নাটঢিলের স্বর্গবাস
আমরা ভাবি এরা ঢিল। এদের গোলযোগ আছে। আসলে এরা অন্য জগতের মানুষ, অন্যরকমের মানুষ। সদানন্দ তাদের দেখেছিল, বুঝেছিল। আমরা বুঝতে পারিনি।
আমরা ভাবি এরা ঢিল। এদের গোলযোগ আছে। আসলে এরা অন্য জগতের মানুষ, অন্যরকমের মানুষ। সদানন্দ তাদের দেখেছিল, বুঝেছিল। আমরা বুঝতে পারিনি।
সদাপুরাণ। আজ সপ্তম পর্ব।
অশোক দেব
সদাপুরাণ – ৭
পানির উপর পাত্থর ভাসে। পাত্থরের উপ্রে বইয়া রইছে বেডা।
পুরুষ। বেডার নাম বদর। হজরত বদরশাহ। বুকে
আল্লার নাম, নজরে আসমান। পাত্থর
ভাইস্যা আইতে আইতে আইলো এক মাডির কাছে। মাডি হইলো জঙ্গল। টিলা। ডাকাইতের বাস।
আটপাড় বাটপাড়।আর দৈত্য দানব, জানোয়ার। বদর বেডা আইয়া লামে। পানির উপ্রে পাষাণ
ভাসাইয়া আইছে। মাডিত পা দিল এইদিগে আর হেইদিগে পাত্থর গেল ডুইব্যা। বেডা আইয়া দেখে
ঘাড়তেরা মানুষ সব। আহারের ঠিক নাই, বাহারের ঠিক নাই। তাইনেরে এই মারে তো হেই মারে। বদর
সাহেব গা করে না। অন্ধকার। বাতাস থিকা বাত্তি জ্বালে। চেরাগ। যে টিলাত হেই বাত্তি জ্বালছিলেন তার নাম
অহনো চেরাগ টিলা। বেডা চাটি পাতে। নমাজ আদায় করে। হেই থিকা চাটিগেরাম। তোমরা কও
চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের পত্তন করছে তাইনে। আমাগো পীর, বদর পীর। একবার তাইনে
চট্টগ্রাম থিকা আইলেন এই রাঙ্গামাডি উদয়পুর। রাজ আমল। আমার দাদার দাদা গিয়া আনল
তারে। রাজারে কইয়া টইয়া আস্তানা বানাইয়া দিল। রাজা হেমেন্দ্র মাণিক্য আছিল তহন।
হের পরে ইহানেই থাইক্যা গেল পীরসাব। হিডাই বদরমোকাম। আমরা তাইনের খাস লোক। এল্লিগা
খাস ভাবে যাই। দাদা পরদাদা ঘোড়াত চইরা যাইত, আমিও যাই। আমি বংশের ধারা ধইরা
রাখলাম।পরের খবর জানি না।
জালালী বলতে সবাই বোঝে পায়রা। কবুতর। আমরা
বুঝি জহিরুল। দূর সিলেট থেকে এই ছেলেটি আসে। গপিস্ট রহিম
ডেকে আনান। পাসপোর্ট টাসপোর্টের
বালাই নেই। যখন খুশি আসে। যায়। সে নিজেকে শাহ জালালের
মুরিদ মনে করে। বলে। তাই জালালী জহিরুল। সে আবার বাঁশি বাজায়। আমাদের গপিস্ট বুড়া বদরসাহেবের একনিষ্ঠ ভক্ত। তার
পূর্বপুরুষেরা বদরসাহেবকে ত্রিপুরায় আনেন বলে তাঁর বিশ্বাস। আজ বদরমোকামে উরস। বাৎসরিক। সেই গাড়ি তৈরি হচ্ছে। ঘোড়ার
গাড়ি। এখন ঘোড়া নেই। তাই জহিরুল। কোথা হতে সে একটি ঘোড়া নিয়ে আসে। এই ঘোড়া গাড়ি
টেনে উরসে নিয়ে যাবে রহিম মিয়াঁ গপিস্টকে। লাল এই ঘোড়াটা আঁশটে গন্ধ মাখা। পুরনো।
এটাকে নিয়ে সে আসে এই উরসের সময়ে। থাকে। কতদিন থাকবে কেউ জানে না। তবে যতদিন থাকবে, জ্বালাবে। গপিস্ট বুড়াকে জহিরুল পাগল
নাচায়। কেউ সেটা
বাইরে থেকে দেখলে হাসি আটকাতে পারবে না,
—
আমি তো হুনছি
আমনে যে পীরের কতা কইলেন, এই পীর হেই পীর না। মুখ ফসকে বলে ফেলে জহিরুল।
—
তোরে কেডা
কইছে? কোন বান্দির পুতে?
—
আরে কইয়েন না,
গপ মারনের মাইনসের অভাব আছেনি?কইছে একজনে। বান্দির পুত। জহিরুল ম্যানেজ করে।
—
শালারা জানে
না, হুনে না, গরুর ডেহা ঘোরাত লাগায়... কিতাবে স্পষ্ট কওয়া আছে একদিন পাষাণে চইরা
এক আসমানি মানুষ চিটাগাং আইব।বলেই তিনি সেই উদ্ভট ভাষায় কোরআন হতে উদ্ধৃত করেন।
এই একটা ভাষা, যার আবিষ্কর্তা এবং ব্যবহারকারী তিনিই।
আরবি উচ্চারণ, কিন্তু ভাষাটা মিথ্যা। যখন যা দরকার, বললেন তো বললেন। যেমন এখন। বলে,
এমনকি সুরা আয়াত নম্বর উল্লেখ করে বলেন, ‘কী বুঝলি?’
—
বুঝলাম আমনে
একটা মাল
—
মানে? কী কইতে
চাস?
—
না মানে, আমনে
ক্যামনে এত মনে রাখেন? কিতা জানি সুরাডা কইলেন?
জহিরুল জানে, রহিম বুড়া গপিস্ট বুড়া। তিনি ফিরে আবার সেই
বানানো সুরা বলতে পারবেন না। রহিম হাল ছাড়েন না। কী একটা বলতে উদ্যোগ নিতেই জহিরুল
বলে, ‘হেমেন্দ্র মাণিক্য কি রাজা আছিল, না রাজার শ্বশুর? এই নামের রাজা...’
গপিস্ট বুড়া নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চান, ‘হেমেন্দ্র
মাণিক্য অইলেন গিয়া...’
—
জেডা ঘোড়াডার
লাইগ্যা মলম কিনুম, ঘোড়ার কনস্টিপাইসন
—
হিডা আবার
কিতা?
—
কনস্টিপাইসন,হাগতে
কষ্ট। মলম লাগে। নাইলে পিডের সওয়ার ফালাইয়া পারাইয়া মারে...
জহিরুল টাকার ব্যবস্থা পাকা করে। এরকম নানা
ফিকির করে সে রহিম মিয়াঁর টাকা হাতিয়ে নেয়। এখন ঘোড়ার কাল্পনিক ওষুধ বাবদ টাকাটা
নিশ্চিত করে এদিকে উঠে আসে। উঠোনে এসে একটা খাটিয়ায় বসে।
এক অনুষ্ঠান হচ্ছে মনসাঘরের সামনে। অনেকটা
জায়গা নিকনো হয়েছে। চারটি বাঁশের খুঁটিতে
টাঙানো হয়েছে ছোট একটা কাশ্মীরি চাঁদোয়া। তার নীচে সুন্দর একটা পাটি। সাদা কাপড়ে
ঢাকা। আজ মজিদ মিয়াঁর জন্মদিন। রহিম মিয়াঁ সে সংবাদ প্রতি বছর জরিনাকে মনে করিয়ে
দেন।‘যেদিন পীর বদর এই দুনিয়া ছাইরা আল্লার বেহেস্তে গেলেন, আমার লালু আইলো। তাইনে
গেলেন, আমার লালুমজিদ আইলো। দেখ না, তার বুক ভরা আল্লার নাম, চোখে আসমান’?
জরিনা লালুমজিদকে আসনে বসায়। গড় করে প্রণাম
করে। তার সামনে থরে থরে সাজানো নানা রকম খাবার। কত যে! ওদিকে জহিরুল জরিনাকে
গিলছে। জহিরুল সুন্দর। কোঁকড়া চুল। শ্যামলা। টানা চোখ। বুদ্ধি আর কৌতুক দিয়ে সে চোখ সাজানো। সে
সুন্দর। সে সূত্রে সকল নারীকে বিজিতা ভাবে জহিরুল। চোখেমুখে এমন ভাব ফোটায় যেন, কাম হল একটা হাওয়ার তৈরি খেলনা। সে সেটা নারীর দিকে ছুঁড়ে দেবে, নারী লুফে
নেবে। এখন সে একের পর এক সেসব খেলনা ছুঁড়ছে জরিনার দিকে। স্বামীসেবায় জরিনা সেটা
লক্ষ করে না। লালুমজিদ করেছে। খুব লক্ষ করেছে। আর, সে একা হতে থাকে। ঝিম মেরে
যায়। তার চোখ নীরব হয়। মুখমণ্ডলে আষাঢ়
মাস ঘনিয়ে এলে জরিনা বোঝে কিছু
একটা গণ্ডগোল হয়েছে। জরিনা তার স্বামীটিকে চেনে। মজিদ কেবল পেটে পেটে কান্না পোষে।
বুক কিলায়, মনে মনে। কিছু বলে না কখনও। কিন্তু কথা সে আটকাতে পারে না আসলে। তার অস্তিত্বই কথা বলে ওঠে। অভিমানের ভাষায় কথা বলে। জরিনা সে ভাষা বোঝে। সে এদিকে
তাকায়, ওদিকে তাকায়। তারপর দেখে জহিরুলকে। দেখেই বুঝে ফেলে কী ঘটেছে। জহিরুল একটা
লাল রুমালকে এমন ভাবে দলা পাকাচ্ছে, নাড়ছে যেন সেটা একটা নারী শরীর।কিংবা জরিনার
সাদা স্তন তার হাতে রুমাল হয়ে লাল হয়েছে। জেগে ওঠে জরিনার ভেতরের দারোগা। সে ছুটে
গিয়ে জহিরুলের সামনে দাঁড়ায়। তার গলায় গামছা পেঁচানো। তার দুপ্রান্ত এক করে শেষে
টেনে ধরে জরিনা, ‘কিতা দেখস, কী দেখতাসস, শালারপুত’?
—
দেখি
—
কিতা দেখস?
—
দেখি নাটঢিলের
স্বর্গবাস
শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জরিনা। ‘কেডা নাটঢিল?’ হিড়হিড় করে
টেনে আনে জহিরুলকে। এনে ফেলে লালুমজিদের সামনে।‘মাফ চা, মাফ চা’। ছুটে আসে
সরাইল্যা। যেন কামড়ে দেবে জহিরুলকে, ছিঁড়ে ফেলবে। লালুমজিদ, ধীরে, প্রায় তদগত ভাবে
বলে, ‘লালুমিয়া আমনে যান, চুপ করেন, শান্ত হন’। পৃথিবীতে একমাত্র লালুই এক কুকুর
যার নাম তার প্রভুর নামে। পৃথিবীতে এই লালুই একমাত্র কুকুর যাকে তার প্রভু, আপনি
বলে সম্বোধন করে। লালুকুত্তা চুপ মেরে যায়। শান্ত। জহিরুল লালুসরাইল্যাকে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এখনও
জরিনা তার গলার গামছা ধরে আছে। যেন ওটা দিয়েই ফাঁস করে মেরে ফেলবে। উথলে উঠছে তার
দুধে আলতা। জহিরুল মহা ধুরন্ধর, সে বলে যায়
—
নাটঢিলেরে
নাটঢিল কইছি। ঠিক করিনাই মজিদভাই? আমনের নাট ঢিল আছে না? আমনে কি আর আমরার মতন?
জরিনা ভাবি ক্ষেপল ক্যান?
—
আছে, আমার নাট
ঢিল আছে। আমনেরটি টাইট, একটু বেশি টাইট, তেল দেন। মজিদ মাটির দিকে তাকিয়ে কথাগুলি
বলে। কিন্তু স্পষ্ট, দৃঢ় সে উচ্চারণ।
হা হা হা করে হেসে ওঠে জহিরুল।
ওদিকে বাঞ্জারাদের দল বসে ছিল। তাদেরও
নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। খাওয়াদাওয়ার পরে গান হবে। কে একজন বলে ওঠে, ‘মার শালে কো’।
বলতেই ছুটে আসে কয়েকজন। চকিতে উঠে দাঁড়ায় লালুমজিদ।‘বিবি হামারি হ্যায়,খুবসুরত
হ্যায়। লোগ
দেখেঙ্গে, তাকেঙ্গে। কয়ি বাত নেহি। আপ কুছ নেহি করেঙ্গে। শান্তি শান্তি’।
ধপাস করে বসে পড়ে জরিনা। সে এই লোকটাকে বুঝতে
পারে না। স্পষ্ট দেখেছে সে মনে মনে কাঁদছিল। এবং কাঁদছিল জহিরুলের ওই অসভ্যতা
দেখে। এখন এই কথা? জরিনা একটা ঊর্ধ্বফণা সাপের মত ঘরে চলে যায়।
ধীরে ঘরে আসে লালুমজিদ। খাটের ওপর বসে। পাশে
বসা জরিনাকে জোর করে বুকে টেনে আনে। জোরাজুরি করতে গিয়ে সবটা জরিনা আসে না। তার
মুখখানি মজিদের বুকে আসে।
—
এত শোর করেন
ক্যান বিবি? এত শব্দ তোলেন ক্যান? নীরব থাকেন, চুপ থাকেন। নীরব থাকনের মত আওয়াজ
নাই
—
কিতা নীরব
থাকুম? আর, ইডি বুঝি শব্দ না?
—
কোনডি?
—
এই যে আমনের
বুকের ভিতরে শুনি, আমি তো দেখি ধড়ফড় শব্দ অইতাছে। ভাইঙ্গা যাইতাছে।না?আমনের পরান
নীরব আছেনি?
আমনে
লুকান কেরে?
—
ও, বলেই
লালুমজিদ সোজা হয়ে যায়। ‘কান পাইত্যা থাকেন, হুনেন’।
বলেই লালুমজিদ
কী একটা করে। ধীরে ধীরে তার বুক শান্ত হয়ে যেতে থাকে। হৃদয়ের গতি কমে। কমে কমে
একসময় আর কোনও শব্দ নাই। লালুমজিদ প্রায় নাই হয়ে যায়। স্থির, নিস্তরঙ্গ হয়ে যায়
শরীর। তার চোখ বন্ধ, তার শ্বাসের গরমও আর নেই। এমনকি শরীরও ঠান্ডা হয়ে যায়। চোখ বোজা কিন্তু আধেক উন্মুক্ত পাতার নীচে চোখের মণি ঊর্ধ্বমুখী।
—
কিতা করেন,
কিতা করেনও মিয়াঁ
জরিনা ভয় পেয়ে যায়। আপ্রাণ ঠেলতে থাকে
মজিদকে। জাগিয়ে তুলতে চায়। একসময়ে সব স্বাভাবিক হয়। লালু চোখ খোলে।‘যে পারে, সে
বাইরে পারে, ভিতরেও পারে। কেবল নিজেরে নিজের শাসনে রাখন লাগে’।
—
কাম নাই
শাসনের। আমনে একটা মানুষ হইয়া ওডেন। একটা পুরুষ মানুষ হন... আমার আর কিছু লাগে
না... আমি আর পারিনাও...
লালু এসব শোনে না। একা বাইরে চলে আসে। সার
করে বাঞ্জারাদের বসায়। সকলের সামনে কলা পাতা দিতে থাকে। ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে
জরিনা তার নাটঢিল স্বামীকে দেখে। গৌরকান্তি, উন্নত, যেন তার চারধারের বাতাস তার
দেহের আলোতে বেঁকে যাচ্ছে। ওই মিট্টি না কী নামের বাঞ্জারা মেয়েটা মজিদকে সাহায্য
করছে। বারেবারেই ছুঁয়ে দিচ্ছে, একটু শরীর ঠেকিয়ে দিচ্ছে মজিদের শরীরে। জরিনা টের
পায় তার ভেতরে শব্দ হচ্ছে, সোরগোল হচ্ছে, ধড়ফড় হচ্ছে। কিন্তু নীরব থাকতে হবে,
নীরব। নীরবতার মতন আওয়াজ নাই।
স,
একটা কোনও দুরূহ সুরের মতন জীবন, না? সবাই
গাইতে পারে না। কেউ কেউ শিখে ফেলে। শিখে নিয়ে আর গায় না। নীরব হয়ে যায়। মনে মনে
ভাঁজতে থাকে জীবন। তুমিও কি সেই সুর? আমি দূর হতে তোমাকে সাধি। এদের দেখি।আর মনে
হয় সব ফেলে ছুটে যাই তোমার কাছে। কিন্তু কোথায়, কোন দিক দিয়ে যেতে হবে? আমিও চাই,
বুকে ধড়ফড় হোক। তোমার দিকে কেউ তাকালে তার চোখের সামনে অন্ধকার লেপে দিতে ইচ্ছে
হোক আমার। সে তো হবার নয়। তবু আমার কেমন লাগে, তীব্র অভিমান হয়। যে তুমি নেই, যাকে
দেখিনি, জীবনে যাকে জয় করিনি, তাকে হারানোর ভয়ে আমি একা হয়ে যাই। পৃথিবী ছেড়ে আমি
এই ঘরে চলে আসি। তোমার জন্য পৃথিবীর সব পুরুষকে অভিশাপ দিই। যে তুমি নেই, তার জন্য
যুদ্ধ করব বলে নিজেকে সশস্ত্র করি। ইতি ১২ মার্চ ১৯৮৪
তোমার একান্ত
সদানন্দ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন