রবিবার, ১৮ জুন, ২০১৭

সদাপুরাণ -১৭


অশোক দেব
সদাপুরাণ- ১৭

বান অইলো নদীর নখরা। মাইয়ালোকের মতন। মাইয়ালোকে প্যাকনা না করতে পারলে পাত্থর অইয়া যায়। নদীরও মাঝেমইধ্যে ফ্লাড করন লাগে। নইলে মইরা যায়। তোমরা গোমতীর নখরা বান্দো? টের পাইবা। এই নদী মইরা যাইবো।
     সারাদিন ওই সুনু চক্রবর্তীর গাড়িগুলি ছোটে। সেনাবাহিনির পুরনো ট্রাক সুনুঠাউর নিলামে কিনেছে। এখন দুনিয়ার টিলা কেটে কেটে মাটি নেয়। দিনরাত এরা টিলার লাল মাটি বয়ে নিয়ে যায়
নদীর ওপর প্রথমে মাটির বাঁধ দেওয়া হবে। পরে সেটা পাকা করা হবে। ড্যাম। বাঁধা পড়লে নদীর পেট ফুলে যাবে জলে। সে জল সরু সরু নালা দিয়ে সেচের জন্য পাঠানো হবে। দূর দূর মাঠে। তারই যজ্ঞ চলছে। সুনু চক্রবর্তী ঠিকাদারত্রিপুরায় ঠিকাদারী নতুন। বেকাররা আসলে বনের গাছের ব্যবসায় দিয়ে শুরু করে জীবনশেষে টাকা হলে ঠিকাদার হয়ে যায়। সুনু চক্রবর্তী ওই মহারানিতে নদী বাঁধার কাজ পেয়েছে।ওইসব নালা কাটার কাজও। নালার পাড় বাঁধার জন্যও যাচ্ছে লাল মাটি। ফেলা হচ্ছে শুকসাগর জলার মাঝে। তিরাশির বন্যায় গোমতী যা-খুশি করেছেসে অপরাধে তাকে শেকল পরানোর কাজ চলছে। একমাত্র গপিস্ট রহিম মিয়াঁ এটাকে নিতে পারছেন না। জীবনে তিনি কারো বাড়ি যান না। আজ সকালে তাঁকে আসতে দেখে ভয় পেলাম গেট খুলে দিলেও তিনি বাড়িতে আসেন না। কী একটা অভ্যর্থনা যেনো আশা করছিলেন। আমি তো বুঝতে পারিনি। টুক করে প্রণামই করে দিলাম। তিনি কয়েকটা একশো টাকার নোট আদেশের ভঙ্গিতে এগিয়ে দিলেন। নিলাম। এবার আসেন। ঘরে এসে সেই দাঁড়িয়ে থাকেন। বসেন না। সোফা একটু হাত দিয়ে ঝেড়ে দিলাম। বসতে বললাম। তিনি বসলেন। ভাবটা এমন, তাঁকে ঠিক করে যেনো বলা হল না। তবু বসলেন।
   পিটিশন লেইখ্যা দেন
   কিয়ের পিটিশন?
   নদী বান্দলে নদী মইরা যাইবো। একবার তো বান্দা অইলো ডম্বুরে আবার কেরে?
    আমনের কতা কেডা শুনবো? কারে লেখতাম পিটিশন?
   নিপেনদারে লেখেন, আমি নিজে গিয়া দিয়া আমুসব কতা হুননের লিগ্যা কয় না মানুষ। কিছু কতা কইয়া রাখন বালা।
     লিখে দিলাম। অদ্ভুত সুন্দর হস্তাক্ষরে নীচে সই করলেন গপিস্ট। আরবি হরফের মতন তাঁর বাংলা হেলে থাকে। কেমন একটা কলম পকেটে করে নিয়ে এসেছিলেন। সেটি বার করতেই কী সুন্দর গন্ধ!­­ একটা খামও এনেছেন। এটাই লিফাফা। যে কাগজে তৈরি সেটাতে কাগজ কম কাপড়ের ভাব বেশি। তাতেও আতর মাখানো।
‘চান্দ উঠতো না। দূরের থিকা আইতো না চৈতপক্ষী। রাইতে গান হুনা যাইতো না’।
    গান?
   গাঙের নিজের গান আছে। রাইতে যার নিন্দ আইয়ে না, হ্যায় হুনে
   আমনে শুনেন?
   হুনি, আমার তো ঘুম আইয়ে না। আমি ঘুমাইতে ঘিন্না করি
   তাইলে বাঁচবেন ক্যামনে?
   আছি তো, হুদা ঘুম দিয়া কী বাচন যায়? জাগনও লাগে। কারও কারও জাগন লাগে।
তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। একদৃষ্টে। বুঝতে চাই। যে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে, সে সত্য বললেও কেমন লাগে
 যামুগা
   কই?
  ঘুঙুর
   হিডা কোনখানে? কন না, ক্যামনে যাইবেন?
  আছে
