অশোক দেব
সদাপুরাণ-২১
সদাপুরাণ-২১
পরচুলা শুকোতে দিয়েছে জহিরুল। ঘোড়া মরে গেলে
সে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। এখন আসে। টুপি পরে। টুপির ফাঁকে কাওয়ালদের মতন চুল
বেরিয়ে থাকে কানের পাশে। এখন টুপি নেই, সেই চুলও নেই। টাক দেখা যায়। ও এখন সকল
ছেড়ে আতরের ব্যবসা ধরেছে। একটা ছোট বাক্স। তাতে নানা রকম খাঁজ। সে খাঁজে খাঁজে কত
আকারের যে শিশি। লাল শালুতে পেঁচিয়ে সে বাক্স কাঁধে ঝুলিয়ে সারাদিন ফেরি করে
জহিরুল। মেলায় মেলায় যায়। নানারকম আতরের গন্ধ
মিশে গিয়ে একটা কেমন নেশা নেশা সুগন্ধ হয়। সেটা তার পিছু পিছু ফেরে। একটু অশক্ত
হয়েছে। চোখও আর তত উজ্জ্বল নেই । কেমন উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে। এখন স্নান করে এলো।
চকচক করছে টাক। যদি ডাক পায় খাবে। আজকাল আর তত রান্না হয় না এ বাড়িতে।
আজ অমাবস্যা। ভাদ্রমাস। এ কারণেই এসেছে জহিরুল। গপিস্ট বুড়ার সারা বছরের রুটিন তার জানা। আজ বিশেষ পূজা হয় ত্রিপুরাসুন্দরী মায়ের। রাজার লেঠেল গপিস্ট বুড়ার বংশ। আজকের দিনে মায়ের দারোয়ান হতেন তিনি। দাতারামে একটা জোলাইবাড়ি আছে। এখানে জোলাইরা থাকতো। রাজ আমলে মায়ের পূজায় মশাল ধরা তাদের কাজ। সুবল দাস। গপিস্টের থেকে বয়সে বড়। সেই বুড়াও একটা ছোট মশাল নিয়ে আসতো। এই দিনে এসে মা-কে দেখিয়ে যেতো। গপিস্ট গিয়ে প্রধান ফটকে একটা লাঠি নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। নিয়মরক্ষা করে চলে আসেন। জহিরুল এটার সুযোগ নিতে আসে। অযথা ঘোড়াটোড়া আনে। হইহই লাগায়। গপিস্টকে সে সাজায় যাত্রার পোশাকে। কোথা হতে একটা বেতের শক্ত লাঠিও আনে লম্বা। এই করে বেশ টাকা নিয়ে নেয়। এবার তার ঘোড়া নেই। তবু আসে। কিন্তু ওই জোলাই সুবল মারা যাবার পরে গপিস্টও যান না নিয়মরক্ষা করতে। জহিরুল আসে। এখন চান সেরে এসেছে। গপিস্টের ঘরে যায় সে।
আজ অমাবস্যা। ভাদ্রমাস। এ কারণেই এসেছে জহিরুল। গপিস্ট বুড়ার সারা বছরের রুটিন তার জানা। আজ বিশেষ পূজা হয় ত্রিপুরাসুন্দরী মায়ের। রাজার লেঠেল গপিস্ট বুড়ার বংশ। আজকের দিনে মায়ের দারোয়ান হতেন তিনি। দাতারামে একটা জোলাইবাড়ি আছে। এখানে জোলাইরা থাকতো। রাজ আমলে মায়ের পূজায় মশাল ধরা তাদের কাজ। সুবল দাস। গপিস্টের থেকে বয়সে বড়। সেই বুড়াও একটা ছোট মশাল নিয়ে আসতো। এই দিনে এসে মা-কে দেখিয়ে যেতো। গপিস্ট গিয়ে প্রধান ফটকে একটা লাঠি নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। নিয়মরক্ষা করে চলে আসেন। জহিরুল এটার সুযোগ নিতে আসে। অযথা ঘোড়াটোড়া আনে। হইহই লাগায়। গপিস্টকে সে সাজায় যাত্রার পোশাকে। কোথা হতে একটা বেতের শক্ত লাঠিও আনে লম্বা। এই করে বেশ টাকা নিয়ে নেয়। এবার তার ঘোড়া নেই। তবু আসে। কিন্তু ওই জোলাই সুবল মারা যাবার পরে গপিস্টও যান না নিয়মরক্ষা করতে। জহিরুল আসে। এখন চান সেরে এসেছে। গপিস্টের ঘরে যায় সে।
-
জেডা
-
কন
-
যাইবেন?
-
মার বাড়ি?
-
হুম
-
না
-
আর পারি না
-
বুজি
-
আমনে থাকেন কই?
-
ঘুরি, আতর বেচি
-
কেমন ব্যবসা, চলেনি?
-
জেডা আমনে একটা কাম কইরা
দেন না আমারে, দিবেন?
-
কন
-
একটা ফতোয়া দেন
-
কেমন?
-
আতর তো চলে না। আইজকাইল
বোতলের সেন্টও চলে না। কিতা বইলে ডিওরেন্ট বাইর অইছে। টিপ দিলে বাইর হয়। ছুত কইরা
গ্যাসের মতন। ইতান কি মোছলমানের গায়ে দেওন হালাল? মোছলমান দিবো আতর।
-
আমনে ভাত খান। বিশ্রাম
করেন। যান গা। আর আইবেন না।
জহিরুল বেরিয়ে যায়। আতরের বাক্সটা নেবার সময়
অযথা শব্দ করে। জরিনা একটু সাধলে খেয়ে যাবে। কেউ কোথাও নেই।
আজও
অমাবস্যা। ভাদ্রমাস। কেমন একটা রাক্ষুসে রোদ উঠেছে। সদার কাচের ঘর। দূরে মেঘের ছায়া
এসে কাচের গায়ে ছায়া পড়েছে। আকাশে সে মেঘ হাঁটে, এই কাচেও। আজ এখানে আসতেই হবে।
নন্দ দারোগা বারবার করে বলে দিলেন। আজকে নাকি কী এক অদ্ভুত জিনিস দেখাবেন। আমাকে
এইটুকু লেখা দিয়ে চলে গেলেন কোথায়। এটুকু পড়লাম। ঠিকই জহিরুল আতর বেচতে আসতো তখন।
তার নাম যে জহিরুল আমরা জানতাম না। ওকে জালালি বলেই ডাকতো সবাই। ঘোড়া আনতো ঠিকই।
সেটা একটা এক্কার সঙ্গে জুড়ে জয়রাইডও করাতো মায়ের বাড়িতে। কিন্তু গপিস্ট তাকে
একদিন বাড়ি থেকে বের করে দিলেন, সে আমরা কী করে জানবো? হঠাৎ করেই তাকে দেখা যেতো
না, এটাও ঠিক। কিন্তু এটুকু লেখা পড়ে আমি কী করব? নন্দদার একটা কাশি আছে। কাশি নয়,
মুদ্রাদোষ। সেটা শুনতে পেলাম সিঁড়িতে।
-
পড়ছেন?
-
হ, ইডা তো এট্টুখানি
লেখা
-
আছে আছে বাকিডাও আছে। ইডা তো স্টার্টার
-
মেইন কোর্স দেন, পড়ি
-
শুনেন, সজুরে মনে আছে?
-
হুম, মদ আর ফেন্সিডিল, তির
খেলা, রড সিমেন্ট... প্রচুর টাকা করছিল। আৎকা মইরা গেল।
-
একজাক্টলি, ক্যামনে মরল?
-
সিরোসিস হইছলো, না? ঘরের
মিধ্যে মইরা পইড়া আছিল
-
ইয়েস, ইয়েস... নেন পড়েন
এইটাও লাল কাপড়ে বাঁধানো খাতা নয়। ডায়েরিও
না। ফাইল। এগুলো থাকে ওই আলমারিতে, যেখানে ওই গয়নাগুলি ছিল। দলিল লেখার কাগজ
এগুলো। শেমি। সেই সুন্দর শীতল হাতের লেখা সদানন্দেরঃ
সজু একটা মারুতি ভ্যান
কিনেছে। সেটা নিয়েই সে এলো। আজ অমাবস্যা। ভাদ্রমাস। গপিস্টকে সে জোর করে। বারবার
বলে ভ্যানে করে মাতাবাড়ি যেতে। দারোয়ানগিরি করতে। কী করে যে রাজিও করে ফেলে।
জরিনাও রাজি হয়। জগতে আমার কোনও কাজ নেই। গপিস্টের কাঁচামিঠে গাছের নীচে বসে
পড়ছিলাম। সজু আসে।
-
চলেন
-
কই যামু?
