কুশল সংবাদ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
কুশল সংবাদ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০২০

কুশল সংবাদ-২


কুশল সংবাদ- দুই


মাঝে মাঝে কয়েকজন জন্মান্ধের সঙ্গে দেখা হয়। তারা হস্তীদর্শন করে ফিরছে। তাদের কিছু জিগ্যেস করি না, নিজেই হাতির দিকে এগিয়ে যাই। যেতে যেতে অন্ধদের অনুমানগুলি মনে করি। তাদের কারও অনুমান হাতি হল একটা নরম থাম, কেউ ভেবেছেন হাতি হল একটি সজীব কুলা, কেউ মনে করে সামান্য একটা রোমঝাড়ুই হাতি... ভাবতে ভাবতে হাতির সামনে চলে আসি। এসে দেখি, কিছু দেখা যাচ্ছে না। চোখের দৃষ্টি চলে গিয়েছে। এইরকম অবস্থা হয় একটি প্রকৃত কবিতা পাঠ করলে। মনে হয়, কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না, কিছু শোনা যাচ্ছে না। বুদ্ধি ও সংস্কারনির্ভর সকল উপকরণই স্তব্ধ হয়ে যায়। বরং অন্তরে অনুমানের পাথর জমা হয়ে যায় অনেক। রঙিন সেই পাথরকেই সত্য বলে বোধ হয়। তাই কবিতা নিয়ে এত গদ্য, এত তাঁর পরিচয়নির্মাণের চেষ্টা। তথাপি, কবিতা সমান অধরা থেকে যাচ্ছেন।

যিনি বিশুদ্ধসত্ত্ব হতে পেরেছেন, তিনি যা চাইবেন তা-ই পাবেন। যা চাইবেন, তাকেই জয় করতে পারবেন। যে লোক কামনা করবেন, সে লোকেই বাস করতে পারবেন।  কিন্তু শুদ্ধতাই তো হল সবচেয়ে বড় কাম্য। সেটি পেয়ে গেলে আর তো কিছু চাইবার থাকে না! তবে? উপনিষদের কবি তাহলে কী আর চাওয়াতে চান সেই শুদ্ধসত্ত্বাধিকারীকে দিয়ে? পৃথিবীতে কত কবিতা লেখা হয়েছে। এক বাংলা ভাষাতেই কত কত কবিতা। একবার পড়লে সারাজীবন মনে তার অনুরণন বাজে  এরকম কবিতাও হাজারে হাজারে রচিত হয়ে গিয়েছে।  সেসবের পরে আর কী চাইবার আছে? নতুন করে আর কী লিখবার আছে? কিংবা একজন কবি একটি উৎকৃষ্ট কাব্যগ্রন্থ লিখে ফেললে তাঁর আর কবিতা লেখার চেষ্টা কেন? তিনি কবিতার কাছে আর কী চান? বিশুদ্ধ একটি কবিতা রচনা করাই তো সাধনা। বিশুদ্ধবস্তু তো বহু হতে পারে না। তাহলে বহু বহু কবিতা যে লেখা হচ্ছে, সে-সব বিশুদ্ধতম কবিতা নয়?

এমন একটি কবিতার সন্ধান করে চলে মানুষ, যেটি লেখ্য নয়। এমন কোনও লিপি, এমন কোনও করণকৌশল মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি, যার দ্বারা সে কবিতা লিখে ফেলা যায়। হয়তো কবিও জানেন না, তিনি এক দুর্বোধ্য, হিরন্ময় অন্ধকার পেতে চাইছেন। যা পেলে প্রাপ্তিবোধও লীন হয়ে যায়। তাই, যেদিন পেয়ে যান, সেদিনও বুঝতে পারেন না পেয়েছেন। তাই চাওয়া শেষ হয় না। চাওয়ার দৌরাত্ম্যে চিত্তও শুদ্ধ হয় না। সুতরাং একটি অশুদ্ধচর্চার নামই কাব্যচর্চা। যেমন বিজ্ঞান। এমন একটি চরম নিয়ম কোথাও আছে, যার দ্বারা সকল নিয়মকে ব্যাখ্যা করে ফেলা যায়। সে নিয়মের নিয়ত সন্ধান করে চলেছে বিজ্ঞান। হয়তো কোনো কোনো বিজ্ঞানী তা অন্তরে জেনেছেন, কিন্তু সেটিকে প্রকাশ্য কোনও মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে ভাগ করা যায় না।

কবিতাও কি যায়? যে নিগূঢ় মনোস্থিতি থেকে ভাব কিংবা ভাবরাশি শব্দবাহিত হয়ে সাদা পাতায় চলে আসে, সে ভাবটি তো শব্দদ্বারা অপরের কাছে সম্পূর্ণতঃ যেতে পারে না। ভাগ হয় না তার। মনের সাহায্যে অপরের মনের কাছে আমরা যে বার্তা পাঠাই তা-ও তো পথভ্রষ্ট হয়। কিংবা উদ্দেশ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়। এমনকি, একের উদ্দেশে প্রেরণ করা বার্তা অন্য কোনো মনে গিয়ে আহত হয়।  কারণ মানুষের অন্তরের গভীরতম প্রদেশ হতে যে বার্তা আসে, তা তো তার অন্তরেই লীন হয়ে যায়। মনের সেখানে কোনওমাত্র ভূমিকা নেই। মন একটি ভোঁতা উপকরণ মাত্র। সে উদ্দীপ্ত হতে পারে। উত্তেজনায় সাড়া দিতে পারে, সে সাড়া সে মানুষের দেহের ভিতরের আরও ভিতরে নিয়ে পৌঁছাতে পারে। যদিও তাকে সে কাজে প্রশিক্ষিত করে নিতে হয়। সে কাজ কঠিন। অন্যদিকে  কবিতা সেই উত্তেজক হতে পারে। যুগযুগ ধরে কবিতাকে তা-ই করার চেষ্টা হয়েছে। হয়তো প্রতিটি কবিই সেটি চান। কিন্তু, যেমন, হিমালয় যেতে গিয়ে পথিমধ্যে অন্য নগরের বৈভবে ভুলে যায় শৌখিন পর্যটক, তেমনি কবিও হয়তো ভুল করেন।

কী জানি কী করেন! পাঠ করতে করতে এই-ই তো মনে হয়। একেবারে ভূমিপার্থিব কোনো ঘটনার বিবরণবাচক কবিতা স্বল্পজীবী হয়ে থেকে যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে যৌবনোদ্দীপক কবিতাসকল আজ আর কাজে আসে না। কেবল সেইসব যুগের কথা, দেশের শিশুকিশোরদের মনে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করবার কাজে তাদের ব্যবহার হয়। বলা বাহুল্য, সে জাগ্রত দেশাত্মবোধ শিশুকিশোরের বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উবে যায়। কবিতা তো হেন উদ্বায়ী হবার কথা নয়!

তাই, চাই না কিছু আর। হয়তো লিখতেও চাই না। শুধু নিজেকে চাইবার মত যোগ্য করে তুলতে চাই। ধীরে ধীরে তাই কমে যাচ্ছে অভিমান। অপরের মুখ ভেবে যখন কেউ ম্লান করে দিয়ে যায় আমার মুখটি, তখন তাকে মনে মনে দেখি। নিজের প্রকৃত মুখচ্ছবি তো মানুষ দেখে না কখনও।

অনুমান করি। কোন্ মুখটা ম্লান হল? যেটিকে দর্পণে দেখি সেটি? নাকি, অপরের চক্ষুমধ্যে বিম্বিত দেখি যাকে সেটি? নাকি এসকল মিলে মনেমনে নিজের মুখের যে ছবি আঁকা হয়ে আছে সেটি? ভাবতে ভাবতে যাই। নিজের দেহের ভিতরের পথে পথে হাঁটি। যেন আমার ম্লানমুখখানিই সে হাতিটি! যদিওবা তার সামনে যেতে পারি, গিয়ে দেখি অন্ধ হয়ে গেছি। কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

এই অন্ধত্ব নিয়ে ভালো আছি।

[ 'জলজ' পত্রিকায় প্রকাশিত, ২০১৬]





পাঠের জন্য ধন্যবাদ

একনাথ ঈশ্বরণের লেখা মুখ্য উপনিষদগুলো



মঙ্গলবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৬

কুশল সংবাদ

 এক.

অশোক দেব

ধীরে ছেড়ে যাচ্ছেন কবিতা। লেখা হচ্ছে না। লিখতে পারছি না। তাহলে কি টান পড়েছে অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারেবন্ধুরা বলেনঅভিজ্ঞতা মরে গেলে ধীরে মরে যায় লেখা। কী এই অভিজ্ঞতা? কাকে বলে অভিজ্ঞতা?
এই বৃষ্টির রাতে একজন সারেঙ্গি বাজাচ্ছেন। জোছনা সরিয়ে সেই সুর তাঁর চারপাশে এঁকে দিচ্ছে বিষাদবিধুর আলপনা। আমি কি শুনছি সেই সুরশুনছি না। নাকি চিনি তাকেচিনি না তো। তবে কি এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোনও প্রান্তে কোনও একা মানুষ সারেঙ্গি বাজাচ্ছেন নাদেখতে পাচ্ছি নাশুনতেও পাচ্ছি না। কিন্তু মনের শ্রবণ দিয়ে তো ঠিক শুনতে পাই। হয়তো এই অশ্রুতি নিয়ে একদিন  বাস্তব পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। তবুও এই সুর সত্য। এ সত্যঅগোচর সত্য। এও তো একপ্রকার অভিজ্ঞতাযা বাস্তবে নেইএরকম অশ্রুত ধ্বনি কি ভেতরে বাজে নাবেজে ওঠে মিলিয়ে যায় নাস্মৃতি কি সুরময় নয়একটি লালমাটির রাস্তার কথা মনে আসে। তার কোনও ঐশ্বর্য নেই। একটু গিয়েই আদিজনদের পাড়ায় সে শেষ হয়ে গেছে। এ পথের মনখারাপের রোগ ছিল। বিকেলে সূর্যাস্তের লালিমা গায়ে লাগলে সে মাথা নিচু করে স্নানে যেত।  নিজের শরীর হতে সকল পদচিহ্ন মুছে দিতে যেন সেই পথ স্নানে চলে যেত। হাঁটতে হাঁটতে সাক্ষাৎ টের পেতাম পথটি নেই। সে চলে গেছে। একদিন ফিরে এসে লিখেছিলামএ পথে হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে আসি সহজে নীলিমায়। লেখাটির বাকি অংশ মনে নেই। এই বিস্মৃতিও সত্য। আবার কবিতাটি যদি এখন খুঁজে পাইওতাহলে এখন আর তাকে ভালো লাগবে নাজানি। তখন নয়আজই মনে হলসেই পথটি যেন তার শরীরের পদচিহ্ন হতে মুক্তি পেতে স্নানে চলে যেত। সে চলে গেলে এক পথশূন্যতা থাকার কথা। সেই শূন্যতাকে তখন নীলিমা মনে হয়েছিল। আজ তাকে অন্যকিছুআরও অমোঘ মনে হয়। সেই অতীতে নীলিমাকেই সত্য মনে হয়েছিলকবিতা বলে মনে হয়েছিল। একই জীবনে বয়সের নৌকা কিছুটা ভাটিতে এলে দেখা গেলসে সত্য সত্য নয়। সে কবিতা তেমন কবিতা নয় আর। তাহলে আজকে যে মনে হচ্ছে কবিতা ছেড়ে যাচ্ছেনসেটাও সত্য নয়আরও একটু ভাটিতে চলে গেলেঅন্য কোনও দারুচিনি দ্বীপের ভেতর দিয়ে যাবার কালে হয়তো মনে হবেসত্য ছিল না কবিতার বিচ্ছেদ। তবে আর কী মূল্য রইল অভিজ্ঞতার?যে অভিজ্ঞতার অভিধা নেইস্থিরমূল্য নেইকালের সাথে যার মাত্রাহানি ঘটে যায়সে তো নিজেই চরম মিথ্যা। মিথ্যাভার কি কবিতার চালিকা হতে পারে?
অথচ একধরণের আনন্দ হয়। এই অতীতচারণায় আনন্দ হয়। ধীরে সকল ইন্দ্রিয় চুপ করে যায়মন তার স্বাভাবিক গাম্ভীর্যে একা হয়ে পড়ে। অতীতে নিয়ে যায়। যে পথ এখন নেইছিলযে অনুভূতি এখন হচ্ছে নাআগে হয়েছেসেখানে নিয়ে ভ্রমণ করিয়ে আনে। স্বপ্নবৎ মনে হয়। যেন দিনশ্রমক্লান্ত হয়ে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়েছি। এখন আর বুকের চিনচিনে ব্যথা নেই। অম্লাধিক্য নেইনেই কনুইয়ের কাছে ক্রমবর্ধমান সিবাসিয়ান সিস্ট। উত্তমর্ণের কুশলজিজ্ঞাসা নেই। এমনকি সাধের নেশাটিও উহ্য হয়েছে। আকণ্ঠ বিষপান করে কে যেন গান গাইছে আমার কানের কাছে। আমি শুয়ে আছি। বধির হয়ে গিয়েছি। তবু শোনা যাচ্ছে সেই বিষ মাখানো গান। যে গাইছেনতাঁর বেদনাটুকু টের পাচ্ছিআবার নিজেও সেই বিষাক্ত সুরের প্রভাবে ধীরে মিইয়ে যাচ্ছিমিশে যাচ্ছি গাঢ়তর কোনও অন্ধকারে। ঘাম দিয়ে ঘুম ভেঙে যায়। জল খাই। কম্পিউটার খুলি। এই স্বপ্নদৃশ্য লিখে রাখতে হবে। এক্ষুণি। কিন্তু এতসব স্যুইচ টেপাটেপি করতে করতে বোঝা গেলসে তো স্বপ্ন মাত্র। আমার স্বপ্নতাতে পাঠকের ভাগ নেই। তাহলে এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলামস্বপ্ন দেখছিলামযতক্ষণ সেই অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছিলাম,  কম্পিউটারের এই তারজালএই সাদা স্ক্রিনএই আলোর আক্রমণ কোথায় ছিল তখনএখনই বা সে গায়িকা কোথায়,নিজে বিষ খেয়ে যে তাঁর সুরের সঙ্গে বিষ মেশাচ্ছিলেনতাহলে কে সত্যএই জাগরণ নাকি সেই নিদ্রাএই বর্তমান নাকি সেই বিকালের লাল পথকাকে আমি অভিজ্ঞতা বলবঘুমের মধ্যে কে জন্ম দিচ্ছিলেন একের পর এক দৃশ্যকেই বা এত করে কাতর করেছিলেন বেদনায়কিংবা যে সারেঙ্গি বাজে নাতার সুর কে শুনিয়ে দিয়ে যায় জানা কথাসে হচ্ছে মনের কারসাজি। সকল ইন্দ্রিয় ঘুমিয়ে গেলেও সে একা জেগে জেগে ষড়যন্ত্র করে চলে। কিন্তু এত যত্ন করে কোনও হেতুব্যাতিরেকে সে এই অদ্ভুত মৃত্যুদৃশ্যের রচনা করেছে কেনতার তাতে কী প্রয়োজনমনের কী অপার প্রতিভাসে এমন এক গুপ্তপদ্ধতি আবিষ্কার করেছে,  যা দিয়ে গানের সঙ্গে বিষ মেশানো যায়। এমন এক স্বর অবিষ্কার করেছে যা কিনা শব্দহীন আবার শ্রুতিসাধ্য। জাগরণে এইসব মিথ্যে হয়ে গেল লহমায়। তাহলে মনের কারবার কি সকলই মিথ্যা নিয়েছলনাকারী সেএই ক্রমক্ষীয়মান বর্তমানকালে কিছুই তো  সত্য থাকছে না। সেদিনের সেই কবিতা আজ আর কবিতা বলে মনে হয় না। আজকের স্বপ্নের সত্যকে শুধু স্বপ্নেই সত্য মনে হয়। জাগরণে সে তার সকল আয়োজন নিয়ে অন্তর্হিত হয়ে যায়। তাহলে কী আছে বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা?
মনে এক কামারশালা আছে। সেখানে নানারকম শব্দ হয়ে চলেছে। কোনও শব্দ লোহিততপ্ত -- স্পর্শ করা যাচ্ছে নাকোনও শব্দের শরীর হতে আগুনের ফুলকি বেরিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোনও শব্দ হাপড়ের আকর্ষণে টেনে নিচ্ছে সকল বাতাসকোনও শব্দকে এইমাত্র জলের মধ্যে চুবিয়ে ধরে শান্ত করা হল। এই শব্দলোক হতে কাকে এনে কোথায় বসাতে হয় -- কবিতায়?  সারাদিনএই আলো হাওয়া রৌদ্রে ঘুরে ঘুরেবরষাপীড়িত হয়েক্লান্তিতে অবশ হয়ে ঘরে এসে বসি। লিখতে বসি। কে যেন এসে সে কামারশালা খুলে দেয়। হাতুড়ি চলতে শুরু করলেই বোঝা যায়না তোএ তো সারাদিন চলেছে। সারাদিন কোনও না কোনওভাবে এই মনকামারের কাছে গিয়েছি। এখন টাইপ করতে বসেছি ঠিক। কিন্তু সারাদিন যে মনে মনে টাইপ করতে চাইনি তা তো নয়। তখন সে চেষ্টা  থিতু হতে পারেনি। আরেকটা কে এসে টেনে নিয়ে পরীক্ষার খাতা দেখতে বসিয়ে দিয়েছে। মন তাহলে একটি নয়বহুতে বিভাজিতএকজন ব্যক্তি আসলে কতগুলি মনের সমাহার। তার মধ্যে কার অভিজ্ঞতা কবিতার কাজে আসেঅথবা মনের নিজস্ব গুণ্ডাবাহিনি রয়েছে। এদিকে যে  যেতে চায়তাকে সে সেদিকে সরিয়ে নেয়। শব্দফুলকি দেখতে গেলে টেনে এনে খাতা পরীক্ষা করতে বসিয়ে দেয়। রাতে এসে সাধ্য সাধনা করিকিছু কি লিখতে পারব না আরহয় না। তখনই মনে হয় ছেড়ে যাচ্ছেন কবিতা। এই ব্যর্থতায় চেষ্টানাশ করার চেয়ে নিদ্রা কাম্য। প্রার্থনা করি যেন নির্বিঘ্ন নিদ্রা হয়। আগামীকাল সকালে আবার রেনকোট পরতে হবেবোতলে জল নিতে হবে। সারাদিন ক্লাসে গিয়ে চেঁচাতে হবে। একটি সফল নিদ্রাই দিতে পারে ঝরঝরে সকাল। নিদ্রার লোভে কখনও ঠিক টুক করে গিলে ফেলি আধ মিলিগ্রামের একটি ইটিজোলাম। কোনও কোনও রাতে সকল উৎকণ্ঠার অবসান আসে। স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের অতীত এক নিদ্রায় লীন হয়ে যায় সবকিছু। এই মরপৃথিবী মিথ্যাও হয় নাসত্যও থাকে না। সারারাত কোথা দিয়ে কেটে যায়। কোথা হতে চলে আসে ঊষার আলোপক্ষীর আলোচনা। ঝরঝরে হয়ে যায় সব। কে যেন সারারাত ধরে মনের মধ্যে গোলাপ চাষ করে গেছে। তার সৌরভে ভরে আছে জগৎ। তখন এইসব কামারশালাএইসব রেনকোট আর খাতাপরীক্ষাফেসবুকের লাইকলোলুপতা কোথায় ছিলএই ঊর্মিবিহীন সমুদ্রের মত নিদ্রা কার উপহারমন তার সেনাদল সহ কোথায় গিয়ে বসে থেকেছেএরকম নিদ্রা হতে জেগে মনে হয়এই তো জাগলাম। এই যে জাগরণের অভিজ্ঞতাতা হয়তো সত্য। কিন্তু তার আগে যে নিদ্রালীন শূন্যকাল সেখানে তো সত্যমিথ্যা কিছুই ছিল না। এই নিদ্রাকাল কি একা কাটিয়েছি আমিআমিত্বের বিলোপ হয়েছিল তখন। তখন তো আর কবিতার প্রয়োজন ছিল নালিখতে না পারার বিকারও ছিল না। নাকি তখনও চিরজাগ্রত থেকেছে কেউ। গভীরে গভীরে। সেই সকলভোলানো নিদ্রাতেওসেই অননুভূতিকেও সে অনুভব করেছে। সে না থাকলে জাগরণে কে মনে করিয়ে দেয়হে ব্যর্থ কবিতোমার নাম অশোক দেব। স্মৃতিবিস্মৃতির পারে গভীর সেই আত্মলুপ্তির পরে কে আবার মনে করিয়ে দেয় বাবাকে স্যালাইন দেওয়াতে হবে আজ। আজ মঙ্গলবার। এই মায়ান্ধকারকে কী নামে ডাকবকী নাম এই অভিজ্ঞতার?
এইসব তো হচ্ছে। এই আত্মযাত্রায় হাঁটি। আর দেখিআসলে কোনও অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় করা গেল না। একটা পথ ধরে হাঁটছিযে আসলে গন্তব্যগামী নয়। অথবা এই দেহের গভীরেই কোথাও রয়ে গেছে সে গন্তব্য। তাকে নির্দেশ করা যাচ্ছে না। দৃষ্টির অতি নিকটে এলে যেমন দেখতে পাওয়া যায় নাএমনকি অতিপ্রিয় কোনও মুখ।  এই ভ্রান্তিবিলাসের ফল কিছু শব্দের ঐশ্বর্যহীন সংযোজনা। এরা আছেগ্রন্থিত হয়েছে। বারবার ধরে ধরে ফেসবুকে পুরনো কবিতা পোস্ট করি। বারবারই মনে হয়নাহ্ এরকম তো লিখতে চাইনি তখন। অন্যকিছু আরও একেবারে অন্যকিছু লিখতে চেয়েছিলাম। পোস্ট করি তবু। টাইপ করতে গিয়ে নিজেই নাকচ করে দিই এইসব কবিতার কাব্যপরিচয়কারণ এবং ফল। সুতরাং যে অভিজ্ঞতা হতে এইসব লিখে ফেলেছিলামতার মরীচিকা সরে গিয়ে উষর মরুবালুকার বিস্বাদ পাই কেবল। এইসব প্রাক্তন অভিজ্ঞতাসকলের কী মূল্যতাহলে কোথায় যাবকে নিয়ে যাবেনিজেকেই যেতে হয় এক একপথ ধরে। কিন্তু তার উপায় জানা হয় না সারা জীবনে। কেবল মরীচিকার অনুসরণ করে যাই আমরা।
এই মরুভ্রমণএই বিভ্রান্তি আজ ফেসবুকের দেওয়ালে দেওয়ালে দেখতে পাই। দলভূক্ত রাজনীতিকে যে সত্য মনে করেনতিনি অকাতরে সেইসব কবিতা লিখে যাচ্ছেনযা তার দলপরিচয়কে সন্তুষ্ট করবে। একদল সেই তুমি-আমি-র ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি করেনঅথচ কোনও এক জাদুবলে নিজেরা ক্লান্ত হচ্ছেন না। একদল আছেনযারা লিখছেনপ্রকাশিত হচ্ছেন। নিজেকে কিছুতেই পরীক্ষা করছেন না। অন্ধকারে যদি তারা কোনওদিন নিজেকেই টুটি চেপে ধরেন,  জিগ্যেস করেনবল শালা কী লিখেছিসকেন লিখেছিসতবে সেই আত্মধমকের চোটে তারা নির্ঘাৎ নিজগ্রাত্রে প্রস্রাব করে দিতে পারেন। সুখের বিষয়তারা লেখেননিজেকে একলা পেয়েও নিজের সাথে মাস্তানি করেন না। ফলে একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি করেন। কবির অভিমান কাঁধে সিঁড়ি নিয়ে কেবল আরও বস্তুলাভের উচ্চতার সন্ধান করেন। অথবা একধরণের কল্পনাবিলাস দেখা যায়যেখানে মানুষ নয়জীবন নয়অন্যকিছু খেলা করে।  এদের লেখায় উদ্দণ্ড কল্পনার উল্লম্ফন দেখতে পাওয়া যায় খালি। বাংলার কবি তেলচিটচিটে চাঁদ দেখাচ্ছেন বহুদিন ধরে। বহুদিন ধরে করোটির কলিংবেল বাজাচ্ছেন। এরা সেটাকেই আরেকটু বুদ্ধিবলে চমকদার করছেন। বিমূর্তায়নকেই সিদ্ধি ভেবে নিজের অন্তরের আলো নিভিয়ে দিচ্ছেন। এতকালের শিল্পতত্ত্ব ভরা বালিশ ছিঁড়ে তুলো ওড়াচ্ছেন। নারীত্বের এতকালের রুদ্ধশ্বাসকে ঝঞ্ঝারূপ দেবেন বলে গ্রীনরুম দখল করতে তৎপর হয়েছেন অন্য একদল। বাংলা কবিতার করুণতম বয়স এখন। তাঁকে দেখি। দেখেসব দেবতাকে ছেড়ে নিজের প্রাণের কাছে চলে আসি। ভাবিকী দিতে পারে এই অপজীবন বাংলা কবিতালক্ষ্মীর পদতলেকিছুই কি পারে?

আসলে এক সুবর্ণকূপ আছে। জাগরণে নয়নিদ্রায় নয়স্বপ্নে কিংবা দুঃস্বপ্নের ভেতর নয়তাহলে কোথায়তার দেখা মেলে অন্য কোনওখানে অন্য কোনও উপায়ে। আত্মজিজ্ঞাসায়নিজের গভীর অন্দরমহলেই তার দ্যুতিবিরাজ। হিরার ভাণ্ডার। তার সন্ধান করিনি এতকাল। গন্ধে মাতোয়ারা হয়েছিআপন কস্তুরীনাভিকে নিজেতে খুঁজিনি। এদিক-ওদিক ছুটেছি কেবল। ভুল হয়ে গেছে। জানি সেই পরশপাথর এ জন্মে আর পাওয়া হবে না। নিজের একেবারে গা ঘেঁষে বসা হল নাদেখা হল না কী নিয়ে শুরু হয়েছিল পথচলা।  নীরবতার থেকে নীরবস্থিরতার থেকে স্থিরতর এক আত্মগোলক আছে। তার সন্ধান পেলে দস্যুও কবি হয়ে যায়। কবিদেবতা হয়ে যায়।  লেখা হচ্ছে না বলে,  লিখতে পারছি না বলে তখন আর কোনও আক্ষেপ থাকে না। তখন নিশ্চিত হওয়া যায় যেলিখতে কেউ পারে না। লেখা হয়। সান্ত্বনা নয়এই উচ্চাশা নিয়ে বেশ ভাল আছি। কুশলে আছি।

(জুলাই ২০১৪)