রবিবার, ৬ আগস্ট, ২০১৭

সদাপুরাণ -২৩



অশোক দেব
সদাপুরাণ -২৩

নীচে ঢেউয়ের প্ররোচনা থাকতে হয়। নইলে মরে যায় বেঁধে রাখা নৌকা
োমতী এখন হীনতোয়া হয়েছে। মহারানি ব্যারেজ থেকে বিকেলের দিকে একটু জল দেয়। সেই জলে গোমতীর না সাজ হয়, না বাহার। ঘাটে গপিস্টের নৌকা। বাঁধা। বহুকাল। মাঝে মাঝে তাঁর হাছনরাজা হবার শখ চাপতো। নৌকায় দিন কাটাতেন। রাতই কাটাতেন বেশি জোছনার রাত। গানবাজনা হত। সঙ্গে চলতো তাঁর গপের আসর। সত্যই বলতেন, নাকি বানিয়ে, বোঝার উপায় নেই। এখন আর হাছনরাজা হওয়া হয় নাএকটু গিয়েই বালিতে আটকে যায় নৌকা।বহুদিন পরে আজ তাঁর শখ হল। যাহোক একটু নৌকাভ্রমণ করতে চান খাওয়াদাওয়ার বিশাল আয়োজন নৌকায় তোলা হবে। সকাল থেকেই রান্নাঘর সরগরম। আর এইদিকে ওই মোরগ নিয়ে লেগেছে ধুন্ধুমার। শান্তি বণিক ব্রয়লার ফার্ম করেছে। সে কয়েকটা মোরগ নিয়ে এসেছে। আজ বিক্রি করবার সুযোগ।
- ইডি কি রাতা মোরগ?
- একদম। রাতা মোরগ। মুরগি না।
- রাতা অইলে বেডাগিরি কই?
- আরে জেডা, এই রাতা হেই রাতা না
- তইলে ইডি কী রাতা?
- এই মুরগা হিতা করে না। কেবল মাংসের লিগ্যা পালি
- কিতা করে না?
- আমনে বুজি বোজেন না? রাতি মুরগীর কাছে যায় না
- হিজড়া?
- ধুর বেচতাম না
আমনের কাছে বেচতাম না মুরগা
- এই হুন, কই থিকা আনছস এই বালমার্কা মুরগা?
শান্তির মুখ কালো হয়ে যায়। সে কী করবে বুঝতে পারে না। ওইদিকে মহা ধুমধাম। নৌকা সাজাতে হবে। একটা বড়সড় বাদামবিহীন নৌকা এটা। ওপরে শামিয়ানা টাঙানো হয়।অস্থায়ী একটা ঘরের মতন বানানো হয়।কাপড়ের আড়াল। তাতে টেবিল চেয়ার। খাওয়াদাওয়া আর গানের আসরের জন্য অপ্রশস্ত একটু জায়গা।মজিদভাইয়েরও বেশ উৎসাহ। সকল কিছু যোগাড় করে ঘাটে নিয়ে যেতে
এদিকে মোরগের ঝামেলায় ডাক পড়লো আমার।
- সদামিয়াঁ, ইডি কী জাতের মুরগা?
- ইডি আসলে ক্রস। ওই জার্সি গরু আছে না? তেমন।
- ও বুজ্জি। বৈজ্ঞানিক কইরা বানাইছে?
শান্তি উৎসাহিত হয়
ইডিরে কয় ব্রয়লার। শুধু মাংসের লিগ্যা পালি। আমনেরে দেখামু।
- কী দেখাবি? চল দেখুম
- চলেন, ছাতা, আমনে বেশি করেন, অহনই চলেন।
- চলেনসেন সদামিয়াঁ, একটু দেখি মুরগার কী কারখানা খুলছে এই শাইন্তা

আমার বিশ্বাস হয় না। রহিম মিয়াঁ কথায় কথায় কারও বাড়ি যান না। কিন্তু এখন তো ঠিকই উঠে পড়লেন। হাঁটতেও শুরু করলেন ওইদিকে। শান্তি হা-হা করে ওঠে। ‘আমনে কি ঠিকই যাইবেন?’
- এই, আমি কি গপ মারিনি তোর লগে? চল।
শান্তি ছুটে আগে আগে চলে যায় বাড়ি। জানে, রহিম মিয়াঁ বড় সহজ কথা নয়। আগে এটা আলপথ ছিল। এখন ইটের সলিং। রহিমের নাগরাই চটি। কেমন করে এমন চকচকে রাখেন কে জানে! চটপট হাঁটছেন। শান্তির বাড়িটা ওই। একটা মাঠ পেরোতে হবে। এখানে আগে আখের চাষ হত। এখন কেউ কিছু করে না। ছেলেরা ক্রিকেটের জন্য তৈরি করে নিয়েছে। রহিম মিয়াঁ কোনাকুনি পথ ধরেন। সোজা শান্তির বাড়িতে ঢুকে গেলে শান্তির মা এসে রহিমকে জড়িয়ে ধরলেন। যেন কতকালের সখ্য। যেন নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলবেন বুড়াকে। ‘অইছে, অইছে, রহিম মিয়াঁ অতিশয় স্নেহে বলেন।
- অইয়া গেছে?
- ধুর নডি, তুই আর ঠিক অইলি না...
এমন হাসি আমি বহুকাল শুনিনি। দুজনে হেসেমিশে যাচ্ছেন। বৃদ্ধদের হাসিতে কেমন অতীতকালও যোগ দেয়। তাই এত সুন্দর, এত আনন্দময়।একটু দূরে শান্তির বাবা। তাকে উদ্দেশ করে রহিম মিয়াঁ বলেন, ‘কিতা রে, ঠাণ্ডা অইয়া গেলি? হেই বেডাগিরি কই? তাই তো আগের মতই
’ প্রথমে একটু ফুঁপিয়ে, তারপরে সশব্দে কেঁদে ওঠেন শান্তির মা। হঠাৎ। ‘আমনে ভগবান, আমনে ভগবান’।
- এই বালের লিগ্যাই কারও বাড়ি যাই না। চুপ কর। চুপ কর। সর, তোর পোলার মুরগার কারখানা দেখতাম আইসি, কই?

     একটা বাঁশের বেড়ার ঘর। মাচার ওপর। চারদিকের বেড়ায় বরফি বরফি ফাঁক
ভেতরে পার্টিশন। একদিকে ছোট মোরগ। একদিকে একটু বড়। প্লাস্টিকের কয়েকটা উলটো কলস। নীচে একটা বাটির মতন লাগানো। কলসের জল এসে তাতে জমে। সে জল প্রাণপণ খেয়ে চলেছে কয়েকটা মোরগ। প্লাস্টিকেরই সাদা পাত্রে কী জানি কী খাবার। কয়েকটা মোরগ খাচ্ছে। প্রাণপণ। একটা গন্ধ আছে, ওষুধ ওষুধ। বাকিগুলো হাঁপাচ্ছে। ওপরে সিলিং ফ্যান ঘুরে চলেছে। কয়েকটা হলুদ বাল্বও আছে। দিনেই জ্বলছেরহিম মিয়াঁ যেনো নেই। একটা মানুষ এমন নীরব কী করে হয়ে যায়! বহুদূরের স্টেশন থেকে যেমন রেডিওতে কথা আসে, তেমনি করে তিনি বলেন, ‘শান্তি, মুরগা এমন হেতায় কেরে রে?’
- ওজনে। নিজের ওজনে নিজেই দাঁড়াইতে পারে না। দুমদাম ওজন বাড়ে তো... শ্বাস নিতে পারে না।
- ভোরে ডাকে?
- না
- মুরগী লাগে না হেরার?
- না
- কাইজ্যা করে?
- না
- বাইর হয়? চরে?
- না
- তাইলে তো মরা। এই শোভা...
ছুটে আসে শান্তির মা,‘কন কন’
- তোর পোলা মরা মুরগা পালে... দেখস না?
- বন্ধ কইরা দিব?
     শান্তি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। মা এমন ভাবে বলছেন, যেনো, রহিম বললেই সব বন্ধ হয়ে যাবে
সে মায়ের দিকে তাকায়। এইসব দেখেশুনে কিছুই বুঝতে পারি না আমিএইবার কথা বলেন শান্তির বাবা। একই কথা, ‘আমনে কইলে বন্ধ কইরা দিব’।
- মানুষ কি কেবল খাইতে আইয়ে জগতে? কেবল খাইতে? এইসব জিন্দা পরাণ থিকা পরাণডা খুইল্যা কেবল মাংস থুইয়া রাখছে। বৈজ্ঞানিক কইরা কী অইব? মুরগা সারা বাড়িত হাটবো, খেলবো, প্রেম-পরিণয় করবো।সংসার করবো। ডিম পাইরা জগতেরে জানাইয়া চিল্লাইবো মুরগি... ভোরবেলা রাতা মুরগা সুইজ্যের দিকে চাইয়া চিল্লাইবো। য্যান সুইজ্যবেডারে সেলিউট দেয়, দেখস না?
- ঠিকই তো। ঠিক।
- কী ঠিক, শোভা? তোরে একটা কতা কই?
- কন, কন যা কইবেন হুনুম
- যামুগা
- ইতান কইয়েন না দাদা... আমনে আছেন আমরা আছি... হায় হায় রে, শান্তি, তুই ইতান কী ব্যবসা ধরলি... ইতান বন্ধ কর...
- শোভা
- না, না। আমনে কন খালি, ইতান বন্ধ কইরা দিব। ওইরে, শান্তি... এই বেডা কেডা জানস না। তোরা জানস না।
আর কিছু বলেন না রহিম। হনহন করে চলে আসেন। আমি থেকে যাই। একটু কেমন বিহ্বল চেয়ে থেকে একটা মোড়ায় বসে পড়েন শোভামাসি। শান্তির মা।
- মাসি
- হ বাবা কও
- তাইনে কেডা?
- ভগবান
- ক্যামনে?
দুদ্দাড় করে উঠে ঘরে চলে যান শান্তির মা। শান্তির বাবা এগিয়ে এসে বসেন। ‘আমরার শরিকি কাইজ্যা আছিলো। বাংলাদেশে। একচেইঞ্জের সময় জেডারে পাডাইলো বাবা। জেডা এদিকে সব ব্যবস্থা করলেন। আইয়া দেখি আমরার লিগ্যা কেবল চর। চরে বালু ছাড়া কিছু নাই। বাড়ির জাগা যিডা দিলো, হিডা আসলে কবরখলা। গর্ত করলেই মাইনসের হাড্ডি উডে। আমি বাবা, আমরা ছুডু ছুডু দুইডা ভাই, আমার সংসার...  তবু কবরের উপরেই বাড়ি করলাম। দুইদিন পরপর কাইজ্যা। জেডাতো ভাইয়েরা আগুন লাগাইয়া দেয়। আমি কুনুমতে আবার ঘর করি। তারা আবার আগুন লাগায়। থানা পুলিশ। কুনু কিছু দিয়া কুনু কিছু অয় না। রহিমভাই এই জাগাটাত থাকতে দিল। লগে ওই দুইকানি ক্ষেত। আইজ পইয্যন্ত কিছু চাইলো না। না টেকাপইসা, না ফসল’।
- আইচ্ছা আমি যাই। আজগা হাছনরাজা অইবো।
- ঘটনা কী? মুরগার ফার্ম দেখতে আইসে কেরে?
- ওই শান্তি গেছলো, মুরগা বেচতো, তাইনে ব্রয়লার মোরগ আর দেখছে না
- ও, তাইনে কি তাইলে মানা করলো?
- আমার তো মনে হয় না। আইচ্ছা মেসো, আমি যাই।
 আমাকে কিছু না বলেই উঠে ঘরে চলে যান শান্তির বাবা।

     ওই তো গোমতী। ঘাট। একটু দূরে একটা জারুল গাছ। নদীকে স্পর্শ করাই তাঁর উচ্চাশা। ফলে কাণ্ড হতে সবটা শরীর নদীর দিকে বাড়িয়ে
ফাল্গুনে এর ফুল আসে। বেগুনী। এখন নেই। নীচে একটা জল মেশানো ছায়া হয় তারছায়াটা আছে। এদিকে একটা ঢাল। চিত হয়ে শোয়া যায়। যেন হাসপাতালের একদিক উঁচু করা বিছানা। আপাতত ওখানে শুয়ে থাকাই ইচ্ছা। এসে দেখি মজিদভাই। আমি যেমনি ভেবেছি, তেমনি শুয়ে আছে। পাশে তার সরাইল্যা। কাছে যাই। পাশে শুয়ে পড়ি। একটু একটা রোদ পাতার ফাঁকে এসে তার বুকের ওপর খেলছে। নদী যেন নিজের ভার নিজে বইতে পারছে নাক্লান্ত তার জলপ্রবাহ। দূরে পশ্চিমে খুব সন্তর্পণে সূর্য ডোবানোর আয়োজন হচ্ছে এখুনি। নৌকায় সব তোলা হয়েছে। সবাই ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ বিড়ি টেনে নিচ্ছে বেশ করে। গপিস্ট বুড়া এলে আর টানতে পারবে না। নৌকা থেকে নেমে আসছে জরিনা। দেখি। নৌকা থেকে পাড়ের মাটি অব্দি একটা কাঠের পাটাতন শোয়ানো। একজন তাকে হাত ধরে ধরে পার করে দিচ্ছে। নামতে গিয়ে আমাকে হাতছানিতে ডেকে দাঁড়িয়ে পড়ে জরিনা। আমি উঠি। কাছে যাই, ‘কন’
- নৌকাডা মরা
- ইডা কী কতা?
- আমনে যাইইয়েন না নৌকাত। আমনের ভাইরেও মানা করেন।
- রহিমজেডা?
- তাইনে যাক। তাইনে তো যাইবোগা... 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন