রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৫

শিল্পীর চাপাতি


সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে ভেদ আছে। থাকলেও বহুকাল এদের মধ্যে বিভেদ ছিল না। মানুষের বৌদ্ধিক উন্মেষ ধর্মকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। কাব্য, সংগীত, চিত্রকলা, যূথনৃত্য, নাটক এমনকি দার্শনিক যুক্তিবাদও ধর্মকেন্দ্রিক চর্চাই ছিল। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ কাব্যে রচিত। ন্যয়বিদ্যা হোক কি গ্রীক দার্শনিক যুক্তিবিদ্যা সবই ধর্মের পার্শ্ববিদ্যা। এমনকি বাস্তুবিদ্যা, নির্মাণবিদ্যাও ধর্মকে কেন্দ্রে রেখেই বিকশিত হয়েছে। কারণ ধর্মই তখন মানুষের জীবনের সাংস্কৃতিক পরিচয় ছিল।
তখনও গ্রন্থনির্ভর ধর্ম গড়ে ওঠেনি, লোকে প্রকৃতির শক্তিগুলিকেই পূজ্য বিবেচনা করত। অথবা, নিজেদের থেকে কোনও উন্নত, শক্তিশালী, বিচক্ষণ মানুষকে দেবতায় উত্তীর্ণ করে গোষ্ঠীনির্মাণ করত। কালে কালে সেই স্বাভাবিক ধর্মের বিলোপ হল। গ্রন্থনির্ভর ধর্ম এল। একটি লিখিত বইকে কেন্দ্র করে লোকে তাকেই নিয়ামক মেনে নিয়ে গোষ্ঠীবদ্ধ হতে শুরু করল। এই বইগুলি অধিকাংশই দুর্বোধ্য ভাষায় লিখিত। ফলে, তাদের প্রতিপাদ্য হয়ে গেল গুহ্য। সে কিছু মানুষের চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। ফলে, প্রতিটি গ্রন্থনির্ভর ধর্মেই পুরোহিতশ্রেণীর বিকাশ হল। তারাই ধর্মকে সংগঠিত করলেন, সংস্কৃতি হতে তাকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। এইখান থেকেই গোল শুরু হল।

ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুধর্ম বলতে যে ধর্মকে বোঝানো হয়, তা কোনও একটি গ্রন্থনির্ভর ছিল না। কোনও গ্রন্থই ছিল না। শ্রুতিমাধ্যমে কিছু বিধি, কিছু দার্শনিক চিন্তা অনুসরণ করত এদিকের মানুষ। প্রকৃতিই ছিল তাদের প্রধান আরাধ্য। কোনও এক সময়ে কে বা কারা মহাভারতের একটি অধ্যায়কে সরিয়ে আলাদা করে গীতা নাম দিয়ে এদিকের মানুষকে তার অধীন করার চেষ্টা করল। সংগঠিত করল। এখন বহু-বহু সাংস্কৃতিক অনুশীলনের বৈচিত্র্যময় ধর্মানুসরণ একটি ‘হিন্দু’ নামে বিলীন হয়ে গেল।
এই পুরোহিততন্ত্রগুলো মানবসভ্যতাকে দিয়েছে ধর্মযুদ্ধ, ফতোয়া, রক্তপাত, উচ্চনীচ ভেদ, অন্ধত্ব। চোখে, মননে ঠুলি লাগানো মানুষ পুরোহিতদের (মোল্লা, পাদ্রী ইত্যাদি সকলকে এই নামেই ডাকা যাক) স্বার্থরক্ষা করতে চাপাতি নিয়ে স্বধর্মের লোকেদের গলা নামাচ্ছে, জরাজীর্ণ মসজিদ ভেঙে উল্লাস করছে, প্লেন নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে বহুতলে।

