অশোক দেব
আমি রাখাল। এই উদোম শরীরই আমার
একমাত্র অর্জন। জানি না, পিতামাতার
কাম্যবস্তু হিসেবে উৎপন্ন হয়েছি আমি, নাকি এই উদোম শরীর তাদের হীনকামনার ফল। এইখানে মাঠ। ওই আমার গবাদি। তারা মাথা
নিচু করে প্রকৃতির দূর্বাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। দূর্বাও শেকড়ে শেকড়ে
চিরজীবিতার অনুশীলন করে চলেছে। আমি একা। চারদিক নিঝুম। অনতিদূরে গ্রাম।
ধান্যক্ষেত্র। সেখানে সকলে প্রত্যক্ষকর্মে ব্যস্ত। আমি আছি এইখানে পরোক্ষে। নেই যেন। আমরা চারণশীল
গবাদি ছাড়া আর কেউ জানে না আমি আছি। আমার একটা বাঁশি আছে। তার ছিদ্রপথে প্রাণবায়ু
নিক্ষেপ করি। বাঁশি বাজে। অন্তর বাজে না। আমার বংশীধ্বনি বাতাসের গায়ে গায়ে গহনা
পরায়। কোনও শ্রোতার প্রাণে পুলক জাগায় না। কারণ, আমি প্রতিদিন বাঁশি বাজাই। যখন তখন বাজাই। ফলে, লোকের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। পল্লীজন আমার বাঁশিবাদন শোনে ঠিক, কিন্তু আমল দেয় না। তাই আমি বাঁশি বাজালেও বাঁশি আর আমাকে
বাজায় না।
দূরে বনভূমি। সেখানে বাঘের বাস। কোথায়, বনের কোন্ গভীরে বাস করে তারা কেউ জানে না। বাঘ চতুষ্পদ। বাঘ ভারি। রহস্যময় ডোরাকাটা তাদের শরীরের বাহার। নীরব চলন। তারা নেই, আবার আছে। এই যে গ্রাম, এই যে ছোটনদী, তার ওপর মানুষের গড়া সাঁকো, এই যে মাটিতে লেপা ঘরবাড়ি, এই যে এত বড় প্রতিষ্ঠা সেখানেও বাঘ আছে। আমার ব্যর্থবাঁশির সুর যেসকল মানুষের মনের কিনার ঘেঁষে হাওয়ায় হারায়, সে-সকল মনের গভীরেই ঘাপটি মেরে থাকে সেই মায়াশার্দূল। আমি ভাবি। যেমন আমার গো-সখিরা জানে, আমি তাদের তৃণচারণায় সঙ্গে রয়েছি — ওরা মাঠে আমি বটতলে — তেমনি আমি জানি, ওইদিকে বনেই প্রকৃত বাঘ আছে। আমার গবাদি আমার থাকা-কে গ্রাহ্য করে না। আমিও বাঘের থাকা-কে গ্রাহ্য করি না। এদিকে পল্লীজগৎ আমার বেঁচে থাকাকেই গ্রাহ্য করে না। আমি রাখাল। গোরক্ষা করি। আমাকে কে রক্ষা করে!
আমি তাই চিৎকার করি — বাঘ, বাঘ, বাঘ
লহমায় লাঠিসোঁটা, দা, কাস্তে, বল্লম, টাঙি, চাপাতি, পাথরের ঢেলা, এমনকি আঁশবঁটি নিয়ে ছুটে আসে মানুষ। আমার নিজের মানুষেরা।
আমার দু’চোখ ভরে যায় জলে, যখন দেখি, দূর হতে রে-রে
করে ছুটে আসছে আমার স্বজন। আমার প্রাণে পুলক জাগে। শরীরে সুর খেলে যায়। নিশ্চিন্ত
গবাদি কিছু না বুঝতে পেরে আমারই কাছে ছুটে আসে। মানুষ নিকটে আসে না, হায়। তারা
আমাকে দেখেও দেখে না। তারা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে। তারা বাঘ খোঁজে, পায় না। কারণ, বাঘ তো আসেনি। আমি হেসে ফেলি। মানুষেরা আমাকে কষে লাথি মারে। আমি আরও জোরে
জোরে হাসি, তারা আমাকে আরও জোরে লাথি মারে।
এখন ক’দিন আমি আর বাঘের খেলা খেলব না ঠিক করেছি। কে আর সেধে লাথি
খেতে ভালোবাসে! অথচ,মানুষের লাথিও
জীবনকে সুন্দরতর করে কখনও ।
সেদিন পান্তা জোটেনি। সেদিন কী
জানি কী কারণে বট তার ছায়া প্রত্যাহার করে নিল। সেদিন বুকের অবশিষ্ট বায়ুতে বাঁশি
আর বাজল না। সেদিন আকাশ ছিল না তেমন দেখার মতন। ছোট্ট নদীটিতে কোনও নতুন রহস্য
জাগেনি। সেদিন অতিশয় শান্ত আর নির্বিঘ্ন ছিল আমাদের গ্রাম, আমাদের প্রতিষ্ঠা। সেদিন দূর হতে কারা যেন আসন্ন বর্ষাকালকে গালিগালাজ করছিল
আর আমি চিৎকার করলাম — বাঘ, বাঘ, বাঘ
শান্তি টুটল। বিঘ্ন সৃষ্টি হল।
বর্ষাকাল ভুলে গিয়ে মানুষ অস্ত্র হাতে নিল। তারা এল। পেল না বাঘ। তাই ওরা আরও জোরে
জোরে লাথি কষালো। অশ্রাব্য গালিগালাজ করল। আমি দেখলাম প্রতিটি সজোর লাথিতে তারা
আমাকে নয়,
নিজেদের অপারগতাকে মারছে। তারা জানে বনের বাঘ তাদের
প্রতিষ্ঠাচূর্ণ করে দেয়। তারা তার সঙ্গে পেরে ওঠে না। মনের বাঘের সঙ্গে আরও পারে
না।
দিন চলে যায়। আমাদের গোহালে নতুন
বাছুর এসেছে। ঋতুর রং পাল্টাচ্ছে। বীজতলায় জাগছে নতুন ফসলের সম্ভাবনা। আজ বাঘ
আসবে। আমি বাঁশি বাজালাম। যতটা মৃত্যু এতকালের পরোক্ষ জীবনে সঞ্চয় করেছি, তাকে সুর
হিসেবে সাজিয়ে দিয়েছি। মানুষ শুনল না। তাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। ছোট নদীটিকে দূর
হতে বললাম, ভালো থেকো। দেখলাম বাঘ আসছে। ধীরে
ধীরে। সে গোরুদের পেরিয়ে চলে আসছে। নরভূক হয়েছে সে। আমিও তার জন্য অপেক্ষা করছি।
দেখছি তার ডোরাকাটা শরীরে রোদের ঝিলিক। সে আমার বিপজ্জনক নৈকট্যে চলে আসে। আমি
পুলকিত,
শিহরিত। শুধু একটু তামাশা করার জন্য চিৎকার করি —বাঘ বাঘ বাঘ
কেউ এল না। লোকের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।
(বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত 'ভাটিয়াল' কাগজে প্রকাশিত)
(বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত 'ভাটিয়াল' কাগজে প্রকাশিত)
VALO LAGLO.... :)
উত্তরমুছুনthanks
মুছুনঅসাধারণ!
উত্তরমুছুনদিদি
মুছুন