কাল কাটালি কালের বশে
সদানন্দ নিজের পিছু
পিছু ফিরত। কী পেত সে? কেনই বা? কোনোদিন কি ঠিক সে দাঁড়াতে পেরেছে নিজের সামনে?
আজ ষষ্ঠ পর্ব।অশোক দেব
সদাপুরাণ – ৬
সদাপুরাণ – ৬
মাটির গভীর
হতে গুম করে একটা শব্দ হয়। গম্ভীর। চাপা। সেটা মাটির শরীর বেয়েই দূরে দূরে বয়ে
যায়। ঠিক কানে শোনা যায় না। কিন্তু শব্দটা হচ্ছে,বোঝা যায়। একটু কেঁপে ওঠে মাটিও। ছোট ছোট ভূমিকম্প। কিছুক্ষণ পরপর এটা হয়ে চলেছে। মানুষের গা-সওয়া হয়ে
গিয়েছে।কিন্তু লালুমজিদের সরাইল্যা কুত্তা সইতে পারে না। শব্দ হয়, মাটি কাঁপে। আর সে কেবল শিউরে ওঠে।
এদিকে ছোটে, ওদিকে ছোটে। কুঁইকুঁই
করে কাঁদে। অজানার উদ্দেশে ছুঁড়ে দেয় তার উন্মত্ত ঘেউ। কিন্তু সেই ভূমিগত শব্দের
বিরাম নেই।
গোমতীর তীরে
তীরে খনিজ তেলের খোঁজ করে ওএনজিসি। কী একটা পাইপের মত মাটির অনেক গভীরে ঘুরিয়ে
ঘুরিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। তার মুখে বাঁধা বোমা। সেটা মাটির গভীরে নিয়ে গিয়ে ফাটায়। তাতেই
গুমরে ওঠে পৃথিবী। আর তাতেই ভূমিকম্প। লালুকুত্তা আশঙ্কা করে। কেউ বাড়ি
থেকে বেরোতে পারে না, সে পায়ে পড়ে। যেতে দিতে চায় না। যেন গেলে আর আসবে না ফিরে। যেন কী একটা বিপদ। দিনের
বেলা এই কাণ্ড, রাতেও মুক্তি নেই। গোমতীর ওপাড়ে আশু কর্মকারের বাড়ির লাগোয়া চরায়
এসেছে বাঞ্জারর দল। তারাও বোমা ফাটায়। তাদেরটা রাতে। বিস্তীর্ণ আখের ক্ষেতে ফাঁদ
পাতে। কাঁচা মাংসের আড়ালে ছোট ছোট বোমা লুকিয়ে পেতে রাখে। শেয়ালেরা আখ ভালোবাসে। আখ
খেতে এসে দেখে মাংস পড়ে আছে। লাল। রক্ত মেশানো, ইতিউতি পাখির পাখনা। খেতে যায়। একটা
বিস্ফোরণের শব্দ, মানে একটা শেয়াল শেষ। মুখ সহ অনেকটা উড়ে যাওয়া শেয়ালের দেহ
বাঞ্জারা লোকেরা সকালে সংগ্রহ করে। শেয়ালের মাংস খায়, নাকি কী করে, কেউ জানে না।
তবে শেয়ালের মাংস খেলে বাত সেরে যায়, এমন প্রচার আছে। বাইদ্যারা নাকি বেতো মানুষের
কাছে সে মাংস বিক্রি করে। কিন্তু এইসব
বোমার আতঙ্কে লালুকুত্তা ব্যতিব্যস্ত। সে একা। কুকুর সমাজে তার কোনও গ্রহণযোগ্যতা
নেই। এ এলাকায় তার জাতের সে একলা। সরাইল্যা। খোদ সরাইল থেকে আনা। সে তার অভিজাত
চেহারা আর দারুণ শিকারি চালচলন নিয়ে একা। সন্ধ্যায় শেয়ালের দূরাগত ডাক শুনে সে
এদিকে থেকে জবাব ভাঁজে। চিৎকার করে। সারাদিন তার প্রভু মজিদের পায়ে পায়ে ফেরে।সর্বক্ষণের
সঙ্গী হয়ে থাকে। আজকাল এই দুইরকম বিস্ফোরণের চাপে পড়ে আরও একা হয়ে গেছে লালু। দেশি নেড়িগুলো এ বাড়িতে আসতে পারে না তার জন্য।সে তার ব্যক্তিত্বের কারণেই ওদের
বাধা। বিনিময়ে
লালুকুত্তাকেও বাইরে যেতে দেয় না নেড়িগুলো। তারা দল বেঁধে ওকে তাড়া করে। ফলতঃ লালুকুত্তা একা
কুত্তা। তার প্রভুর ডাকনামও লালু। ভালো নাম মজিদ মিয়াঁ। এদের মধ্যে একাকীত্বে মিল।মজিদেরও
কারও সাথে সখ্য নেই। কারও সাথে শত্রুতাও নেই। ভাব নেই, তাই অভাবও নেই তার।
লালুমজিদ গোমতীর
চরার দিকে চলেছে। গানের সন্ধানে। ওপাড়ে চরা। সেখানে তাঁবু খাটিয়েছে বাঞ্জারার দল।
লোকে বলে বাইদ্যা। ওরা নিজেদের বলে বাঞ্জারা। অনেক বাধা দিয়েও মজিদকে আটকাতে পারে
না লালুকুত্তা। শেষ অব্দি মজিদ পোষাটাকে বেঁধে রাখে চালতা গাছের সঙ্গে। পেতলের তৈরি
খুব বাহারি শেকল। রাতে বাঞ্জারাদের
গানবাজনার শব্দ ভেসে আসে। আর আসে বিবাদের শব্দ। কলহ আর সংগীতকে যারা এভাবে মেলাতে
পারে, তারা কেমন জাত? তাছাড়া লালুমজিদ হিন্দি বলতে ভালোবাসে। সেটা বলবার মত লোক
কই? লালুমজিদ যায়।
এখন দূর
পাহাড়ে জঙ্গলে জঙ্গলে আগুন দেওয়া হয়। বাতাসে ভেসে আসে পোড়া পাতা। কত দূর থেকে এরা
ওদের নশ্বরতা বয়ে নিয়ে উড়ে আসে! জুমের জন্য টিলা জ্বালানো হচ্ছে। রাতে ওদিক থেকে
বাঁশ ফাটার শব্দও শোনা যায়। সেটা মৃদু। ওই
দুরকমের বিস্ফোরণের তলায় হারিয়ে যায় অনেক শব্দ। বাঁশ ফাটার করুণ শব্দটিও হারিয়ে
যেতে পারত। কিন্তু লালুমজিদ শব্দপাগল। সে শুনে ফেলে। তার কুকুরের সঙ্গে এই তার
আরেক মিল। এরা অনাগত শব্দও শুনতে পায়। এখন একটা পোড়া পাতা বাতাসে ভেসে এসে লালুর
মুখে লাগে। লেগেই যায়। লালু সেটাকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে গিয়ে কালো করে ফেলে মুখ।
এমন সময় জরিনাবিবি তার বৈকালিক স্নান সেরে ফিরছিল।
— কীও, মুখ কালা কইরা কই যান?
— গানে
— কই গান?
— চরাত, হেই পারে
— আমিও যামু
বাঁধা পড়ে যায়
লালুমজিদ। বাহারি বউ তাকে বেঁধে ফেলেছে। শেকল, শেকল। স্থাণু হয়ে যায় লালুমজিদ। ভুল হয়ে
গিয়েছে। বউ ভেবেছে কোথাও নিমাই সন্ন্যাস কিংবা রূপবান হচ্ছে। সেসবকেই এদিকে গান
বলে। জরিনা তো ভেবেছে সেই গান। কিন্তু লালু যাচ্ছে বাঞ্জারাদের তাঁবুর
দিকে। অন্য কোনও নতুন গানের খোঁজে।
এরা ভোরে উঠে
যায়। সারাদিন ধনুক নিয়ে বনে বনে ফেরে।কারও কাছে থাকে গুলতি। কেউ সরু বাঁশের ছোট
বোঝা নেয়। এসব বাঁশ আসলে অস্ত্র। একটার
সঙ্গে একটা জুড়ে দেওয়া যায়। লম্বা হতে হতে গাছের মগডালে চলে যায়। বসে থাকা পাখির
নীচে দাঁড়িয়ে একটা বাঁশের মাথায় আরেকটাকে গাঁথে বাঞ্জারা পুরুষ। একদম ওপরেরটাতে থাকে একটা ফলা। সেটাকে বসে থাকা, বিশ্রামরত পাখির অজান্তে তার দিকে
তুলে নিয়ে যায়। সন্তর্পণ। নীরব। নিষ্কম্প। স্থিরদৃষ্টি। একসময় গাছের ডাল থেকে পাখি
পেড়ে আনে। আহত, ঝটপট করতে থাকা বিমুঢ় পাখি। দিনে এসব পাখি, কাঠবিড়ালি মারে এরা। আর বিকেলে,
সন্ধ্যার দিকে বোমা পাততে যায়। ফিরে এসে সন্ধ্যা গাঢ় হলে নেশা করে। উদ্দাম বিবাদ করে। গান গায়।নানারকম পশুর ছাল, বাঘের নখ, সাপের চামড়া,
শক্ত, আঠালো কস্তূরী, গণ্ডারের শিং, ভালুকের লোম আরও কত কী নিয়ে আসে এরা। বাতবিষ টেনে
আনার মাটির শিঙ্গা,নানারকম তেলের শিশি আনে। আর
আনে ওই একটা নালের মত বাদ্যযন্ত্র, একটা ডাফলি,
ঝুনঝুনি। কী অদ্ভুত!কীসের সঙ্গে কী! তারা গান করে। কেমন উতলা সুর সে গানের। গাইতে
গাইতে হেসে লুটিয়ে পড়ে। আবার একটু এদিক ওদিক হলেই থেকে থেকে কলহ করে। লালু সেই
গানের লোভে যাচ্ছিল। তার মুখ পাহাড় থেকে উড়ে আসা অর্ধদগ্ধ পাতার কালোতে কালো হয়ে
আছে। এখন অপ্রস্তুত হয়ে আরও নিভে গিয়েছে।
জরিনার
স্নানের জন্য পুকুরের শরীরে বেড়া দিয়ে আড়াল তৈরি করা। সেখানে যে ও স্নান করছিল,
লালু জানত না। সামনে পড়ে গিয়েছে। এখন বলছে যামু। যামু মানে তো যামু। কিন্তু তাহলে
তো লালু একা হয়ে যাবে। মানুষের সঙ্গ লালুমজিদকে একা করে দেয়। সে নিজের সঙ্গ করতে
পারে না। কেউ থাকলে তার সাথেই কথা বলতে হয়। নিজে একলা পড়ে যেতে হয়। মানুষের সঙ্গে তাই মজিদের নিজেকে একলা লাগে। সে ছুট লাগায়। যেন কেউ তাকে
তাড়া করেছে, কেউ তাকে মারতে আসছে। লালু এক ছুটে অনেকটা চলে আসে। কখন পেরিয়ে গিয়েছে
ধোয়াইছড়ি ব্রিজ, আশু কর্মকারের বিশাল উঠোন... ভেজা ভেজা বালুর চড়ায় সে চলে আসে। হঠাৎ
নরম বালুতে ছুটতে গিয়ে টাল সামলাতে পারে না। হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সে যার গায়ে এসে পড়ল,
তার নাম মিঠি, নাকি মিট্টি?
— ধীরে... ধীরে বাবুজি, হম কাঁহা ভাগে যা রেহে হ্যায় ...
আপকাই ইন্তিজার থা... ইতনি জলদি কিস বাত কি, ধীরে... ধীরে...
বলেই জোরে তার স্তনের
মধ্যে গুঁজে ধরে লালু মজিদের মুখ। ঠেসে দেয়। লালু সেই সোঁদা গন্ধ, পোড়া ভুট্টার
গন্ধ মাখা বুকজোড়ায় নিজেকে পায় নাকি হারায় কে জানে, ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। আপ্রাণ
জড়িয়ে ধরে মিট্টিকে। মিট্টি হেসে হেসে জগৎকে খবর পাঠায়, ‘দেখো দেখো, মিট্টি নে
কেয়া পাকড়ি... ঘড়িয়াল... ঘড়িয়াল পাকড়লি...’ ছুঁড়ে ফেলে লালুমজিদকে। বিকেলকে শিউরে
দিয়ে হেসে ওঠে। হেঁটে চলে যায় তাঁবুর দিকে। অকারণ অশ্রুভরা চোখে লালুমজিদ দেখে
একটা নদীর চরার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আরেকটা নদী। কোমরে রূপার বিছা, সেটা দুলে
দুলে তখনও বাতাসের সঙ্গে খুনসুটি করছিল। লালু নিজেকে তোলে না। তাকে একটা গান এসে
বেঁধে ফেলেছে আপাতত। তার শরীরটাই গেয়ে ওঠে,
‘এ যে যৌবনকাল কামে
চিত্তকাল
কোন কালে তোর হবে দিশে...
কাল কাটালি কালের বশে...’
কোন কালে তোর হবে দিশে...
কাল কাটালি কালের বশে...’
গোমতীর নীচের
থেকে একটা গুমরে ওঠা শব্দ এসে লালুমজিদের শরীরে মিশে যায়। কেঁপে ওঠে ভূমি। তার গান
সহ কেঁপে ওঠে লালুমজিদ।
স,
গভীরে সন্ধান
করতে হলে মনের মাথায় বোমা বাঁধতে হয়, না? মনের গভীরেই প্রবেশ করাতে হয় বোমা বাঁধা
মন? নিজেকে কাঁপিয়ে দিয়ে নিজেকে ছারখার
করতে হয়? জানি না, মজিদ জানে। এই যে তুমি আসলে নেই, তাতে এক ভালো, ওই শেয়ালগুলির
মত মরি না। তবে মরছি তো ঠিক। শব্দ হচ্ছে, শোনা যায় না। তুমি নেই বলে তোমাকে পাওয়ার
তাড়া নেই। আমি নিজের পিছু পিছু ফিরি, দেখি তুমি কেমন আগে আগে আছ। এই থাকাটুকু
রেখো।
একদিন হয়তো
দেখা হয়ে যাবে তোমার সাথে, যে তুমি নেই। তখন কী নামে ডাকব তোমাকে? কী দিয়ে সম্ভাষণ
করব? জানি না। ইতি ১০ মার্চ ১৯৮৪
তোমার একান্ত
সদানন্দ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন