অশোক দেব
উল্কি
এক.
মেয়েটির নাম উল্কি। তার বাবা ছিলেন ঘোর কুৎসিত। মা
ততোধিক। উল্কির জন্ম হলে সবাই ঘাবড়ে গেল। বাবা হাউমাউ কান্না জুড়ে দিলেন। কারণ, পৃথিবীর বিরলতম সৌন্দর্য নিয়ে উল্কি এসে জন্ম নিল। বাবা
আর মা। এ বিরাট বাড়িতে তো আর কেউ নেই। কাজে ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে যায় না। বাড়িটাকে
আরও বাড়ি কিংবা বসুধাপ্রতিম করে গড়ে তোলার কাজ করে যান তারা। বাবার ভেতরে একটা
বাগান ছিল। তার একটা নকল তিনি এ বাড়িটাতে গড়েছেন। মায়ের ছিল স্বর্গের মত
মন। তারা দুজনে মিলে এইখানে ছোট মত একটা
বৈকুণ্ঠ বানালেন। পাড়ার
ছেলেরা এ বাড়ি ছাড়ে না। ফলটা, ফুলটা, প্রেমটা, খুনসুটিগুলি সব
এখানে। যেন ছাড়া বাড়ি। আসতে অনুমতি লাগে না। যেতে বিদায় নিতে হয় না। বাবা-মা কাউকে কিছু বলেন
না। তাদের খালি বাধে। কারণ, পাড়ার সকল বিচ্ছুর
কাছে এ বাড়ি হল ‘মাঙ্কি স্টুডিও’। বাবা-মা কুৎসিত কিনা, বানরের মত দেখতে। ছেলেরা আসতে যেতে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে।
ফিক। সেই বাবা-মা নিজেরা বিহ্বল, নিজেরাই হতবাক। কোথা হতে এক দেবী এসেছে গর্ভে। সে
ভূমিষ্ট হয়ে তাদের আরও কুৎসিত করে দিল। বাবা কি সে কারণে কাঁদছিলেন?
দুই.
এইখানে গান্ধিঘাট। আগরতলা তখন নিতান্ত গঞ্জ। ওইদিকে নদী।
এইটুকু। বর্ষায় তার মাথার ঠিক থাকে না। তাই তার পাড় বেঁধে দেওয়া হয়েছে উঁচু করে । বাবার কি বাবা ছিল না? মা? বাবা পূর্বপাকিস্তান
থেকে একটা পাতিছুট পাখির মত আসেন আগরতলায়। এসেছিলেন। এসে একটি শিশুভিক্ষুক হয়ে যান। তখন, আরও আগে, দেশপ্রীতিই ছিল লোকের প্রধান আবেগ। মহীন গাঙ্গুলিরও ছিল। তখন ধনী লোকেরা, কেন যে, নিঃসন্তান হত! মহীন গাঙ্গুলিও নিঃসন্তান ছিলেন। বাবাকে তাঁর কাছে
আনলেন। বাবার মাথা ছিল। বাবা পড়া করতেন। বাবা এ বাড়িতে একজন বাবা একজন মা পেলেন। বাবা বড় হলেন। তাঁর বাবা-মা, নিঃসন্তান বাবা-মা, মারা গেলেন। বাবা
একটা বিরাট মানুষ হলেন একদিন। সরকারের কৃষিবিভাগের সর্বেসর্বা। এই বিরাট বাড়ি
বাবার হল। ঠাকুর ঘরে এ বাড়িতে মানুষে পূজা পায়। বাবার বাবার ছবি, বাবার মায়ের ছবি। সে ছবি বড় সুন্দর। তাদের পদবি
গঙ্গোপাধ্যায়।
বাবা ঠিক করেছিলেন উল্কা। কারণ অগ্নিসুন্দর হয়েছে তাঁর
কন্যা। বাবা আর মায়ের মধ্যে কথার সম্পর্ক নেই। মানে, তাঁদের সম্পর্ক কথা দিয়ে বাঁধা নয়। সেই গিঁট অন্যত্র
লাগানো। তাঁরা নিজেদের ঘ্রাণে নিজেদের চেনেন, নিজেদের শ্বাসে শ্বাসে কথা বলেন। বাবার কখন কী লাগবে, মায়ের গা ম্যাজম্যাজ করছে কিনা, বলতে হয় না। তাঁরা বোঝেন। পরস্পর। তেমনি বাবা বুঝলেন, উল্কা মায়ের পছন্দ নয়। উল্কা নামটা মনে ধরেনি। ‘ঠিকই, জ্বইল্যা গিয়া নিব্যা
যায়’। বলেই বাবা উল্কার নাম ঠিক
করে দিলেন উল্কি। উল্কি গঙ্গোপাধ্যায়। সে যখন বড় হচ্ছিল ‘মাঙ্কি স্টুডিও’ নামটাও ধীরে ধীরে
ক্ষয়ে যেতে লাগল। সেই বিচ্ছুরা এখন প্রাচীন হয়েছে। নতুন বিচ্ছুরা সময় পায় না। তাই
উল্কিদের বাড়িতে পাঁচিল না থাকলেও কেউ আর তেমন যায় না। আর উল্কির মত মেয়েদের
বাড়িতে যেতে মানুষের ভয় ভয় করে। সৌন্দর্যের ভয়। উল্কি বড় হচ্ছে।
উল্কি বড় হচ্ছে। বাবা কিছু কাণ্ড করেন। কাণ্ডই করেন কিছু। প্রতিদিন স্কুল
থেকে ফিরলে, সেই ছোটবেলা থেকে
উল্কিকে দেখেন বাবা। প্রায় নগ্ন করে সারা শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। কোথাও
একটা ফুসকুড়ি, কোথাও একটু লাল হয়ে
আছে, একটা নতুন তিল। বাবা দেখেন। এসবের নানা নিরাময়ের
ব্যবস্থা করেন। ‘ব্যথা পাইবেন না। সাবধানে থাকবেন। এই শরীরে কোনও দাগ
লাগতে দিবেন না। মনে
রাখবেন, এইটা শরীর না, মন্দির’। প্রতিদিন এইসব বলেন
বাবা। এইসব সময়ে আপনি করে
বলেন। এটা একধরণের আদর। আদর করে আপনি বলা। বাবা যে উল্কিকে
স্পর্শ করেন, যেন একটা অলৌকিক
পাখির পালক। উল্কি সাবধানে চলে, সাবধানে হাঁটে। কলম
খুলতে গিয়ে, সেফটিপিন লাগাতে
গিয়ে, পেন্সিল কম্পাসে... পরে পরে বিজ্ঞানের ক্লাসে উল্কি বাবার ভয়ে ব্যথা হতে
বাঁচে। নিজেকে বাঁচায়। সখিরা ঠোঁট বেঁকিয়ে রঙ্গ করে। ‘দেহিস ট্যাপ পইড়া
যাইব’। ট্যাপ পড়া মানে কী?
তিন.
উল্কি বড় হল। সেদিন বিকেলেও বিবেকানন্দ ব্যায়ামাগারের
সেই স্লিপটাতে গেল। পেছনের সিঁড়িটা দিয়ে বাবা তুলে দেন। উল্কি স্যাঁত করে নেমে
আসে। স্লাইড করে। সেদিন নেমে এসেই দেখল রক্ত। কোথাও ব্যথা নেই। কিছু না। জামা তুলে
দেখতে গেল। সবজে ফর্সা পা বেয়ে রক্ত। কোথায় তার উৎস? বাবাও দেখলেন। ওমা, বাবা রাগ করলেন না। মেয়ের পিঠে একটা
ফুসকুড়ি যাকে মেরে ফেলে,এত রক্তে তাঁর
ভাবলেশ নেই! উল্কি ফুঁপিয়ে
কেঁদে ফেলে। এইটা শরীর না মন্দির। ‘বাবা, আমি কিছু করছি না, ব্যথা পাইছি না’। ‘নেভার মাইন্ড, ইট হ্যাপেনস’। বাবা গোপন আর
গুরুত্বপূর্ণ কথা ইংরেজিতে বলেন। সন্ধ্যায় গোলাপি অ্যাম্বেসাডরে চেপে রাকা শূর এলেন। ড. রাকা শূর । স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি ব্যস্ততম, ডাকসাইটে। বাবা পারেনও। কুৎসিত বাবাটার মাথার নাম আছে, প্রভাব আছে। ডাকলে রাকা শূরও বাড়ি চলে আসেন। কিছুই দেখলেন না ডাক্তার। আমি স্ত্রী? মেয়ে নই আর? আমার স্ত্রীরোগ হল? ডাক্তার চা খান, শিঙাড়া খান। মিটি মিটি
হাসেন। মা একটা কী বেঁধে দিয়েছেন, তবু রক্ত বন্ধ হবার নাম
নেই। ডাক্তারেরও তাকে দেখার নাম নেই। বাবা খালি পীড়াপীড়ি করলেন। উল্কিকে একটু দেখে দিতে বললেন। ডাক্তার হাসলেন। ‘কেবল আপনারই একটি মেয়ে আছে...’। কটাক্ষ। বাবার গায়ে লাগল। ‘ইয়েস, গড হ্যাজ গ্রেসড মি উইথ’। ড. লোধ বুঝলেন। ‘জল খেতে হবে বেশি।
আয়রন ট্যাবলেট বছরে একশোটা। হেলদি ডায়েট, হাইজিনিক পোশাক। কী
বলি বলুন তো’, মায়ের দিকে তাকালেন ডাক্তার। মা হাতে একটা ইঙ্গিত
করলেন। ইশারাতেই বললেন, ‘পাগল পাগল, মাইয়া বলতে পাগল’। যাবার সময় উল্কির মাথায় হাত দিয়ে সীমা লোধ বললেন, ‘বড় হয়ে গেছ। আর চিন্তা নেই’।
পরদিন স্কুল বন্ধ। তার পরদিন। তার পরদিন। বাবা কোথা
হতে এক রাজস্থানী
বাঞ্জারাদের দল ধরে নিয়ে এলেন। প্রায়ই পথের মানুষ এনে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়ান। টাকা দেন।
সেই বাঞ্জারা দলের একটি মহিলা গান করে। হাঁটুর নীচে
ঢোলক রেখে নিজেই বাজায়। ও সাথী রে তেরে বিনা ভি কেয়া জিনা। দিওয়ানে হ্যায় দিওয়ানো কো না ঘর চাহিয়ে।
কী সুর! কী কণ্ঠ! সবচেয়ে আকর্ষণ ওই সুতরাং চিহ্নটাতে। মহিলা কালো। মাজা।
তার কী সুন্দর ঢেউ খেলানো শরীর। অযত্ন এত সুন্দর? চিবুকেও একটি ঢেউ খেলে আছে। সেখানেই সেই সুতরাং -এর তিনটি বিন্দু। উল্কি। ‘বাবি’? ‘না... ব্যথা লাগবে’। সেই থেকে ইচ্ছাকে চাপা দেওয়া শুরু। উল্কির উল্কি করার ইচ্ছা, ব্যথার ভয়ে বাদ গেল। শরীরে কোনও দাগ লাগানো যাবে না। শরীর শরীর না, মন্দির। আর, সেই থেকেই তৃষ্ণাহীনের জলপান
শুরু। বাবার সামনে পড়লেই একটু জল খাইয়ে দেবেন। আর সেই লাল লাল আয়রন ফোলিক
অ্যাসিড। গুঁড়ো মাছ। কলার মোচা... যা-কিছু আয়রন। শুধু এবার আর বাবা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সারা
শরীরে বেদনা খোঁজেন না। একটা বিশাল ঘর। সেটা খোলা হল। দারুণ
করে সাজানো হল। এই হল উল্কির ঘর। তার দক্ষিণে জানালা। প্রায় সারা দেওয়াল জুড়ে।
পুরনো। কাচের। সেদিকে একটা কাঠগোলাপের গাছ। বাঁকা, সারা গায়ে তার ইয়া ইয়া টিউমার। তথাপি তার শ্রী আছে।
পাতায় আশ্রয়দানের আততি আছে। সেই গাছ যেন বাবা-গাছ। উল্কি সে গাছকে নিজের শরীর দেখায় গোপনে। দেখ বাবা
কোনও ব্যথা নাই। সাবধানে চলি...
চার.
বাবার মত উল্কিও পন্থনগর গেল। কৃষিবিদ্যা নিয়ে। তখন
উত্তরপ্রদেশ ছিল। এখন উত্তরাখণ্ড। মায়াময় শীতল জায়গা। শান্ত। প্রতিদিন বাবার শান্ত সব চিঠি।
প্রতিদিন বাবাকে চিঠি। মাঝে মাঝে ট্রাঙ্ককল করে কথা। এদিকে সুরেশটা ড্যাবড্যাব করে
না তাকালে রাগ ধরে যায় উল্কির। তাকালে গা শিরশির করে।
ট্রাঙ্ককল। ‘বাবি, মা-রে একটু দাও’। ‘নিন’। উল্কি কাঁদে। মায়েরা
কান্নার ভাষা জানে। ...কী নাম?... সুরেশ।... টাইটেল? ভট্ট।... উড়িয়া? না গুজরাতি।... ও, ব্রাহ্মণ? হু।
বাবা কিছু কাণ্ড করেন। কাণ্ডই করেন। ইউনিভারসিটি। সেখান
থেকে নান্দোল, গুজরাত। সেখান থেকে
বাবা উল্কিকে এনে সুরেশ দিলেন। সুরেশ ভট্ট। বিয়ে হল আগরতলায়। সেই এক বিয়ে হয়েছিল।
সুরেশ থেকেছিল বছর চারেক। তারপর চলে গেল। বাবা কাণ্ড করেন। কাণ্ডই করেন কিছু।
সুরেশের জন্য বাড়ির সকলকে ভেজিটিরিয়ান হয়ে যেতে হল। উচ্চপদে চাকুরি হল তার। উল্কিও গিয়ে জয়েন করল
সরকারের কৃষি বিভাগে। কেবল সুরেশের সঙ্গে কথা বলেন না বাবা । বাবা তো কথা বলেন না। টুম্পা আসার আগে বাবা কী বাড়াবাড়িটা
করলেন। সুরেশকে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে উল্কির ঘর থেকে বের করে দিলেন। রাতে চারবার তিনি উল্কির ঘরে। ‘ব্যথাটেথা? কিছু খাবেন? জল আনি? আবু মারে? পেটে লাথি দেয়’? টুম্পা এলে সেটা
আরও বেড়ে যায়। বাবা টুম্পাকে অধিকার করে নিলেন। সুরেশ যেন কিছু নয়। টুম্পাই বাবাকে
হাসাতে পারল। এদিকে সুরেশ ক্রমে গম্ভীর হয়ে যায়। সোনার খাঁচা সোনার খাঁচা। চলে
গেল। বাবা সুরেশকে রাখতে চেয়েছিলেন? জোর করেছিলেন? না। গম্ভীর, ‘মামলার কাম নাই। মিউচুয়ালি হোক।
টুম্পা নান্দল যাইত না। উল্কিও না’। হয়ে গেল। উল্কি
বাবাকে কী বলবে? একা সেই বাবাগাছের
দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কান্না করল। উল্কি ইচ্ছা চাপতে পারে। কেবল সেটাই পারে। শিখে
ফেলেছে। সুরেশ চলে গেল। কিন্তু এ উল্কি সে উল্কি নয়। উল্কি ভট্টগঙ্গোপাধ্যায়।
পাঁচ.
সেদিন বাবা খবর দেখলেন। কল্পনা চাওলা আর ফিরে আসতে
পারলেন না। আকাশেই জ্বলে গেল তাঁর দেহ।‘সোনার মাইয়াডা কী কষ্টডা পাইলো’। বলে বাবা শুতে গিয়েছিলেন।
ফেব্রুয়ারির এক তারিখ বাবা একটা স্থির হাসি নিয়ে শুয়ে আছেন সকালে। আর জাগলেন না।
মা একে তাকে ফোন করলেন। দু-চারটে। প্রথমে সকলের কুশল জানছেন। যেন কিছুই হয়নি। জেনে নিচ্ছেন কে কোথায় আছেন। তারপর, ‘আপনের দাদা... আমারার তাইনে তো
গেলেন গিয়া’। যেন মা-ও জানতেন বাবা যাবেন। কত লোক, কত লোক। ভিখিরিদের দল, রিকশাওয়ালার দল, বিহারি মুটেরাও কাজ ফেলে দিয়ে এসেছে। তারা দূরে ওদিকে গোল
হয়ে বসে কী যেন কীর্তন জুড়ে দিল। বাঞ্জারাদের দল উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লেগেছে এসে। পুরো গান্ধিঘাট বন্ধ হয়ে গেল। বিবেকানন্দ ব্যায়ামাগারের
সকলে চলে এল। সারা আগরতলা। নেতা।
গায়ক। কে নেই... সকলে ‘মাঙ্কি স্টুডিও’তে চলে এসেছে।
কুৎসিত বাবার সে স্বর্গীয় হাসিটা যেখানেই দাঁড়াও না কেন, দেখা যাচ্ছে। খবরের কাগজের লোকেরা এলো। কেবল উল্কি একা সেই নিজের ঘরে। দক্ষিণের জানালা দিয়ে বাবাগাছের দিকে তাকিয়ে
থেকেছে।‘বাবি ব্যথা পাইতাছি’। একটা পুতুল কোলে নিয়ে টুম্পা ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা বাড়ি।
বাবা ঠাকুর ঘরে গেলেন। তাঁর বাবা-মায়ের ছবির সাথে
উল্কির কুৎসিত বাবার ছবিও বসলেন। তার ঠিক পরের মাসে মা-ও সেখানে গিয়ে বসেছেন। বাড়িতে কোনও মা-গাছ ছিল না।
ছয়.
উল্কি ভট্ট যেদিকে যান সেদিকে সোনা ফলে। রূপসুন্দর
জুয়েলার তাদের বিজ্ঞাপনে তাঁকে মডেল করতে কী না করেছে। কাকে না ধরেছে। শেষে উল্কিম্যাম রাজি হয়েছেন। তাঁকে হীরার গহনা পরানো হয়েছিল। তাঁদের
বাড়িতেই। নানা রকমের আলো এলো, ছাতার মত রিফ্লেক্টর
এলো। সেই জানালার কাছে উল্কি ম্যাম বসলেন একটা পুরনো, অ্যান্টিক
ধরনের আরাম কেদারায়। বই
পড়ছেন। ফেটে পড়ছে তাঁর রূপ। হীরার গহনার থেকে ভেসে
আসছে চমক। সেই ছবি কাগজে
কাগজে, টিভিতে, টিভিতে, বিলবোর্ডে বিলবোর্ডে... নীচে লেখা, ইউ আর অলওয়েজ
গ্রেসফুল। টুম্পাটাও বাইরে চলে গিয়েছে পড়তে। মেল করে। মা,ইউ আর অলওয়েজ গ্রেসফুল। সেই বিজ্ঞাপনে টাকা দিয়েছিল ওরা।
বেশ টাকা। উল্কিম্যাম সে টাকা দিয়ে দিলেন আনন্দ শিশুগৃহকে। বাবার বদান্যতায়
সেটা শুরু হয়েছিল।
সেই দেখেই মনে হয়, কদিন ধরে ছেলেটা ঘুরছে। বিউটি পার্লার খুলেছে। সেটাতে
একদিন যেতে হবে। ছবিটবি তুলে ফেসবুকে দেবার ধান্ধা। উল্কি ছেলেটাকে দেখেন। ডান
হাতে একটা বৃশ্চিক। ‘এটা কী’? ‘ট্যাটু ম্যাম’। ‘আমি তো এটাও করি।
এখন ট্রেন্ড’। ‘খুব ব্যথা হয়’? ‘নো নো ম্যাম, নাথিং’। ‘আমায় করে দেবে’? ছেলেটা সম্ভবত কলকাতার। ঝাঁকড়া চুল, শ্যামল সুন্দর দাড়ি। বেশ যত্নের শরীর। সে যেন পাগল হয়ে
গেল, কী করবে না কী করবে... ‘ইয়েস ম্যাম, মাই প্লেসার, আই অ্যাম অনার্ড... বলুন কী করাবেন, কোথায় করাবেন’
— সুতরাং। চিবুক দেখিয়ে উল্কিম্যাম বললেন এখানে
তিনটে বিন্দু এঁকে দাও
ছেলেটা কিছু কাণ্ড করে। কাণ্ডই করে। ডু সামথিং ডিফরেন্ট ম্যাম। সোজা উঠে চলে এল। পেছনে গেল, চুল সরালো, ঘাড়ের ডান দিকে
পিঠের একটু ওপরে সেই জায়গাটাতে গোল গোল করে তর্জনী ঘোরালো, ‘হিয়ার, আ বিউটিফুল
বাটারফ্লাই’। তর্জনী নাকি পালক
এটা? আর এই ছেলে কী জানে এইখানে যে একটা সমুদ্র থাকে? নিজের
চুল লাগলেই উল্কার ইহকাল হয়ে গেছে, পরকাল হয়ে গেছে। ...সুরেশ ও সুরেশ ইউ নিউ দ্যাট... একটা
দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে উল্কি ম্যাম বলেন, ‘ক্যান আই কল ইউ বাবি’?
— মানে? আমি বুঝতে পারিনি
ম্যাম
— তোমাকে আমি বাবা ডাকতে পারি?
গম্ভীর হয়ে গেল ছেলেটা। প্রায় আদেশের স্বরে বলে, ‘দাঁড়ান’। উল্কি
ম্যাম যেন যন্ত্র। ‘চটি
খুলুন’। উল্কি যেন যন্ত্র হয়ে
গেলেন সত্য। ছেলেটা
কাণ্ড করে।কাণ্ডই করে কিছু। নীচু হয়ে বসল, শাড়ি সরিয়ে পায়ের পাতা দুটো প্রায় টেনে বের করে আনল। পা
চেপে ধরে এমন করে কেউ প্রণাম করে? ‘হাজার
বার ডাকবেন’
— শোন
ছেলেটা কাণ্ড করে। কাণ্ডই করে কিছু। এক লাফে তুমি? ‘বলো ব্যাবি’
ছেলেটা কাণ্ড করে। কাণ্ডই করে কিছু। এক লাফে তুমি? ‘বলো ব্যাবি’
— তোমার বাইকটার এমন বিকট শব্দ হয় কেন? এত জোরে চালাও...
— ইটস ট্রেন্ড ব্যাবি... রয়্যাল অ্যানফিল্ড... সে তখনও সেই ঘাড়ের সমুদ্রবিন্দুটাকে একটু একটু নাড়াচ্ছে।
উল্কি ম্যাম দিয়ে রেখেছেন।
— কাল এসো, এখানে এসেই করে দিয়ে যাও
— নো ম্যাম, ইউ হ্যাভ টু কাম টু মাই
প্লেস
উল্কি ম্যাম
গেলেন।দারুণ সাজিয়েছে পার্লারটা। এয়ার কন্ডিশনড। মেয়েগুলো বেশ সুন্দর। সবার সাথে
পরিচয় করিয়ে দিল। মিট মাই নিউ ফাউন্ড ডটার... হা হা হা। কাঠের চেয়ার।
সামনে দেওয়াল জুড়ে আয়না। ঘাড় নীচু করে বসলেন ম্যাম। জায়গাটাকে স্পিরিট দিয়ে ধুয়ে
দিল বাবি। যে প্রজাপতিটা আঁকবে সেটা দেখাল। দারুণ দারুণ। একটা পুঁচকে যন্ত্রের
মাথায় একটা সুঁচ। সেটাকে ডিজইনফেক্ট করা হল। কেমন একটা ঘোর। ছোট ছোট প্রায় না-পাওয়া ব্যথা লাগছে। যেন ছোট ছোট আনন্দকে শরীরে ঢুকিয়ে
দিচ্ছে ছেলেটা। তার চুলের থেকে, শরীর থেকে একটা ফেনা
ফেনা গন্ধ ভাসছে। উল্কি ম্যামের ভালো লাগছে এই মিহি বেদনা। ভেবেছিলেন সমুদ্রটা মরে
গিয়েছে... এই ছেলে জাগিয়ে দিল। সুরেশ জানত ওখানে স্পর্শ করলে আকাশ
মাটিতে নামানো যায়... হয়ে গেলে অনেক অনেক
ছবি তোলা হল। মোবাইলে। ফেসবুকে বন্ধু হওয়া হল। মেয়েটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে
ভালোই করেছে। উল্কি
ম্যামের একটা পেছন ফেরা ছবি। উল্কি-দেখানো। বাবি ক্যাপশন দিল, মাই নিউ ফাউন্ড ডটার, আ রিয়েল বিউটি।
— এটা কতদিন থাকবে?
— লাইফ লং। কিছুদিন বেবি অয়েল লাগাবে বুঝলে...
সাত
জুলাই এসে গেল। টুম্পা
আসবে। ফোনে কথা হল। সকালে অফিস যাবার আগে একটু ফেসবুক খোলা আজকাল নেশা হয়েছে।
খুলেই হতবাক। একটা সাদা বিছানা। মাটিতে পাতা। তাতে সারা গা ঢেকে শুয়ে আছে বাবি।
বাইকটা ঢুকে গিয়েছিল লরিটার নীচে। বাবি শুয়ে আছে। একটা হাসি স্থির হয়ে আছে তার
মুখে, নিমীলিত চোখ দুটিতে। উল্কি ম্যাম কাঁদতে জানেন না। জানালা
খুলে দিলেন। বাবাগাছ যেন আরও গাছ হয়ে গেছে। সেদিকে পিঠ এগিয়ে দিলেন ম্যাম। ঘাড় কাত করে সেই প্রজাপতিটা
দেখা যায় একটু। ওমা, সে নেই। নেই নেই নেই। উল্কি ম্যাম সব পোশাক
খুলে ফেলেন, যেন পাগল। যেখানে যত আয়না, সবগুলোতে খোঁজা হল। নেই। নেই সে প্রজাপতি। এইটা শরীর না, মন্দির। দাগ লাগতে দিবেন না। উল্কি ম্যাম জানালার কাছে আসেন। নগ্ন
তিনি। একটু দূরে বাবাগাছ। নিজেকে
দেখাচ্ছেন উল্কিম্যাম। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। দেখ বাবি দাগ নেই কিছু। এত বাতাস, একটিও পাতা নড়ছে না। তারা সব খুঁটিয়ে দেখছে উল্কির শরীর।
(শারদীয়া স্যন্দন, ২০১৬)
বিউটি।
উত্তরমুছুনথ্যাংকস অমিতাভদা
মুছুনঅবশেষে পড়া হলো ...আমার খুব ভালো লেগেছে ...তাই আরো আরো পড়তে চাই ...
উত্তরমুছুনবছরের শুরুতেই হঠাৎ পেয়ে যাওয়া। খুব ভালো লাগলো ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনআহা...
উত্তরমুছুন