অশোক দেব
সদাপুরাণ-১৮
সদাপুরাণ-১৮
মৌমাছির বাসা দেখছেন? মোম-মোম, নরম নরম? ঠিক এমনই
এক বিছনা আছে একখানে। আরও মোম আরও
নরম। হেইখানে আকাশ আছে। বায়ু আছে।ঋতুর খেলা আছে। আছে কেবল
জোছনা।চান্দ আছে। অনেক। চান্দে চান্দে জোছনা চালাচালি হয়। হেই চান্দের থিকা ফুল
ঝইরা পড়ে। ঐ বিছনাত হেই ফুল আইয়া বয়। বইয়া থাকে আর আরেক চান্দের আশা করে। তখন
আকাশের মালিক আকাশ আকাশ করে। পাখি পাখি করে। পুরুষ পুরুষ করে। অন্দরের চান্দ
বাইরের চান্দেরে ডাক পাডায়। তখনই পুরুষের শরীরে গান বাজে।চান্দের টানে রক্তে জোয়ার
খেলে। বিন্দু বিন্দু চন্দ্র
তখন কেবল ঠেলে পুরুষরে। হেরারও আকাশ আকাশ করে। পাখি পাখি করে। ওই বিছনার মালিকই আসল
মানুষ। নারী। পুরুষ কিছু না। বেডাআইত কেবল রক্তের ছানা তোলার কারিগর। নিজেরে মারে,
মারে, মারে। বারবার নারীর কাছে গিয়া মরে। নিজের চান্দের দানা ঠেইলা পাডায় ওই
ভিতরের আকাশে। একবার চান্দের গায়ে চান্দের মিলন হইলে দশমাসে এক বছর। উল্টাপুষ্প
আকাশে ফুডে। একদিন তার মরণ আইয়ে। ঝইরা পরে। আমরা কই জন্ম অইলো। জন্ম অইলো। আসলে তো
মরণ হয়। তো, পুরুষের আসা যাওয়া না অইলে হেই বিছনা ভাইঙ্গা যায়। তখন অমাবস্যা অয়।
বাঁকানদী বাইয়া নাইম্যা যায় ওই বিছনার ফুল। রক্তের কান্দন আইয়ে। ভাটির কান্দন
আইয়ে। লতা আইয়ে না।
হেরা আমরার মতন না। মরণে যায় না । বারবার মরে না। আপ্তনাশ করেনা। আমরা পারি না। হেরা পারে। আমার মজিদ পারে। জরিনা মা পারে।
হেরা আমরার মতন না। মরণে যায় না । বারবার মরে না। আপ্তনাশ করেনা। আমরা পারি না। হেরা পারে। আমার মজিদ পারে। জরিনা মা পারে।
—
আমনে কী কন তো আমি বুঝি
না
—
বুঝতেন না... ওই দেখেন। যান, আজগা জরিনা
মা-র অমাবস্যা।
বলে
আমাকে ওই জানালার দিকে দেখতে বলেন। আধোসন্ধ্যা। ঘন একটা মেঘ ছিল। এখন ওটি লাল
হয়েছে। সেই লালিমাই এখন রং। রহিম মিয়াঁ আমাকে চোখের ইশারায় ওইদিকে যেতে বলেন। এখনই
কি দিনের তৃতীয় সন্ধ্যার সময়? আমি যাই। ওই জানালার আয়ত পরিসর দিয়ে ঘরে চোখ রাখি।
নিজেই নিজের থেকে পিছলে পড়ে যাচ্ছে জরিনা। পোশাক একটি নির্লজ্জ প্রতিষ্ঠা। নিজেকে
তার আড়াল হতে বের করে এনে মানবাতীত হয়েছে সে। একটা বহুযুগের সুখনিদ্রার মত জরিনার দেহটি দাঁড়ানো। আসল মোম জ্বালানো হয়েছে। দোকানের কেনা সাদা মোম না। কেমন
হলদেটে তার রং। মসৃন। শিখাটি বেপথু নয়। দৃঢ়। কেবল ঊর্ধ্বের ডাকে সে
দণ্ডায়মান। বিরাট একটি ধূপতি। পেতলের। গনগনে আগুনের আওতা ছেড়ে সুরের মত উঠে যাচ্ছে
ধোঁয়া। লালুমজিদ জরিনার প্রায়স্থির মূর্তিটির সামনে বসা। সোজা। কী রহস্য কে জানে।
এখন এরা কী করবে? আমি সরে আসি। এদের কিছুই আমি বুঝি না।
—
যান গা নিকি? রহিম মিয়াঁ
জিগ্যেস করেন
কিছু
