গান গায়। ডাক্তার সদানন্দ বিজলি বাতি এনেছে। কৃষিকাজ যে এগ্রিকালচার, সেটা তার আগে কে জেনেছে? কৃষিকাজ দেখভালের জন্যেও সরকারি বাবু আছে, কে আগে জেনেছে? সদানন্দ মাঠে গিয়ে নামে। নকুল ডাক্তার জমি তো কম করেনি। সে জমিতে পুকুর করেছে সদানন্দ। হাজারটা হাঁস, মোরগ। মৌমাছি যে এমন বাক্সে করে পোষ মানানো যায়, সেটাও কি কেউ জানে? সদানন্দ পারটিলা এনেছে। পাওয়ার টিলার। গ্রামের ছেলেরা সেসব বেশ চালাতে জানে। গ্রামে সবার বাড়িতে একটা করে পায়খানা হল। পাকা। সদানন্দ কী করেছে, সরকারই দিল খরচাপাতি। এখন ডাক্তার সদানন্দ যা বলে তাই নিয়ম। আর কী তার গানের গলা! কেমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে গান বাঁধে। লহমায়। শীতল সরকার যে এত বড় কবি, সে-ও এসে একবার লড়ে গেলো তার সাথে। হেরে গেলো। লবকুশ সহ সীতামাকে বনে দিয়ে আসাটা রামের সত্যি ঠিক হয়নি। সদানন্দ স্পষ্ট করে গেয়ে দিল সেই কথা। শীতল সরকার হার মানলো।
          কিন্তু ডাক্তার সদানন্দ তো ওই কন্যাতীরে গিয়ে বসে থাকে একা। দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। বিকালে কে না দেখেছে সদানন্দ মাঠ পেরিয়ে কোথায় চলে যায়! ওই বনে বাঘভাল্লুক নেই, কিন্তু সাপের তো অভাব নেই, না? সদা যায় কোথায়? সদানন্দ আসলে কেমন! তার বউ থাকে কই জানি। শনিবার আসে, রবিবার থাকে সোমবার যায়। কই যায়?
 ইংরেজি ঝগড়াগুলো বাংলার থেকে নিষ্ঠুর
সদাবউ ইংরাজিতে সদাকে গালি দেয়
সদানন্দ নীরব থাকে
সদাবউ কেবল বলে, হেল হেল... হেল...
পারুলের মা বোঝে হেল হল একটা অভিশাপ
। হয় এই অভিশাপটা সদাবাবা বউকে দিয়েছে, নাহয় বউ সদানন্দকে দেয়, প্রতিদিন। আর ওই ছোকড়া গুরুটা মিটি মিটি হাসে। তার যে কী গুরুগিরি কেউ জানে না। কী যে তার ধর্ম! গিটার বাজিয়ে কীর্তন করে সে। তাতে না আসে ভক্তি, না আসে ভাব। ওইটুকুন গুরু, সদাকে বলে, বাবা যেনো সদানন্দ তার ছেলে।  সদা চোখমুখ দিয়ে তাকে অস্বীকার করে।
          পারুলের সময় পারুলের মায়ের সূতিকা হল। নকুল ডাক্তার বাঁচালেন। সেই থেকে এই বাড়িতে সারাদিন থাকে পারুলের মা। খেটে দেয়। খেতে পায়। রাতে কেবল নিজের ঘরে যায়। স্বামী মরে গেলে আর যায়ই না। পারুল একদিন পালিয়ে গিয়েছিল নারুর সাথে। এখন থাকে অনেক দূরে। এখন এ বাড়িই পারুলের মা-র বাড়ি। সে জানে, ডাক্তার সদানন্দ আসলে হেরেছে। একদিন সাহস হল তার। শত হলেও সদানন্দ তার সন্তান। সদা এলো আর তার মা মরলো। পারুলের মা-ই তো সব করলো। সেই টানে সাহস হল তার। গুরুর ঘরে ঢুকে গেলো পারুলের মা। গুরুকে গিয়ে সোজা বলে,
    বাবু তোমার বয়স কত?
    তোমার কী চাই মা?
    চাই টাই না, বয়স কত বল?
    সে দিয়ে তোমার কী হবে, বল তো...
    তুমি আমার সদাবাবারে মুক্তি দাও, ওইটুকুন ছেলে...
    মুক্তি? মুক্তির জন্যই তো এতকিছু
          বউটা তখনও তার কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল। গুরুটার লম্বা দাড়ি। তার একটাকে আঙুলে পাকাচ্ছিল সদাবউ। মাঝে মাঝে টান মেরে ব্যথা দিচ্ছিল গুরুকে। ব্যথা পেলেই ওই গুরুটা খানকির মত চোখ করে হাসছিল। আর কোথাও, কী করে যেনো, গোপনে, বউকে চিমটি কাটছিল। বউটাও ঝিনকি তুলছিল। পানের পিক, পানের ছাবা, খয়েরের কালো আর পুরাতন বৈধব্য এক করে পারুলের মা ঘরের মাঝখানে ছিটিয়ে দিলো। সব ভেঙে গেলো তারপর।
চার.
ভেঙে গেলে মানুষ বনে চলে যায়। কন্যা পেরিয়ে এসে সদানন্দ এই বনে চলে আসে। এর আগে অনেক মানুষ এসেছে। মানুষকে দু পায়ে দাঁড় করানোর আগে পৃথিবী পথ কাকে বলে জানতো না। এখন যত ঘন বনই হোক পৃথিবী নিজে পথের সম্ভাবনা সাজিয়ে রাখে। সদানন্দ সেইরকম একটি পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে। সে যত এগোয়, তার ভাঙা ভাঙা জিনিসগুলো তত তাকে ছেড়ে ফিরে চলে যায়। যেতে যেতে যেতে, হেঁটে হেঁটে, সদানন্দের তৃষ্ণা পেল। অনেক দূর হাঁটলে পরে মানুষের তৃষ্ণা পায়। বাতাসের শীতলতায় সদানন্দ বোঝে কাছেই কোথাও জল আছে। ঝোপ সরিয়ে সদানন্দ দেখে এইসব ভেঙে যাওয়া সত্য নয়। ওই ঝিলটা সত্য। এটাই হয়তো এই বনের নাভি। জলনাভি। সদা কাছে যায়। জল খিলখিল করে ওঠে। ঝিলের পাড়ে একটা গাছ। বৃক্ষ। সব পাতা যেনো কারও আধবোজা চোখ। সদা আঁজলা ভরে জল খায়।
    কিছু কি ভেঙেছে তোমার?
সদা গা করে না। এ ঘোর জঙ্গলে কে আর কথা বলবে এমন সুরেলা কণ্ঠে? সদার বিভ্রম হচ্ছে। সে আরেকবার জল নেয় আঁজলা ভরে।
    কে তোমায় বিদ্রূপ করে?
    কে কে?
এবার সদানন্দ সচকিত হয়। বউ তাকে গাইঁয়া বলে। মধ্যবিত্ত বলে। বিয়ের মানে বোঝে না বলে। বলে সদানন্দ চাষাড়ে। বলে ভূত, পাগলছাগল। সদানন্দ সত্যিই চমকে যায়, কে তুমি?

          হস্তিনী আসবে টের পেলে যেমন ছোট প্রাণীরা সরে যায়, তেমনি সরে গেল সন্ধ্যা। দূরে ওই গাছের নীচে গিয়ে গুটিসুটি বসলো। স্পষ্ট দেখতে পেয়ে সদানন্দ ভয় পায়। আবার ভয় পাচ্ছে জেনে তার নিজেকে হাস্যকর মনে হল। এমনি এক সন্ধ্যায় সে এক মায়াবী মেয়েমানুষকে কবিতা পড়ে শুনিয়েছিল শহরের সবচেয়ে নির্জন নদীপাড়ে। এমন সন্ধ্যাগুলিতেই পৃথিবীতে মেয়েরা কবিদের প্রেরণা আর বিষ পাঠায়। বলেছিল সে। সেইসব মনে হয়।মনে হতেই ঝিলের মাঝখানের জল কেমন একটা ঘূর্ণির মতন ওপরে উঠে গেলো। সেটা স্থির হলে উঠে এলো এক নারী। না, সোনার মুকুট নেই, তেমন কিছু সাজ নেই। কেবল ওই একটি হাসি আছে
। শান্ত জলে ঢিল পড়লে যেমন জল সরে যায়, তেমনি সন্ধ্যাকাল সরে যাচ্ছিলো আরও দূরে। আর ওই নারীর শরীর হতে একটা সুগন্ধি আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিলো।
    তোমার কী ভেঙেছে?
    কেন?
    বল
    তুমি কে?
    আমি তোমার নুনুদিদি
    না।ও তো বিচ্ছিরি ছিল
    থাক তবে, আমি শিবু পাটোয়ারি
    সে তো পুরুষমানুষ ছিল
    ও, আমি রসিক, আমি দিলীপ নাগ, আমি শ্যামলতনু
    এই এই, বেছে বেছে এদের নাম নিচ্ছ কেন? কে তুমি?
    আমি হাঁটি। পথে পথে। ঘরে ঘরে যাই। যাদের সকল ভাঙে, যারা সকলের কাছে হেয় হয় তাদের ঘরে যাই।  হেয় হতে হতে গাছের কাছে গিয়ে নালিশ করে যে, আমি সেই রসিকের কাছে যাই। শ্যামলতনুর কাছে যাই। সে রাতের পর রাত চেষ্টা করে একটা গান বাঁধতে পারে না।আমি দিলীপ নাগের কাছে যাই। সে আর আগের মতন পট আঁকতে পারে না। লক্ষ্মী এঁকে নিজেই নিজের আঁকা পটকে বেশ্যা বলে গালি দেয়। আমি তার কাছে যাই। এরা অকারণ ভেঙে যায়। বছরের পর বছর রোগে ভুগে ভুগে যখন নুনু আর পারে না, তার কাছে আমি যাই। সে-ও ভেঙে যায়। ভাঙা মানুষ জোড়া লাগাতে সময় নেই কারও। এমনকি, নিজেকে সবটা দিতে চেয়ে নেবার লোক পায় না বলে অনেকে ভেঙে যায়। তাদের কাছে যাই আমি। তুমি তো নিজে চলে এলে...
    আমি তো তোমার কাছে আসিনি
    আমার কাছেই এসেছো। এতকাল চেষ্টা করেছো, আসতে পারোনি আজ এসে গেলে... চলো
    কোথায়?

          গাছের নীচে জমাটবাঁধা সন্ধ্যা ছুটে এসে সদাকে কী দিয়ে মুছিয়ে দিলো। শীতল শীতল। সারা গায়ে কেমন আনন্দ। সামনে ওই রহস্যময়ী নারী, সদানন্দ তার পিছু পিছু যায়। যেতে বাধ্য হয়। একটা বিদেশি গমক্ষেত। সোনালি হলুদ। তার আকাশে কয়েকটা উড়ন্ত কালো কাক স্থির হয়ে আছে। এ গমক্ষেত সত্য নয়। কে যেন এঁকেছে। একটা এঁকে রাখা হাওয়াকলের নীচে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লো একটা লোক। তার এক কান কাটা। তাতে ব্যান্ডেজ।সদানন্দ হাত নাড়াতে যায়, চেয়ে  দেখে লোকটা নেই। গমক্ষেত, কাক সেসব কিছু নেই। উল্টে কারা যেন একটা ট্রামলাইন পেতে দিল। আকাশ হতে ঝুলতে লাগল বাসি সব ডিমের বড়া। ট্রামলাইন দিয়ে পেছনে ঘা নিয়ে ছুটে আসছে একটা ষাঁড়, নাকি ট্রামই? একটা লোক গোঁয়ারের মত মাথা নিচু করে তার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। আর এদের সকলকেই ঠেলে দিচ্ছে গিটার হাতে একদল তরুণ গুরু। তাদের দাড়ির থেকে ঝুলছে ছোট ছোট বিদ্রূপাত্মক গান। দূরে কারা যেন লালনীল শাড়ি শুকোতে দিয়েছিল... সেসব এখান সাদাকালো দেখাচ্ছে... কে একটা লোক সিনেমার ক্যামেরার পেছনে বসে সিগারেট খাচ্ছিলো...

(প্রকাশিতঃ যাপন কথা)