এতসব কথা মনে করিয়ে দিলেন পার্থদা। তাঁর একটি ছবি দেখে এইসব কথা মনে এল। নদীকেন্দ্রিক মানব সভ্যতায় স্বভাবতই ধর্মেও নদীর ভূমিকা বিরাট। কোনও কোনও ধর্মে নদীকে দেবীরূপে পূজা করা হয়। সেই নদী আবার বহমান সময়ের সাক্ষী, নীরব কিন্তু সবল সাক্ষী। একটি বহমান নদীতীরে একটি ধর্মবৃক্ষ, সে বটসদৃশ হলেও দৃশ্যত তার পরিচয় দেননি শিল্পী। হয়তো সে নিজেই ধর্ম। শোণিতলাল হয়ে গিয়েছে সে, সন্তানের কত রক্ত দিয়ে যেন স্নান করানো হয়েছে তাকে। ক্ষীণকায় হয়ে যাওয়া সময়-নদের পারে একা নিরুপায় দাঁড়িয়ে আছে রক্তছায়া নিয়ে একটি রক্তবৃক্ষ। একটি চরা কিংবা স্থলভাগ। সে-ও যেন ক্ষীণকায় হয়েছে। একটি সাপের ফণা কিংবা বুকে হাঁটা কোনও কীটের উত্থিত মাথার মত জেগে আছে। কোনও মানুষ নেই। কোথাও নেই তারা। নদীতেও দেখা যাচ্ছে মাঝিবিহীন নৌকাগুলি যথেচ্ছ এদিক-ওদিক যাচ্ছে। একধরণের নীরব, হতশ্বাস নৈরাজ্য চলছে। আর সেই মানবরহিত স্থলভাগে পড়ে আছে একা ধর্ম। প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক দিনে আসতে আসতে মানুষ যত ধর্মীয় মোটিফের রচনা করেছে, পার্থদা প্রায় সকলের স্থান দিয়েছেন এখানে। কিন্তু মানুষ নেই। কী করে থাকবে, তারা তো ইতিমধ্যে নিজেদের নিজেরাই খুন করে করে নিকেশ করে দিয়েছে। শিউরে উঠি এই বিচিত্র স্থলভাগটি দেখে। শিল্পী যে সাবধানবানী উচ্চারণ করলেন, তা যদি সত্য হয়ে যায়? ধর্মকে নিয়ে মারামারি করে সকলে মরে গেলে পরে একা ধর্মই পড়ে থাকবে। সে ধর্ম কী করবে তখন? কার কাজে লাগবে? উঃ।
কলেজজীবন থেকে পার্থদার কাজ দেখে আসছি। মাধ্যম, কন্টেন্ট আর দৃষ্টিকোণ নিয়ে তিনি নিরলসভাবে নিজেকে প্রায় প্রতিটি ছবিতে পাল্টে ফেলেন। এই ছবিটিতে একটি ব অনুজ্জ্বল পট নিয়েছেন তিনি। কম্পিউটারের স্ক্রিনে দেখে মনে হচ্ছে হাতে বানানো নেপালি তুলোট কাগজ। তাতে নানা মাধ্যমের মিশ্রণ দিয়ে কাজটি করেছেন। দ্রুত করেছেন, যার ফলে ছবিটিতে একটি চাপা অস্থিরতাও আঁকা হয়ে গিয়েছে। যেন একজন মেধাবী কবি, তার লেখাটি লিখে তাকিয়ে আছেন, ছবিটি দেখলে শিল্পীর উপস্থিতিও টের পাওয়া যায়।

কিছুকাল ধরে পার্থদা একধরণের নিসর্গ তৈরি করেন। যেন ওপর থেকে দেখা, যেন বহুদূর কোনও গ্রহ হতে। সেই ছবিগুলো আমার প্রিয়তম। মার্কিন শিল্পী ওয়েন থেইবো-র (wayne thiebaud) কাজেও, বিশেষ করে নিসর্গচিত্রে, এই ধরণের দৃষ্টিকোণ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু পার্থদার কাজগুলি আরও কাব্যিক। সেগুলো নিয়েও কথা হবে। পরে।

৫টি মন্তব্য:

  1. ছবি নিয়ে লেখাটা যে নিজেই একটা কবিতার মত হয়ে গেলো... খুব ভালো লাগলো... দু'জন শিল্পিকেই আমার শ্রদ্ধা জানালাম...

    উত্তরমুছুন
  2. ছবিটি সুন্দর। তবে তা দেখে আপনার যেমন মনে হয়েছে আমার তেমন নাও হতে পারে। আবার কিছুটা মিলেও যেতে পারে। সেখানেই মূলত ভিজুয়াল আর্টের রহস্যময় সার্থকতা। আবার ছবির ভাষা লিপির ভাষার থেকে শক্তিশালীও বটে। শেষ পর্যন্ত দুটি রচনাই ভিন্ন ভাবে আমার ভালো লাগলো। ধন্যবাদ অশোকদা।

    উত্তরমুছুন