     রাস্তার দিকের জানালা বন্ধ ছিলো। খুলে দিলাম। খুলতেই ওই সেনাবাহিনির পুরনো ট্রাক। কেমন কিপ্টে চেহারা। কেমন কঠিন, ভয়ঙ্কর। পিঠে লাল মাটির ইয়া স্তুপ।
   যামু গা
   ইতান কইয়েন না
   সদামিয়াঁ
   কন
  আমনেরে কু কু কইলে চেতেন কেরে?
   চেতি না, কষ্ট লাগে
  কেরে?
   ওই নিজেরে একটা কেমন লাগে, মানুষের থিকা কম...
  মানুষের সমান অইতে পারে না মানুষ। অয় আগাইয়া যায়,  নয় পিছাইয়া যায়... আমনে আগাইয়া আছেন
   আমি?
   হুনেন, মানুষের লগে মিশন ভালা, মিশ্যা যাওন ভালা না।
   বুঝলাম না...
     একটা কুকুর ডেকে উঠলো বাইরে। চিনি একে।লালুসরাইল্যা। বাইরে যাই। লালুমজিদ নিজের নামে কুত্তা পোষে। এই হল মজিদ ভাই। তার ডাকনাম লালু। এই তার পোষা সরাইল্যা। তার নাম লালু।
   বাপজানরে পাই না। কয়দিন ধইরা কেবল কন, যামুগা যামুগা
   আমনে ভিতরে আইয়েন
   না, তাইনে যে কই যাইতে পারে হিডাই তো বুঝলাম না। তবু খুজি একটু
    তাইনে আমার ঘরে
মজিদভাই আমার চোখের দিকে তাকান। অবিশ্বাস।
    পিটিশন লেখাইতে আইছেন
    গাঙ লইয়া?
   হুম
   আমারেও কইছলেন, দিলাম না। আমার পিটিশন লেখতে ঘিন্না লাগে। কেডা কার কাছে পিটিশন লেখব? কেডা কার ‘অধীনের বিনীত’?
     আমাদের কথার মাঝখানেই বেরিয়ে আসেন রহিম মিয়াঁ গপিস্ট। পেছনে দাঁড়ান। আমাদের থেকে অন্তত ফুট খানেক উঁচু। চওড়া মানুষ। সারাক্ষণ বসে থাকেন। বোঝা যায় না। যেনো পূর্বনির্ধারিত ছিল, তিনি আদেশ করেন, ‘চলেন’। আমরা তাকে অনুসরণ করি।
     এই হল ধোপাইছড়ি ব্রিজ। গোমতীর এইখানে ঘাট ছিলো। ধোপা ঘাট। এখন ব্রিজ হয়েছে। নেতাজি সুভাষ ব্রিজ। গপিস্ট হাঁটেন। রাস্তার মানুষ বেকুব। কী যেনো আছে তাঁর।তিনি হাঁটছেন, লোকে পথ ছেড়ে দিচ্ছে।এটা গপ নয়। আমরা আশু কর্মকারের বাড়ি পেরিয়ে গোমতীর জলের কাছে চলে আসি। রহিম মিয়াঁ এসে এইখানে দাঁড়ান। গোমতী আশ্চর্য একটা কাণ্ড করেছে এখানেশ্মশান থেকে সোজা এসে চলে যাচ্ছিলো উত্তর পশ্চিমে।হঠাৎ কেন সরে এসেছে। একটা ঘূর্ণি বানিয়ে জল যেনো মাথা কুটে কুটে ফিরে যায়।
    নিচে পাষাণ আছে, বিরাট ওই পুবগকুলপুর পয্যন্ত, গাঙেরে আটকাইয়া রাখছে
  তই?
  তই কিছু না, চলেন
     আবার হনহন করে হেঁটে চলে আসেন গপিস্ট। আশু কর্মকারের বাড়ির পাশে বস্তিমত কয়েকটা ঘর। দুটি লোক ছুটে এলো। বিস্মিত তারা।রহিম মিয়াঁ দাঁড়ান। এরা একে একে প্রণাম করে। তিনি দুজনকে দুটো একশো টাকার নোট দেন। এক তাড়া টাকা তাঁর পাঞ্জাবির পকেটে। তাতেও স্পষ্ট আতরের গন্ধ।
      সদানন্দের এইসব লেখা পড়তে পড়তে দিশাহীন লাগে।গপিস্ট তো গপিস্ট ছিলো। প্রতিপত্তি ছিল ঠিকদানের হাত ছিল। কিন্তু এতটা তো বুঝিনি। জানতাম, তাঁর কথাতেই অনেক লোকে ভোট দিতো। ভোটের আগে তাঁর বাড়িতে মিটিঙের পর মিটিং। দু দলই মিটিং করতো। সিপিএম আবার কংগ্রেস। আমরা হাসতাম। গপিস্টকে তরমুজ ডাকতামতবে সকলেই দু’দলের মিটিঙে যেতআসল কথা ওই খাদ্যখাবার। মিটিং চলাকালীন নানা মুখরোচক। তারপরে তো বেশ ভুরিভোজ। সে গপিস্ট তখন মহারানিতে গোমতীর ওপর বাঁধের বিরোধিতা করেছিলো? তার কথা সরকার পর্যন্ত গেলো কিনা কে জানে গেলে ভালো হত। সত্যিই নদীটা মরে গিয়েছে। ফ্লাড আর হয় না বটে, কিন্তু নদীও বেঁচে নেই। সেচের কাজেও আসে নাআ তেমন। আজ সদার ঘরে এসেছিলাম ওইসব গয়নার রহস্য জানতেনন্দ দারোগার শরীর ঠিক নেই। তবুও তাকে ফোন করে আনালাম। আজ রবিবার, সারাদিন খুঁজবো ওই গয়না আসলে সে কার জন্য যোগাড় করতো? খুঁজবো তার ‘স’ কে। সোনালির মা-ই বা তাকে কী কারণে রবীন্দ্রনাথ মনে করতো?
   নন্দদা
    কন
   আমনের মনে আছে রহিম মিয়াঁরে?
   আলবৎ মনে আছে
  মালটা আসলে কিতা আছিল?
   আমি তো হিডা জানি। যিডা জানি না হিডা অইলো ওই জরিনা।
   আমনেও?
   হ রে ভাই, আমিও জরিনার প্রেমে পড়লাম। অহন যিহানেই থাক যদি থাইকা থাকে, আমি দেখতাম চাই। বুড়ি হোক থুত্তুরি হোক, একবার দেখতাম।
বলেই সদানন্দের একটা লেখার অংশ এগিয়ে দেন।
     আজ বাজারে মিট্টিকে দেখে আমি বিশ্বাস করিনি। মিট্টি সেই বাইদ্যানি। ওইরকম কালো রঙের জেল্লা আলাদা। ফর্সা রঙে সে জিনিস কোনওদিন আসবে না। কোমর দুলিয়ে বিধু স্টোর্সের গলিতে কোথায় যাচ্ছিলো। আমাকে দেখেই দাঁড়ালো
     বাবু, পেহচানা?
     মিট্টি, আছো কেমন?
    বঢ়িয়া। ইধর আইয়ে তো
মাছ বাজারের দিকে একটু টেনে নিয়ে গিয়ে সে আমাকে ফিসফিস করে বলে, ‘ও জরিনা ঠিকঠাক হ্যায়?’
   একদম, বিলকুল
    পাগল নেহি বনি?
   না তো, নেহি...
    বুখার উখার, লম্বি কয়ি বিমারি?
   না তো...
    অব হোগি, হম যো আয়ে... বাবু
    বলো
    হম আপনা জান লেনে আয়ে হ্যায়
    জান?
   ও হ্যায় না, মজিদ... রুলাতা হ্যায়... হমকো রোনা আচ্ছা লাগতা হ্যায়...
     এরকম একটা বেদেনির সঙ্গে বাজারের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছি? চারদিকে তাকাই। এর মধ্যেই দুএকটা কু কু বেজে গিয়েছে। আমি সরে আসি। ভয় পাই। একটা অটো নিয়ে সোজা চলে আসি পাড়ায়। ব্যাগটা রেখেই রহিম মিয়াঁ গপিস্টের উঠানে। ওইদিকে চালতাতলায় মজিদ ভাই। তার পায়ের কাছে শুয়ে আছে সরাইল্যা। মজিদ মিয়াঁ এই যে চোখ বন্ধ করে রাখে, বসে থাকে, এটা দেখলে যে কেউ দমে যাবে। যেনো, এখনো বানানো শেষ হয়নি এমন একটা যোগীর প্রতিমা। তার চারপাশে বাতাস হাল্কা। কিছু পক্ষীডাক তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে। একটা চাঁদ এসে যেনো বিধুবতী হয়েছে তার পেছনে। আমিও দমে যাই। উশখুশ করছি। সাড়া নেই কারও। কোথায় গেলো পরিভাবি?
     একটু বাদে পাশের ঘরের থেকে বেরিয়ে এলো জরিনা। স্পষ্ট। নির্বিকার। আমি ছুটে কাছে যাই। কী যেনো ছিলো আমার গতির মাঝে লুকনো। জরিনা দাঁড়িয়ে পড়ে। আমি যেতেই সেই হাসিটা। কোনও বনের দূর গোপনে লুকনো ঝরনা। সেটার দরোজা খুলে দেয় জরিন। একসময় থামে।
   ডরাইছেন?
   মানে?
   আবার দেখা অইলে ওই মিট্টিরে কইবেন, তাই অইলো বাটপাড় বাইদ্যানি... আমিও ঘুঙুর।


১০টি মন্তব্য:

  1. "গাঙের নিজের গান আছে"
    এই লেখাটির ও নিজস্ব সুর আছে
    বয়ে চলা আছে।

    উত্তরমুছুন
  2. নদীতে বাঁধন দিলে নদী মরে যায় গো,
    জরিনাও কি নদী ? তাই জরিন‌ ...

    উত্তরমুছুন
  3. "হুনেন, মানুষের লগে মিশন ভালা, মিশ্যা যাওয়া ভালা না।" 🙏🏼অশোকদা।

    উত্তরমুছুন