অশোক দেব
নাচের ক্লাস
এক.
আয়নার এদিকে
আবু। ওদিকে গিনিপিগ। যাজ্ঞসেনীর নাম কে রেখেছে আবু? বাড়িতে সবাই ওটাই ডাকে।
বন্ধুরা ডাকে যাজ্ঞ। ফলে সে নিজেকে কী নামে ডাকবে, স্থির করতে পারেনি কোনোদিন।এদিকে, হাজার
হাজার গিনিপিগ ছুটে ছুটে আসছে। অন্ধ গিনিপিগ। সারা ঘরে ছোটাছুটি করে। দেওয়ালের সঙ্গে,
বইয়ের শেলফের সঙ্গে, ড্রেসিং টেবিলের সঙ্গে এরা গিয়ে ঢুঁশ খাচ্ছে। ঠোক্কর খেয়ে
উল্টে পড়ছে। পড়ে আবার ছোটে।যন্ত্রণাই কোনও প্রাণীকে
এমনি ছোটাতে পারে।যাজ্ঞসেনী চোখ বন্ধ করে। তার চোখ দুটি রাজবাড়ির দিঘির মত। আবু চোখ বন্ধ করলে অতীতকাল কথা বলতে আসে। শোনা যায়। এখনও শোনে।
—
কাজল পর?
—
হুম
—
কেনা?
—
হুম, অম্বর কোম্পানির
—
বাজে
—
মানে?
—
চোখের পাতিতে কী পরছ?
—
মাশকারা
—
হিডা তো আরও বাজে
—
মানে?
—
এসব কেমিক্যাল কসমেটিক্স বানাইতে কোম্পানি কী করে, জান? এরা গিনিপিগের
চোখের মধ্যে প্রথমে লাগায়। পরীক্ষা করনের লাইগ্যা। মানুষের ক্ষতি হইব কিনা টেস্ট
করে। কত গিনিপিগ অন্ধ হয়...
সেই থেকে
গিনিপিগের দল আয়নার পেছনে এসে আছে। আবু মাশকারা পরে, কাজল পরে, আই লাইনার লাগায়,
এরা আয়না থেকে বেরিয়ে এসে সারা ঘরে ছোটাছুটি করে। আবু সাজে না তাই। অন্তত চোখ
সাজায় না। আজকাল অবশ্য মাঝে মাঝে সাজে। সাজতে হয়।
একজনকে ছবি পাঠাতে হয়।
জেঠুদা।
জেঠুদা হলেন পদ্মাদির বাবা। পদ্মাদি একা।মা নেই তাঁর।ওই বাবার সঙ্গে থাকেন। বিশাল
বাড়ি। এখন তাঁদের এই একটিমাত্র বাড়ির জায়গায় আস্ত একটা বাস স্ট্যান্ড হয়েছে। সরকারি।
পদ্মদি এখন কোথায় কে জানে। জেঠুদার বিরাট ঘর ছিল দোতলায়। নীচে হল। একদিকের দেওয়াল
জুড়ে আয়না। ওটাই নাচের ক্লাস। তার ঠিক ওপরের ঘরটাই জেঠুদার।সেটাও ওই নীচের হলের
সমান।
আবু
ক্লাস নাইন। আবু ধীরে ধীরে যাজ্ঞসেনী হয়ে উঠছে। শরীর নয়। হোম। কারও কারও কাছে
জাস্ট আগুন। কিংবা হোমাগ্নিই তার শরীর হয়ে উঠছে। এই আগুন নিয়ে পথে বেরোনো মুশকিল।
তখন বেল বটম। তখন রাজেশ খন্না পেরিয়ে গিয়ে চারিদিকে অমিতাভ বচ্চন। কান ঢাকা চুল।
কোমরে গিঁটে গাঁথা শার্ট। আর ওই বুক ভরা কেশ। বোতাম খোলা। ওটাই যা একটু তাকিয়ে
দেখার মত। যাজ্ঞসেনী তাকায় না। তখন কথায় কথায় অ্যাসিড বাল্ব। কথায় কথায় ড্যাগার। এর
মধ্যেই যাজ্ঞসেনী কাজল পরা শিখে নিয়েছে। আইলাইনার লাগাতে শিখেছে। নাচের ক্লাসে যায়। কিন্তু মন দোতলায়। কারণ ঘণ্টায় ঘন্টায় বিচিত্র সব শব্দ ভেসে আসে ওই
ঘরটা থেকে। চার্চের ঘণ্টা বাজে। কত কত পাখি কিচিরমিচির করে ওঠে। বড়
পেতলের ঘণ্টায়
কে যেন মিহি করে আঘাত করে।নাচ বন্ধ করে দেয় যাজ্ঞ। থেমে
যায়। বাকিরা
অভ্যস্ত। যাজ্ঞসেনী তার দিঘি দুটিকে প্রসারিত করে পদ্মাদির দিকে তাকায়।
—
যাবি?
—
যাই?
—
যা, দেখে আয়
আবু যেন একটা
ঘূর্ণি। দোতলায় উঠে আসে। দরোজা খোলা। এ ঘরটা থেকেই সব শব্দ আসছে। সোজা ঢুকে পড়ে
আবু। ঝালাপালা শব্দের মধ্যে একটা বিশাল চেয়ার। যেন বিছানা। কী কাঠ কে জানে, কালো।
পেশল চেয়ার। একটা পা রাখার পাটাতন চেয়ারের কোথা হতে বেরিয়ে এসেছে। তাতে দুটো পায়ের
পাতা।একটু ওপরে। লালাভ গোলাপি। একটিকে আদর করছে অন্যটি। আবু থমকে
দাঁড়ায়। সারা
ঘরে কত যে ঘড়ি। কত রকমের। সিনেমাতেই দেখেছে এরকম সব ঘড়ি। দেওয়ালে, উঁচুতে লাগানো কতগুলো বিলিতি
কুঁড়ে ঘরের মত। তার নীচে ঘড়ি। ছোট দরোজা দিয়ে তখনও একটা একটা কী পাখি বেরিয়ে এসে
ডাকছে।একেকটা ঘড়ির ঘর থেকে একেক রকমের পাখি। সার করে অনেকগুলো গ্র্যান্ডফাদার দাঁড়
করানো। কত রকমের ঘণ্টা বাজাচ্ছে। চকচকে কাঠের একটা বেশ বড় বাহারি টেবিল। ছোট ছোট
পায়া। তার মধ্যে সাজানো সব টেবিল ক্লক। ওরা অবশ্য শব্দ করছে না। উলটো দিকের
দেওয়ালে কত রকমের ওয়াল ক্লক। সবাই নানারকম ভাবে বাজছে। এই ঝালাপালাটা মিঠে।
—
রাজীবের মাইয়া?
আবু থতমত
খায়। মুখের ওপর থেকে পত্রিকা সরালে দেখা যায় ওই কণ্ঠস্বরের মালিককে। বুড়ো হলে মানুষের চোখ ম্লান হয়ে যায়। এঁর এমন নয়। যেন চোখের থেকে আলো ঠিকরে
বেরিয়ে আসছে। জগদীশ বসুর মত একটা চশমা। ওই চোখ দুটির কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে আছে সেটা। চোখ সুন্দর না হলে যাজ্ঞসেনী মানুষকে মানুষ মনে করে না। এ মানুষ তো মানুষের থেকে যেন
কিছু বেশি। যাজ্ঞ তাকিয়ে থাকে।
—
রাজীবের মাইয়া?
—
হ্যাঁ
—
কত নম্বর?
—
দুই
—
বাংলা না কেলো?
—
কেলো কই না
—
পিরিয়ড চলতাছে?
যাজ্ঞসেনী
এটাকে বলে স্যবাড়া খাওয়া। মানে থতমত। সে যাবার উদ্যোগ করে।
—
দাঁড়াও
আবু দরোজায়
দাঁড়ায়। শুয়ে শুয়ে তিনি বলেন। যেন ক্লাস
নিচ্ছেন। ‘পিরিয়ডের সময় রিহার্সাল না করলে কী হয়? তোমার না খুব ব্যথা করে?’
আবু কাঁপে।
এসব কথা তো পদ্মাদিকে বলেনি সে। তো?
—
চোখে ক্যামিকেল কাজল পর ক্যান? কালকে আইয়া কাজল লইয়া যাইও। ক্যামিকেল
কাজলের লাইগ্যা কত গিনিপিগ অন্ধ হয় জান? আর ওইটা কী? চোখের পাতায়?
—
মাশকারা
—
হেইডা তো আরও বাজে...
আবু ছুটে চলে
আসে।
দুই.
—
কী?
—
কী?
—
কী?
—
আরে, কী?
—
কী করছেন?
—
সাজি
—
নেলপলিস?
—
হুম
—
গোলাপি?
আবু স্যাবড়া
খায়। লোকটা কে আসলে? টুক করে পায়ের ছবি তুলে ফেলে। সেন্ড বাটন টিপে দেয়। সে সত্যি
গোলাপি পলিস লাগাচ্ছিল।
—
বলিনি?
—
স্যালিউট
—
হা হা হা
—
কী করে বোঝেন?
—
বুঝি
—
আর কী কী বোঝেন?
—
বুঝি আজ অফিস যাবেন না। ব্যথা। তলপেটে। খিমচে ধরে মাঝে মাঝে। ওটি ছাড়ে না
—
কী করে?
—
মানে?
—
মানে, কী করে বোঝেন?
ব্যাস, কী সব
ইমোটিক দিয়ে লোকটা বেপাত্তা। এই যে ফেসবুক, হোয়াসস্যাপ, হাইক... আবু আজকাল এসবে
বেশ সড়গড় হয়েছে। ফেসবুকে এটা ওটা লেখে। ভালো ভালো লেখা, স্ট্যাটাস খুঁজে খুঁজে পড়ে। আর ছবি
তুলে আপলোড। এই ছিল। কবে যে এই অদ্ভুত লোকটা এসে ফ্রেন্ডলিস্টে ঢুকেছে! এমনকি হোয়াসস্যাপের
নম্বরও জেনে গিয়েছে লোকটা। কী করে যে, মনে করতে পারে না আবু। কাছাকাছি কেউ নাম
ভাঁড়িয়ে মজা করছে? শান্তু নিজেই? শান্তুনু তো ব্যস্ত থাকে। সারাদিন কাজ।কাজ যেন
একটা কোন স্বর্গের মদ। শান্তু কাজমাতাল হয়ে থাকে। রাত নটায় বাড়ি ফেরে। তারপরও
এগারোটা অব্দি কীসব করে। ফাঁকে হাল্কা করে খায়। খেতে খেতেই এটা ওটা বলে। নিজের ঘরে
গিয়ে জোরে যশরাজের কিছু একটা বাজিয়ে ঘুম। একই শিল্পীকে সে যে কতবার শুনতে পারে।
যাজ্ঞসেনী নানা ভাবে বের করতে চেষ্টা করেছে লোকটা কে। শান্তু না তো? নাহ্।শান্তু
ওসব ফেসবুক,টেসবুককে একদম নিতে পারে না।বলে, বালখিল্য। সময় কোথায়? ওটি শান্তু নয়।
আর হলেও ওই প্রমথেশ নামটা ও নিজেকে দেবে না। প্রমথেশ সেন। শুনলেই মনে হয় ফেক।
—
ফেক নয় হে। টুং করে ওঠে মেসেঞ্জার।
—
অ্যাই, আমার এসব খুব ভৌতিক লাগে। প্লিজ। ভয় পাই।
—
ভয়ের কিছু নেই। প্রচুর জল খান। বলেই অফলাইন হয়ে যায় প্রমথেশ।
আজ আবু
সেজেছে। মন চাইলো। ওই মাশকারাটা ও শান্তুর জন্য পরে। সানন্দা রাখে যাজ্ঞসেনী। পড়ে
না। দেখে। একদিন এক মডেলের চোখ দেখে শান্তু বলেছিল ‘আইল্যাশই হল চোখের আসল গহনা’। সেই থেকে কখনো কখনো চোখ সাজায় আবু। আজকাল শান্তু আসে। দেখে না। তবু যে
চোখে গহনা পরে। আর সেটি করতে গেলেই ছুটে আসে গিনিপিগ। আর ওই জেঠুদা।
—
আমারে কী ডাকবা?
—
কী? জেঠু?
—
না, জেঠুদা, হা হা হা।
লোকটা তাঁর
ঘড়ির মত হাসে। যেন অনেকের হাসি তিনি একা হেসে দিচ্ছেন। ঘড়িগুলো কোনটা জার্মান,
কোনটা ইতালীয়, কোনটা বার্মিজ কাঠের তৈরি ক্যাবিনেটে রাখা, কার কত বয়স সব বলেছিলেন
একদিন। তাঁর আবার চোখে পরার একটা ঠুলি লেন্স আছে। সেটা চোখে লাগিয়ে ঘড়ির যন্ত্রপাতি
সারাই করেন। এমনকি ঘড়ির সঙ্গে কথা বলেন
তিনি। কী আজব শখ! ‘সময় চলিয়া যায়...আমি এই ঘরে সময়ের কারাগার বানাইলাম। চলিয়া কোথায় যাইবে’? অদ্ভুত সব কথা বলেন জেঠুদা। আজ
সারা ঘরে ঘিয়ের গন্ধ। কয়েকটা নিভে থাকা প্রদীপ। ছোট ছোট থালা বাসন। সবই রূপার।
প্রদীপগুলোও চকচকে। পেতলের? জেঠুদা একটা বাহারি কাজলদান বের করেন। সেটাও রূপার।
ছোট ছোট পাথর বসানো। আবুর দিকে এগিয়ে দেন।
—
নও। ঘিয়ের প্রদীপের কাজল। ইডাই পরবা। এইসব কাজল চোখের লাইগ্যা ভালো।
—
মানে... মা...
—
আমার কথা কইবা। কালকে পইরা আইবা। আমারে দেখাইবা। তোমার পদ্মদিও আমার
করা কাজল পরে। ঘিয়ের।কালকে
ঠিক চারটার সময় আইবা। বিকালে।
আবু গিয়েছিল
পরের দিন।ক্লাস ছিল না। অন্যদের ক্লাস। গণেশ বন্দনা হচ্ছিল। আবু দরোজার সামনে দাঁড়াতেই
পদ্মদি তাকে দেখে মিটি মিটি হাসে।
—
তোর মত চোখ থাকলে আমি শেলিং করতাম।
—
শেলিং?
—
তুই বুঝবি না। যুদ্ধক্ষেত্রের ব্যাপার... বলে হা হা হা করে হাসেন, যা
দোতলায় জেঠুদাকে দেখিয়ে আয়।
আবু যেতে চায়
না। পদ্মদি ঠেলে পাঠান। সেও ঢুকেছে অমনি সারা ঘরে
বিকেল চারটে। নানারকমের চারটি ধ্বনি।আবু দাঁড়িয়ে থাকে। ওই বিশাল একটা কোম্পানি
চেয়ারে আধো শোয়া। হাতে একটা কী বই। সামনে একটা রাজস্থানী চৌকি।বাহারি।
—
এইটাতে বও
আবু বসে।
মাথা নুইয়ে রাখে। জেঠুদা আলতো করে মুখ তুলে ধরেন তার। তাকিয়ে থাকেন। আবু কিছু
করেনি। তার দিঘি দুটোতে জলোচ্ছ্বাস হল।
—
কান্দো ক্যান? তুমি না বলে নাচো? দাঁড়াও।
আবু
দাঁড়ায়।জেঠুদা চশমা খোলেন।‘আমার চোখের দিকে তাকাও’ আবু তাকায়। ওমা চোখ পাল্টে যায়
বুড়োর। ‘এটা হল রাগ, রুদ্র’। আবু ও চোখের দিকে তাকাতে পারে না। ‘এটা বাৎসল্য’, এটা অনুরাগ,
এটা অভিমান, এটা প্রেম, এটা ক্লেশ, এটা দুঃখ...আবু কী দেখছে! কী করছে এ মানুষ? আবু
স্যাবড়া খায়। থতমত। আবু কিশোরী। আবুর ক্লাস নাইন তোলপাড় করে দিয়ে ওই বৃদ্ধ দেখায়,
‘এইভাবে চোখে হাসতে হয়’।
তিন.
আবু চোখে
হাসে। ভেতর কাঁদলেও তার চোখ হাসে। নাচের ক্লাস আর পদ্মদির কাছে রইলো না। আবু সোজা
দোতলায় চলে যায়। কখনো বাংলা কবিতা, কখনো জীববিদ্যা, কখনো ওই সিঁড়িভাঙা অংক। কখনো
মেঘদূত। কখনো শকুন্তলা। আবার কখনো সোজা হিন্দি সিনেমা। ফিতার ভিডিও ট্যাপ। পেটুক
একটা টিভি। একদিন ‘তেজাব’ দেখল তারা। জেঠুদা
সিনেমা লাগিয়ে দিয়ে কীসব পড়েন। দেখেন না। তেজাব দেখে আবু কেঁদেছে। কিন্তু আসল হল ওই নাচের মুদ্রা। নাচ। কখন যে
তিনি নাচতে শুরু করবেন ঠিক নেই। মুখ গম্ভীর হয়। চোখ জ্বলে ওঠে। স্ট্রাইপ
ট্রাউজার্স আর পাঞ্জাবি। সব পাঞ্জাবিই ঘিয়ে রঙের। দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি টানটান করলে
বুঝতে হবে এখন তিনি নাচবেন। কী করে এমন একজন বৃদ্ধ এত সাবলীল নাচ করেন? এমনি একা একা গেয়ে গেয়ে চিত্রাঙ্গদা করে দেখান?
কী করে?আবুর নামও পাল্টে গিয়েছিল। সৈরিন্ধ্রী। কেমন একটা খটোমটো শব্দ কেমন আদর
মেখে মেখে উচ্চারণ করতেন তিনি।
একদিন
কাজলদানী ফুরিয়ে গেল।একদিন নাচের ক্লাস বন্ধ হয়ে গেল। মা-ই কী বুঝে সেটা বন্ধ করে
দেন। আবু হাঁশপাশ করে। একদিন জেঠুদা আসেন। ‘কই, রাজীব কই’? বাবা হাঁহাঁ করে এগিয়ে
যান। জেঠুদাকে কেউ কোনওদিন বাড়ির বাইরে দেখেনি। অথচ তিনি সকলকে চেনেন। সকলে তাঁকে
চেনে। জেঠুদা কারও বাড়িতে গেলেন মানে, পাড়ায় তার সম্মান বেড়ে গেল।
—
সৈরিন্ধ্রী কই?
—
কে, দাদা?
—
তোমার ছোট মেয়েটা, যাজ্ঞসেনী?
আবু তো ছুটে
রান্নাঘরে। মায়ের কাছে। মা তাকিয়ে আছেন। এ দৃষ্টিটার নাম রুদ্র?
—
‘সমম আলোকিতম সাচি প্রলোকিত নিমীলিতে
উল্লোকিতানুবৃত্তে
চ তথা চৈবাবলোকিতম...’
বসার ঘর থেকে
জোরে জোরে নন্দিকেশ্বরের দৃষ্টিভেদ আবৃত্তি করেন জেঠুদা। সবটা করেন না।
—
তুমি এদিকে আইয়ো তো সৈরিন্ধ্রী
—
তাইর নাম আবু, যাজ্ঞসেনী তাইর ঠাকুরদা রাখছে। মা শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন।
—
আমি রাখছি সৈরিন্ধ্রী। কই এদিকে আইয়ো।
মাঝখানে পড়ে
গেল আবু আর বাবা। আবু মরে যাচ্ছে। বাবা কিছু বুঝতে পারেন না। ছুটে রান্নাঘরে যান।
মা বাবাকে টেনে নিয়ে কী যেন ফিসফিস করেন। বাবা একবার মায়ের দিকে একবার আবুর দিকে তাকান। আবুকে
দ্যাখে বাবা। যেন অচেনা কেউ হয়ে গিয়েছে আবুটা। এই বাবাই ওকে বেশি আবু আবু করে। কেমন যেন কঠিন করে তাকালো
বাবাটা। আবু কেঁদে ফেলে। নিজের ঘরে চলে যায়।
—
ঠিক আছে, ঠিক আছে, কান্দাকাটির দরকার নাই। আমি গেলাম।
চার.
নাচের ক্লাস
বন্ধ হল। অ্যানুয়েল প্রোগ্রামের সময় সাতদিন যেতে পেরেছিল আবু। সঙ্গে মা। আবু কান
পেতে থাকে। দোতলার ঘর থেকে ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায় না আর। আবু নিজের ছোট হাতঘড়িটা
দ্যাখে ঘণ্টায় ঘণ্টায়।
—
দম দেওয়া হয় না। ভুইল্যা যায় বাবা
পদ্মদি
হাওয়ার মধ্যে কথাটা ভাসিয়ে দেন। আবু ফস করে কেঁদে ফেলে। মা কিছুই না বুঝে আদর করতে
লেগে যান। ভাবলেন নাচে ভুল করে কাঁদছে মেয়ে।‘মনোযোগ দিয়া কর। কিচ্ছু হইত না’।
বড়
ক্লাসে যাওয়া হল। নাচ বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে। আবু স্কুলে
যায়। আবু স্যারের
বাড়ি যায়। ওদের বাড়ির উল্টো দিকে একটা ছোট শনিমন্দির। জেঠুদা দাঁড়িয়ে থাকেন। এখন
তাঁকে সত্যকার বুড়ো মানুষ মনে হয়। বৃদ্ধ। আবু কাছে গিয়ে তাকাতে চায় সে চোখ দুটোর
দিকে। অসম্ভব। এ পথটুকু মা এগিয়ে দেন। রিকশায় তুলে দিয়ে তবে ফেরেন। জেঠুদা কোনোদিন
এগিয়ে আসেন না। কথা বলেন না। তাকিয়ে থাকেন। চুল সব সাদা হল।একদিন মা চলে গেলে আবু
রিকশা ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল। জেঠুদা নেই।কিন্তু নতুন উৎপাতটা আছে। ভুটন।ষাঁড়।তার
দৃষ্টিটাকে ঠিক কী বলা যায়? শরীরের যেখানে সেটা লাগে, জ্বলে যায়। জ্বালা করে। ‘আবু
প্লাস বুড়া’। এই কথাটা ওই-ই সারা পাড়া করেছে। মাধ্যমিক দিয়েই তাই আবুকে ছাড়তে হল
পাড়া। বাকি বড় হওয়া, কলেজ, শান্তুনু সব কলকাতায়। শান্তুনুদের পুরনো পরিবার।
আগরতলার বনেদি। সে তখন যাদবপুরে পড়ে
—
ব্যথা কমল? টুং করে মেসেঞ্জার।
—
না
—
জল খেলেন?
—
হুম
—
আপনার অনেকগুলো ঘড়ি?
—
শখ
—
গোল ডায়ালের কালোটা বেশ সুন্দর। ছবিটা দেখলাম।
—
দাঁড়ান
আবু তার
হাতঘড়ির কালেকশন বের করে। সাজায়। স্মার্ট ফোনে ছবি তোলে। সেন্ট
—
অত?অতগুলো?
—
এটা যে জানলেন না? আপনি তো সব জানেন।
—
জানি
—
কী জানেন?
—
জানি, আপনি পাখিও পোষেন, অনেক পাখি
—
কী করে? অ্যাই? কী করে?
—
পাখির নানারকম ডাক আপনার ভালো লাগে, কলতান...
—
কী করে? কে আপনি? এ পাড়ার?
—
নোপ। গতবসন্ত খবর পাঠালো
বলেই
বেপাত্তা হয়ে যায় লোকটা। আবু তাকিয়ে থাকে।
বিকেল পেরিয়ে যাচ্ছে। বড় বড় খাঁচা। তাতে অনেক পাখি। অনেক। গোধূলি আর ভোরে
এরা বাড়ি মাথায় করে। আবু জানালা দিয়ে তাকায়। এদের বাড়িটি পুরনো। পুরনো সব গাছ।
বাইরে বাহারি করে খাঁচা গড়ে দিয়েছে শান্তনু। খাঁচাতেও যাতে একটু মুক্তির স্বাদ
পাওয়া যায়, তাই বড় বড় খাঁচা। শুধু শান্তুটাই রইলো না। কেমন একটা যন্ত্র হয়েছে সে। বছরে একবার বেড়ানো। প্রতি রবিবার সিনেমা। ইচ্ছে
হলেই একটা ঘড়ি কেনা। আর আঙটি। কত আঙটি যে শান্তু কিনতে পারে। আর সেসব পরতেও হবে।
কখনো সব আঙুলেই একটা করে। অফিসে সবাই হাসে। আবু ইচ্ছে করলে খুলে রাখতে পারে, আবার
শান্তু আসার আগে পরে নিতে পারে। অমন করে না। এটাও একরকম ঠকানো হয়ে যায়। কিন্তু ওই
রুটিন বাঁধা কাজ সব। রুটিন করে, হিসেব করে করা। আবু কেমন দুমড়ে থাকে। এই ফেসবুক
এসে ভালো হল। সময় কেটে যায়। শুধু এ লোকটা কোত্থেকে এলো কে জানে। প্রমথেশ সেন। ছবি
একটা আছে ঠিক। কেমন উদাসী দুটি চোখ। সাধারণ চেহারা। কিন্তু ওই চোখ দুটিই ওর ভালো
লেগেছিল।
—
থ্যাংকস। টুং করে ওঠে মেসেঞ্জার।
—
মানে
—
না, এমনিতেই
—
হঠাৎ ধন্যবাদ?
—
না, ওই চোখে কী একটা পড়ল আমার...
বলেই চুপ। ‘ওয়াজ
অ্যাক্টিভ ওয়ান মিনিট অ্যাগো’
পাঁচ.
আজ বারো
ডিসেম্বর। আজ বিবাহবার্ষিকী। ফেসবুক বন্ধ করে দেয় আবু। ওই ওখানে কোনও আত্মীয় যদি
শুভেচ্ছা পাঠালো, তো সেরেছে। এবার যে কত রকমের কত ঢঙের শুভেচ্ছাবার্তা আসবে তার
ঠিক নেই। সেসবের জবাব লেখা এক ঝক্কি। ওই মেসেঞ্জারটা আছে। হোয়াসস্যাপ আছে। হাইকও।
বাকি সব আছে। একেবারে নিকট জনেদের সঙ্গে কথা হয়। ভালো হল, আজ মুসলিমদের কী একটা
পার্বণ। অফিস ছুটি। শান্তু সকালে স্নানটান করে বেরিয়ে গেল। মুখ থমথম। অফিসের
ঝামেলা কিছু হবে। ওর তো ছুটি নেই। আবু জানে বিকেলে তাড়াতাড়ি চলে আসবে আজ। ওই যশরাজ
শুনবে। ছুটির দিনে আবার যোগ হয় জগজিৎ সিং -এর গজল। ওই চাপা,ফ্ল্যাট কণ্ঠ আবুর ভালো
লাগে না।যাজ্ঞসেনী সময় নিয়ে স্নান করে। ঠাকুর ঘরে যায়। পাখিদের খাওয়ায়। দুপুর
গড়িয়ে যাচ্ছে। শান্তুকে ফোন করে। কেটে দিয়ে মেসেজ করে, জাস্ট কল ইউ লেটার। আবু
অবাক হয়। শান্তুটা কেমন হয়ে যাচ্ছে যেন। ছুটি হলে বাড়িতে থাকছে না। মাঝে মাঝে
গন্ধও পাওয়া যায়। ওটি একদম সইতে পারে না আবু। কথা বলে না।কথা না বললেই শান্তুর সব
উথালপাথাল হয়ে যায়। ‘আই ফিল অ্যাবানডনড। যা খুশি হোক, কথা বলা বন্ধ করবে না’। এখন
কথা না বললেও উদাস কিছু যায় আসে না ওর। আসলে, অফিসে কাজ বেড়ে গেল। হয়তো।
বিকেল
পেরিয়ে যাচ্ছে। পাখিদের কলরব শুরু হয়ে গেল। আবু ড্রেসিং টেবিলের সামনে আসে। সাজে।
চোখে গহনা পরে। মাশকারাও। তাকায়। কত কত গিনিপিগ। ছুটে আসে। সারা ঘরে ছোটাছুটি করে।
চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। আবার খোলে, আয়নার থেকে সরে চলে আসে বারন্দায়। বেতের ঝোলানো
চেয়ার। বসে। কেমন শীতল একটা সন্ধ্যা হচ্ছে। পাখিরা খাঁচায় ওড়াউড়ি লাফালাফি করে।
যেন এটাই তাদের আসল বাড়িঘর। শান্তুর মেসেজ এল, দেরী হবে, খেয়ে নিও। ভেতরটা চুপ করে
যায় আবুর। সে অনলাইনে আসে, যেন অন্তকালের মত একটা সময় তাকে একা কাটাতে হবে। ওই
মেসেঞ্জার, হোয়সস্যাপ, হাইক... সব সব খুলে দেয়।একেকটার নোটিফিকেশনের শব্দ একেক
রকম। এই একটা ফোনে কত শব্দ আর সময় বাঁধা পরে আছে!
—
হ্যাপি অ্যানিভার্সারি
—
থ্যাংকস, এটাও জানেন?
—
জানি
—
আমি এলেই কী করে টের পান? এই তো দেখলাম, ওয়াজ অ্যাক্টিভ টুয়েন্টি মিনিটস
অ্যাগো...
—
সময়টা ভুল বলছে,
ওটা মিনিটস হবে
না
—
তো?
—
ইয়ার্স হবে, টুয়েন্টি ইয়ার্স...
টুক করে নিভে
যায় সবুজ বাতিটা।যাজ্ঞসেনী ভালো করে তাকায় ফোনের স্ক্রিনটার দিকে। চোখ বড় করে। হাজার হাজার ছোট ছোট গিনিপিগ ছোটাছুটি করছে। ওরা
অন্ধ।
(
(