রবিবার, ৬ আগস্ট, ২০১৭

সদাপুরাণ -২৩



অশোক দেব
সদাপুরাণ -২৩

নীচে ঢেউয়ের প্ররোচনা থাকতে হয়। নইলে মরে যায় বেঁধে রাখা নৌকা
োমতী এখন হীনতোয়া হয়েছে। মহারানি ব্যারেজ থেকে বিকেলের দিকে একটু জল দেয়। সেই জলে গোমতীর না সাজ হয়, না বাহার। ঘাটে গপিস্টের নৌকা। বাঁধা। বহুকাল। মাঝে মাঝে তাঁর হাছনরাজা হবার শখ চাপতো। নৌকায় দিন কাটাতেন। রাতই কাটাতেন বেশি জোছনার রাত। গানবাজনা হত। সঙ্গে চলতো তাঁর গপের আসর। সত্যই বলতেন, নাকি বানিয়ে, বোঝার উপায় নেই। এখন আর হাছনরাজা হওয়া হয় নাএকটু গিয়েই বালিতে আটকে যায় নৌকা।বহুদিন পরে আজ তাঁর শখ হল। যাহোক একটু নৌকাভ্রমণ করতে চান খাওয়াদাওয়ার বিশাল আয়োজন নৌকায় তোলা হবে। সকাল থেকেই রান্নাঘর সরগরম। আর এইদিকে ওই মোরগ নিয়ে লেগেছে ধুন্ধুমার। শান্তি বণিক ব্রয়লার ফার্ম করেছে। সে কয়েকটা মোরগ নিয়ে এসেছে। আজ বিক্রি করবার সুযোগ।
- ইডি কি রাতা মোরগ?
- একদম। রাতা মোরগ। মুরগি না।
- রাতা অইলে বেডাগিরি কই?
- আরে জেডা, এই রাতা হেই রাতা না
- তইলে ইডি কী রাতা?
- এই মুরগা হিতা করে না। কেবল মাংসের লিগ্যা পালি
- কিতা করে না?
- আমনে বুজি বোজেন না? রাতি মুরগীর কাছে যায় না
- হিজড়া?
- ধুর বেচতাম না
আমনের কাছে বেচতাম না মুরগা
- এই হুন, কই থিকা আনছস এই বালমার্কা মুরগা?
শান্তির মুখ কালো হয়ে যায়। সে কী করবে বুঝতে পারে না। ওইদিকে মহা ধুমধাম। নৌকা সাজাতে হবে। একটা বড়সড় বাদামবিহীন নৌকা এটা। ওপরে শামিয়ানা টাঙানো হয়।অস্থায়ী একটা ঘরের মতন বানানো হয়।কাপড়ের আড়াল। তাতে টেবিল চেয়ার। খাওয়াদাওয়া আর গানের আসরের জন্য অপ্রশস্ত একটু জায়গা।মজিদভাইয়েরও বেশ উৎসাহ। সকল কিছু যোগাড় করে ঘাটে নিয়ে যেতে
এদিকে মোরগের ঝামেলায় ডাক পড়লো আমার।
- সদামিয়াঁ, ইডি কী জাতের মুরগা?
- ইডি আসলে ক্রস। ওই জার্সি গরু আছে না? তেমন।
- ও বুজ্জি। বৈজ্ঞানিক কইরা বানাইছে?
শান্তি উৎসাহিত হয়
ইডিরে কয় ব্রয়লার। শুধু মাংসের লিগ্যা পালি। আমনেরে দেখামু।
- কী দেখাবি? চল দেখুম
- চলেন, ছাতা, আমনে বেশি করেন, অহনই চলেন।
- চলেনসেন সদামিয়াঁ, একটু দেখি মুরগার কী কারখানা খুলছে এই শাইন্তা

আমার বিশ্বাস হয় না। রহিম মিয়াঁ কথায় কথায় কারও বাড়ি যান না। কিন্তু এখন তো ঠিকই উঠে পড়লেন। হাঁটতেও শুরু করলেন ওইদিকে। শান্তি হা-হা করে ওঠে। ‘আমনে কি ঠিকই যাইবেন?’
- এই, আমি কি গপ মারিনি তোর লগে? চল।
শান্তি ছুটে আগে আগে চলে যায় বাড়ি। জানে, রহিম মিয়াঁ বড় সহজ কথা নয়। আগে এটা আলপথ ছিল। এখন ইটের সলিং। রহিমের নাগরাই চটি। কেমন করে এমন চকচকে রাখেন কে জানে! চটপট হাঁটছেন। শান্তির বাড়িটা ওই। একটা মাঠ পেরোতে হবে। এখানে আগে আখের চাষ হত। এখন কেউ কিছু করে না। ছেলেরা ক্রিকেটের জন্য তৈরি করে নিয়েছে। রহিম মিয়াঁ কোনাকুনি পথ ধরেন। সোজা শান্তির বাড়িতে ঢুকে গেলে শান্তির মা এসে রহিমকে জড়িয়ে ধরলেন। যেন কতকালের সখ্য। যেন নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলবেন বুড়াকে। ‘অইছে, অইছে, রহিম মিয়াঁ অতিশয় স্নেহে বলেন।
- অইয়া গেছে?
- ধুর নডি, তুই আর ঠিক অইলি না...
এমন হাসি আমি বহুকাল শুনিনি। দুজনে হেসেমিশে যাচ্ছেন। বৃদ্ধদের হাসিতে কেমন অতীতকালও যোগ দেয়। তাই এত সুন্দর, এত আনন্দময়।একটু দূরে শান্তির বাবা। তাকে উদ্দেশ করে রহিম মিয়াঁ বলেন, ‘কিতা রে, ঠাণ্ডা অইয়া গেলি? হেই বেডাগিরি কই? তাই তো আগের মতই
’ প্রথমে একটু ফুঁপিয়ে, তারপরে সশব্দে কেঁদে ওঠেন শান্তির মা। হঠাৎ। ‘আমনে ভগবান, আমনে ভগবান’।
- এই বালের লিগ্যাই কারও বাড়ি যাই না। চুপ কর। চুপ কর। সর, তোর পোলার মুরগার কারখানা দেখতাম আইসি, কই?

     একটা বাঁশের বেড়ার ঘর। মাচার ওপর। চারদিকের বেড়ায় বরফি বরফি ফাঁক
ভেতরে পার্টিশন। একদিকে ছোট মোরগ। একদিকে একটু বড়। প্লাস্টিকের কয়েকটা উলটো কলস। নীচে একটা বাটির মতন লাগানো। কলসের জল এসে তাতে জমে। সে জল প্রাণপণ খেয়ে চলেছে কয়েকটা মোরগ। প্লাস্টিকেরই সাদা পাত্রে কী জানি কী খাবার। কয়েকটা মোরগ খাচ্ছে। প্রাণপণ। একটা গন্ধ আছে, ওষুধ ওষুধ। বাকিগুলো হাঁপাচ্ছে। ওপরে সিলিং ফ্যান ঘুরে চলেছে। কয়েকটা হলুদ বাল্বও আছে। দিনেই জ্বলছেরহিম মিয়াঁ যেনো নেই। একটা মানুষ এমন নীরব কী করে হয়ে যায়! বহুদূরের স্টেশন থেকে যেমন রেডিওতে কথা আসে, তেমনি করে তিনি বলেন, ‘শান্তি, মুরগা এমন হেতায় কেরে রে?’
- ওজনে। নিজের ওজনে নিজেই দাঁড়াইতে পারে না। দুমদাম ওজন বাড়ে তো... শ্বাস নিতে পারে না।
- ভোরে ডাকে?
- না
- মুরগী লাগে না হেরার?
- না
- কাইজ্যা করে?
- না
- বাইর হয়? চরে?
- না
- তাইলে তো মরা। এই শোভা...
ছুটে আসে শান্তির মা,‘কন কন’
- তোর পোলা মরা মুরগা পালে... দেখস না?
- বন্ধ কইরা দিব?
     শান্তি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। মা এমন ভাবে বলছেন, যেনো, রহিম বললেই সব বন্ধ হয়ে যাবে
সে মায়ের দিকে তাকায়। এইসব দেখেশুনে কিছুই বুঝতে পারি না আমিএইবার কথা বলেন শান্তির বাবা। একই কথা, ‘আমনে কইলে বন্ধ কইরা দিব’।
- মানুষ কি কেবল খাইতে আইয়ে জগতে? কেবল খাইতে? এইসব জিন্দা পরাণ থিকা পরাণডা খুইল্যা কেবল মাংস থুইয়া রাখছে। বৈজ্ঞানিক কইরা কী অইব? মুরগা সারা বাড়িত হাটবো, খেলবো, প্রেম-পরিণয় করবো।সংসার করবো। ডিম পাইরা জগতেরে জানাইয়া চিল্লাইবো মুরগি... ভোরবেলা রাতা মুরগা সুইজ্যের দিকে চাইয়া চিল্লাইবো। য্যান সুইজ্যবেডারে সেলিউট দেয়, দেখস না?
- ঠিকই তো। ঠিক।
- কী ঠিক, শোভা? তোরে একটা কতা কই?
- কন, কন যা কইবেন হুনুম
- যামুগা
- ইতান কইয়েন না দাদা... আমনে আছেন আমরা আছি... হায় হায় রে, শান্তি, তুই ইতান কী ব্যবসা ধরলি... ইতান বন্ধ কর...
- শোভা
- না, না। আমনে কন খালি, ইতান বন্ধ কইরা দিব। ওইরে, শান্তি... এই বেডা কেডা জানস না। তোরা জানস না।
আর কিছু বলেন না রহিম। হনহন করে চলে আসেন। আমি থেকে যাই। একটু কেমন বিহ্বল চেয়ে থেকে একটা মোড়ায় বসে পড়েন শোভামাসি। শান্তির মা।
- মাসি
- হ বাবা কও
- তাইনে কেডা?
- ভগবান
- ক্যামনে?
দুদ্দাড় করে উঠে ঘরে চলে যান শান্তির মা। শান্তির বাবা এগিয়ে এসে বসেন। ‘আমরার শরিকি কাইজ্যা আছিলো। বাংলাদেশে। একচেইঞ্জের সময় জেডারে পাডাইলো বাবা। জেডা এদিকে সব ব্যবস্থা করলেন। আইয়া দেখি আমরার লিগ্যা কেবল চর। চরে বালু ছাড়া কিছু নাই। বাড়ির জাগা যিডা দিলো, হিডা আসলে কবরখলা। গর্ত করলেই মাইনসের হাড্ডি উডে। আমি বাবা, আমরা ছুডু ছুডু দুইডা ভাই, আমার সংসার...  তবু কবরের উপরেই বাড়ি করলাম। দুইদিন পরপর কাইজ্যা। জেডাতো ভাইয়েরা আগুন লাগাইয়া দেয়। আমি কুনুমতে আবার ঘর করি। তারা আবার আগুন লাগায়। থানা পুলিশ। কুনু কিছু দিয়া কুনু কিছু অয় না। রহিমভাই এই জাগাটাত থাকতে দিল। লগে ওই দুইকানি ক্ষেত। আইজ পইয্যন্ত কিছু চাইলো না। না টেকাপইসা, না ফসল’।
- আইচ্ছা আমি যাই। আজগা হাছনরাজা অইবো।
- ঘটনা কী? মুরগার ফার্ম দেখতে আইসে কেরে?
- ওই শান্তি গেছলো, মুরগা বেচতো, তাইনে ব্রয়লার মোরগ আর দেখছে না
- ও, তাইনে কি তাইলে মানা করলো?
- আমার তো মনে হয় না। আইচ্ছা মেসো, আমি যাই।
 আমাকে কিছু না বলেই উঠে ঘরে চলে যান শান্তির বাবা।

     ওই তো গোমতী। ঘাট। একটু দূরে একটা জারুল গাছ। নদীকে স্পর্শ করাই তাঁর উচ্চাশা। ফলে কাণ্ড হতে সবটা শরীর নদীর দিকে বাড়িয়ে
ফাল্গুনে এর ফুল আসে। বেগুনী। এখন নেই। নীচে একটা জল মেশানো ছায়া হয় তারছায়াটা আছে। এদিকে একটা ঢাল। চিত হয়ে শোয়া যায়। যেন হাসপাতালের একদিক উঁচু করা বিছানা। আপাতত ওখানে শুয়ে থাকাই ইচ্ছা। এসে দেখি মজিদভাই। আমি যেমনি ভেবেছি, তেমনি শুয়ে আছে। পাশে তার সরাইল্যা। কাছে যাই। পাশে শুয়ে পড়ি। একটু একটা রোদ পাতার ফাঁকে এসে তার বুকের ওপর খেলছে। নদী যেন নিজের ভার নিজে বইতে পারছে নাক্লান্ত তার জলপ্রবাহ। দূরে পশ্চিমে খুব সন্তর্পণে সূর্য ডোবানোর আয়োজন হচ্ছে এখুনি। নৌকায় সব তোলা হয়েছে। সবাই ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ বিড়ি টেনে নিচ্ছে বেশ করে। গপিস্ট বুড়া এলে আর টানতে পারবে না। নৌকা থেকে নেমে আসছে জরিনা। দেখি। নৌকা থেকে পাড়ের মাটি অব্দি একটা কাঠের পাটাতন শোয়ানো। একজন তাকে হাত ধরে ধরে পার করে দিচ্ছে। নামতে গিয়ে আমাকে হাতছানিতে ডেকে দাঁড়িয়ে পড়ে জরিনা। আমি উঠি। কাছে যাই, ‘কন’
- নৌকাডা মরা
- ইডা কী কতা?
- আমনে যাইইয়েন না নৌকাত। আমনের ভাইরেও মানা করেন।
- রহিমজেডা?
- তাইনে যাক। তাইনে তো যাইবোগা... 

রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৭

সদাপুরাণ-২২


অশোক দেব
সদাপুরাণ-২২

রক্ত ভারি অয়। সব শিরা ঢিলা অইয়া যায়। চক্ষের আর দেখবার ইচ্ছা থাকে না। দুনিয়াত হুননের মতন কুনু কথা থাকে না আর
মন নতুন কিছু নেয় না।  মনের মিধ্যে জাগা থাকে না আরমন ঘামাইয়া যায়। দেখবেন বাইচ্চা অইলে নতুন নতুন কেবল ঘুমায়। ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া কার লগে জানি হাসে। কেবল হাসে। ঘুমের বাইচ্চা খিলখিল কইরা উডে। আবার ঘুমাইয়া যায়। তারে আল্লামিয়াঁ কতকিছু খেইল দেখায়। কয়, এমন এক জাগা আছে কেবল জল। যত দূরে দেখবা কেবল জল। হিডারে কয় সাগর। ঘুমের বাইচ্চা বিশ্বাস করে না। হাসে। আল্লামিয়াঁ কয়, এমন একটা জাগা বানাইছি কেবল বালুযতদূর দেখবা কেবল বালু। শিশু মানে না, হাসে। তবু তার ঘুম ভালা লাগে। যা দেখেনাই, যা হুনেনাই, তা দেখনের লিগ্যা, তা হুননের লিগ্যা ঘুমায়। সারাদিন ঘুমায়। আমারও ঘুম আইয়ে। অহন আমি আর বাইচ্চা নাই। সাগর দেখসি না, তবে সাগর আছে। মরু দেখসি না, তবে আছে। জানি। যারা দেখসে তারা কয়। আমিও যা যা পারলাম দেখলাম, হুনলাম। অহন পুরান অইছি। ঘুমের নিশা অয়। ঘুমের মিধ্যে দেখি ওই দেশ। হেই দেশে  হাতে পরাণ লইয়া মানুষ মানুষের দিকে দৌড়াইয়া যায়। বাইচ্চা ঘুমের পিডে চইরা জগতে আইয়ে। আমি বুড়া ঘুমের উপরে চইরা দুনিয়ার থিকা যাইগা।
- আমনে না ঘুমাইতে ঘিন্না করেন?
- করতাম
- অহন?
- ওই যে কইলাম, কতা বোজেন না?
- বুজি
- সদামিয়াঁ
- কন
- যামুগা
- কই যাইবেন?
- ওই যে পক্ষীডা ডাকে হুনেন? ওই যে, টুবুর টুবুর... টুবুর টুবুর... হুনেন? ওইখানে যামু
- ইডা তো ওই তো, কামরাঙা গাছে বইয়া ডাকতাছে
- এই তো বুঝলেন না। আমনে হুনতাসলেন? আমি কওনের আগে পক্ষীডার ডাক আমনে হুনতাসলেন? হুনেননাই। কিন্তু ওইডা তো আছিলো। আছিলো না? আমনে জানতেন না কই আছিলো।হারাদিন তো খাইলো দাইলো, যদ্দুর উড়নের উড়লো। অহন ওই গাছে বইছে। আছে কিন্তুক নাই। ডাকে কেবল ডাকে, বিশ্রাম নাই... কেবল ডাকে... জিকির দেয়, আমনেরা য্যান কন জপ... পক্ষী জপ করে। একটাই কতা বারবার কয়... আমিও একটা কতা অহন কেবল কই... যামুগা, যামুগা, যামুগা... একটা কতা বারবার নিজেরে কইলে কতাডাই আমনেরে চালাইবো। হারাদিন উড়বেন, খাইবেন দাইবেন, একটা সময় বইয়া ওই পক্ষীর মতন একটা বালা কতা বারবার কইবেন...
- তাইলে কী অইব?
- আমনে বালের নি শিক্ষিত? কিতা বোজেন?
- না, মানে একটা কতা বারবার...
- এই নাটঢিল, আমনেরে কু-কু কইলে কান্দেন কিলিগ্যা?
- কান্দি না। কষ্ট লাগে...
- একটা আওয়াজ আমনেরে কষ্ট দিতো পারে, আরেকটা আওয়াজ আনন্দ দিতো পারতো না? আমনে দুনিয়াত
 বাইর অন না, কেডা কুন সময় কুউ করবো... ডরান...
- না, মানে...
- না, আমনে ডরান। একটা শব্দ আমনেরে ডর লাগাইয়া দিতো পারে
মনে অশান্তি আনতো পারে। একটা এমন শব্দ কি নাই, যিডা আনন্দ দিবো, শান্তি দিবো? যান টোকান, আমি ঘুমামু...
     উঠি না। এই হল কাঁচামিঠে আমের গাছ। এইখানে তার আসন পাতা। গপিস্ট বুড়া সত্যই ঘুমিয়ে পড়েছেন। এবং সত্যই মুচকি মুচকি হাসছেনমাঝে মাঝে ভ্রূ কুঁচকে কী যেনো অস্বীকার করছেন। পাখিটা ডাকছে। একটা কলাপাতা ওই। সে বাতাসে নড়ে। ডানে আর বামে। যেনো নিজের গাছকে সে হাওয়া করে দিচ্ছে। আজ রবিবার। এখন দুপুর। নিদাঘ। কী একটা রান্না হবে বলে ডাক পেলাম। কই কোথাও কোনও সাড়া নেই। খিদে পেয়েছে। বাড়িটা সত্যই শুনশান। কী করব? পাশে একটু দূরে একটা ঝোপ। তারপরেই কামরাঙা গাছটা। টুবুর টুবুর। দেখি তো কী পাখি। কাছে যেতেই ঝোপে অলস কিছু পোকা ওড়াউড়ি করে। যেনো অনিচ্ছায়। ভালো করে দেখি জোনাকি। কেমন বেমানান। এখন এই এত আলো। দিনের বেলা। এখন জোনাকি তার আলো কী করেছে? আছে, নাকি নিভিয়ে রেখেছে? দিনের পৃথিবীতে জোনাকি থাকে?
     আজকের দুপুরে আর খাওয়াদাওয়া হবে না। বুঝলাম দুপুরটা নিরেট। হাওয়া আছে। ওপরে কারণ ওই দূরে তেঁতুল গাছের ওপরের পাতা সব নাচছে। নীচে কিছু নেই। কেবল একটা কেমন ডাক ভাসছে। অনেক দূরে কে একটা মা তার ছেলেকে ডাকছে, ‘বাবানু রে...’ হয়তো গোমতীর জলে গিয়ে হুটোপুটি করছে বাবানু। বাবানু। কী নাম... বাবানু রে...

     নন্দদার প্ল্যান বেশি কাজ কম। আসলে কেমন যেনো দিশেহারা। সদানন্দের খাতা, ডায়েরি, ওই ফাইলের লেখা, সব সাজিয়ে একটা বই করতে হবে। এই কাজে তিনি আমায় ডাকেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু গুছিয়ে করতে দেন না। এই খাতাটা দেন, সেটা কেড়ে নেন। সেই ফাইল দেন তো সবটা দেন না। আজকাল আর ভালো লাগে না। কিছুই ভাবতে পারি না। নিজের পাড়াটাকেই কেমন রহস্যময় লাগে।
- বুজ্জি
- না, নন্দদা, সময় নষ্ট। আমনে কী চান কন
- আমি জানলে তো আমনেরে কইতাম... আমনে একবার একবার পড়েন
আমি তো কতবার পড়লাম।
- কী করতাম, কন। আমার মনখারাপ অইয়া যায়...
- আমারও অয়। তবুও দেখেন
বলে একটা খাতা এগিয়ে দেন। পড়ে মনে হল আগের লেখাটার অংশইঃ
এই বাজারটার নাম আৎকা বাজার। আজকাল যেখানে খুশি, যখন খুশি একটা বাজার বসে যায়। সব আছে। মাছও। সব্জি। সবাই ছোট ছোট বাল্ব লাগিয়ে নিয়েছে। কেমন করে সারা উদয়পুরে রটে গেলো এখানে সব তাজা, সব সস্তা। সবাই আসে। অনেকের গাড়ি হয়েছে। গাড়ি নিয়ে আসে। এই একটা ছোট বটগাছও কে যেন লাগালো। হঠাৎ করে রীতিমত বাজার। তাই আৎকা বাজার। মাঝে মাঝে জরিনার ঘোরার বাতিক চাপে। দুপুরে কোথায় একটা জায়গায় গেলোওএনজিসি গ্যাসের জন্য কূপ খুঁড়েছে। তাতে কী করে আগুন লেগে গেছে। মাটির অনেক গভীর হতে দগদগে আগুন ওপরের দিকে উঠে আসে। রাশিয়া না জাপান থেকেও লোক এসেছে। নেভাতে পারছে না। দুপুরে সেইটাই দেখতে গেছে জরিনা। দুপুরে খাওয়া হল নাখাবার নিয়ে এলো খেতে হল। এখন ওই বাজারে যাবে। আৎকা বাজারে। সব্জি নিয়ে বসে একটা ছেলে আছে। মামুনওকে গিয়ে বলে, ‘কও মামুন, কিতা আছে আমার লিগ্যা’। মামুন তার সর্বস্ব দিয়ে ফেলতে চায়। কাস্টমার গুল্লি মারাক।
- কেমন দেখলেন আগুন?
- আমনে দেখছেন? যাইবেন?
- না
- রাগ?
- না
- খাইছে, আমনে দেখি মাইপ্যা কতা কওন শিখছেন। আজগা লাল লাল বেডা দেখলাম। সোজা সোজা। পরিষ্কার। কেমন জানি পানসা।
- ও
- ও কিতা?
- আমনেরে দেইখ্যা মরছেনি এক দুইডা?

     কেমন চুপ মেরে গেলো পরিভাবি। জানালার দিকে যায়
ওইদিকে ছাত। গ্রিলে হাত রাখে। ধরে না কিছু রাখে। এমনি রাখে। উলটো দিক থেকে আলো আসছে। হাতের পাতায় পড়ে ভেদ করে বেরিয়ে চলে আসছে আলো। আসতে গিয়ে গোলাপি হয়ে যাচ্ছে। আঙ্গুলগুলিতে একটা পাখির ডাক। টুবুর টুবুর... টুবুর... টুবুর... অনামিকা। কেমন বেঁকে আছে মধ্যমার দিকে। কনিষ্ঠা ওইদিকে গ্রিলের একটা রডকে আলতো করে ছুঁয়ে আছে। মধ্যমা গ্রিলের একটা রডের আড়ালে পড়ে গেলো। তাই আলো ওকে ছুঁতে পারছে না। আঁকুপাঁকু করছে। বৃদ্ধা আর তর্জনী নিজেদেরকে কী বলাবলি করছিল।  যতটা বাহু আলোতে পড়েছে সেখান থেকে আলো বেরুচ্ছে উলটো। তার তোড়ে বাকি আলো নাই আর। বাইরের আলোটা, যেটা কোথায় কোন সূর্য হতে আসছিল, কেমন দিনের জোনাকি হয়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখলাম লোহা গলে যাচ্ছে। আমার পায়ের কাছে কেমন একটা শিরশির হচ্ছে। দেখি পা গলে যাচ্ছে। যেনো মাটি দিয়ে বানানো হয়েছিলো আমাকে। গলে যাচ্ছি, জল পড়েছে গায়েদূরে একটা পাখি ডাকছে, কোথায়? টুবুর টুবুর। আমি নেই। আমি এখন একটা গলে যাওয়া মানুষ। মেঝেতে পড়ে আছি। একটা পাখির ডাক সেই মাটির স্তূপ হতে বেরিয়ে যাচ্ছে। টুবুর টুবুর, টুবুর টুবুর...
-হুনেন
 ডাক শুনতেই দেখি সব আগের মতন। আমি আসলে দাঁড়িয়ে আছি। এদিকে ফিরে আমার চোখের দিকে তাকায় ভাবি। এবার আলো তার পেছনে এসে দাঁড়ালো

-
এই উপরের থিকা পড়লে কেমন ব্যথা?
বুঝতে পারি। চুপ করে থাকি। সজু ওইটা ভালো কাজ করেনি। ওভাবে মরে যায় কেউ?
-আমি মানুষটা কিতা কইতে পারেন? আমি কেডা?
-আমনে কন
-আমনে কন। আমনে কইবেন
আমি কেডা? কেডা আমি? কিতা? কিতা আমি? একজন একজনরে মাইরা লায়। একজন মইরা যায়... আমি কেডা? আমি য্যান চাইয়া থাহি একটা মাইনসের দিকে হ্যায় আমারে মানুষ মানে না। আমার পায়ের সামনে বয়। আমারে সাজায়। গান দিয়া সাজায়, কতা দিয়া সাজায়। সাধনা করে। সাধে না...
- ছাড়েন। ছাড়েন এইসব কথা

- কেরে ছাড়ুম? অদ্দেক জীবন দেখলাম একটা বাঁশির মিধ্যে শ্বাস ফালাইয়া আর কাইন্দা কাডাই দিলো। যত তাইনের তে দূরে যাই, তত তাইনে হাসে... কাছে আইলে কান্দে...
- মজিদভাই তো এমনই?
- তই আমি কেমুন?
হঠাতই বুক হতে কাপড় সরিয়ে দেয় পরিভাবি। কেমন একটা সুডৌল অনচ্ছতা। একটা খাম। বেশ বড়। ব্লাউজের ভেতর বুকের ওপর থেকে নীচে। এক টানে ওটাকে খোলে। ভেতরের সব কাগজ ছুঁড়ে মারে আমার দিকে। এই ছাতা আমনেরে দেখাইতে আনছিলাম হেইদিন। আমনেও হেই পাও লইয়া পড়লেন... আমিও দেখাইতে পারলাম না... দেখেন। হেইদিন দেখলে আজগা আর এই লাজে পড়ি না আমি।


     উইল। সজু করে গিয়েছেসব।সবকিছু। স্থাবর অস্থাবর। মালিক জরিনাবিবিস্বামীঃ মজিদ মিয়াঁ।