বলি না। চলে আসি। দূরে কে যেনো উলুধ্বনি দিলো। একটা কাঁসর বাজলো, দায়সারা ভাবে।
আবার ওইদিকে কাদের মেয়ে হারমোনিয়ম বাজিয়ে রেওয়াজে মেতেছে। আকাশের লালিমা সরে
গিয়েছে এখন। জগতে জগৎ মিশবে বলে কেমন আয়োজন চারদিকে। আকাশের ওপার হতে কেমন একটা মন
এসে আমার মনে প্রবেশ করছে। গম্ভীর হয়ে যাচ্ছি। শীতল হয়ে যাচ্ছে শরীর। এইখানে ঘাস।
ঘাসেরও মাথায় ওই ফুলের ব্যবস্থা আছে। এত ক্ষুদ্র, তথাপি সে ফুলে ফুলে আনন্দ আর ধরে
না। যত ক্ষুদ্র ফুলই হোক, তাদেরও পরাগসাধনের জন্য আছে পতঙ্গ। ওইসব ক্ষুদ্র পোকা উড়ে উড়ে ততোধিক ক্ষুদ্র ফুলকে সার্থক করে
দিচ্ছে। বসি। ওইসব পতঙ্গ আমাকে পাত্তা দেয় না। নিকটপুষ্প ছেড়ে ওরা একটু দূরে যায়।
একই কাজ করে। ক্ষুদ্রের কাছে আনন্দই কাজ। কে বসলো, কে মাড়িয়ে গেলো, তাদের সেসব
দেখলে চলে না।
স্যাঁট করে এসে দাঁড়ায় সজু। একটা লাল রঙের মোটরবাইক কিনেছে। তিরখেলার ব্যবসাটা আছে। ফেন্সিডিলেরটাও। সঙ্গে ওই টিলা কেটে মাটি ভরাটের নতুন ব্যবসা সে-ও শিখেছে।
স্যাঁট করে এসে দাঁড়ায় সজু। একটা লাল রঙের মোটরবাইক কিনেছে। তিরখেলার ব্যবসাটা আছে। ফেন্সিডিলেরটাও। সঙ্গে ওই টিলা কেটে মাটি ভরাটের নতুন ব্যবসা সে-ও শিখেছে।
—
কু
আমি কিছু বলি না।
—
কুউউউউউ
ঘাড় তুলে তাকাই।
—
সদাভাই?
—
ক
—
তুমি কিতা বুন্দা নি?
—
অইলে তোর কী?
—
এতকিছু জানো, হারাদিন
পড়ো... কী ভালা রেজাল্ট করছ...
—
আসল কতা ক
—
এই এক শেখবাড়িত পইড়া
থাকো... তোমার মতলব কী?
—
মতলব ছাড়া কিছু অয়না?
—
ইন্টুপিন্টু অয়। তোমার
তো হেই হাডানও নাই... হুনো
—
ক
—
এই বুড়া মরলে এত জাগাজমি
কী অইবো? বেডার দুইপোলার দুইটাই নাটঢিল। ছুডুডা তো ওই গান মারাইয়া আর ধ্যান
মারাইয়াই কাইত... বউ একখান পাইছে...
—
তোরটা ক...
—
হুনো... এই জরিনা
আমার... এইসব পুস্কুনি আমার, যা দেখো আমার... এই জরিনা বেডি যার, এই দুনিয়া তার...
তোমারে লাস্টবার কই এই রাস্তা ছাড়ো...
—
আমি তো কুনু রাস্তা ধরছি
না
—
এই, বুন্দা ভোদাই...
যিডা কই হিডা করবি... আমি ভোমাগুড্ডি উড়াই, জরিনা আইয়ে। চায় আমারে। কেবল ছুঁইয়া
দিলে ফিট অইয়া যায়... হিডা এক্টিং। ঠিক অইয়া যাইবো... গপিস্ট মরবো... দিন
ঘনাইছে...
উঠে
দাঁড়াই। বাইকের হ্যান্ডেলবারে সজুর ডান হাত। তখনও এক্সেলারেটর একটু একটু ঘুরিয়ে
গোঙানি বাজাচ্ছিল। কব্জিটা ধরি। ক্রোধের শক্তি যেনো কেমন। আমি নিজেই জানি না, এত
শক্তি কোথা হতে এলো। সজু অবাক। তার চোখে ভয়। আমি খালি ওর কব্জি ধরে রেখেছি। ও
প্রাণপণ ছাড়াতে চায়। আমি ধরে থাকি। আর কী করতে হবে তো জানি না। ছেড়ে দিতে চাই।
পারি না। কে যেন ধরিয়ে রেখেছে। সজু অনেক জোরাজুরি করে। শেষে না পেরে ওই কু কু কু শুরু করে। আমি শিথিল হয়ে যাই।
সজু আমাকে মেরেছিল?
সদানন্দের খাতা পড়তে পড়তে আমারও সব তালগোল পাকিয়ে যায়। কেমন ঝিমঝিম করে
সদানন্দের খাতা পড়তে পড়তে আমারও সব তালগোল পাকিয়ে যায়। কেমন ঝিমঝিম করে
—
নন্দদা
—
কহেন
—
সজুসা তো বিরাট প্ল্যান
পাকাইছলো
—
ঠিক
—
শুনেন
—
কন
—
আমনে কী মনে করেন?
সদানন্দ এইসব লেইখ্যা রাখছে কেরে? আসলেই তো একটা বুন্দামার্কা পোলা আছিল। মাথা
নোয়াইয়া চলতো
—
কেরে লেখছিল?
—
নেন
এই
খাতাটা আমি চিনি। চিঠির খাতা। নন্দদা এগিয়ে দেন।
স,
অপ্রাপ্তি সুন্দর। সজুকে দেখে জানলাম আজ। সে
এই সৌন্দর্যের সন্ধান পায়নি। এই যে না চাইতে বাতাস গিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে বুক, এই যে
না চাইতে আকাশে আলোর অনুষ্ঠান, এসব দেখে না ওরা। পাওয়া মানেই পুড়ে যাওয়া। বাতাস
বুকে গিয়ে পুড়ে যায়। এতসব দৃশ্য, এতসব সুর, এই যে নদীর প্রশান্তি সব এখন দেখছি। দেখে নেবার পরেই স্মৃতি হয়ে
যাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে। শেষ হয়ে যাচ্ছে। পেলেই শেষ। এই যে জীবন পাইনি আমি, পাইনি।
তাই, অন্যের জীবন দেখে দেখে লিখি।লিখে রাখি।
জীবন বলে কিছু নেই। তুমিও নেই।মজিদভাইরা ঠিক বলে। চাঁদের আকাশ থেকে ছিটকে যেদিন এইখানে এলাম, মরে গেলাম। মরণে গেলাম। এখন একটি একটি মুহূর্ত পাচ্ছি। আসলে একটি একটি মুহূর্ত বিয়োগ হয়ে যাচ্ছে। হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে। কে আর তেমন করে সময় পায়? পাই না বলেই এইসব দেখতে দেখতে যাই। এইসব শুনতে শুনতে যাই। স্মৃতির ভাগাড় হয়ে যাচ্ছে এই দেহ। দেখি, শুনি। এইসব স্মৃতিতে গিয়ে জমে। উবে যায়। পাই না কিছু। অপ্রাপ্তি সুন্দর। তুমি সুন্দর।ইতি ১১ জুন ১৯৮৭
জীবন বলে কিছু নেই। তুমিও নেই।মজিদভাইরা ঠিক বলে। চাঁদের আকাশ থেকে ছিটকে যেদিন এইখানে এলাম, মরে গেলাম। মরণে গেলাম। এখন একটি একটি মুহূর্ত পাচ্ছি। আসলে একটি একটি মুহূর্ত বিয়োগ হয়ে যাচ্ছে। হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে। কে আর তেমন করে সময় পায়? পাই না বলেই এইসব দেখতে দেখতে যাই। এইসব শুনতে শুনতে যাই। স্মৃতির ভাগাড় হয়ে যাচ্ছে এই দেহ। দেখি, শুনি। এইসব স্মৃতিতে গিয়ে জমে। উবে যায়। পাই না কিছু। অপ্রাপ্তি সুন্দর। তুমি সুন্দর।ইতি ১১ জুন ১৯৮৭
তোমার একান্ত
সদানন্দ
সদানন্দ
অসাধারণ লাগলো। এতসব সুন্দর সরল বাক্যবন্ধ।
উত্তরমুছুনএত সোজাসুজি লেখা অথচ গভীর অর্থবহ। শুভেচ্ছা।
অসাধারণ লাগলো। এতসব সুন্দর সরল বাক্যবন্ধ।
উত্তরমুছুনএত সোজাসুজি লেখা অথচ গভীর অর্থবহ। শুভেচ্ছা।