শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০১৭

আকাশে ভোমা পরনে মারু
সদানন্দের চোখে কী পড়েনি? সারা পাড়া ঘুরে ঘুরে এসব সে সংগ্রহ করে গিয়েছে এইসব মানুষ তো আমরাই সদা আমাদের দেখেছে, আমরা ওকে দেখিনি কী দেখেছিল সেই রাতে সদানন্দ?
অশোক দেব
সদাপুরাণ -
ওই যে নিচু আকাশে একটা লণ্ঠন উড়ছে, সেটা ঘুড়িতে বাঁধা। ভোমাগুড্ডি। এই বিশাল ঘুড়ির নাম ভোমাগুড্ডি। গপিস্ট রহিম এই একটি কাজ নিজে হাতে করেন। হাল্কা ধুতির কাপড়ে ভোমাগুড্ডি বানান কত তার করণকৌশল, কত আয়োজন, কত হেল্পার।কিন্তু কোথা হতে তিনি জেনেছেন, ঘুড়ি ওড়ানো হারাম। তাই এই ভোমা ওড়ে নগুসার বাড়ি থেকে। একবার উড়িয়ে দিতে পারলে সে সারারাত স্থির হয়ে ওড়ে। তখন শক্ত মোটা টুইল সুতোয় গাছের সঙ্গে বেঁধে দিলেই হল। বাঁশের দুটো কঞ্চি কায়দা করে  ঘুড়ির কানের সঙ্গে জোড়া। বাতাসে আহত হয়ে এরা শব্দ করে।  একটানা একটা শব্দযেন গোঙায়। সেই শব্দের নীচে নগুসার ভাঙা সংসারের উঠোনের দোলবেদীতে বসে আছে তার বড় ছেলে। সজল। সজু। ঘুড়িতে বাঁধা লণ্ঠন। সে আকাশের ছোট্ট একটি টুকরোকে আলোকিত করেই ফুরিয়ে যায়। সেই আলোর নীচে বসে আছে জরিনা। তার থুতনি সজুর হাঁটুর ওপর রাখা। সেটি দিয়ে মাঝে মাঝে সে জোরে চাপ দেয়। একটু ব্যথা পায় সজু। মধুর সে ব্যথা সে থাইয়ের পেশি শক্ত করে চাপটা নেয়। এটা একটা খেলা। জরিনা খেলে। জরিনার গায়ের গন্ধ খাচ্ছে সজু। তার জন্যেই আসে জরিনা।
মজিদ মিয়াঁ তার স্বামী। সে তার লালুকুত্তাকে বসিয়ে রাখে ঘরের সামনে। আর সারারাত ধ্যান করে। মাঝে একবার ওঠে, কোনও লোহা যেমন তার চুম্বকের দিকে ধায়, তেমনি ধেয়ে যায় মজিদ। আকাশের দিকে ধায়। যেন আকাশ তাকে আকর্ষণ করে। ওপরের মাদা অন্ধকারের দিকে মুখ তুলে তাকায়। কাকে যেন বলে, ‘আর কত? আর কত?’ এক সময় ফিরে এসে একটি শীতল পাটি পেতে শুয়ে পড়ে। বালিশ নেই। লুঙ্গির গিঁট খুলে সেটাকেই জড়িয়ে নেয় গায়ে। পাশে তাদের সেগুন কাঠের খাট। বাহারি। খুব সুন্দর করে সাজানো। যেন চিরবাসর। সেটি খালি, পাশাপাশি দুটো বালিশ। আছে। নির্বিকার। মজিদের বাবার দেওয়া স্ত্রী তখন ঘরে নেই। সে নগুসা-র দোলের সিঁড়ি করা মাটির বেদীতে বসে আছেসজুর খোলা থাইয়ে থুতনি দিয়ে চাপ দেয়। সজু আজকাল শর্টস পরে।বারমুডা প্যান্ট এদিকে এটাকে বলে মারু হাফ প্যান্ট।
জরিনা স্পষ্ট করে হাসে না। তার ওপরের পাটির দাঁতের মাঝে একটু ফাঁক। সেটাকে খুঁত মনে করে সে। আসলে সেটি যে তাকে আরও সুন্দর করেছে তা বুঝেছে সজু। জরিনার রান্না করার বাতিক। খাওয়ানোরও। খেতে বসে কোনও একটা পদ নিয়ে বললেই হল, ‘নাহ্‌, জমল নাহাহা হাসিতে ফেটে পড়ে জরিনা।তার রান্না খারাপ হয়েছে, এমন হাস্যকর কিছু যেন পৃথিবীতে নেই। ধরা যাক বনপথে পথভ্রষ্ট কেউ হঠাৎ একটা ঝরনার কাছে গিয়ে পড়ল। সেই বুনো ঝরনার মত হাসি তার। সে হাসি হাসলেই সজু বলবে, ‘দেইখ্যা লাইছি, দেইখ্যা লাইছি
  কী দেখলেন সজুমিয়া?
  দাঁড়ি
  দাঁড়ি মানে কিতা?
  লেখার শেষে থাকে যে, ইংরাজিতে ফুলস্টপ, বাংলায় দাঁড়ি
  কই দেখলেন?
  আমনের দাঁতের ফাঁকে। য্যান আল্লায় একখান কবিতা লেখছে, আপনের দাঁতের ফাঁকখান তার দাঁড়ি। আমনেরে লেইখ্যা আল্লামিয়াঁ আর কবিতা লেখেছে না।
তখন আমাদের পাড়ায় নতুন কারেন্টের লাইন আসে। ইলেকট্রিক। সেদিন রহিম মিয়াঁর বাড়িতে লাইন দিল। আলো জ্বলল। হলুদ উপোস করা একটা বাল্ব। তথাপি তার আলো হ্যারিকেনের থেকে চমৎকার। সে উপলক্ষে আমাদের খাওয়াল জরিনা। কী সুখাদ্য, কী সুখাদ্য! সেই আসরেই  জরিনা-সজুর এইসব কথা শুনলাম। আমি তো সদা। কুউউ। আমাকে কেউ গা করে না। আমি ওই মুখ নিচু করে থাকি। কিন্তু মজিদ ভাই? লালুমজিদ? ওরা তাকেও গা করে না।কেয়া বাত, কেয়া বাত। আমনে কী সোন্দর কথাডা কইলেন সজুভাই... আল্লার লেখা কবিতা, বাহ্‌বরং উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে লালুমজিদ।
  আমনে খালি হুইন্যা যানঝামটা মারে জরিনা। লালু চুপ। আমিও।
সেই জরিনা এখন, এই রাতে, আধো জোছনায় সজুকে লেপটে বসে আছে। জরিনা স্বামীর অনুমোদন ছাড়া আসে না। সজু আকাশে ভোমা ওড়ালেই সাজ শুরু হয় তার। আর  শুরু হয় গালিগালাজ।
  ওই নিব্বংশিয়া ডাকে আমারে
  যান, আমনেরে ভালাপায় তো
  লাজ লাগে না আমনের? বুকে আগুন জ্বলে না?
  কেরে জ্বলব, আমনেও তো ভালাপান, যান
  না, আমি যাইতাম না।
  আইচ্ছা, তাইলে থাক
এর পরেই শুরু হয় জরিনাবিবির দারোগাগিরি। এমন কোনও গালি নেই সে লালুমজিদকে দেয় না। এটা ছোঁড়ে, সেটা ভাঙে। লালুমজিদ উদাসীন তাকিয়ে থাকে। যেন জরিনাবিবি তার বাজাতে না পারা বাঁশি। কিংবা তার অসাধ্য সুর। একসময় হার মানে জরিনা।
  হুনেন
  কন
  আমরারে কত কাম কইরা দেয়, বাজার আইন্যা দেয়। আমি তো এমনেই যাই, খারাপ কিছু তো নাই
  মানুষের কাছে মানুষ যাইব, খারাপ কিতা থাকব?
  যাই?
  যান
          এক ছুটে চলে যায় জরিনা। সোজা সজুর কাছে। সজুটা কথা বলে না। যখন বলে, দারুণ বলে। তীর খেলা, ফেন্সিডিল ছাড়া তার আরেক নেশা আছে। বই। সে কত পড়ে কে জানে!
আজ ভোমাগুড্ডির সেই গোঙানির  নীচে আমি তাদের দেখি। আকাশে একটা নিয়মরক্ষার চাঁদফালি। এখানে একটা বাঁশের বেঞ্চ। বাঁশের চারটে খুঁটির ওপর মুলিবাঁশ শুইয়ে বানানো। বসে আছি।  ওদের দেখি। আমি সদানন্দ। আমি কুউউ। আমাকে কেউ গা করে না
  আমনেরে একটা কথা কই’? জরিনা বলে
  কও
  আমনে খুব স্বাদ। ওই যে ইংরাজিতে কন...টেস্টি...
  কোন সময় খাইলেন আমনে আমারে?
  হিহিহি
মানুষকে মানুষ বলছে স্বাদ। সুস্বাদু? অবাক।
  আমনে আমারে বিয়া করেন
  করুম
  এক্ষণ করেন
সজু উঠে দাঁড়ায়। চাঁদের আলো এসে জরিনার দুধে আলতা গাত্রবর্ণের কাছে ক্ষমা চেয়ে সরে যাচ্ছে। সজু তার পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে বসে। ছাত্রদের নিলডাউনের মত। জরিনাকে জড়িয়ে ধরে কোমরে। এর পরেই শুরু হয়ে যায় সেই উদ্ভট কাণ্ড। জরিনা কাঁপতে থাকে, তারপর দুলতে থাকে, তার কেশদাম নাচাতে থাকে। যেন একটা পাগলি। তার আঁচল সরে যায়। হয়তো কোনও বক্ষবন্ধনী নেই ভেতরে, দুলতে থাকে তার ছোট কিন্তু সুডৌল স্তনযুগল। এরা তার শরীর ছেড়ে সজুকে গিয়ে মারবে যেন। এ কী? আমি কি করব? ছুটে গিয়ে ধরব ওকে? সজু কিছু করছে না কেন?
এটাই শেক বাড়িতে মনসা পূজার রহস্য? গপিস্ট রহিম শ্রাবণ মাসে বেশ ঘটা করে মনসা পূজা করান। পুরো শ্রাবণ মাস জরিনা শাঁখা-সিঁদুর পলা পরে। বাইরে একটা মাটির ঘর। সারা বছর বন্ধ থাকে। শ্রাবণে খোলা হয়। সেখানে পদ্মাপুরাণ গাওয়া হয় সারা শ্রাবণ। গপিস্ট জগতকে এটা বোঝাতে পেরেছেন, তাঁর রূপসী পুত্রবধূর শরীরে ভর করে মনসা। আসলে তিনিই মনসা।কাগজে খবর হয়, মুসলমানের বাড়িতে হিন্দুদেবীর পূজা...
একসময় ধপাস করে পড়ে যায় জরিনা। আকাশের ভোমা তখনও গোঙায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় জরিনার চাপা গোঙানিও। সে কী যেন বলে।শালারপুত মজিদ্যা, লালু, কুত্তা একটা, মজিদ্যাকুত্তা... শালার শালা ধ্যান মারায়... আকাশের লগে কথা কয়...আমনে বেডা আমনে বেডা... আমনে টেস্টি, আমনে টেস্টি... স্বাদ সজু ওকে কোলে তুলে নিয়ে এদিকে  আসছে। হয়তো বেঞ্চে  শুইয়ে দেবে। আমি উঠে চলে আসি।
,
সেই সজনে গাছেই ফাঁসি দিয়েছিল নগুসার বউটা। তার ডালের সঙ্গেই বাঁধা ছিল ভোমাগুড্ডি। গোঙাচ্ছিল। যেন সে গোঙানিটাই ফেলে গিয়েছে নগুসার বউ।সেই শব্দের সঙ্গে শক্ত টুইল সুতায় সজনে গাছ যেন নিজেকে ফাঁসিতে ঝোলালো।আমি চলে এলাম। আমি জানি, জরিনার কী হচ্ছিল। শুধু সবটা দেখার সাহস হল না।
এই সাহস নেই বলেই আমি সদানন্দ। কুউ।এখন এসে নিজের শরীরকে জিগ্যেস করি, তার নেই পুরুষ হবার ক্ষুধা? শরীর আসলে বেশি বেশি বলে। সে-ও গপিস্ট। শরীর একটা অতিকথন, জানো? রোজ ক্ষয়ে যেতে থাকা একটা নদীর চরা। মাটি। মাটি বলেই সে আগাছা জন্ম হতে দেয়। কিন্তু মজিদ কী জিগ্যেস করে আকাশকে? ‘আর কত, আর কত?’
জানি না, আজ অবশ লাগছে। একটু হুইস্কি খাব। ইতি ৫ মার্চ ১৯৮৪
তোমার একান্ত
সদানন্দ






মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

অশোক দেব
সদাপুরাণ-
মজিদ মিয়াঁ নিজের নামে কুত্তা পোষে। সরাইল্যা কুত্তাখোদ বাংলাদেশের সরাইল থেকে আনা। মেটে লাল গায়ের রং। মজিদের ডাকনাম লালুমিয়া। এত ফর্সা যে লাল বলে ভুল হয়। তার কুকুরটির নামও লালু। লালু মজিদের পায়ে পায়ে থাকে। লালুমিয়া বাঁশি বাজায় বাজাতে চায়। সুবিধা করতে পারে না। সে আসলে গায়ক। তার গান যে শুনেছে সে জানে। কিন্তু মজিদের উচ্চাশা বাঁশিয়াল হওয়া। সারাদিন নিজের গান একপাশে সরিয়ে রেখে বাঁশি বাজাতে যায় মজিদ। পারে না।
শ্বাসের যন্ত্র। পরান থিকা বাতাস আইন্যা ছয় ছিদ্রে চালান করন, কম কথা?
লালুমিয়াঁ বলে। আর সারাদিন সুর ভাঁজে। পরাণ থিকা বাতাস আনার আবেগেই সে কেঁদে ফেলে। বাঁশিকে আর বাজাতে পারে না। এদিকে পাশের হিন্দুবাড়ির শঙ্খধ্বনি হোক কি উলু, লালুকুত্তা গলা তুলে সুর মেলায়। ঘে--লালুমজিদ যখন বাঁশি বাজায়, তখন তার সরাইল্যা লালুমিয়া সঙ্গত করে। ঘে--উ। শঙ্খ হোক কী বাঁশি সরাইল্যা তাতে সুর মেলাবেই মরাকান্নার মত এই সঙ্গত ফলে এই বাঁশির রেওয়াজ একটি হাঙ্গামা হয়ে ওঠে। রোজকার।
গপিস্ট বুড়া ধুরন্ধর। তিনি পুরুষ। পুত্রদের কাছে পৌরুষ আশা করেন। বড় ছেলে হাসন সুযোগ্য। সে কাঁহা কাঁহা থেকে বিয়ে করে আনে গপিস্ট বুড়া নতুন বউ আসা মাত্র মা-মা শুরু করেন। গুচ্ছের গহনা দেন আশীর্বাদী। তাঁর বড় পুত্র হাসন কদিন ঘর করে, তারপর তালাক, তালাক, তালাক। তারপর আবার নতুন একটা। কিন্তু এটিকে সে কোথা হতে এনেছে কে জানে? এই জরিনা? কথা শুনলে মনে হয় কুমিল্লার। আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টানও আছে। এই হল দুধে আলতা। এই হল হুর। জরিনার মেজাজও সেতারের তার। বায়ু গেলেও বেজে ওঠে। এটাই গপিস্ট বুড়ার পছন্দ
— ‘সংসারে একটা দারোগা বেডিয়াইত থাকন লাগে। নাইলে বেডা আর কিতা, ভিজা মুড়িরহিম মিয়াঁ তত্ত্ব দেন।
কিন্তু হাসন তো হাসন। কী নিয়ে জরিনা তাকে কষে থাপ্পড় দিল একদিন। হাসনও, ‘তালাক, তালাক, তালাক
— ‘
কইলেই হইল? জরিনাবেডি কই যাইব? শালারপুত? জরিনা-মা এই বাড়িত থাকবরহিম মিয়াঁ রায় দেন।
— ‘
আপনের ইদ্দত শুরু হইলো, আপনে থাকেনজরিনাকে এই কথা বলেই তিনি লালুমজিদকে ডাকেন। জরিনাবেডি আপনেরআপনে তো মারফতি মানুষ। বিয়াশাদির কাম নাই। ঘর করেন
সেই থেকে জরিনা লালুমজিদের দারোগা বেডিয়াইত।
জরিনাবিবির নেশা আছে। রান্না করাটাই তার নেশা। সারাদিন যে কতরকমের রান্না সে করতে পারে! দুটি মেয়ে তাকে এগিয়ে দেয়। সজু হল রহিম মিয়াঁর পোষা সে হিন্দু। নগুসা-র ছেলে। কিন্তু  সেটা নয়, এটাই যেন তার আসল পরিচয়, গপিস্ট বুড়ার চ্যালা তীর খেলা আর ফেন্সিডিল হলেই তার চলে। আর সারাদিন রহিম মিয়াঁর মুরিদগিরি। সে-ই দুনিয়ার বাজার করে। জরিনা কেবল উচ্চারণ করে, বোয়াল। চলে আসে বোয়াল। উচ্চারণ করে গোস্ত, চলে আসে গোস্ত। আমিও আসি। সজু আসে এক ধান্ধায় আমি আসি এইসব দেখার ধান্ধায়।
আজ গরুর গোস্ত হচ্ছে। সকালে একরকম হয়েছে। এখন আরেক রকমে হচ্ছে। সোনামুড়া থেকে শুক্রবার-শুক্রবার মমতা বেগম আসে। গপিস্ট বুড়া বলেন, ‘কালা হইলে মমতা বেগম, ভালা অইলে আল্লামিয়াঁকালা মমতা একটা ঢাউস ব্যাগে করে গরুর গোস্ত নিয়ে আসে। রিকশায় বসে বসে ফেরি করে। পাড়ার ভেতরে ভেতরে। বড় রাস্তায় যায় না। তার সারা গায়ে সোনার গয়না। নিয়ে আসে। যাবার সময় থাকে না। এসব আসলে গপিস্ট বুড়া আনান। গপিস্ট বলেন, ‘ছাগলারি। বেডাআইয়েতের একটু একটু ছাগলারি করন লাগেমমতাকে দিয়ে তিনি এসব স্মাগলারি করান। সেই মমতার আনা গোস্ত রান্না হচ্ছে। কাবাব হবে? কী জানি!-ম করছে। আর এদিকে লালুমজিদ আর লালুকুত্তার সমবেত সংগীতসাধনা চলছে। রান্না ঘরের পাশেই এই চালতা গাছ। গোমতীর কালো মাটি দিয়ে লেপা উঠানসে মাটি শুকিয়ে গেলে জোছনার মত সাদা হয়ে যায়।
       বালডা না বাজাইয়া একখান গান গাইয়া লান। এই বাল আপনের দ্বারা হইত নারান্না ঘর থেকে আওয়াজ দেয় জরিনা।
লালুমিয়া শোনে না। সে বাঁশি বাজাতে যায়। সরাইল্যাও গলা তোলে। এটা যে কী একটা হল্লা হয়ে ওঠে! হঠাৎ জরিনা বেরিয়ে এসে একটা কী ছুঁড়ে মারে লালুকুত্তাটাকে। সে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। লালুমজিদ তাকে ডাকে, ‘লালুমিয়া কই যান? আইয়েন, বাঁশি বাজামু
লালু লেজ নাড়তে নাড়তে এসে আবার বসে।
এইখানে বসে আছি। কাবাবের আশা আছে। ওইদিকে কাঁচামিঠে আমগাছের নীচে তাঁর মিথ্যার সাম্রাজ্য নিয়ে বসে আছেন রহিম মিয়াঁ। এখন তাঁর নীরবতার সময়।  এটুকু সময় কথা বলেন না। পরপর তিনটে পুকুর। দুপাশে দুটি, মাঝখানে একটা ছোটএটা জিয়ল মাছের জন্য। রহিম মিয়াঁ নীরবে এদের ওপাড়ে হিন্দুপাড়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। নীরবজপ। এটাও মিথ্যা। রহিম মিয়াঁর নীরবতা সত্য। মৌনজিকির মিথ্যা। তিনি চুপ মেরে বসে থাকেন। আসলে নানা ফন্দি আঁটেন। আমি বসে বসে এসব দেখি।
একসময় আবার বেজে ওঠে বাঁশি। বেসুর। বেজে ওঠে কুত্তাটাও। তারও যেন পরানের থিকা শ্বাস এনে নিজেকে বাজাবার বড় তাগিদ। লহমায় বেরিয়ে আসে জরিনা। একটু তাকিয়ে থাকে লালুমজিদের দিকে। লালু চোখ বন্ধ করে ছয় ছিদ্রের বাঁশিকে পোষ মানাতে চায়। জরিনা রুদ্রাণী। লালুকুত্তা চুপ। মুহূর্ত গেল, এক, দুই, তিন... জরিনা এক দলা থুতু হঠাৎ থু করে ছুঁড়ে মারে লালুমজিদের চোখে মুখে। লালু চোখ খোলে। তার সামনে ভাদ্রের রোদের মত জরিনা,
       চুপ চুপ, একদম চুপ কর্‌ কইয়া দিলাম বাঁশিটা কেড়ে নিতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না জরিনা। শুধু ধরে থেকেছে লালুমজিদ। নির্বিকার। অথচ সে বাঁশি সবটা বল লাগিয়েও নিতে পারল না তীক্ষ্ণ জরিনা।  শেষে আর একটা ফুঁ দিবি... তোর বাঁশি...’  বলেই ঝমঝম করে রান্না ঘরে চলে যায়
স্মিত হাসে মজিদ। সারা মুখে ফেনা ফেনা থুতু। মোছে না, যেন কিছু হয়নি। আমি তার কাছে যাই। চালতা গাছটায় হেলান দিয়ে বসে আছে। একটু বেশি হেলেছে এবার।
       সদা ভাই
       হু
       দেখলেন?
       আয়াম সরি, মজিদ ভাই
       সরির কিছু নাই। কোই বাত নেহি। আপ কিঁউ সরি হতে হ্যায়? এই যে আমি, এই যে আমার লালু। আমিও লালু, আমার কুত্তাও লালু।
মজিদ মিয়াও গিয়েছিল উত্তরপ্রদেশ। মাদ্রাসায়। মাঝে মাঝে হিন্দি বলে।  
       না, মানে...
       এই যে আপনে সদা ভাই, আপনেরে কু কু কইরা ডাকে না মাইনসে?
       ডাকে... তবে... জল আনি, মুখটা ধুইবেন?
       না, র‍্যান দিজিয়ে...এই ছ্যাপ আমি মুছুম না, থাকএই থুক তো আমিই দিলাম আমারে... বউ তো অছিলা...
রেহনে দিজিয়ে। একটা লোক সারা মুখে মানুষের দেওয়া থুতু নিয়ে বসে আছে। তার চোখ বোজা। সে এইসব থুতু রেখে দিতে চায়? লালুমিজদ এখন যেন একটা প্রত্নমানুষ। তার কোন দূর অন্দর হতে ভেসে এলঃ
তুই যেখানে সে-ও সেখানে
খুঁজে বেড়াস কারে রে
হাতের কাছে যারে পাও
ঢাকা-দিল্লি খুঁজতে যাও, কোন অনুসারে...
কেন কাছের মানুষ ডাকছো শোর করে...’

লালুমজিদ গান গায় না। যেন এই গানটা বাতাসে ছিল। সে বাতাস হতে ছেঁকে এনে পরিবেশন করছে। তার সারা মুখে থুতু, চোখে জল। লালুমজিদ গান গায়। লালুকুত্তা কেবলই তার মুখের দিকে জিব নিয়ে যায়, মজিদ সরিয়ে দেয়। গানটাকে আপ্রাণ জড়িয়ে ধরতে চাইছে লালুসে গানে কী ছিল কে জানে, একটা দিশাহীন দাবানলের মত ছুটে এল জরিনাএইমাত্র সন্তান হারানো কোনও মায়ের মত চিৎকার করে সে। কেঁদে গিয়ে আছড়ে পড়ে লালুমজিদের বুকের ওপর।মাফ করেনও মিয়াঁ, মাপ করেন গো, আমারে মাপ কইরা দ্যানআঁচল দিয়ে আছুড়িপিছুড়ি মুখ মুছিয়ে দেয়। লালুমজিদ একটা হাত জরিনার পিঠে বোলায়, যেন সান্ত্বনা দেয়। দুধে আলতা পিঠে এ হাত  যেন সেই কবে, কোনকাল থেকে সান্ত্বনা বুলিয়ে যাচ্ছে
,
কতদূর নিকট হলে কাছের মানুষ হওয়া যায়?  লালুমজিদের চালতা তলায় আমি কী দেখলাম আজ? এসব কথা আমি তোমাকে লিখি কেন? কে তুমি? একটা কথা মনে হল আজ, জানো? মনে হল গান আসলে গায় না মানুষ। গান হয়ে ওঠে। মজিদ আজ গান হয়ে উঠেছিল। এরকম হয়ে ওঠায় বেদনার ভূমিকা আছে। তুমি আমার না-পাওয়া বেদনা। যে ব্যথা, যে ব্যর্থতা জীবনে আসেনি, সে তুমি। আমি বেদনার সাধনা করি। এই যে লোকে আমাকে ক্ষেপিয়ে তোলে, কু কু করে চিৎকার করে আমি তাতে কুঁকড়ে যাই। ওই শব্দে লোকের হাহাকার শুনি। রাগ ওঠে। কান্না পায়। কিন্তু সে কান্না আমি কেঁদে ফেলতে পারি না। একা একা কাঁদা যায়? যে কান্নাকে সান্ত্বনা এসে মহৎ না করেছে, সে কান্না কেঁদে কী লাভ বল? আমি তাই এসব লিখে রাখি। একদিন হয়তো তোমার কাছে এসব যাবে। যে তুমি আসলে নেই, তার কাছে আমার এসব কান্না আমি সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য বিছিয়ে রেখে যাই। তুমি নেই, তুমিই কাছের মানুষ। নীরবে ডাকি তোমায়, শোর করি না। ইতি ২ মার্চ ১৯৮৪
তোমার একান্ত

সদানন্দ