অশোক দেব
সদাপুরাণ – ১৫
সদাপুরাণ – ১৫
বেজে চলেছে গায়ত্রী। নন্দদার ফোন। গায়ত্রীমন্ত্র
পরানো আছে তাতে। ফোন করলেই বাজে। একটানা,
বারবার। কিরিং করে থামে, তারপর আবার শুরু। শুনতে থাকি। একসময় ধরলেন, ‘কন’।
‘নন্দদা, মাচ্ছা স্বপন...’ ফোন যতটা জোর দিতে পারে, তার থেকে জোরে নন্দদা হাসেন।‘জানি,
মনে হইছে ঘটনা? বিকালে আইয়েন সদার ঘরে। এই রং রং না, আরও রং আছে।’
বিকেল হল। একটা ঘুম দুপুর হতে সারা পাড়া ঘুরে বেড়িয়েছে। আমি তার পিছুপিছু হেঁটেছি। সুনীল মজুমদার। এখন কোথায় ছেলের কাছে চলে গিয়েছেন। বাড়ি বিক্রি করে দিলেন। তার এক বাড়ি এখন সাতটা বাড়ি হয়েছে। এই নতুন মানুষগুলো কেমন! চিনি না। এই বাড়ির সেই গাছগুলো নেই, সেই গন্ধটাও না। সুনীলকাকা একটা আণ্ডারওয়্যার পরে থাকতেন সারাদিন। ধুতির নীচে পরার সুতির হাফ প্যান্ট। সেটা ঢাকতো বটে, প্রকাশ করত তার থেকে বেশি। অসভ্য। সেটি পরে তিনি এদিক ওদিক ঘুরতেন। মেয়েদের স্নানের সময়ে পুকুরের ধারে ধারে হাঁটতেন। অকারণ শাক তুলতেন। শোনা যায় একদিন কে এক নারী বাগে পায় তাকে। মুচড়ে দেয়। সুনীলকাকা অসুস্থ হয়ে যান। সেই থেকে ধুতিকে লুঙ্গির মত পরতেন।
বিকেল হল। একটা ঘুম দুপুর হতে সারা পাড়া ঘুরে বেড়িয়েছে। আমি তার পিছুপিছু হেঁটেছি। সুনীল মজুমদার। এখন কোথায় ছেলের কাছে চলে গিয়েছেন। বাড়ি বিক্রি করে দিলেন। তার এক বাড়ি এখন সাতটা বাড়ি হয়েছে। এই নতুন মানুষগুলো কেমন! চিনি না। এই বাড়ির সেই গাছগুলো নেই, সেই গন্ধটাও না। সুনীলকাকা একটা আণ্ডারওয়্যার পরে থাকতেন সারাদিন। ধুতির নীচে পরার সুতির হাফ প্যান্ট। সেটা ঢাকতো বটে, প্রকাশ করত তার থেকে বেশি। অসভ্য। সেটি পরে তিনি এদিক ওদিক ঘুরতেন। মেয়েদের স্নানের সময়ে পুকুরের ধারে ধারে হাঁটতেন। অকারণ শাক তুলতেন। শোনা যায় একদিন কে এক নারী বাগে পায় তাকে। মুচড়ে দেয়। সুনীলকাকা অসুস্থ হয়ে যান। সেই থেকে ধুতিকে লুঙ্গির মত পরতেন।
সরকারদের
বাড়ি। একটা ছেলে পাগল।এখন আর ছেলে নেই, প্রৌঢ়। খিদে পেলে টিনের ঘরে লাঠি দিয়ে
মারতে থাকে আর পুরনো হিন্দি গান আবৃত্তি করে। খাবার দিলে সে গান সুরেলা হয়ে যায়।
শোনা যায় সে প্রেমের পাগল। বিকেলে একা বসে চিৎকার করে, ‘আংরেজি মে কেহেতে হ্যায় কে
আই লভ ইউ’। তার সামনে দিয়ে মেয়ে বৌ-রা হাঁটে না। দেখলেই সে ওদের প্রাক্তন, বর্তমান, কিংবা পরকীয়া
প্রেমিকের নাম জোরে জোরে বলে।কবে কে কোথায় কার সাথে দেখা করে, মিলন করে, সেসবের
ধারাবিবরণী দেয়। পাড়ায় পরকীয়ার অভাব নেই। নানা কিসিম। সবাই এই নিলু পাগলাকে ভয়
পায়। জগৎ দেখলে দেখুক, নিলু যাতে না দেখে। মেয়েরা
নিলুকে ভয় পায়। পুরুষ ভয় পায় ততোধিক। সকলের
সামনে তার বা তার স্ত্রীর বেচাল নিয়ে ঠাস করে বলবে। প্রায়
প্রতিদিন নিলুর এখানে ফোলা, ওখানে কাটা। নীল হয়ে থাকে চোখ। কেউ না কেউ মেরেছে।
নিলু গা করে না। এখন প্রায় প্রৌঢ়ত্বে এসেও সে আসলে সতেরো বছরের প্রেমিক। নিতান্ত
একা হলে, কাছে গিয়ে বসলে ও বলে। একটা ট্রাঙ্কের থেকে এনে পুরাতন প্রেমপত্র পড়ে
শোনায়। ছবি দেখায়। সত্যিই সুপুরুষ ছিল সে।
নন্দদা
ফোন করেন,‘কই, আইয়েন। বইয়া রইলাম। আজকে আমনে বেকুব অইয়া যাইবেন’।
আসি।
সদানন্দের পড়ার ঘর।খাতা নয়, নন্দদা একটা
ফাইল খুলে কয়েক তাড়া কাগজ বের করে দেন। পড়ি।
জরিনার
স্নানের ঘাট। এখানে পুকুর নিজেই ঢেউ তুলতে সাহস করে না। এ ঘাটে কেউ নামে না। এত দুঃসাহস
অন্তত এ পাড়ার কারও নেই। এই সন্ধ্যায় সেই ঘাটের জল সাদা হয়ে যাচ্ছে। সজু কলসি কলসি দুধ নিয়ে এসেছে। কোমর অব্দি জলে দাঁড়িয়ে মাথায় দুধ ঢেলে চলেছে। পুকুরের জল প্রথমে ঘন সাদা,
পরে নীলচে সাদা হচ্ছে। আবার সে আরেক কলসি দুধ নিয়ে মাথায় ঢালে, ‘ইডা আবার কিতা?’
বলেই ফেললাম কথাটা।
— শালারপুত, কালকে রাত্রের কথা ভুইল্যা গেছো? তোমারেও দেখুম আমি। তোমার দিন
ঘি দিয়া স্নান করুম।
— ও
আর
ভালো লাগে না। চলে আসি।কিছুতেই কাঁপটা কমছে না। ভেতর হতে কাঁপে শরীর। থেকে থেকে
দামের গভীর হতে উঠে আসা স্বপনের হাতটা মনে পড়ে। আপ্রাণ হাতছানি দিচ্ছিলো। ঘোরাচ্ছিলো। দামের গভীরে ওকে
ঘিরে ধরছিল মৃত্যু। আর সে হাত নেড়ে ডাকছিলো ওপরে যারা বেঁচে আছে, তাদের। মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে
ওই তার হাত নাড়া। একটু জীবন খরচ করে ওকে টেনে তুলতে বলছিল সে পৃথিবীর মানুষকে?
নাকি, কী বলছিল? আমাকে বেঁধে রেখেছে সজু আর ওর মদখোর চ্যালাগুলো। একটা কী গাছ, বয়স
কম। তার সঙ্গে এনে আমাকে বেঁধেছে। গাছটা কী যেন করছিল। তাতে সারা শরীর চুলকায়।
চিৎকার করছি। সজু এসে দমাদম
চড় কশাচ্ছে। কী জোর ওর হাতে! আমি
চিৎকার করছি। শিখিনি চিৎকার
করতে, তাই সেটা চিৎকার হচ্ছিলো না। গোঙানি হয়ে যাচ্ছিলো। কেউ
শুনতেই পেলো না।
সন্ধ্যায়
মাচ্ছা স্বপনকে নিয়ে সজু এলো আমার ঘরে। একটা হান্ড্রেড পাইপারস এনেছে। ব্রিটিশের দোকান হতে চপ এনেছে শূয়রের মাংস এনেছে। অনেক
কাজুবাদাম এনেছে। আর এনেছে একটা ঘোলা রঙের বাংলা মদের
বোতল। সে এসে নাগাড়ে গেটের সামনে কু-কু করছিল। গেট খুলতেই ঢুকে পড়ে। ‘পার্টি করুম’।
— আমার ঘরে?
— কেরে? ইডা কি সৎসঙ্গ আশ্রম?
— না... মানে...
— হুনো, কুউউউ, তোমার এই ভ্যাবলামার্কা বদনডা পাল্টাও। ইডার ভিতরে তুমি যে কী
মাল, আমি জানি। ইডা দেখছ?
সে একটা মাছমার্কা ড্যাগার বের করে। কানকো
চাপে, তড়াক করে বেরিয়ে আসে উদ্যত শাণ। আবার গুছিয়ে রাখে।
— ডরান কেরে সদাভাই? ফুর্তি করবো। আমনে বিলাতি আমরা বাংলা... মাচ্ছা স্বপন
বলে
— আচ্ছা তোমরা বও, গেটটা লাগাইয়া আই
গেট
বাইরে থেকে কে যেন লাগিয়ে দিয়েছে। কী করি এখন আমি? আজ আমার গান শোনার দিন।
রামপ্রসাদ শুনবো। আজ অমাবস্যা। ঘরে এসে আমার আর কিছু করার থাকলো না। কোথা হতে কাটাবাপ্পা,
টিংকু, আর একটা ছেলে এসেছে। ওর কী যেনো নাম, সবাই লারেলাপ্পা বলে ডাকে। সে-ও
এসে বসে গিয়েছে মেঝেতে। এরা কেউ তেমন খাচ্ছে না। মাচ্ছা স্বপন মৃদু হাসছে আর
গেলাসের পর গেলাস খেয়ে চলেছে। এক গেলাস খেয়ে নিলেই সজু ওকে দশ টাকা দিচ্ছে। স্বপন
সেটা পকেটে পুরেই আরেক গেলাস চোঁ করে গিলে নেয়। হাত পাতে, টাকা নেয়।
ফোনের
কাছে যাই, কাউকে একটা ফোন তো করি। তুলে দেখি নিরেট হয়ে আছে। এরা কী প্ল্যান করেছে?
ফিরে আসবো, আমাকে চ্যাংদোলা করে এরা ভ্যানটাতে তোলে। একটা ছেলে হাত দুটো এক করে
ধরে রেখেছে। এত পাথর হতে পারে কারও হাত? চিৎকার করি, হয় না। সজু সামনের সিটে, কে
যেন গাড়িটা চালাচ্ছিলো। দুদিকে মুখ করা দুটো সিট। লম্বা। আমার সামনে মাচ্ছা স্বপন,
প্রায় শোয়া। শুয়ে শুয়েই সে ডান হাতের তর্জনী তুলে তালে তালে নাচাচ্ছে। মনে মনে কী
গান গাইছে, এটা তার তালরক্ষা। কী
হতে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। লহমায় ছনবন দামের কাছে চলে এলো গাড়ি। মেয়েদের স্কুলের পেছন দিয়ে কাদাভরা রাস্তা পেরিয়ে একেবারে উত্তরে। কে যেন
ঠেলে দিল।মাটিতে পড়তেই এই দেখি এই তরুণ গাছ। তাতেই বেঁধে ফেলল আমায়। যেন কোনও
সিনেমা, যেন একটা ঘটছে না এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। স্বপনকে নামানো হল। ও দাঁড়াতে পারছে
না। সজু নাগাড়ে মেরে চলেছে স্বপনকে। কেড়ে নিয়েছে সবগুলো টাকা। স্বপন কেমন একটা
করছে, মার থামলেই ও আবার কেমন মার খেতে চাইছে যেন। লালামাখা মুখ তুলে, মৃতপ্রায়
দৃষ্টি মেলে সে বলে, ‘আমি জানি কেরে মারতাছো, আমারে পরী-এ মারছে। তুমি কি বাল
মারবা?’
ওকে
ওরা চ্যাংদোলা করে নেয়। যেন অতিশয় যত্ন।
তখনও মাচ্ছা মনেমনে সে গান গাইছিলো। ডান হাতের তর্জনী নাচিয়ে তাল রেখে যাচ্ছিলো। যেন কোনও দামি তরল। এক পাত্র হতে আরেক
পাত্রে ঢালা হচ্ছে তাকে। এমনি করে ওরা দামের ওইটুকু ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিল স্বপনের
দেহ। আমি চিৎকার করেছি প্রাণপণ। হয় না। সকলে চিৎকার করতে জানে না।
— পরীভাবি মারাইবা না। আমি
ছুঁইলে ফিট অইয়া যায়? তোমরা অইলে রসকষ সিঙ্গারা বুলুবুল?
লালুমজিদ্যার বাড়িত যাইবা, তোমারও এই অইবো... আমাকে স্থির ভাবে এই কথা বলে সজু।
সকলে
সমস্বরে কু কু কু... আমাকে ঘিরে ওরা নাচে। অন্ধকারের যে নিহিত আলো তাতে আমি দেখি। দেখি, দামের ফাঁক
দিয়ে দেখা যাচ্ছে স্বপনের হাতখানি। সে প্রাণপণ হাতছানি দিচ্ছিল। দামের ঘাস ধরে
টানছিল। ওসব ঘাস ওকে তিলমাত্র সাহায্য করেনি। একসময় থেমে যায় হাতনাড়া। সজু এসে
লাথি মারে আমাকে। একটা লাথি মারে একবার কু করে চিৎকার করে। জীবনে মার খাইনি। মার
খাওয়া এমন? একসময় হয়তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছি। কতক্ষণ চলে গেলো? দেখি আমার বাঁধন খোলা।
মাটিতে পড়ে আছি। স্বপনের হাতটা দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার এসে লেপে দিয়েছে সব।
পেচ্ছাপ পেলো। ছুটে বাড়ি চলে আসি। কেউ কি আমায় দেখেছে?
গেট
খোলা হাট করে। ঘরের অবস্থা সঙ্গিন।জল খাই, বসি। কাউকে বলব? কাকে? কিছুই মাথায় আসে
না আমার। মজিদভাইকেই বলবো কাল।
স্বপনের
দাহ হল। এখন বিকেল। আর সজু ওই জরিনার ঘাটে দাঁড়িয়ে দুধ ঢেলে চলেছে মাথায়। মজিদভাইয়ের চালতা তলায় যাবো, তার আগেই ডাকেন রহিম মিয়াঁ। যাই তাঁর ঘরে।
— আমরা পুরান লাইঠ্যল। জানি, বুঝি। চুপ থাকেন, ভুইলা যান
— কী কন?
— যা কই হুনেন
চলে
আসি। এইখানে একটা তেঁতুল গাছ। ওই দূরে চাষ হচ্ছে। পাওয়ার টিলার। ধাতব
দাঁত দিয়ে মাটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে একটা
প্রায়শুষ্ক মানুষ। একঘেয়ে একটা শব্দ হচ্ছে ওই যন্ত্রলাঙল হতে। দূরে আরও দূরে একটা
তারা উঠে এসেছে। পৃথিবীকে সন্ধ্যাকাল শেখানো তার কাজ। ছোট একটা নৌকা গোমতী পেরিয়ে যাচ্ছে। বসি।
কী যেন ঘাস এগুলো। ছুঁচলো। লাগে। তবু বসি।
সামনে
একটা লঙ্কাক্ষেত করেছে কে যেনো। বেড়া দিয়েছে। তাতে একটা পাখি। একটা কেমন তালে সে
লেজ নাড়ায়। সকলের ভেতরেই গান থাকে। জীবনে বাজে। মৃত্যু নিকটে এলেও বাজে হয়তো।
স্বপন কাল রাতে তার তালে তাল রেখেছিলো?
— নন্দদা...
— বলেন, কন
— এইসব সত্য? সদা সাহিত্য কইরা লেখছে না তো?
— তাইলে কি আর আলগা কইরা ফাইলে লুকাইয়া রাখতো?
— ঠিক ঠিক
— মাল খাইবেন?
— না, আমি যাই
চলে আসি। বাড়ি যেতে মন চাইছে না।পশ্চিমে সেই
তেঁতুল গাছ। দূরে সন্ধ্যাতারা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন