মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

অশোক দেব
সদাপুরাণ-
মজিদ মিয়াঁ নিজের নামে কুত্তা পোষে। সরাইল্যা কুত্তাখোদ বাংলাদেশের সরাইল থেকে আনা। মেটে লাল গায়ের রং। মজিদের ডাকনাম লালুমিয়া। এত ফর্সা যে লাল বলে ভুল হয়। তার কুকুরটির নামও লালু। লালু মজিদের পায়ে পায়ে থাকে। লালুমিয়া বাঁশি বাজায় বাজাতে চায়। সুবিধা করতে পারে না। সে আসলে গায়ক। তার গান যে শুনেছে সে জানে। কিন্তু মজিদের উচ্চাশা বাঁশিয়াল হওয়া। সারাদিন নিজের গান একপাশে সরিয়ে রেখে বাঁশি বাজাতে যায় মজিদ। পারে না।
শ্বাসের যন্ত্র। পরান থিকা বাতাস আইন্যা ছয় ছিদ্রে চালান করন, কম কথা?
লালুমিয়াঁ বলে। আর সারাদিন সুর ভাঁজে। পরাণ থিকা বাতাস আনার আবেগেই সে কেঁদে ফেলে। বাঁশিকে আর বাজাতে পারে না। এদিকে পাশের হিন্দুবাড়ির শঙ্খধ্বনি হোক কি উলু, লালুকুত্তা গলা তুলে সুর মেলায়। ঘে--লালুমজিদ যখন বাঁশি বাজায়, তখন তার সরাইল্যা লালুমিয়া সঙ্গত করে। ঘে--উ। শঙ্খ হোক কী বাঁশি সরাইল্যা তাতে সুর মেলাবেই মরাকান্নার মত এই সঙ্গত ফলে এই বাঁশির রেওয়াজ একটি হাঙ্গামা হয়ে ওঠে। রোজকার।
গপিস্ট বুড়া ধুরন্ধর। তিনি পুরুষ। পুত্রদের কাছে পৌরুষ আশা করেন। বড় ছেলে হাসন সুযোগ্য। সে কাঁহা কাঁহা থেকে বিয়ে করে আনে গপিস্ট বুড়া নতুন বউ আসা মাত্র মা-মা শুরু করেন। গুচ্ছের গহনা দেন আশীর্বাদী। তাঁর বড় পুত্র হাসন কদিন ঘর করে, তারপর তালাক, তালাক, তালাক। তারপর আবার নতুন একটা। কিন্তু এটিকে সে কোথা হতে এনেছে কে জানে? এই জরিনা? কথা শুনলে মনে হয় কুমিল্লার। আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টানও আছে। এই হল দুধে আলতা। এই হল হুর। জরিনার মেজাজও সেতারের তার। বায়ু গেলেও বেজে ওঠে। এটাই গপিস্ট বুড়ার পছন্দ
— ‘সংসারে একটা দারোগা বেডিয়াইত থাকন লাগে। নাইলে বেডা আর কিতা, ভিজা মুড়িরহিম মিয়াঁ তত্ত্ব দেন।
কিন্তু হাসন তো হাসন। কী নিয়ে জরিনা তাকে কষে থাপ্পড় দিল একদিন। হাসনও, ‘তালাক, তালাক, তালাক
— ‘
কইলেই হইল? জরিনাবেডি কই যাইব? শালারপুত? জরিনা-মা এই বাড়িত থাকবরহিম মিয়াঁ রায় দেন।
— ‘
আপনের ইদ্দত শুরু হইলো, আপনে থাকেনজরিনাকে এই কথা বলেই তিনি লালুমজিদকে ডাকেন। জরিনাবেডি আপনেরআপনে তো মারফতি মানুষ। বিয়াশাদির কাম নাই। ঘর করেন
সেই থেকে জরিনা লালুমজিদের দারোগা বেডিয়াইত।
জরিনাবিবির নেশা আছে। রান্না করাটাই তার নেশা। সারাদিন যে কতরকমের রান্না সে করতে পারে! দুটি মেয়ে তাকে এগিয়ে দেয়। সজু হল রহিম মিয়াঁর পোষা সে হিন্দু। নগুসা-র ছেলে। কিন্তু  সেটা নয়, এটাই যেন তার আসল পরিচয়, গপিস্ট বুড়ার চ্যালা তীর খেলা আর ফেন্সিডিল হলেই তার চলে। আর সারাদিন রহিম মিয়াঁর মুরিদগিরি। সে-ই দুনিয়ার বাজার করে। জরিনা কেবল উচ্চারণ করে, বোয়াল। চলে আসে বোয়াল। উচ্চারণ করে গোস্ত, চলে আসে গোস্ত। আমিও আসি। সজু আসে এক ধান্ধায় আমি আসি এইসব দেখার ধান্ধায়।
আজ গরুর গোস্ত হচ্ছে। সকালে একরকম হয়েছে। এখন আরেক রকমে হচ্ছে। সোনামুড়া থেকে শুক্রবার-শুক্রবার মমতা বেগম আসে। গপিস্ট বুড়া বলেন, ‘কালা হইলে মমতা বেগম, ভালা অইলে আল্লামিয়াঁকালা মমতা একটা ঢাউস ব্যাগে করে গরুর গোস্ত নিয়ে আসে। রিকশায় বসে বসে ফেরি করে। পাড়ার ভেতরে ভেতরে। বড় রাস্তায় যায় না। তার সারা গায়ে সোনার গয়না। নিয়ে আসে। যাবার সময় থাকে না। এসব আসলে গপিস্ট বুড়া আনান। গপিস্ট বলেন, ‘ছাগলারি। বেডাআইয়েতের একটু একটু ছাগলারি করন লাগেমমতাকে দিয়ে তিনি এসব স্মাগলারি করান। সেই মমতার আনা গোস্ত রান্না হচ্ছে। কাবাব হবে? কী জানি!-ম করছে। আর এদিকে লালুমজিদ আর লালুকুত্তার সমবেত সংগীতসাধনা চলছে। রান্না ঘরের পাশেই এই চালতা গাছ। গোমতীর কালো মাটি দিয়ে লেপা উঠানসে মাটি শুকিয়ে গেলে জোছনার মত সাদা হয়ে যায়।
       বালডা না বাজাইয়া একখান গান গাইয়া লান। এই বাল আপনের দ্বারা হইত নারান্না ঘর থেকে আওয়াজ দেয় জরিনা।
লালুমিয়া শোনে না। সে বাঁশি বাজাতে যায়। সরাইল্যাও গলা তোলে। এটা যে কী একটা হল্লা হয়ে ওঠে! হঠাৎ জরিনা বেরিয়ে এসে একটা কী ছুঁড়ে মারে লালুকুত্তাটাকে। সে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। লালুমজিদ তাকে ডাকে, ‘লালুমিয়া কই যান? আইয়েন, বাঁশি বাজামু
লালু লেজ নাড়তে নাড়তে এসে আবার বসে।
এইখানে বসে আছি। কাবাবের আশা আছে। ওইদিকে কাঁচামিঠে আমগাছের নীচে তাঁর মিথ্যার সাম্রাজ্য নিয়ে বসে আছেন রহিম মিয়াঁ। এখন তাঁর নীরবতার সময়।  এটুকু সময় কথা বলেন না। পরপর তিনটে পুকুর। দুপাশে দুটি, মাঝখানে একটা ছোটএটা জিয়ল মাছের জন্য। রহিম মিয়াঁ নীরবে এদের ওপাড়ে হিন্দুপাড়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। নীরবজপ। এটাও মিথ্যা। রহিম মিয়াঁর নীরবতা সত্য। মৌনজিকির মিথ্যা। তিনি চুপ মেরে বসে থাকেন। আসলে নানা ফন্দি আঁটেন। আমি বসে বসে এসব দেখি।
একসময় আবার বেজে ওঠে বাঁশি। বেসুর। বেজে ওঠে কুত্তাটাও। তারও যেন পরানের থিকা শ্বাস এনে নিজেকে বাজাবার বড় তাগিদ। লহমায় বেরিয়ে আসে জরিনা। একটু তাকিয়ে থাকে লালুমজিদের দিকে। লালু চোখ বন্ধ করে ছয় ছিদ্রের বাঁশিকে পোষ মানাতে চায়। জরিনা রুদ্রাণী। লালুকুত্তা চুপ। মুহূর্ত গেল, এক, দুই, তিন... জরিনা এক দলা থুতু হঠাৎ থু করে ছুঁড়ে মারে লালুমজিদের চোখে মুখে। লালু চোখ খোলে। তার সামনে ভাদ্রের রোদের মত জরিনা,
       চুপ চুপ, একদম চুপ কর্‌ কইয়া দিলাম বাঁশিটা কেড়ে নিতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না জরিনা। শুধু ধরে থেকেছে লালুমজিদ। নির্বিকার। অথচ সে বাঁশি সবটা বল লাগিয়েও নিতে পারল না তীক্ষ্ণ জরিনা।  শেষে আর একটা ফুঁ দিবি... তোর বাঁশি...’  বলেই ঝমঝম করে রান্না ঘরে চলে যায়
স্মিত হাসে মজিদ। সারা মুখে ফেনা ফেনা থুতু। মোছে না, যেন কিছু হয়নি। আমি তার কাছে যাই। চালতা গাছটায় হেলান দিয়ে বসে আছে। একটু বেশি হেলেছে এবার।
       সদা ভাই
       হু
       দেখলেন?
       আয়াম সরি, মজিদ ভাই
       সরির কিছু নাই। কোই বাত নেহি। আপ কিঁউ সরি হতে হ্যায়? এই যে আমি, এই যে আমার লালু। আমিও লালু, আমার কুত্তাও লালু।
মজিদ মিয়াও গিয়েছিল উত্তরপ্রদেশ। মাদ্রাসায়। মাঝে মাঝে হিন্দি বলে।  
       না, মানে...
       এই যে আপনে সদা ভাই, আপনেরে কু কু কইরা ডাকে না মাইনসে?
       ডাকে... তবে... জল আনি, মুখটা ধুইবেন?
       না, র‍্যান দিজিয়ে...এই ছ্যাপ আমি মুছুম না, থাকএই থুক তো আমিই দিলাম আমারে... বউ তো অছিলা...
রেহনে দিজিয়ে। একটা লোক সারা মুখে মানুষের দেওয়া থুতু নিয়ে বসে আছে। তার চোখ বোজা। সে এইসব থুতু রেখে দিতে চায়? লালুমিজদ এখন যেন একটা প্রত্নমানুষ। তার কোন দূর অন্দর হতে ভেসে এলঃ
তুই যেখানে সে-ও সেখানে
খুঁজে বেড়াস কারে রে
হাতের কাছে যারে পাও
ঢাকা-দিল্লি খুঁজতে যাও, কোন অনুসারে...
কেন কাছের মানুষ ডাকছো শোর করে...’

লালুমজিদ গান গায় না। যেন এই গানটা বাতাসে ছিল। সে বাতাস হতে ছেঁকে এনে পরিবেশন করছে। তার সারা মুখে থুতু, চোখে জল। লালুমজিদ গান গায়। লালুকুত্তা কেবলই তার মুখের দিকে জিব নিয়ে যায়, মজিদ সরিয়ে দেয়। গানটাকে আপ্রাণ জড়িয়ে ধরতে চাইছে লালুসে গানে কী ছিল কে জানে, একটা দিশাহীন দাবানলের মত ছুটে এল জরিনাএইমাত্র সন্তান হারানো কোনও মায়ের মত চিৎকার করে সে। কেঁদে গিয়ে আছড়ে পড়ে লালুমজিদের বুকের ওপর।মাফ করেনও মিয়াঁ, মাপ করেন গো, আমারে মাপ কইরা দ্যানআঁচল দিয়ে আছুড়িপিছুড়ি মুখ মুছিয়ে দেয়। লালুমজিদ একটা হাত জরিনার পিঠে বোলায়, যেন সান্ত্বনা দেয়। দুধে আলতা পিঠে এ হাত  যেন সেই কবে, কোনকাল থেকে সান্ত্বনা বুলিয়ে যাচ্ছে
,
কতদূর নিকট হলে কাছের মানুষ হওয়া যায়?  লালুমজিদের চালতা তলায় আমি কী দেখলাম আজ? এসব কথা আমি তোমাকে লিখি কেন? কে তুমি? একটা কথা মনে হল আজ, জানো? মনে হল গান আসলে গায় না মানুষ। গান হয়ে ওঠে। মজিদ আজ গান হয়ে উঠেছিল। এরকম হয়ে ওঠায় বেদনার ভূমিকা আছে। তুমি আমার না-পাওয়া বেদনা। যে ব্যথা, যে ব্যর্থতা জীবনে আসেনি, সে তুমি। আমি বেদনার সাধনা করি। এই যে লোকে আমাকে ক্ষেপিয়ে তোলে, কু কু করে চিৎকার করে আমি তাতে কুঁকড়ে যাই। ওই শব্দে লোকের হাহাকার শুনি। রাগ ওঠে। কান্না পায়। কিন্তু সে কান্না আমি কেঁদে ফেলতে পারি না। একা একা কাঁদা যায়? যে কান্নাকে সান্ত্বনা এসে মহৎ না করেছে, সে কান্না কেঁদে কী লাভ বল? আমি তাই এসব লিখে রাখি। একদিন হয়তো তোমার কাছে এসব যাবে। যে তুমি আসলে নেই, তার কাছে আমার এসব কান্না আমি সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য বিছিয়ে রেখে যাই। তুমি নেই, তুমিই কাছের মানুষ। নীরবে ডাকি তোমায়, শোর করি না। ইতি ২ মার্চ ১৯৮৪
তোমার একান্ত

সদানন্দ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন