মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০১৭



অশোক দেব
সদাপুরণ-১৩

মাচ্ছা স্বপন ডেঞ্জারাস। চাইলে সে শুকনো ডাঙার থেকে মাছ ধরে দেখাতে পারে। ঘোর অন্ধকারে জলের দিকে তাকিয়ে থাকে স্বপন। শ্বাস নেয় না। গভীরে মাছের চলাচল জলে যে কম্পন তোলে তার কাঁপ স্বপনের শরীরে এসে বাজে। ঝুপ করে জলে লাফায় স্বপন। নিঃশব্দ। মাছের থেকেও নিঃশব্দে সে জল কাটতে পারে
ঝাঁপ দেয়, ডোবে। মাছ তুলে আনে। হয়তো কোনও সোমত্ত রুইহয়তো একটি তরুণ কাতলামাছ। তন্বী মৃগেল।স্বপন জল থেকে ছিনতাই করে আনলে মাছ কিছু মনে করে না।স্বপনের হাতে একটু লাফালাফি করে। যেন কেউ কাতুকুতু দিচ্ছে হাসে। মনে করে খেলা। শেষে বুঝতে পারে স্বপন আসলে নিষ্ঠুর। বাতাসের মাঝখানে থেকে বাতাসের অভাবেই মাছ মরে যায়। মরার পরেও অভ্যাসবশত কানকোর হাপড় নাচায় কিছুক্ষণ। মাচ্ছা স্বপন হাসে।
     তৃতীয়ার চাঁদ অলস। সে তার খণ্ডিত কলা আকাশে রেখে বাকিটা জরিনার শরীরে সরিয়েছে। একটা আলোকের মত দাঁড়িয়ে থাকে জরিনা। তাই দেখতে বয়স্ক দিনের কোলে নিজের ভগ্নাংশ নিয়ে উঠে এলো চাঁদ। এটা জরিনার স্নানের পুকুর। আজকাল অসুবিধে হচ্ছে। জলে নামলেই মাছের শিশুরা তার পায়ে এসে ছোট ছোট কামড় দেয়। এমনকি জঙ্ঘায় উঠে এসে আলতো ঠাট্টা করে। কিছুক্ষণ ভালো লাগে। বেশিক্ষণ কিছুই ভালো লাগে না তার সে ঘোষণা করে, তার স্নানের পুকুরে একটাও মাছ থাকা চলবে না। চলবে না, মানে চলবে না। গপিস্টের কানে যেতেই জেলেদের খবর দেওয়া হল। রহিম মিয়াঁ গপিস্টের জরিনা-মা আকাশের চাঁদ চাইলে রহিম মিয়াঁ পাঁচটা চাঁদ এনে দেবেন। কিন্তু জেলেরা তো আজ আসি কাল আসি করে আসে না।দু-বেলা স্নানের অভ্যাস তার, জরিনার মন খারাপ।মাছ, মাছধরার খবর স্বপনের কাছে বাতাসে বলে দেয়সংবাদ সে  শুনেছে। সে নিজেই একটা ভোঁদড়, উদমানুষ। উদবেড়াল হতে গিয়ে মানুষ হয়ে গিয়েছে।আজকাল প্রতিদিন আসে। অদ্ভুত কায়দায় মাছ তুলে আনে।দুটো তিনটে মাছ এভাবে সে সকলের পুকুর থেকেই তোলে। সেগুলো বেচে দিতে পারলেই দিনের রাজা। কেউ কিছু বলে না। স্বপন রাতে পুকুরে পুকুরে ঘোরে বলে বড় চোরেরা তফাৎ থাকে।  আজকাল জরিনার পুকুরে তার বিস্ময়কর শিকার চলছে জরিনা দাঁড়িয়ে দেখে। একদিন, দুদিন। তিনদিন।
     আজ তৃতীয় দিনে যখন মাচ্ছা স্বপন এসে জরিনার ঘরের সামনে দাঁড়ালো, যখন সে গলা খাঁকাড়ি দিল, জরিনা বাড়িতে নেই ভেবে উদ্বিগ্ন হল, যখন স্বপন অকারণ পায়চারি করছিল, যখন সে বারবার জরিনার ঘরের ভেতরে সোজা না তাকিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল,  যখন তার কেমন অস্থির অস্থির লাগছিল, তখনই হেসে ওঠে জরিনা। সেই হাসিটা, যে হাসিটা আসলে একটা বুনো ঝরনার শব্দ।  স্বপন ভ্যাবাচেকাচলে যাচ্ছিলো। হুনেন, যান কই?জরিনা ডাকে। স্বপন পড়া না পারা ছেলের মতন এসে দাঁড়ায়। আমি আর মজিদ ভাই একটু হেঁটে এসেছি। এখন বেলের পানা খাবো। জ্বালে জ্বালে প্রায় লাল হয়ে যাওয়া দুধতার সঙ্গে বেলের লালচে হলুদ মাংস মিশিয়ে তাতে মাতারবাড়ির পেঁড়া মেখে জরিনা এই অমৃত বানায়। আপাতত মজিদভাই সেটা খাচ্ছেন বড় পেতলের জামবাটি গোল একটা গভীর চামচ।এসব সকালে খাওয়া ভালো। কিন্তু জরিনার খেয়ালে সকালটাই যদি বিকাল হয়, কে কী করবে? লালুসরাইল্যাও চেটে চেটে খাচ্ছে তার নির্ধারিত স্টিলের পাত্র হতে। জরিনা এই কুকুরকে নির্বিচারে সব খেতে শিখিয়ে ফেলেছে। আমার খাওয়া স্থগিত হল। আমি ওইদিকে তাকিয়ে আছি, যেদিকে জরিনা তার হাসিটি থামালো। মাচ্ছা স্বপন আসলে ধরা পড়েছে। সে উদমানুষ, জানে না, তার ভেতরের নড়াচড়া আসলে ধরে ফেলছে কেউজরিনা তাকে এখন জল থেকে তুলে বাতাসে রাখবে।
   গান গাইতে পারেননি আমনে?
এই প্রশ্ন শুনে কিছু না বলেই স্বপন শুরু করে গান।জিসকি বিবি মোটি, উসকা ভি বড়া নাম হ্যায়সে তার কণ্ঠে একটা আলগা ওজন দিয়ে অমিতাভ বচ্চন হতে চায়। বেতাল, বেসুর। আমার হাসি পেল। হেসে উঠি। শুনেই স্বপন থমকে যায়।
   এই কু, কুউউ, শালারপুত, হাসলি ক্যারে?
পরীভাবি ক্ষেপেছে। আমার হেসে ফেলা উচিৎ হয়নি। আর আমার হাসিটাও নোংরাহা হা হা। এটা শুনলেই জরিনা বলে, ‘হাসতেও শিখন লাগে, এমনে হিয়ালের মতন হাসেন কেরে?’ এখন, মানুষের মতন হাসতে তো পারি না। আর শেখা হল না, আমি কী করি! আর যার হাসি ঝরনার মতন, তার কাছে সব হাসিই শেয়ালের হাসি। গান থামিয়ে রাখা মাচ্ছাস্বপন বুঝতে পারছে না কী করতে হবে। একটা খিলখিল এলো হঠাৎ। তারপর জরিনা তাকে টেনে নিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে
   স্বপইন্যা, তোর বাপের নাম মনে কর শেষবারভুলনের সময় অইছে
মজিদভাই রসিকতা করলে সেটাতে হাসি ওঠে না। পুলক জাগে।
   পোলাডা কই থিকা আইছে সদাভাই, জানেন? আগে দেখছি না তো।
   রাইয়াবাড়ির থিকা বলে, দাঙ্গার পরে, নতুন আইছে।
   দাঙ্গা কথাডা কন কেরে? শুননে মে ঠিক নেহি লাগতা
   অইছে দাঙ্গা, কিতা কমু?
   কিতা কইবেন... ঠিকই তোমানুষ এতো লরে কেরে কন তো?একবার হিন্দুস্তান পাকিস্তান, একবার টিপরা বাঙালি... কত লরে?
    নিজের ঘরে বসে বেলপানা খাচ্ছিলেন রহিম মিয়াঁ। বাটি হাতে বেরিয়ে এসেছিলেন, এঁটো কিছু তিনি নিজের ঘরে রাখেন না। এরা পিতার সামনে বসে না। রহিম মিয়াঁ আসতেই মজিদভাই উঠে দাঁড়ায়যেন সৈনিক। আমিও দাঁড়াই।‘বইয়েন বইয়েন, কতা আছে’। আমরা দুজনে বসি। রহিম মিয়াঁর ঘরে সজু যে ছিলো, সেটা এতক্ষণ বোঝাই যায়নি। এখন সে একটা চেয়ার এনে রহিম মিয়াঁকে বসতে দেয়। চোখের গতি বেড়ে যায় রহিম মিয়াঁর। পিটপিট। পিটপিট। বোঝা যায় তিনি এখন গপিস্ট হবেন, এখন তিনি বলবেন। ভাবছিলাম কী বলবেনএর মধ্যেই শুরু হয়ে গেলঃ
     তহন আমি পাইখ্যল। পাখি ধরি। খোয়াইয়ের জঙ্গলে অস্ত্র পাইলাম। হেডির সুতা ধইরা দেখা অইলো আমার গুরুর লগে।নবকুমার ঘুঙুর। পাখি ধরন ক্ষেমা দিয়া আমি ছায়ার মতন গুরুর পায়ে পায়ে ঘুরি। আমার মনে অইলো গুরুর শত্রু আছে। আমরার লাইঠ্যলের বংশ। বাপদাদারা রাজার লাইঠ্যল আছিল। আমি নিজে নিজেই অইয়া গেলাম গুরুর লাইঠ্যল। সেইবার গুরু যাইবেন আসাম। তহন দেশভাগ অইয়া গেছে। কিন্তু পাসপোর্ট ভিসা নাই। ডেলি ডেলি মানুষ আইয়ে পাকিস্তান থিকা। রিফুজি। গুরু মনতলা স্টেশন থিকা রেলে উঠলেন, পাকিস্তানি রেল।ইন্ডিয়ার কাছে আইয়ে। ভিতরে ঢোকে না। লস লসই, খাইল্যা রেল ফিরা যায়। য্যান কাইজ্যা লাইগ্যা আইঅন যাওন বন্ধ করছে ভাইয়ের বাড়িত ভাই।এদিগে আবার ইন্ডিয়ার রেল। রেলের চেয়ারা একই। পাকিস্তানে পাকিস্তানি চানতারা মার্কা টিকেট, ভারতের টিকেটের চেয়ারা মনে নাই। মনতলা থিকা লাটু, লাটু থিকা মহিষাসন। তারপর গুরু হেই রিফুজি মাইনসের ছদ্মবেশ ধরে। আমিও। পোটলাপুটলি লইয়া রেললাইন ধইরা হাইট্যা গিয়া আমরা যাই এক ঘুঙুরের বাড়িত। বেড়ার ছোট্ট একটা ঘর। সারা ঘরে, সারা বাড়িত মাছের গন্ধ। কৈবর্ত। সোনারাম ঘুঙুর। রাইতে গুরু ঘুমাননা। ডর আছে। আমিও জাইগা থাকি। হুনি, সোনারামরে তার বউয়ে কী জানি কয়। কয়, ক্যামনে চলবো? জাল বন্ধক, চাল নাই। হের মইধ্যে অতিথি দুইজন।থাকবো চাইরদিন। সোনারাম কয়, আমি তো জাল ছাড়া পারি না। আমি কি উদবিলাই? আমি কিতা করতাম? আমি হুনি। গুরু হুনেন। আমার গুরু নবকুমার ঘুঙুর। একটা মড়া নেওয়ার খাটেই তাইনের বিছনা। তাইনে শোয়া, আমি বইয়া আছি। য্যান একটা কেডা চুতরা পাতা লাগাইয়া দিছে গুরুর শইলে। মাইনসের কষ্ট হুনলে তাইনে চেইত্যা যানগাকার উপরে জানি চেতেন। সারারাত উসখুস উসখুসআকাশে ভোরের ফর অইতেই গুরু কন, ‘ডাকো’
   সোনারাম
   গুরু, কন
   কত টেকা?
   দেরশো
   নও
সোনারাম নিতে চায় না। গুরু চোখ দিয়া তারে লেইপ্যা দেন, যেমন বেডিয়াইতে মাটির ঘর লেপে। সোনা টেকা নেয়।
   দুইদিনে তোমার টেকা আইয়া পড়বো। শুকনাত খেও দিলেও মাছ পাইবা
     সোনারাম বেকুবের মত গুরুর দিকে চায়। আমি তারে আবার কইলাম, ‘শুকনাত খেও দিলেও মাছ পাইবা, গুরু তো কইয়া দিলেন যাও জাল ছুডাও খেও দেও, খেও দেও’।
     গপিস্টের কথার মাঝেই জরিনার ঘরের থেকে সে হাসি ছুটে আসে। তার সাথে বেরিয়ে আসে মাচ্ছা স্বপন। থরোথরো। কাঁপে। মজিদভাই আবার রসিকতা করে, ‘ইডা ছোবলের কাঁপ না। তারে খালি শ্বাসের বাড়ি দিছে’। আমি হাসবো না চুপ থাকবো ভাবতেই বেরিয়ে আসে জরিনা। মজিদভাইয়ের করাতের লুঙ্গি পরেছেকামলাদের মত হাঁটুর ওপরে শক্ত করেপেছনে নিয়ে গোঁজা। যেন মল্লযোদ্ধা। একটা লাল গামছায় ব্লাউজের ওপর স্তনযুগল টাইট করে বাঁধা। যেন ত্রিপুরী রমণী। বাকি উন্মুক্ত শরীর হতে কী একটা ঠিকরে বেরোচ্ছে। আলোও হতে পারে, ঊষাও হতে পারে। এই দৃশ্য দেখে চোখ সরিয়ে রাখেন রহিম। আমার কৌতুক হল। কিন্তু হাসে কোন শালা! জরিনা সোজা চলে আসে মজিদভাইয়ের সামনে। পিছু পিছু চলে আসে মাচ্ছা স্বপন, শ্বাসের বাড়ি খেয়েছে সে। নিরুপায়।
   আমি সাতার শিখুম। স্বপনভাই শিখাইবো।
   শিখেন, আচ্ছাই হোগা। ছানের ঘাটেও আর বেড়া দিয়া রাহন লাগতো না।
   স্বপনভাই আমারে একদিনে সাতার শিখাইবএকদিনেই শিখ্যা লামু।
     স্বপনের কাঁপ বাড়ে। যেন সে সারাজীবনের সাঁতার জরিনার পায়ে এখুনি ঢেলে দেয়। কী জানি কী বুঝে সে বলে, ‘চলেন জলে যাই’।আর এতেই লেগে যায় আগুন। সজু এসে মাচ্ছা স্বপনের ঘাড়ের কাছে লাথি মারে। সজু আবার সিনেমা দেখে ক্যারাটে শিখেছে। লাথি খেয়ে পড়ে যায় স্বপন।এসব আসলে তার গায়ে লাগে না। কিন্তু আপাতত উঠবে নাকি মাটিতেই শুয়ে থাকবে,বুঝতে পারে না। করুণ করে জরিনার দিকে তাকায়। চোখ দিয়ে বলে, ‘আরও মারতে বলো, মার খেতে সুখ’। তাতেই সজু আবার মারে। মজিদভাই এসব দেখছিল। মজিদভাই নীরবতাকেই কেমন করে যেন কথা করে তোলে। সেই নীরবতাকে আরও নিরেট একটা শব্দে বদলে নিয়ে মজিদভাই বলে, ‘থামেন’। সজু স্থির।
   মারেন কেরে?
   সাতার শিখলে আমি শিখামু, তে কেডা?
   আমনে কেডা?
   না, মানে...
   কুনু মানে নাই। যে শিখতে চায় তে ঠিক করব কার থিকা শিখবো, আমনে যান
     যেন ভিজে গেছে দেশলাই। সজু। সে তরতর করে বেরিয়ে যায়। কী বুঝে সে জরিনাকেই বলে, ‘দেইখ্যা দিমু’।
    দেইখ্যা দিবেন? দিয়েন দিয়েন। ভালা কইরা দেইখ্যা লইয়েন দেওনের আগে।
তারপর সেই ঝরনাটা খুলে দেয় জরিনা। হাসে। স্বপনকে টেনে নিয়ে সোজা জলে ছুঁড়ে মারে।
     সুর কেটে যায়। কেবল রহিম মিয়াঁ তাঁর গপের থেকে বেরোতে পারেন না। ‘এই পোলাডার গাওয়ে হেই গন্ধডা আছে’।
   কোন গন্ধডা?
   ওই যে মাচ্ছা গন্ধ
   আইচ্ছা আমনের সব বুঝি, ঘুঙুর বুঝি না।
   সব বোজেন?
   না, মানে... ঘুঙুর কয় রকম?
   আমনে লালনের নাম হুনছেন?
   হুনুম না ক্যান
   লেলিন?
   লেনিন?
   ওই অইলো
     বলেই নিজের ঘরে চলে যান রহিম। আমার বেলের পানাটা আর খাওয়া হল না। এতক্ষণে কেমন একটা থকথকে ভাব এসে গেছে। এদিক দিয়ে ছোট একটা বেগুন ক্ষেত। তার মাঝখান দিয়ে একটা শর্টকাট। চলে আসি।
***
এখন খুব গরম। সদার এই মদ্যপানের ঘর। পাগলের মতন বাতাস। এই তার কাপড়ে বাঁধাই করা খাতা। এটাতে চিঠিগুলো নেই। তারিখও না। সবটা পড়ি। বারবার পড়ি।  দেয়ালে একটা ছবি আছে সদানন্দের। বেশ বড়। সাদাকালো। সেটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। হাসছে। এ হাসিটা তাচ্ছিল্যেরযেন সে জগতকে পাত্তা দিচ্ছে না। যেন সে এখন আমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে গালি দিচ্ছে। উল্টে আমার রাগ চড়ে যায়, ‘তুই কুত্তারবাচ্চা, শালারপুত,বাঞ্চোত, বাঞ্চোত’আমি চিৎকার করছি না এখন। আমার সবটা শরীর চিৎকার হয়ে গেল। সে চিৎকার সদার ছবির দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে সেই শব্দ... কু কু কুউউ...
 


   
অশোক দেব
সদাপুরাণ -১২

লঙ্কর হল এক ধরনের আঁকশি। কিংবা হরপুন। কিন্তু তা দিয়ে কিছু শিকার করে না কেউ। চারমাথার নোঙরের মত দেখতে। শক্ত। বাঁশের তৈরি। লম্বা, মজবুত দড়ির মাথায় সেটা বাঁধা।বর্ষাকালে গোমতী কুলটার মত হাসে। বিশাল বিশাল গাছের শেকড়ে সুরসুরি দিয়ে উপড়ে নিয়ে চলে আসে। এর ঘরের বেড়াটা, ওর সাজানো বাগান পুরোটা, যখন যা মনে আসে টেনে আনে
এইখানে সমতল। এই উদয়পুর। ছনবন। সেই দূর উজান থেকে এতসব গাছপালা, কাঠ, গাছের গুঁড়ি ভেসে ভেসে আসে। সমতল বলে একটু ধীর হয়েছে নদী। পাড়ে দাঁড়িয়ে লোকে সেসব ভেসে আসা জিনিস লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে লঙ্কর। লাগিয়ে ফেলতে পারলে দড়ি ধরে থাকো। মানুষের রশিতে আটকে পড়া কিছুই নেয় না উন্মাদিনী গোমতী। অর্ধবৃত্তাকার পথে একে পাড়ে এনে ঠেকিয়ে দেয়। মানুষের লাকড়ির অভাব। সেসব সংগ্রহ করে রাখে। শুকিয়ে রাখে। জ্বালায়। এমন একটা লঙ্কর এখন জরিনার ঘরের দরোজায় ঝোলানো। এ জিনিস এখন আর কাজে আসে না। কেউ ছুঁড়বার নেই। কিন্তু জরিনার দরোজায় লঙ্কর ঝোলানোর অর্থ আছে। অর্থাৎ, সে চুপ করলো। মাঝে মাঝে এই জিনিস দরোজায় ঝুলিয়ে সে নীরব হয়ে যায়। কথা বলে না। কোনও লাটের বাট এলেও তাকে আর কথা বলাতে পারবে না।  আমি তো খেয়াল করিনি। সেদিন গিয়ে ডাকি, ‘পরীভাবি, পরীভাবি’। নীরব। মজিদভাই বারান্দায়। হাত দিয়ে দেখালো দরোজায় ঝুলে আছে লঙ্কর। তবু ঘরে যাই। একটা আরামচেয়ার। এরকম জিনিস রহিম মিয়াঁ ছাড়া কারও বাড়িতে নেই। জরিনা প্রায় শুয়ে আছে। কেন যে শাড়ি উঠে আছে অনেকটা। পায়ের পাতা দুটি দেখা যাচ্ছে। ফুটে আছে যেন। দেবতার গায়ে পা লাগলে প্রণাম করে পাপস্খালন করে লোকে। এ দুটি পা দিয়ে যেন, উল্টে পূজাই দেওয়া যাবে। যেন ফুল, নিছনি। আমি সদানন্দ দাশগুপ্ত। কু-কু। তাকিয়ে রইলাম। ধীরে নরম হয়ে যাচ্ছে মন। মন যেন একটা কী, কী এই মন? যেন একটা কেমন রান্না, কে যেন আমার মনকে ছোট আঁচে তাতিয়ে কিসের সিরায় চুবিয়ে ধরেছে। এ জিনিস আমার হতে নেই। হতে নেই। বেরিয়ে আসবো, দেখি একটা আলো। সে বাইরে থেকে জরিনার মুখে এসে পড়েছে, নাকি তার নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে বুঝতে পারিনি। ইশারায় বসতে বলল। বসি। জরিনা বেরিয়ে যায়। একটু পরে আসে। একটা বড় প্লেটে নানারকম সন্দেশ, পেতলের গেলাসে জল। গেলাস কুরুশে বোনা ঢাকনায় ঢাকা। আমার খাদ্যে মন নেই। মন অন্যত্র। আড়ে আড়ে সেইদিকে তাকাই যেখানে তার অপার্থিব পায়ের পাতা মাটিকে স্পর্শ করছে। জরিনা কী বোঝে, আমাকে আঙ্গুলের ইশারায় তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে বলে। বাইরে একটা গুনগুনের পিছা করছে মজিদ। সরাইল্যা কুত্তাটাও আছে। তার থাকাটারও একটা শব্দ আছে। খেয়ে নিলাম। জরিনা নেই। কখন বেরিয়ে গেল!
     আমার কী হল? নারীদর্শন করলাম? আমি কী করব? গা কাঁপছে। ধীরে বেরিয়ে আসি। এখন বিকাল। দূরে কাঁচামিঠে আমগাছের নীচে তার একঘেয়ে আসনে বসে আছেন রহিম মিয়াঁ গপিস্ট। বেরোতেই ইশারায় ডাকলেন। যাই অর্ধেক চোখ দিয়ে আকাশে দেখেন রহিম। যেন আমাকেও দেখতে বলেন। দেখি আকাশ ভরা শকুন। কে এদের জ্যামিতি শিখিয়েছে কে জানে। এরা আকাশে বৃত্ত আঁকবে বলে ওড়ে।
   সদামিয়াঁ
   কন
   পারবেন?
   কী
   আমনের ভাবিরে কথা কওয়ান। দেখেন আকাশে হগুণ। সব যাইব।
     আকাশে শকুন এলে লোকে ভয় পায়। কার ধলীগাই যাবে, কার শখের ছাগল যাবে, ঠিক নেই। লোকে আগেভাগে গোমতী ছানাছানা করে। কোথাও উজান হতে কোনও গবাদির শব এসে কোনও চরায় আটকে আছে কিনা দেখে। সেটা পেয়ে গেলে স্বস্তি। নইলেই শঙ্কা। ‘আমি কী পারুম?’
   পারবেন, যান
     যাই। বারান্দায় মজিদ। তার গায়ে গায়ে সেই গুনগুন। এত গান সে কোথা হতে আনে? সারা বাড়িতে আজ অদ্ভুত নীরবতা। দূরে জহিরুলের ঘোড়া। দড়ি নেই তার। মুক্ত। ধীরে ঘরে যাই। নিচু কাঠের টেবিলে তখনও সেই সন্দেশের প্লেট। গেলাস। তার থেকে জল নিয়ে চকচকে পালিশ করা টেবিলে জরিনা লেখে, ‘ঊষা, সোনাচর’। ফাঙ্গাসের লেজ দিয়ে তৈরি চাবুকে কেউ মারলো আমায়? কেউ এক লক্ষ সোনামুখি সুচ ফুটিয়ে দিল মেরুদণ্ডের কশেরুকার ফাঁকে ফাঁকে? ঝটিতে বেরিয়ে চলে আসি।
     আজ আর বাড়ি যাব না। এখন থেকেই বসে থাকবো এইখানে, এই সোনাচরে। গোমতীর এই পাড় ঘেঁষা এই চরে সোনা ফলে। তাই সোনাচর। আসি।একটু দূরে মেলাঘর থেকে আসে কুমোরের নৌকা। সোনাচরে তাদের তাঁবু। একটা বৃদ্ধ নৌকার পাহারায়। বিচ্ছু ছেলেরা ঢিল ছুঁড়লে বিপদ। মাটির তৈজস তারা সাজিয়ে তোলে নৌকায়। একটা ঢিল এসে পড়লে ভাঙবে।এমন করে সাজানো, একটা ভাঙলে সব এক এক করে ভাঙে। চলে আসি। বিকেলের দিকে মুখ করে বসি। দূরে ওপাড়ে নদীর থেকে খাড়া উঠে গিয়েছে পাড়। লাল হলুদ রং। তাতে ছোট ছোট গর্ত করে কী সব পাখি নিজেদের বাসা তৈরি করেছে। উড়ে এসে সোজা ঢুকে যাচ্ছে, বেরিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট কী পাখি দুটি ডানার একেবারে প্রান্তদেশ নদীর জলে ছুঁইয়ে উড়ে চলেছে। ওইদিকে ছাতারিয়া গ্রাম। আগে নদী সাঁতরে যেতে হত বলে, সাঁতারিয়া। ছাতারিয়া। কেমন অবসন্ন লাগছে। কেন? কুমোরেরা এখন মাটির পাত্র নিয়ে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে। ধানের বদলে মৃৎপাত্র। কখনো টাকাও নেয়। তাদের তাঁবু খালি। গিয়ে দেখি পাটি, কাঁথা আর শক্ত বালিশ। বসি। এলিয়ে পড়িএকদিকে উলুধ্বনি, তার আড়ে আড়ে আজানের শব্দ বেজে সন্ধ্যা নামে। আমাকে কে কী করেছে, এত ঘুম পাচ্ছে কেন? যেন কে ঘুম পাড়িয়ে দিল।  
     দেখি, গোমতীর কিছুটা কেটে নিয়ে মূল ধারা থেকে সরিয়ে একটি স্তব্ধপ্রায় ধারা তৈরি করা হয়েছে। গোমতী তখনও গোমতী? কিন্তু এটি রাঙ্গামাটি। রাজধানী। এইখানে নৌবহর। রাজনৌকা অনেকগুলো। একই রকম সব। রাজা ঠিক কোনটায়, শত্রু যেন ঠাহর করতে না পারে। প্রাসাদ থেকে একটু দূরে কুলদেবতার মন্দির। তার পাশেই এই ছোট্ট বন্দর। দেবপ্রণাম করে সেই নৌকা করে বেরিয়ে যাচ্ছে রাজপোশাক পরা কে যেন? কে? জহিরুল, নাকি সজু ওটা? কালো কালো শরীরের মাঝিরা একে একে গিয়ে নৌকায় চেপেছে একটু আগে। একজন সান্ত্রির কাছে তাদের শরীর দেখাতে হয়েছে। জ্বরজারি, রোগবালাই নেই তো? কারও কাছে নেই তো গুপ্ত অস্ত্র? রাজপোশাক পরে যে লোক সবার আগে যাচ্ছিল, এখন দেখি সে তো আসলে মজিদ। দূরে একজন পুরোহিত। এতক্ষণ রাজার যাবার পথে পথে শান্তিজল ছেটাচ্ছিল। এখন, ক্ষণে রহিম মিয়াঁ, ক্ষণে আরেকটা কে যেন হয়ে যাচ্ছে। একটা আলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনেকগুলো আলো। কে ইনি? জরিনা? চারদিকে কে এত ঘুঙুর বাজালো? তীব্র একটা আলো এসে আমার চোখে পড়ে। চোখ খুলে দেখি মুখ। কাঁচাপাকা দাড়ি, কষ বেয়ে কী পড়ছে, রক্ত? নাহ, পান খেয়েছে লোকটা। উঠে বসি। ‘বাড়ি কই? ইহানে কিতা? মাল টানছেন?’ আমি উঠতে যাই, ‘না না ঘুমান ঘুমান, আমরা নৌকাত যাই’। বলেই কুমোর লোকটা চলে যায়। এখন রাত? ঊষা হতে আর কতক্ষণ বাকি? ঝিম ধরে আছে পৃথিবী। বাইরে বেরিয়ে দেখি আসলে ফিকে হয়ে গেছে রাত।
     একটু দূরে সেই ঝোপ। তার অনেক কুখ্যাতি। এখানে শ্যাওড়া গাছে শত্রুকে বাণ মারে লোকে। এই গাছটাতে শত্রুকে প্রতিষ্ঠা করে তাতেই একটা তীর গেঁথে দেয়। শত্রুর কী হয় জানি না, গাছের কিছু হয় না।  চারদিকে ছোট ছোট বাঁশের ঝোপ। মাঝখানে একটু জায়গা কেন যে নিকনো, কে জানে। অজান্তেই চলে আসি। জরিনা। দাঁড়িয়ে নেই, পৃথিবী তাকে ঠেলে ওপরে ধরে রেখেছে যেন। যেন তার পদতলে থাকতে পেরে এই শেষরাতের পৃথিবীর আনন্দ ধরে না। একটু একটু পাখিও পাঠালো কে। তারা কোথা হতে আধো আধো ডাকে। আমাকে কে কী করেছে। দাঁড়াই। টলতে থাকি। জরিনা এগিয়ে এলে আপনি হাঁটু গেড়ে বসে পড়ি মাটিতেযেন, তৃষ্ণা একটা রোগ, আমাকে ঔষধ দেওয়া হবে এমনি করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরি মুখ।আমার এই চির অবনত মুখ সেই পরী নিজের হাতে ধরে। চুম্বন করে। তারপর কাঁপতে থাকে জরিনা। আমার ভেতরে একটা আলো এসে ঢুকে গেছে। শীত শীত, পুষ্প পুষ্প। কাঁপছি। আমাকে লতা করে পরীভাবি বৃক্ষ হল। আবার আমাকে বৃক্ষ করে লতা। শরীর শরীরকে স্পর্শ করছে না। আবার ছেড়েও যাচ্ছে না। সকল শূন্য হয়ে যাচ্ছে। স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারা সব ঘুঙুর বাজাচ্ছে। জরিনা আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে, ‘মানুষ থাইক্যা কী করবা? হেই তো মরণ লাগবো। ঘুঙুর অও, ঘুঙুর অও’।
     আমি কি আছি নাকি নাই? সময় এমন যে, কেবল চলে যায়।
     অনেকের সোরগোলে চেয়ে দেখি পড়ে আছি মাটিতে। সত্যই কি সদানন্দ দাশগুপ্ত আজকের ঊষাকালে আর মানুষ নেই? ঘুঙুর? বেরিয়ে আসি এই বাণমারা ঝোপের থেকে। ছেলে ছোকরাদের বিরাট মিছিল। বাঁশে উলটো করে বাঁধা জহিরুলের ঘোড়া। সামনে দুজন, পেছনে দুজন তাকে কাঁধে করে নিয়ে আসছে।  ফেলে যাবে নদীতে। উপরে তাকিয়ে দেখি এখনও আকাশে বৃত্ত এঁকে চলেছে শকুন। ল্যাতপ্যাত করছে জহিরুলের ঘোড়ার গ্রীবা। মুখ লেগে যাচ্ছে মাটিতে। চুম্বন করছে নাকি? নাকি পৃথিবীর পথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৃত্যু রেখে রেখে যাচ্ছে এই শব?
     দ্রঃ সদানন্দ কি সত্য নাকি মিথ্যা? আঠারো এপ্রিল, ১৯৮৪ সালের এই এন্ট্রিটা আমাকে পড়ে শোনালেন নন্দ দারোগা। শেষ করেই উঠে দাঁড়ান, ‘কই গেলো জরিনা? কই গেলো মজিদ’? এই মশাই, আপনে এই পাড়াত আছেন জন্ম থিকা। আপনে দেখছেন না?’
   দেখছি। আছিলো তারা। সদাও তো আছিলো। নিজেরে গুলি কইরা মারলো। তারেই কি দেখছি? দেখলেই ডাক দিছি, কু কইরা। হে যে দেখতে জানে, হিডা কি আর জানছি?
   দেখতাম চাই,আমি দেখতাম চাই, জরিনারে দেখতাম চাই। ঘুঙুর কিতা?
   নন্দদার হাত থেকে খাতাটা নিই। গুছিয়ে রাখি, ‘সবাই জীবনে একবার জরিনারে দেখতে চায়। চাইতে চাইতে দেরী করে, আকাশে শকুন আইয়া পড়ে’।