-
মার বাড়িত যামু। জেডা
একটু নিয়ম করবো। আমরা আইয়া জেডারে নামাইয়া দিয়া ঘুরুম। ভাবিও যাইব।
আমি ওর পিছু পিছু যাই। ও
নিজেই চালাবে? কবে শিখলো গাড়ি চালানো? ওর পাশে আমি বসি। জরিনা রহিম মিয়াঁকে নিয়ে
আসে। গাড়িতে বসে। রহিম মিয়াঁর যেন ইচ্ছে নেই তেমন। সজু নেমে গিয়ে সাঁত সাঁত করে
দরোজা লাগায়। ছোটে। সবাই নীরব। মাতাবাড়ি। আমি নামলাম না। সজুও না। জরিনা গপিস্টকে
নিয়ে নামে। ওই তো মূল ফটক। রাস্তা থেকে দূরে, উঁচুতে। দেখা যায়। গপিস্ট শিরদাঁড়া
সোজা করে মিনিটখানেক দাঁড়ালেন। আবার বসলেন এসে গাড়িতে। আবার সজু সাঁত করে দরোজা
লাগায়। ছোটে। বাড়ি এসেই রহিমকে নিজে গিয়ে নামিয়ে দিতে যায়। জরিনা নামে না। আমিও না। চুপ। কোথায় ঘোরাতে নিয়ে
যাবে সজু আমাদের? ভাবিকে জিগ্যেস করি,
-
কই যাইবো?
-
জানিনা
-
তই?
-
তই কিছু না, নাটক, বইয়া
থাকেন, দেখেন
সজু আসে। বসে। গাড়ি স্টার্ট করে। ছোটে। অমরপুরের রাস্তা ধরে। কী স্পিড! যেনো কে পালিয়ে যাচ্ছে।
-
সদাভাই
-
কও
-
আমনে হুনছেন সুইজ্য যহন
অস্ত যায় তখন ক্যামনে পাখি ছাড়া বাকিরা চুপ করে?
-
পাখির ডাক শুনি
-
হেইডা তো হগলে শুনে
-
তো?
-
যিডা চুপ অইয়া যায়, হিডা
হুনছেন? আই মিন সায়লেন্স?
-
সজু
-
কন
-
তুমি তো একসময় প্রচুর
পড়তা। কিতা কিতা লেখতা, ঠিক না?
-
পড়তাম। লেখতাম, কবিতা...
ছদ্মনামে... সজল সমুদ্র
-
অহন?
-
অহন মাডি টানি, রড
সিমেন্ট ঘাডি
-
তিরখেলা?
-
আছে... ইতান বাদ দেন, এই
দেখেন
এর মধ্যেই সে চলে আসে এইখানে। দূরে কালাঝারি
পাহাড়। এদিকে তার কোল ছড়ানো। সূর্যাস্ত হয়ে গিয়েছে। উলটো দিকে। সত্যই কেমন একটা
নীরবতা ছড়িয়ে আছে, শব্দের মতন।
-
লামেন
জরিনা নেমে আসে। আমরা তিনজন। ওই দূরে একটা
অজানা নীলে চোবানো পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছি। একটুক্ষণ। যেনো বহুদূর থেকে কেউ
মন্ত্র পড়ছে, এমন ভাবে কথা বলে সজু, ‘আমি খারাপ। মা সুইসাইড। বাবা পাগল পাগল। ভাই
কই জানি। বইনডা সার্কাসের পোলার লগে গেলো গা। অহন শিলচরে বেশ্যা। এইসবের লিগ্যা
না। আমি এমনেই খারাপ। আমনেরে বালাপাইছি। কাছে যাইতাম চাই। আমনে ফিট অইয়া যান।
আমনের লিগ্যা মাচ্ছারে মারছি। মাইরা লাইছি। আমারে মাপ করেন।
-
কি কও সজু, চুপ করো
-
আমনের লগে কেডা কতা কয়?
আমনে চুপ থাকেন সদাভাই
ধীরে
গাড়িতে গিয়ে উঠে পড়ে জরিনা। পিছু পিছু আমিও যাই। বসি সজুর সঙ্গের সিটে। সামনে। ও
আসে না। দাঁড়িয়ে আছে এখনও। একটা আঁধার তার পায়ের থেকে ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠছে। যেন
এই সময়টা শেষ হবে না। আমি নেমে গিয়ে ওকে নিয়ে আসবো? দরোজা খুলতেই ও ফিরে আসে।
অবিশ্বাস্য
স্পিডে সজু আমাদের উদয়পুর নিয়ে আসে। এই পাড়াটা আমার তেমন চেনা নেই। অনেক গলি। কোথা কোথা দিয়ে
সে একটা বাড়িতে এনে সোজা উঠানে চলে আসে। বাড়িটা পুরনো। সজু নামে। কেন কে জানে,
নিজেই দরোজা খুলে নেমে পড়ে জরিনা। বাড়িটার দিকে তাকায়, ইতিউতি দেখে।
-
আমার। পুরান বাড়ি কিনলাম
-
সব বাড়িই পুরান
-
চলেন
বলেই ঘরে যায় সজু।
জরিনাও। পিছু পিছু গিয়ে ঘরে ঢুকে আমি অবাক। এত বড় ঘর? একটা বিশাল টেবিল। তার ওপর
একটা সত্যকার ঝাড়বাতি। জ্বলছে। টেবিলটাকে ঘিরে সিনেমার চেয়ারের মতন চেয়ার পাতা। সজু একটাকে একটু সরিয়ে জরিনাকে বসতে
দেয়। জরিনা বসে। সজু আমাকে হাতে ইঙ্গিত করে বসতে। বসি। একটা
বড় গেলাস আর দামি হুইস্কি নিয়ে আসে। সঙ্গে একটা সাদা কৌটো। একটাই জিনিস কেমন
লাগছে, সারা মেঝেতে কী জানি বড়ির খালি র্যপার ছড়িয়ে আছে। সদা মদ ঢালে। জরিনা কেমন বিবশ।
-
আমি যামু
-
যাইবেন
-
শইল খারাপ লাগে। আমনে
ইতান কইরেন না
‘থাক না সজু’। বলে সারিনি, ‘এই কু-র বাচ্চা।
চুপ মাইরা ব, দেখ কিতা করি’ জরিনা কেমন ফুঁপিয়ে ওঠে, ‘না, আমার কিছু করনের নাই
সজু, তুমি বালা মানুষ, আমার মানুষের লগে অয় না... বন্ধ করো, সদাভাই আমনে কন না’
-
সজু, জানোই তো ভাবি পারে
না মদ সইজ্য করতে...
-
চুপ
সজু
মদ ঢালে। অনেকটা। সাদা কৌটা থেকে অনেকগুলো বড়ি ঢেলে দেয় তাতে, ‘আমি জানি, আমি খারাপ।
আমার আর ভাল্লাগে না কিছু। সদাভাই, আমি ওই জমিবাড়ি চাইছিলাম, ভাবিরে চাইছিলাম।
দুইডা মিশ খায় না। আমিই মিশ খাই না। ইডি ঘুমের ট্যাবলেট। দেড়শোডা... আমারে মাপ
কইরেন... টুক করে গিলে ফেলে সে এই বড়ি মেশানো মদ। নিট। চোখমুখ কেমন করে ওটাকে সহ্য
করে নেয় একটু। কাঁদছে? কেমন একটা মদ যেনো,
পুরনো আতরের মত গন্ধ। ও গিলতেই বেরিয়ে যায় জরিনাভাবি। বিদ্যুৎ। আমি চেয়ার ছেড়ে
বেরিয়ে আসতেই দেখি ছুটছে...
-
কী বুঝলেন?
-
নন্দদা
-
কন
-
আমনে চুপ কইরা থাকেন তো
অনেকক্ষণ। চুপ করেন।
Greetings from the UK.
উত্তরমুছুনThank you. Love love, Andrew. Bye.
Thanks a lot... can you read and understand bangla? Thanks again.
মুছুনসুন্দর
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুন