মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০১৭



অশোক দেব
সদাপুরাণ - ১৪

দিঘির বয়স হয়ে গেলে সে তার জল লুকিয়ে ফেলে। দামের আড়ালে জলের টলটল ঢেকে দেয়। আজকাল কিছু লিখতে পারি না। সদার মতন হয়ে যায় লেখা। সদানন্দ একটা নেশা হয়ে পড়েছে। আজ ছুটি। সদার বাড়িতে যাবার উদ্যোগ নিলেই বউ টের পায়। ‘এই কু-ডার বাড়িত কী পাও তোমরা? সারাডাদিন পইড়া থাকো। সুইসাইড কেইস... ডর লাগে। মদ খাওনের অইন্য জাগা নাই?’ কিছু বলি না।চুপচাপ বেরিয়ে যাই। গোমতীর গায়ে গায়ে কয়েকটা বাড়ি। পেরিয়ে গেলেই সদানন্দের আস্তানা
গেলাম। বন্ধ। ভেতর থেকে গেট লাগানো। বুঝি, ভেতরে নন্দদা। এখন তার সদার ঘর গোছানোর কাজযত্নে সবকিছু ঝকঝক তকতকছিলেন তদন্তকারী পুলিশ অফিসারসদানন্দের মৃত্যুর কারণ খুঁজে বার করবার কথা ছিল তারএখন সেটি নয়, তার ফেলে যাওয়া জীবনের রূপ খুঁজে চলেছেন। আমাকেও নিয়ে জোটালেন এতে এখন আমারও ওই এক নেশা। সদানন্দ।আজ আর  সদাকে পড়া হবে না। শত ডাকলেও নন্দদা গেট খুলবেন না এখনচলে আসি।
     এমন বিকেলে উদয়পুরে ঘুরবে? চলে যাও গোমতীর কাছে। কিংবা শুকসাগরের পাড়ে
নাহয় এইসব দিঘির পায়ে পায়ে ফেরো। আনন্দ আর অতীত এদের ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় চকচক করে। এইসব দিঘি রাজাদের। নদীর ওই পারে আসল রাজধানী। এখন প্রাচীন প্রাসাদের একটুখানি ভূমি ছাড়া আর কিছু নেই। লোকে দখল করে নিয়ে নিয়েছে। সেসবের আবার কাগজপত্রও আছে। বৈধই নাকি সব। মানুষের কাছে প্রাচীন রাজা হোক কি দেবতা, সবাই হেরে যায়। আজকের উদয়পুরের অর্ধেক ভূসম্পত্তির মালিক দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী। রাজা দেবীকে লিখে দিয়েছেন। এখন দেবীর জমিতেও মানুষের একতলা, দোতলা।বাকি উদয়পুরের বেশিটা আসলে জল। দিঘি। রাজারা দেবতার জন্য দিঘি খনন করেছেন কখনও। কখনও রানির বায়না রাখতে। রাজা যায়। রাজা আসে। কিন্তু কখনও এমন যায় যে, আর আসে না। হাজার বছরের পুরনো এই মাদা রঙের শহর আসলে পরিত্যক্ত রাজা পরিত্যাগ করে গিয়েছিলো। সেই পরিত্যাগের মাদা রং আর যায় না। কিছুতেই একে উজ্জ্বল করা যায় নাযত আলোই দাও, উদয়পুর নিজেকে কেমন আলো-আঁধার করে রাখবে।
     এইটা দিঘি নয়। দাম। এটাও হয়তো কোনও রাজার কাটা দিঘি ছিল। ছনবন, মেয়েদের ইশ্‌কুলের পেছনে বিশাল এই দিঘি
কালের অযত্নে নিজেকে দামের আড়ালে ঢেকেছে।  হেঁটে চলে যাও, পারবে। ঘাস লতাপাতা আছে, ছোট ছোট ঝোপও আছে। ভাসন্ত। হাঁটলেই টের পাওয়া যায় টলটল করে। দেবে দেবে যায় ঘাসের জমি। নীচে জল। গভীর। মাঝে মাঝে একটু একটু গর্ত, কালো রঙের জল। সেখানে তাকালে মুখচ্ছবি টলটল করে উঠবে।এইসব ঘাসলতা খাবার জন্য গরু বেঁধে দিয়ে যায় লোকে। কখনও,তার পেছনের সরু একটা পা দামের নরম ভেদ করে নীচে চলে যায়। গরু সেটাকে তুলতে সামনের পায়ে ভর দিয়ে চেষ্টা করে। এবার সামনের পা ডুবে যায়, পেছনের পা উঠে আসে।এ এক খেলা। যে দেখে তার জন্য খেলাগরুটির জন্য প্রাণান্তকর। এখনও ওই একটা গরু কতক্ষণ ধরে সেই চেষ্টা করে চলেছে।আজ কেন যে মৃত এই দিঘির কাছেই এলাম! তার ঢেউ নেই, জল নেই কিন্তু সে আছে।
     রাজাদের সব দিঘিই এমন দাম হয়ে গিয়েছিল।জলের ওপর এমনই টলটলে স্থলজঙ্গল
তার ভিত্তি আসলে গুপ্ত, গভীর জল একদা সরকার দামে ঢাকা দিঘিগুলির লুকনো জল বার করে আনতে উদ্যোগ নিলকোদালি লাগানো হল, মাটি কাটার লোকজন এলো। দেখা গেল, কোদাল চালাতে চালাতে টুক করে ডুবে যায় কোদালি। ডুবে গিয়ে নেই। নেই মানে নেই এই শহরে কিছু নতুন উদ্যোগ করলে রক্ত দিতে হয়। গোমতী বাঁধবে মহারানিতে? একজন মরল।কী জানি কী গোলাগুলি হয়েছিলতার আগে, ধোপাইছড়িতে নেতাজি সুভাষ সেতু বানাবে? তিনজন শ্রমিক একদিনে নাই। এই সেদিন নতুন রেল স্টেশন হল শুকসাগর জলার শুকিয়ে যাওয়া জমির মাঝখানে একজন শ্রমিকের ওপর দিয়ে চলে গেল ট্রেন। সে কি আছে, না মরে গিয়েছে? এ শহরের জন্ম রক্ত ঝরিয়ে। গোপীপ্রসাদ রাজার শ্বশুর। সেনাপ্রধান। জামাতাকে হত্যা করে হলেন রাজা। নিজের নাম রাখলেন উদয়মাণিক্য। এই হল রাজধানী।  তার নাম হয়ে গেল উদয়পুর। সে রক্ত যেন উদয়পুরকে ছাড়ে না আরদামের আড়াল হতে প্রাচীন দিঘিগুলির লুকোনো জল প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা হচ্ছিলোতখনও হচ্ছিলো লোকক্ষয়  তখনও রক্ত। দিঘি টপাটপ গিলে নিচ্ছিল মানুষ। শেষে কোদাল বাদ গেল আনা হল করাত। লম্বা শক্ত বরাক বাঁশ শোয়ানো হল। বাঁশের ওপর কাঠের শক্ত তক্তা পেতে করাত দিয়ে কাটা হল নরম স্থল। বের করে আনা হল দিঘি। অমরসাগর, জগন্নাথ দিঘি।প্রায় সব দিঘিই এমন নতুন জাগানো! কিন্তু এটিকে আর জাগিয়ে তোলা হল নাসে এখনো টলটলে স্থল নিয়ে দাম হয়ে আছে। সে এখনও ভয়ঙ্কর
     উদয়পুরটা আসলে কয়েকটি পরিবারের শহর হয়ে পড়েছিল। ছিল তো মগের মুলুক।  তাদের হাত থেকে নিল ফা-রাজারা। তারাই আবার মাণিক্য হল। রাঙামাটি থেকে উদয়পুর। যুদ্ধ, যুদ্ধ, যুদ্ধ। কিন্তু পরাধীন হয়নি কখনও এ শহর
শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা। দখল করেছিল। ধরে রাখতে পারেনি। উদয়পুর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে। উদয়পুর।শখ করে এক রাজা পুত্রের নামে এর নাম রেখেছিলো রাধাকিশোরপুর। থানা আর পোস্ট অফিস ছাড়া সে নাম কেউ মনে রাখেনি। যেমন এই জায়গাটার নাম  রাজেন্দ্রপল্লী, সেটাও কেউ মনে রাখেনি। রাজেন্দ্র ভট্টাইজ। এদিকটা তাদের। পুকুরের পর পুকুর। ভূমির পর ভূমি। আরও পূর্বদিকের উদয়পুর শ্যাম সাহাদের। পুকুরের পুকুর, ভূমির পর ভূমি। শ্যাম সাহা এমনকি গোমতীর পরিত্যক্ত খাতকেও নিজের নামে করেছে। মাস্তানদেশভাগের সময় মুসলমানদের মেরেপিটে, ভয় দেখিয়ে তাড়িয়েছে। এক ছিল ম্যাজিস্ট্রেট তারক গাঙ্গুলি। তার সাথে শ্যাম সাহার কী সব যোগাযোগ। মুসলমানদের বিরাট পরিবারকে টুকরো করে শ্যামসাহা পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকিয়ে দিতো। একই পরিবারের চার ভাইকে চারদিকে কাউকে ঢাকায় ছেড়ে দিলো, কাউকে হবিগঞ্জে, কাউকে চিটাগাং তো কাউকে নোয়াখালি। এরা একও হতে পারে না। ফিরে এসে জমিজমার দাবিও করতে পারে না। শ্যাম সাহার ছিল দোনলা বন্দুক আর লোক ঠকানোর নেশা। এই করে তার দখলে অনেকটা উদয়পুর গেলো এমনকি আগরতলায়, এমনি সোনামুড়ায়, এমনকি অমরপুরে তার ঠকিয়ে দখল করা বিশাল ভূসম্পদ কিন্তু ভোগ করবে কে? শ্যাম সাহার ছেলেরা কেন কে জানে টপাটপ গলায় দড়ি দেয়। যেটা বেঁচে থাকে পাগল-পাগল হয়। ঝিম ধরানো। তার যদি সন্তান হল, টেঁকে না। হয় জলে ডুবে, নয় গলায় দড়ি।শ্যাম সাহার জগৎ পেরিয়ে এসে ভট্টাইজদের উদয়পুরতারপরে সেনেদেরতার পরে ওই রহিম মিয়াঁ ‘গপিস্টে’র সাম্রাজ্য। শ্যাম সাহার প্রতিপক্ষ ছিল এই ‘গপিস্টে’রা। রাজার লেঠেল। এদের তাড়ানো যায়নি। সদানন্দ এর বাড়িতে অত পড়ে থাকতো কেন?‘মজিদ্যার বৌডার লগে লাইন আছিল’, একদিন স্ত্রী আমাকে এই কথা বলে। কিছু বলি না। কেবল মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘লাইন’
     সেদিন আঁতিপাঁতি করে খুঁজলাম। সদানন্দের কাপড়ে বাঁধানো খাতাগুলি,ছোট ছোট পকেট ডায়েরিগুলি, অন্য সব ডায়েরি। মাচ্ছা স্বপনের কথা আর কোথাও লেখা নেই। মনটা খুঁত খুঁত করছিলো। মাচ্ছা স্বপনকে আমি চিনতাম। তার কী হল? ‘মাচ্ছা স্বপনের কী হইলো নন্দদা?’
   খোজেন খোজেন, পাইবেন
   কই খুজুম?
   ক্যান? আমনে এ পাড়ার না? মনে করেন, মনে করতে চেষ্টা করেন
     আজ সকালেই দুম করে মনে এলো। মনে এলো? নাকি সদানন্দ মনে এসে বসেছে আমার? নাহলে এত জায়গা থাকতে আমাকে এই বিশাল দিঘির মৃতদেহের সামনে কে নিয়ে এলো?
     তখন জরিনার স্নানের পুকুরে বিকেল এলে একটা সার্কাস শুরু হয়ে যায়।প্রায় প্রতিদিন মাছ ধরবার আয়োজন। যে যা ধরতে পারবে সেটি তার। ফ্রি। ‘গপিস্ট বুড়া’ বলেন, ‘মাছ বেইচ্যা টেকা কামানের দিন অহনও আইছে না’। তার ওপর, যেদিন মাছ ধরা নেই, সেদিন সাঁতার শেখা। মাচ্ছা স্বপন শেখাবে কী, নিজে জলের মধ্যে কত কায়দা করতে পারে, সেসব দেখাতেই তার যত আনন্দ
ডুব দিলো তো দিলো, আর ওঠে না। দেখা গেলো দুটো মাছ নিয়ে ওই দূরে ভেসে উঠলো। জরিনাকে তার হাতের তালুতে রেখে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মাঝখানে। সে যে এতক্ষণ জলের নীচে কী করে থাকে! জরিনা ভাসতে ভাসতে হাসে। সে হাসির আঘাতে জলের ঢেউ আর ঢেউ থাকে না। খিলখিল হয়ে যায়জরিনাকে ভাসিয়ে নিয়ে মাঝপুকুরে ছেড়ে দেয় স্বপনএকটু হাবুডুবুর মাঝখানেই আবার তুলে ধরে। ‘এমনেই শিখন লাগে সাতার’, বলেমার খায়। কিন্তু খেলা বন্ধ নেই। দর্শকেরও অভাব নেই। কাঁচামিঠে আমগাছের নীচে ‘গপিস্টে’র পাশে বসে থাকে সজু। দেখেছি তাকে। স্পষ্ট মনে আছে। সদার খাতায় এসব না পড়লে অনেক রহস্য জানা হত না।
     সেদিন বিকেল। ছনবনের এই দাম। দামের ওপর যে স্থল, সে ছদ্ম। তাতে একটি সরু ফাঁক। নীচে গভীর জল। সেই ফাঁক দিয়ে একটি মানুষের বাম হাত। সাদা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। নখে লেগে আছে ঘাস। সেসব আঁকড়ে নীচের লোকটা হয়তো প্রাণপণ উঠে আসতে চাইছিল। পারেনি। পুলিশ এলো, ক্লাবের ছেলেরা এলো। কাঠের তক্তা, বড় বড় বরাক বাঁশ এলো
সেসব বাঁশ আড়াআড়ি রাখা হল দামের তুলতুলে ভূমিতেতার ওপর পাতা হল তক্তা। তাতে দাঁড়িয়ে বহু কায়দা করে তুলে আনা হল স্বপনকে। মাচ্ছা স্বপন।

     স্বপন রাতের আঁধারে কোথায় কোথায় না ঘোরে? কোন্‌ সে জলাভূমি যেখান থেকে সে টুক করে মাছ তুলে আনতে পারে না? আর এই দামের গোপন জলে যে বিশাল বিশাল সব শোল মাছের সাম্রাজ্য, কে না জানে? কে না স্বপনকে বলেছে, ‘দামের সইলমাছ পাইলে দিস’? কে না জানে স্বপনের কেউ নেই কোথা হতে সে এসেছে, রাইয়াবাড়ি না কোন সে গ্রাম থেকে কে জানে একটা বাড়ি তার ছিল বটে। টিনের একচালা একটা ঘর, তাতে বেড়া আছে তারা যে আছে, তাদেরই হাসি পায়। এখন, এই মরে যাওয়া স্বপনকে কে কী করবে? তার দাহ কে করবে? কে দেবে খরচ? রহিম মিয়াঁই সেসব ভার নিলেন। স্বপনকে পুলিশ নিল না, মর্গে নিলো না, তাকে কাটাচেরা করা হল না।
     রহিম মিয়াঁর বাড়ি। বাইরের উঠোনে একটা পুরাতন পাটির ওপর শুয়ে আছে স্বপন। খালি গা। একটা গামছা টাইট করে পরা। তখনও। চোখেমুখে কেমন একটা বিস্ময় তার। যেন ভাবছে, মরেই গেলাম, সত্যি! বাম হাতটা যে ওপরে তোলা সেটাকে নীচে শরীরের সমান্তরালে আনা যাচ্ছে না
একটা কে যেন, হাতটা এনে রেখেছিল শরীরের পাশে।  সেটা আবার বেঁকে যায়। লোক জমে গেছে। নানা তত্ত্ব ছড়াচ্ছে। মাছ মাছ কইরা পোলাডা গেল। ওইদিকে সদানন্দ ছিল? ছিল। মজিদ মিয়াঁ লালুর সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল সে। এখন মনে করতে পারছি। জরিনা? একটা কেমন শ্যাওলা রঙের শাড়িতে এক সময় সে আসে। স্বপনের পাটির যে অংশে স্বপন ছিল না, সেখানে অনেকগুলো টাকা রাখে।দাঁড়ায়। একটু কি ফোঁপাচ্ছিল? স্বপনের বেঁকে যাওয়া হাত বারবার সোজা করছিল যে, সে আসলে সজু। জরিনাকে দেখে কেন কে জানে, ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। লাথি মারে স্বপনের শবে, ‘সব জলে সাতার মারাইতে যাইও না, শালারপুত’।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন